আমাদের পরিকল্পনা কমিশনকে কেন শক্তিশালী করা প্রয়োজন by ড. শামসুল আলম
গত জানুয়ারির মধ্যভাগে ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে আমার জানার সুযোগ হয়েছিল। এ সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের কার্যপ্রণালি ও দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ। মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখনো একটি পরিকল্পিত অর্থনীতির দেশ।
ভারতে এখন ১১তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০০৭-১২) বাস্তবায়নাধীন। বিশেষ করে মুক্তবাজার ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের এখনকার কর্মপরিধি ও পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া ছিল আমার সফরের উদ্দেশ্য। সে অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের পুনর্গঠন সম্পর্কে আমি কিছু মত প্রকাশ করতে চাই। এর আগে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম ও অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা বলে নিই।
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে পরিকল্পনা কমিশন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব ডেপুটি চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত, যিনি ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন। পদাধিকার বলে তিনি নিয়মিতভাবে সব কেবিনেট সভায় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যসংখ্যা একজন সদস্যসচিবসহ মোট ৯ জন। সদস্যদের পদমর্যাদা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রীদের সমমর্যাদার। ডেপুটি চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যপদ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে নিয়োগ হয়। সদস্যপদগুলো ভারতের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, সুশীলসমাজ, শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও বা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা উন্নয়ন বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব, তাঁদেরও এ পদে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হয়। তবে সদস্যপদে যোগদানের আগে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে হয়। অর্থাৎ পরিকল্পনা কমিশন সদস্যপদে আমলাতন্ত্র থেকে সরাসরি পদায়ন করা হয় না। আর আমাদের দেশে এখন কদাচিৎ আমলাতন্ত্রের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নেওয়া হয়।
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন ভারত সরকারের 'ঞযরহশ ঞধহশ', চিন্তা-সরোবর হিসেবে বিবেচিত। এ কমিশন ভারত সরকারের সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। কমিশন দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা, মধ্যমেয়াদি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ বিষয়ভিত্তিক কৌশলগুলো প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে। কমিশন প্রাদেশিক সরকারের উন্নয়নের বিষয়েও কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে। ভারতের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্য, কৌশল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ বরাদ্দের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশনের। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে পরিকল্পনা কমিশন ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে, আমাদের মতো অবনয়ন করা হয়নি।
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সম্পদের চাহিদা নিরূপণ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে প্রাদেশিক সরকারগুলোকে উন্নয়নবিষয়ক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করে। তাদের নিরূপিত আর্থিক চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের সংস্থান করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। অর্থের সংস্থানের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চূড়ান্ত বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। সম্পদের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়ার পর কমিশনের মূল্যায়ন অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রাদেশিক সরকারের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বরাদ্দের আলোকে মন্ত্রণালয়গুলো বিনিয়োগ প্রোগ্রাম বা স্কিম গ্রহণ করে। কমিশন কর্তৃক প্রোগ্রাম বা স্কিমগুলোর রূপরেখা অনুমোদন দেওয়ার পর এর বিপরীতে গৃহীত স্কিম অনুমোদনের জন্য পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে আসতে হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা ১৫০ কোটি রুপি পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদনের সুপারিশ করে থাকেন। এ অনুমোদন প্রদানের সুপারিশ আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়। ১৫০ কোটি রুপির ঊধর্ে্বর প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া সচিব, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মূল্যায়িত হয়। সব পর্যায়ের স্কিম অনুমোদনের চূড়ান্ত ক্ষমতা ভারতীয় মন্ত্রিসভার ওপর ন্যস্ত।
