আদিবাসী শিশুরা কবে মাতৃভাষায় পড়ালেখার সুযোগ পাবে? by শক্তিপদ ত্রিপুরা
বাংলাদেশ বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু ধর্মের দেশ। রাষ্ট্রীয় ভাষা 'বাংলা' ছাড়াও এ দেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাও, কোচ, বম, খ্যাং, খুমি ইত্যাদি ভাষা রয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের হিসাবে বাংলাদেশে ৪৬টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে। এদের প্রত্যেকের আলাদা ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে।
আদিবাসীদের এই ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের দেশ যে বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ_এটি আমাদের গর্ব।
মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা_মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। এই তিনটি বিষয়ের ওপর আঘাত এলে, বঞ্চনার শিকার হলে পৃথিবীর কোনো জাতি নীরবে সহ্য করে না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' ঘোষিত হলে বাংলার ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদের মিছিলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শহীদ হন। ভাষার অধিকারকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সংগ্রাম রচিত হয়েছিল, সে সংগ্রামের পথ বেয়ে '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান অতঃপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জম্ম। এসব আন্দোলনের মধ্যকার একটির সঙ্গে অপরটির সংযোগ রয়েছে। তবে সূত্রপাত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সুতরাং বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের অবদান অপরিসীম।
ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসী জাতি শ শ বছর ধরে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। কোনো কোনো আদিবাসী জাতি হাজার বছর ধরে শৌর্য বীর্যের সঙ্গে এ ভারতবর্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইতিহাস তার সাক্ষী। ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক নিদর্শন তার সাক্ষী। আমাদের এই বাংলাদেশেও এ ধরনের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে, যেগুলোর কিছু কিছু ক্ষেত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে আবার কিছু কিছু ক্ষেত্র ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা বেদখল করে রেখেছে। এ দেশের কোনো কোনো আদিবাসী জাতির ভাষা ও সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য এ দেশের সম্পদ। আদিবাসীদের এই সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। আদিবাসীদের এবং দেশের এই মহামূল্যবান সাহিত্য সম্পদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ অতীব জরুরি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মূল সুর ছিল রাষ্ট্রে যতগুলো ভাষা আছে, সব ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে। কোনো ভাষাকে অবহেলা বা পরাধীন রাখা যাবে না। এই যুক্তির ভিত্তিতেই বাঙালি জাতি উর্দুর ন্যায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির দাবিতে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করেছিল। যে বাঙালি জাতি ভাষা অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সে জাতির শাসকগোষ্ঠী দেশের অপরাপর ভাষার অধিকারের কথা ভুলে গেল_এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে। অতীব দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন যে বাঙালি জাতি, সে জাতির স্বাধীন দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এসব ভাষা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে আগামী কয়েক যুগে বেশ কয়েকটি আদিবাসী ভাষা হারিয়ে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং তাদের অধিকার ও অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। অথচ মধ্য যুগে বাংলা ভাষাকে সুরক্ষা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন বহু আদিবাসী রাজা মহারাজা। আরাকান ও ত্রিপুরা মহারাজার রাজসভায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংগীত চর্চা হতো। এমনকি ত্রিপুরা মহারাজার রাষ্ট্রে 'বাংলা' রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রেও আদিবাসী ভাষার অবদান অনস্বীকার্য। এ দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে এ দেশকে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার আন্দোলনের সূত্রপাতও করেছিল এ দেশের আদিবাসীরা।
ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সূত্রপাত হলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা থাকলেও চুক্তি সম্পাদনের আজ এক যুগ অতিবাহিত হয়েছে তথাপি চুক্তির এই বিধান আলোর মুখ দেখেনি। শামসুল হক শিক্ষা কমিশন (১৯৯৬-২০০১ সময়কালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গঠিত শিক্ষা কমিশন) কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার প্রস্তাব ছিল। তৎকালীন সরকারের আমলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতিতে (২০০৯) আদিবাসীদের নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবং এ দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, যা আদিবাসীদের প্রাণের দাবি। এত দিন পর্যন্ত সরকার আদিবাসীদের 'উপজাতি' হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে। যদিও বা সরকারি বহু কাগজপত্রে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিকে 'আদিবাসী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ভাষা অধিকারের জন্য লড়াইকারী জাতির দেশে অপরাপর জাতির মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হবে না; বরং কোনো না কোনোভাবে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চলবে তা হতে পারে না। এই সংস্কৃতিপ্রেমী জাতির দেশে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে_এটি হতে পারে না। এটি দেশের জন্য শুভ সংবাদ নয়। এটি বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলনের গৌরবকে ম্লান করে দেয়। এটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি'কে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা' দিবস হিসেবে স্বীকৃতির গৌরবকে ম্লান করে দেয়। আমরা ভাষা অধিকারের জন্য লড়াইকারী সংগ্রামী বাঙালি জাতির কাছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার সুরক্ষা ও স্বাভাবিক বিকাশে পর্যাপ্ত সহযোগিতা কামনা করি। আদিবাসীদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সুরক্ষা ও বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাবনা_১. অচিরেই আদিবাসী জাতিসমূহের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হোক; ২. আদিবাসীদের ভাষা, সাহিত্য সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমীর আদলে 'আদিবাসী একাডেমী' বা 'আদিবাসী ভাষা ইনস্টিটিউট' প্রতিষ্ঠা করা হোক; ৩. সংবিধানে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি প্রদান করা হোক; ৪. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক; ৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে আদিবাসী ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা হোক; ৬. আদিবাসী বিভিন্ন জাতিসমূহের ভাষার অভিধান তৈরি করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হোক; ৭. আদিবাসী ভাষা, সাহিত্য সংগ্রহ ও এ-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হোক এবং ৮. গবেষণালব্ধ ও আদিবাসী বিষয় নিয়ে প্রস্তুতকৃত বই, ম্যাগাজিন প্রকাশনার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হোক ইত্যাদি।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল, যেখানে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুসহ আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি উন্নয়নের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ইতিমধ্যে দুই বছর পার হয়েছে। তথাপি পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সমতলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় পড়ালেখা শুরু হয়নি। একুশের মাসে আদিবাসীদের প্রশ্ন_কবে এ দেশের আদিবাসী শিশুরা নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পাবে?
লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট
মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা_মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। এই তিনটি বিষয়ের ওপর আঘাত এলে, বঞ্চনার শিকার হলে পৃথিবীর কোনো জাতি নীরবে সহ্য করে না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' ঘোষিত হলে বাংলার ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদের মিছিলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শহীদ হন। ভাষার অধিকারকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সংগ্রাম রচিত হয়েছিল, সে সংগ্রামের পথ বেয়ে '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান অতঃপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জম্ম। এসব আন্দোলনের মধ্যকার একটির সঙ্গে অপরটির সংযোগ রয়েছে। তবে সূত্রপাত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সুতরাং বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের অবদান অপরিসীম।
ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসী জাতি শ শ বছর ধরে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। কোনো কোনো আদিবাসী জাতি হাজার বছর ধরে শৌর্য বীর্যের সঙ্গে এ ভারতবর্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইতিহাস তার সাক্ষী। ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক নিদর্শন তার সাক্ষী। আমাদের এই বাংলাদেশেও এ ধরনের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে, যেগুলোর কিছু কিছু ক্ষেত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে আবার কিছু কিছু ক্ষেত্র ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা বেদখল করে রেখেছে। এ দেশের কোনো কোনো আদিবাসী জাতির ভাষা ও সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য এ দেশের সম্পদ। আদিবাসীদের এই সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। আদিবাসীদের এবং দেশের এই মহামূল্যবান সাহিত্য সম্পদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ অতীব জরুরি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মূল সুর ছিল রাষ্ট্রে যতগুলো ভাষা আছে, সব ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে। কোনো ভাষাকে অবহেলা বা পরাধীন রাখা যাবে না। এই যুক্তির