ভয়ের কারখানা! by রুবাইয়া ইয়াসমিন
বিশ শতকের শুরুর দিকে মনোবিজ্ঞান তখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে। তবে শুরুতেই এর অগ্রগতি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সূচনালগ্নের গবেষকরা ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করেন মানুষের মনের প্যাঁচ খোলার কাজ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কৌতূহল মেটাতে নিরলস গবেষণা শুরু করেন। এ রকম এক মনস্তাত্তি্বক ছিলেন জন বি. ওয়াটসন।
১৯১৯ সালে একটি শিশুর কুকুরের প্রতি অকারণে ভয় দেখে এই মনোবিজ্ঞানীর মনে কৌতূহল জাগল। ওয়াটসন ধারণা করলেন, সদ্য জন্মানো মানব শিশুর জন্মগতভাবে গৃহপালিত পশুর প্রতি কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু যদি কোনো পশু তার মধ্যে একবার ভয় সঞ্চার করে দেয়, তখন সে যে কোনো লোমশ পশু দেখেই ভয় পাবে। তার বিজ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে তিনি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা চালালেন। শুধু দেখার জন্য যে, কোমল সি্নগ্ধ প্রকৃতির পশু ও সঙ্গে কৃত্রিম উদ্দীপক ব্যবহার করে শিশুর মধ্যে ভয় সৃষ্টি করা যায় কি-না। এর প্রায় দুই দশক আগে ঘণ্টা বাজিয়ে প্যাভলভের কুকুরের মুখ দিয়ে লালা ফেলানো হয়েছিল। ওয়াটসন এই ধারণা সম্প্রসারণে আশাবাদী ছিলেন।
১৯২০ সালে ওয়াটসন তার পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের এক নার্সের স্বাস্থ্যবান এবং তখন পর্যন্ত প্রায় আবেগবোধহীন ৯ মাসের শিশুকে ঠিক করলেন, যার নাম ছিল আলবার্ট বি। তার সহকারী ছিলেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যলয়ের এক স্নাতক শিক্ষার্থী রোসাইল রাইনার। এই গবেষকদ্বয়ের গবেষণার প্রথম লক্ষ্য ছিল মনোবিজ্ঞানের একটি ভিত্তিরেখা স্থাপন করা। তারা আলবার্টকে সাদা ইঁদুর, খরগোশ, কুকুর এবং বানর দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। শিশুটি বেশ আগ্রহভরেই প্রতিটি পশুর দিকেই এগিয়ে গিয়েছিল। তার পর গবেষকরা পশমি মুখোশ, ক্লাম্প ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষা করলেন। এগুলোও শিশুটি ঔৎসুক্যের সঙ্গেই নাড়াচাড়া করতে লাগল। এবার তারা আলবার্টের মাথার পেছনে হাতুড়ি দিয়ে শব্দ করলেন। তখন শিশুটি ভয়ে কেঁপে উঠল। শিশুটির প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিরেখা ঠিকমতোই চিহ্নিত করে রাখা হলো। এর দুই মাস পর শিশুটির ওপর যৌথ উদ্দীপনার অদ্ভুত একটি পরীক্ষা চালানো হলো।
ডক্টর ওয়াটসনের নোট থেকে তার পরীক্ষার অগ্রগতির কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় :
বয়স :১১ মাস ৩ দিন
ঝুড়ি থেকে হঠাৎ একটি ইঁদুর বের করে আলবার্টের সামনে নেওয়া হলো। শিশুটি যখনই হাত দিয়ে পশুটিকে স্পর্শ করল, সঙ্গে সঙ্গেই তার পেছনে ঘণ্টা বাজানো হলো। অমনি সে ভয়ে লাফিয়ে উঠে বিছানায় মাথা গুঁজে নিল। যেই না তার ডান হাতটি ইঁদুরের গায়ে লাগল, সাথে সাথে আবার ঘণ্টা বাজানো হলো। আবারও শিশুটি ভয়ে লাফিয়ে উঠে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
বয়স :১১ মাস ১০ দিন
কোনো শব্দ ছাড়াই একটা ইঁদুর আলবার্টের সামনে আনা হলো। ইঁদুরটা যখন তার বাম হাত নিজের নাকে লাগিয়ে ঘ্রাণ নিতে গেল, অমনি সে হাত সরিয়ে নিল। এতে বোঝা গেল যে, গত সপ্তাহের যৌথ উদ্দীপনার পরীক্ষা বৃথা যায়নি।
এরপর আবার তার ওপর এই যৌথ উদ্দীপনার পরীক্ষা চালানো হলো। শব্দ আর ইঁদুর একসঙ্গে আসতেই সে ডান দিয়ে ঘুরে শুয়ে কাঁদতে শুরু করল।
এবার শুধু ইঁদুর আনা হলো। ইঁদুর দেখেই শিশুটি কাঁদতে শুরু করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে বাম দিকে ঘুরে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেল।
এখন বিজ্ঞানী ওয়াটসনের সন্দেহ হলো, আলবার্টের এই ভয় অন্য প্রাণীর প্রতিও কাজ করে কি-না। দশ দিন বিরতির পর আরও কিছু বাড়তি পরীক্ষা করা হলো :