পরিকল্পনা কমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত প্রাদেশিক সরকারের প্রোগ্রামগুলোর ফলপ্রসূতা স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। যদিও প্রোগামগুলোর মূল্যায়নের জন্য আলাদা 'স্বাধীন মূল্যায়ন দপ্তর' (ওহফবঢ়বহফবহঃ ঊাধষঁধঃরড়হ ঙভভরপব) রয়েছে। এ দপ্তর বাংলাদেশের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমতুল্য এবং পরিকল্পনা কমিশনের আওতাবহির্ভূত। স্বাধীন মূল্যায়ন দপ্তর ভারত সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়িত সব প্রোগ্রাম বা স্কিমের মূল্যায়ন করে। এ দপ্তরকে প্রতিবছর নূ্যনপক্ষে চারটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করতে হয়। পরিকল্পনা কমিশন সাধারণত প্রোগ্রামগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে এবং প্রোগ্রামগুলোর বিন্যাস বা সমন্বয়ের বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করে। কমিশন উন্নয়ন-সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করে।
বাংলাদেশের মতো ভারত সরকারও মধ্যমেয়াদি বাজেট সহায়তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে (গঞইঝ); তবে উন্নয়ন-সংক্রান্ত বরাদ্দ চূড়ান্ত করার ক্ষমতা পরিকল্পনা কমিশনের আওতাভুক্ত। পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্তই মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য চূড়ান্ত। বাংলাদেশের মতোই ভারতের মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পাঁচ বছরের জন্য প্রণীত হয়। ভারতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (পিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শেই অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। এর আওতায় বেশ কিছু বৃহৎ আকৃতির অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। দিলি্লতে সম্প্রতি নির্মিত অত্যাধুনিক বিমানবন্দর পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মান্দ্রা সমুদ্রবন্দরও সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ভারত ক্রমান্বয়ে এ পর্যন্ত ১১টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। ২০১২ সালের মধ্যেই ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলো (ঝঃৎধঃবমরপ উরৎবপঃরড়হ) নির্ধারণের কাজ চলছে। এর জন্য খাতভিত্তিক স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছে। আলোচনাক্রমে জানা যায় যে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে কম-বেশি দুই বছর সময় লেগে যায়। পরিকল্পনা প্রণয়নে বহু সাব-কমিটি গঠন করা হয় এবং এ কাজে শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদসহ সুশীলসমাজের মতামতের ভিত্তিতে দলিলটি চূড়ান্ত করা হয়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো ও পরিকল্পনা কৌশল চূড়ান্ত অনুমোদনের ক্ষমতা ভারতীয় উন্নয়ন কাউন্সিলের (ঘধঃরড়হধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঈড়ঁহপরষ) ওপর ন্যস্ত। অনেকটা আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের মতো (ঘঊঈ)। এ কাউন্সিলের প্রধান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কাউন্সিলের সদস্য। ভারতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো ভারতীয় লোকসভার অবগতির জন্য পেশ করা হয়।
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের কার্যাবলিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভারতীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করার পূর্বতন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে কৌশলগত পরিকল্পনা (Strategic Planning) প্রণয়ন করছে। উপরন্তু ভারতের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয়ে সরকারের কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশন পালন করে। দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস ভারতের উন্নয়নের অন্যতম কৌশল। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নের পরিমাণ নগণ্য। ভারত সরকার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়া উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণ করে না। পরিকল্পনা ব্যবস্থায় এখন প্রাদেশিক সরকারগুলো যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে এবং যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান অলাভজনক তা বন্ধ বা বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ভারতে উঁঃরবং ও ঞধী ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা হচ্ছে। ভারতের মাথাপিছু আয় প্রতিবছর ৬ থেকে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দারিদ্র্যের হার ১৯৭৩ সালের ৫৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ২৭.৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারত বর্তমানে যে উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে তা মোটামুটি ব্যক্তি খাতনির্ভর। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রবৃদ্ধির হারও শ্লথ। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিং ও সার্ভিস সেক্টরে প্রবৃদ্ধির হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের ঠুঁটো জগন্নাথ পরিকল্পনা কমিশন পাল্টাতে হবে
পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থা অনুসরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব ও কার্যপ্রণালি সুবিন্যস্ত ও সময়োপযোগী করা অত্যাবশ্যক। পরিকল্পনা কমিশনকে সরকারের প্রকৃত 'Think Tank'-এ রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। তাই কমিশনের পেশাগত দক্ষতা ও অর্থনৈতিক বিশ্নেষণমূলক কাজে পারদর্শিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ কাজই মুখ্য; অর্থনীতিতে প্রকল্প বা কর্মসূচির প্রভাব ও ফলপ্রসূতা বিশ্লেষণের কাজ গৗণ। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশন আমলাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হতে পারে না। সদস্যপদ এখন এতটাই অবমূল্যায়িত যে এখন, এমনকি ভারপ্রাপ্ত সচিবকেও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করে পাঠানো হচ্ছে। কমিশনের কার্যকারিতা এবং পেশাদারিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে কমিশনের অবস্থান (status) স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের আদলে পুনর্গঠন করা অত্যাবশ্যক। কেননা, বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর বাইরে সঠিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে, যথাযথ সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি পেশাগত প্রাজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন বাংলাদেশের জন্য জরুরি, যা এই সময়ের একটি বড় চাহিদা। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশে যে পরিকল্পনা কমিশন করা হয়েছিল, তা ছিল ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের মতো স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী। তখন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদদের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করা হয়েছিল। বিভাগীয় প্রধানদেরও তখন আউট সোর্সিং করা হতো। বিভাগীয় প্রধানদের মর্যাদাও ছিল সচিব সমমানের।
পরিকল্পনা কমিশনের সব সদস্য নিয়োগ উন্মুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রথিতযশা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূরণ করা যায়। কমিশনের সদস্যপদ প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ে হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে কমিশনের ওপর আমলাতন্ত্রের খবরদারি না থাকে। প্রয়োজনবোধে বিভাগ প্রধানদেরও ৫০ শতাংশ পদ প্রাজ্ঞ পেশাজীবীদের জন্য উন্মুক্ত করা বা আউট সোর্সিং করা যেতে পারে অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম বা অন্যান্য প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা শিথিল করা প্রয়োজন। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য আলাদা বিভাগ থাকায় কমিশনের কার্যকারিতা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের অনুরূপ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কমিশনের আওতাভুক্ত করা সংগত হবে। ফলে কাজের দ্বৈততা কমবে ও সমন্বয় সহজতর হবে। উন্নয়ন-সংক্রান্ত অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো ব্যবস্থা (MTBF) পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক নিরূপিত চাহিদার আলোকে হতে হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে আইএমইডিকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আর্থিক মনিটরিংসহ ফলাফল পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ফলাফল মূল্যায়নে পরিকল্পনা কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে বৃহৎ আকৃতির প্রকল্পে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব আউট সোর্সিং করা যেতে পারে। অর্থনীতির বর্তমান জটিলতা, বিশ্বায়নের ফলে উদ্ভূত প্রতিযোগিতা ও বিশাল ব্যক্তি খাতকে সফলভাবে নির্দেশনা দিতে পরিকল্পনা কমিশনকে ঞযরহশ Tank বা চিন্তা-সরোবর হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে পরিকল্পনা কমিশন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব ডেপুটি চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত, যিনি ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন। পদাধিকার বলে তিনি নিয়মিতভাবে সব কেবিনেট সভায় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যসংখ্যা একজন সদস্যসচিবসহ মোট ৯ জন। সদস্যদের পদমর্যাদা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রীদের সমমর্যাদার। ডেপুটি চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যপদ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে নিয়োগ হয়। সদস্যপদগুলো ভারতের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, সুশীলসমাজ, শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও বা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা উন্নয়ন বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব, তাঁদেরও এ পদে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হয়। তবে সদস্যপদে যোগদানের আগে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে হয়। অর্থাৎ পরিকল্পনা কমিশন সদস্যপদে আমলাতন্ত্র থেকে সরাসরি পদায়ন করা হয় না। আর আমাদের দেশে এখন কদাচিৎ আমলাতন্ত্রের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নেওয়া হয়।
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন ভারত সরকারের 'ঞযরহশ ঞধহশ', চিন্তা-সরোবর হিসেবে বিবেচিত। এ কমিশন ভারত সরকারের সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। কমিশন দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা, মধ্যমেয়াদি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ বিষয়ভিত্তিক কৌশলগুলো প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে। কমিশন প্রাদেশিক সরকারের উন্নয়নের বিষয়েও কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে। ভারতের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্য, কৌশল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ বরাদ্দের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশনের। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে পরিকল্পনা কমিশন ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে, আমাদের মতো অবনয়ন করা হয়নি।