ভিত্তিতেই বাঙালি জাতি উর্দুর ন্যায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির দাবিতে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করেছিল। যে বাঙালি জাতি ভাষা অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সে জাতির শাসকগোষ্ঠী দেশের অপরাপর ভাষার অধিকারের কথা ভুলে গেল_এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে। অতীব দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন যে বাঙালি জাতি, সে জাতির স্বাধীন দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এসব ভাষা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে আগামী কয়েক যুগে বেশ কয়েকটি আদিবাসী ভাষা হারিয়ে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং তাদের অধিকার ও অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। অথচ মধ্য যুগে বাংলা ভাষাকে সুরক্ষা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন বহু আদিবাসী রাজা মহারাজা। আরাকান ও ত্রিপুরা মহারাজার রাজসভায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংগীত চর্চা হতো। এমনকি ত্রিপুরা মহারাজার রাষ্ট্রে 'বাংলা' রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রেও আদিবাসী ভাষার অবদান অনস্বীকার্য। এ দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে এ দেশকে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার আন্দোলনের সূত্রপাতও করেছিল এ দেশের আদিবাসীরা।
ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সূত্রপাত হলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা থাকলেও চুক্তি সম্পাদনের আজ এক যুগ অতিবাহিত হয়েছে তথাপি চুক্তির এই বিধান আলোর মুখ দেখেনি। শামসুল হক শিক্ষা কমিশন (১৯৯৬-২০০১ সময়কালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গঠিত শিক্ষা কমিশন) কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার প্রস্তাব ছিল। তৎকালীন সরকারের আমলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতিতে (২০০৯) আদিবাসীদের নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবং এ দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, যা আদিবাসীদের প্রাণের দাবি। এত দিন পর্যন্ত সরকার আদিবাসীদের 'উপজাতি' হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে। যদিও বা সরকারি বহু কাগজপত্রে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিকে 'আদিবাসী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ভাষা অধিকারের জন্য লড়াইকারী জাতির দেশে অপরাপর জাতির মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হবে না; বরং কোনো না কোনোভাবে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চলবে তা হতে পারে না। এই সংস্কৃতিপ্রেমী জাতির দেশে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে_এটি হতে পারে না। এটি দেশের জন্য শুভ সংবাদ নয়। এটি বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলনের গৌরবকে ম্লান করে দেয়। এটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি'কে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা' দিবস হিসেবে স্বীকৃতির গৌরবকে ম্লান করে দেয়। আমরা ভাষা অধিকারের জন্য লড়াইকারী সংগ্রামী বাঙালি জাতির কাছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার সুরক্ষা ও স্বাভাবিক বিকাশে পর্যাপ্ত সহযোগিতা কামনা করি। আদিবাসীদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সুরক্ষা ও বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাবনা_১. অচিরেই আদিবাসী জাতিসমূহের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হোক; ২. আদিবাসীদের ভাষা, সাহিত্য সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমীর আদলে 'আদিবাসী একাডেমী' বা 'আদিবাসী ভাষা ইনস্টিটিউট' প্রতিষ্ঠা করা হোক; ৩. সংবিধানে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি প্রদান করা হোক; ৪. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক; ৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে আদিবাসী ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা হোক; ৬. আদিবাসী বিভিন্ন জাতিসমূহের ভাষার অভিধান তৈরি করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হোক; ৭. আদিবাসী ভাষা, সাহিত্য সংগ্রহ ও এ-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হোক এবং ৮. গবেষণালব্ধ ও আদিবাসী বিষয় নিয়ে প্রস্তুতকৃত বই, ম্যাগাজিন প্রকাশনার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হোক ইত্যাদি।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল, যেখানে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুসহ আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি উন্নয়নের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ইতিমধ্যে দুই বছর পার হয়েছে। তথাপি পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সমতলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় পড়ালেখা শুরু হয়নি। একুশের মাসে আদিবাসীদের প্রশ্ন_কবে এ দেশের আদিবাসী শিশুরা নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পাবে?
লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট
No comments