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সম্পদের চাহিদা নিরূপণ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে প্রাদেশিক সরকারগুলোকে উন্নয়নবিষয়ক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করে। তাদের নিরূপিত আর্থিক চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের সংস্থান করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। অর্থের সংস্থানের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চূড়ান্ত বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। সম্পদের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়ার পর কমিশনের মূল্যায়ন অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রাদেশিক সরকারের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বরাদ্দের আলোকে মন্ত্রণালয়গুলো বিনিয়োগ প্রোগ্রাম বা স্কিম গ্রহণ করে। কমিশন কর্তৃক প্রোগ্রাম বা স্কিমগুলোর রূপরেখা অনুমোদন দেওয়ার পর এর বিপরীতে গৃহীত স্কিম অনুমোদনের জন্য পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে আসতে হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা ১৫০ কোটি রুপি পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদনের সুপারিশ করে থাকেন। এ অনুমোদন প্রদানের সুপারিশ আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়। ১৫০ কোটি রুপির ঊধর্ে্বর প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া সচিব, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মূল্যায়িত হয়। সব পর্যায়ের স্কিম অনুমোদনের চূড়ান্ত ক্ষমতা ভারতীয় মন্ত্রিসভার ওপর ন্যস্ত।
পরিকল্পনা কমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত প্রাদেশিক সরকারের প্রোগ্রামগুলোর ফলপ্রসূতা স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। যদিও প্রোগামগুলোর মূল্যায়নের জন্য আলাদা 'স্বাধীন মূল্যায়ন দপ্তর' (ওহফবঢ়বহফবহঃ ঊাধষঁধঃরড়হ ঙভভরপব) রয়েছে। এ দপ্তর বাংলাদেশের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমতুল্য এবং পরিকল্পনা কমিশনের আওতাবহির্ভূত। স্বাধীন মূল্যায়ন দপ্তর ভারত সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়িত সব প্রোগ্রাম বা স্কিমের মূল্যায়ন করে। এ দপ্তরকে প্রতিবছর নূ্যনপক্ষে চারটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করতে হয়। পরিকল্পনা কমিশন সাধারণত প্রোগ্রামগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে এবং প্রোগ্রামগুলোর বিন্যাস বা সমন্বয়ের বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করে। কমিশন উন্নয়ন-সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করে।
বাংলাদেশের মতো ভারত সরকারও মধ্যমেয়াদি বাজেট সহায়তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে (গঞইঝ); তবে উন্নয়ন-সংক্রান্ত বরাদ্দ চূড়ান্ত করার ক্ষমতা পরিকল্পনা কমিশনের আওতাভুক্ত। পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্তই মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য চূড়ান্ত। বাংলাদেশের মতোই ভারতের মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পাঁচ বছরের জন্য প্রণীত হয়। ভারতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (পিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শেই অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। এর আওতায় বেশ কিছু বৃহৎ আকৃতির অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। দিলি্লতে সম্প্রতি নির্মিত অত্যাধুনিক বিমানবন্দর পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মান্দ্রা সমুদ্রবন্দরও সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ভারত ক্রমান্বয়ে এ পর্যন্ত ১১টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। ২০১২ সালের মধ্যেই ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলো (ঝঃৎধঃবমরপ উরৎবপঃরড়হ) নির্ধারণের কাজ চলছে। এর জন্য খাতভিত্তিক স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছে। আলোচনাক্রমে জানা যায় যে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে কম-বেশি দুই বছর সময় লেগে যায়। পরিকল্পনা প্রণয়নে বহু সাব-কমিটি গঠন করা হয় এবং এ কাজে শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদসহ সুশীলসমাজের মতামতের ভিত্তিতে দলিলটি চূড়ান্ত করা হয়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো ও পরিকল্পনা কৌশল চূড়ান্ত অনুমোদনের ক্ষমতা ভারতীয় উন্নয়ন কাউন্সিলের (ঘধঃরড়হধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঈড়ঁহপরষ) ওপর ন্যস্ত। অনেকটা আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের মতো (ঘঊঈ)। এ কাউন্সিলের প্রধান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কাউন্সিলের সদস্য। ভারতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো ভারতীয় লোকসভার অবগতির জন্য পেশ করা হয়।
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের কার্যাবলিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভারতীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করার পূর্বতন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে কৌশলগত পরিকল্পনা (Strategic Planning) প্রণয়ন করছে। উপরন্তু ভারতের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয়ে সরকারের কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশন পালন করে। দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস ভারতের উন্নয়নের অন্যতম কৌশল। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নের পরিমাণ নগণ্য। ভারত সরকার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়া উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণ করে না। পরিকল্পনা ব্যবস্থায় এখন প্রাদেশিক সরকারগুলো যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে এবং যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান অলাভজনক তা বন্ধ বা বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ভারতে উঁঃরবং ও ঞধী ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা হচ্ছে। ভারতের মাথাপিছু আয় প্রতিবছর ৬ থেকে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দারিদ্র্যের হার ১৯৭৩ সালের ৫৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ২৭.৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারত বর্তমানে যে উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে তা মোটামুটি ব্যক্তি খাতনির্ভর। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রবৃদ্ধির হারও শ্লথ। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিং ও সার্ভিস সেক্টরে প্রবৃদ্ধির হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের ঠুঁটো জগন্নাথ পরিকল্পনা কমিশন পাল্টাতে হবে
পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থা অনুসরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব ও কার্যপ্রণালি সুবিন্যস্ত ও সময়োপযোগী করা অত্যাবশ্যক। পরিকল্পনা কমিশনকে সরকারের প্রকৃত 'Think Tank'-এ রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। তাই কমিশনের পেশাগত দক্ষতা ও অর্থনৈতিক বিশ্নেষণমূলক কাজে পারদর্শিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ কাজই মুখ্য; অর্থনীতিতে প্রকল্প বা কর্মসূচির প্রভাব ও ফলপ্রসূতা বিশ্লেষণের কাজ গৗণ। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশন আমলাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হতে পারে না। সদস্যপদ এখন এতটাই অবমূল্যায়িত যে এখন, এমনকি ভারপ্রাপ্ত সচিবকেও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করে পাঠানো হচ্ছে। কমিশনের কার্যকারিতা এবং পেশাদারিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে কমিশনের অবস্থান (status) স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের আদলে পুনর্গঠন করা অত্যাবশ্যক। কেননা, বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর বাইরে সঠিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে, যথাযথ সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি পেশাগত প্রাজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন বাংলাদেশের জন্য জরুরি, যা এই সময়ের একটি বড় চাহিদা। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশে যে পরিকল্পনা কমিশন করা হয়েছিল, তা ছিল ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের মতো স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী। তখন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদদের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করা হয়েছিল। বিভাগীয় প্রধানদেরও তখন আউট সোর্সিং করা হতো। বিভাগীয় প্রধানদের মর্যাদাও ছিল সচিব সমমানের।
পরিকল্পনা কমিশনের সব সদস্য নিয়োগ উন্মুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রথিতযশা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূরণ করা যায়। কমিশনের সদস্যপদ প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ে হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে কমিশনের ওপর আমলাতন্ত্রের খবরদারি না থাকে। প্রয়োজনবোধে বিভাগ প্রধানদেরও ৫০ শতাংশ পদ প্রাজ্ঞ পেশাজীবীদের জন্য উন্মুক্ত করা বা আউট সোর্সিং করা যেতে পারে অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম বা অন্যান্য প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা শিথিল করা প্রয়োজন। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য আলাদা বিভাগ থাকায় কমিশনের কার্যকারিতা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের অনুরূপ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কমিশনের আওতাভুক্ত করা সংগত হবে। ফলে কাজের দ্বৈততা কমবে ও সমন্বয় সহজতর হবে। উন্নয়ন-সংক্রান্ত অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো ব্যবস্থা (MTBF) পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক নিরূপিত চাহিদার আলোকে হতে হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে আইএমইডিকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আর্থিক মনিটরিংসহ ফলাফল পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ফলাফল মূল্যায়নে পরিকল্পনা কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে বৃহৎ আকৃতির প্রকল্পে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব আউট সোর্সিং করা যেতে পারে। অর্থনীতির বর্তমান জটিলতা, বিশ্বায়নের ফলে উদ্ভূত প্রতিযোগিতা ও বিশাল ব্যক্তি খাতকে সফলভাবে নির্দেশনা দিতে পরিকল্পনা কমিশনকে ঞযরহশ Tank বা চিন্তা-সরোবর হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য
No comments