বয়স :১১ মাস ২০ দিন
শুধু ইঁদুর আনা হলো। বামদিকে ঘুরল। কিন্তু এবার আর কাঁদল না। বরং একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তখন ওয়াটসন ভাবলেন, এখন আরেকটি যৌথ উদ্দীপক দিয়ে তার সংবেদনশীলতাকে পুনর্জাগ্রত করা যাক।
যেই-না ইঁদুরের হাতের ওপরে রড দিয়ে শব্দ করা হলো, অমনি সে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখাল।
এবার শুধু খরগোশ আনা হলো। সে এটা দেখে বামে ঘুরে যথাসম্ভব দূরে সরে গেল আর কাঁদতে লাগল।
তারপর যখন খরগোশটিকে তার পায়ের ওপর অনেকক্ষণ ধরে রাখা হলো, সে প্রথমে এটিকে ধরতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু পরে আঙুল দিয়ে খরগোশের লোমগুলো টানতে লাগল। ঠিক তখনই ঘণ্টা বাজানো হলো। অমনি সে প্রচণ্ড কান্না শুরু করল। এবার যখন শুধু খরগোশ আনা হলো। সে ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠল, কিন্তু কাঁদল না।
খরগোশের প্রতি আলবার্টের এই চরম নেতিবাচক আচরণই প্রমাণ করে যে, তার ভয় এখন অন্য প্রাণীর প্রতিও কাজ করতে শুরু করেছে। আলবার্ট এখন কুকুর দেখেও ভয় পায়। এমনকি তুলার তৈরি কোনো জিনিসেও তার ভয়। কিন্তু যখন ওয়াটসন আলবার্টকে তার কাঠের খেলনার বাক্স দিলেন, সে দিব্যি এটা নিয়ে খেলতে লাগল।
এখন ওয়াটসন দেখতে চাইলেন, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই ভয় স্থায়ী হয় কি-না। এর পর তারা এক মাসের বিরতি নিয়ে আবার আলবার্টের এই 'লোমভয়' নিয়ে কাজ শুরু করলেন।
বয়স :১২ মাস ২১ দিন
এবার আনা হলো সান্তাক্লজ মুখোশ। প্রথমে সে এটাকে সরিয়ে দিল। তারপর এটা না ধরেই এটাতে দিল চড়। তার পর সে কাঁদতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সে সামান্য একটা মুখোশ দেখেও কাঁদছে। তখন পশমি কোট আনা হলো তার সামনে। সে প্রথমে নাক সিঁটকে এটাকে দুই হাত দিয়ে সরিয়ে দিল। যখন এটা আবার তার কাছে আনা হলো, সে তখন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক পাশে সরে গেল। তারপর দুর্ঘটনাবশত তার হাতটা একটু এটাতে লাগতেই সে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। এবার ইঁদুর দিয়ে পরীক্ষা। সে ইঁদুরটিকে সরিয়ে না দিয়ে বরং তার কাছে আসতে দিল। এমনকি ইঁদুরটা তার বুকের ওপর উঠে গেল, তবুও সে কিছুই করল না।
এবার খরগোশ। খরগোশ আনা হলে কয়েক সেকেন্ড পর সে মুখ তুলে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরীক্ষকের দিকে দেখতে লাগল। তারপর সে একটু দূরে গিয়ে হাত বাড়িয়ে খরগোশটির গায়ে স্পর্শ করল। তখন পরীক্ষক তার হাত ধরে খরগোশের পিঠে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলবার্ট হাত সরিয়ে নিয়ে বুড়ো আঙুল চুষতে লাগল। তারপর খরগোশটিকে তার কোলে শুইয়ে দেওয়া হলো। তখন সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল।
জন বি. ওয়াটসন_'নিঃসন্দেহে একটি শিশুর মনে সৃষ্ট ভয় দূর করার জন্য মাত্র এক মাস বিরতি যথেষ্ট নয়।' তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়_ তারা কি এই আবেগীয় প্রতিক্রিয়া দূর করতে ল্যাবরেটরি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন? ওয়াটসন মূলত পরে শিশুটির মনে নতুন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আগে সৃষ্ট ভয়টাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার পরীক্ষা থেকে এই অংশটি বাদ দিতে হয় সময়স্বল্পতার কারণে। যখন তিনি তার পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেন, তখন তিনি পরামর্শ দিলেন, এই ভয় দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আবার সেই ধাতুতে আঘাত করে শব্দ সৃষ্টি করে ভয়টাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। তবে সেটা হতে হবে ইতিবাচক উদ্দীপক দিয়ে। যেমন :ক) শারীরিক উদ্দীপনা সৃষ্টি, যেমন প্রথমে ঠোঁট, স্তনবৃন্ত, শেষে যৌনাঙ্গ খ) ক্যান্ডি অথবা খাবার গ) গঠনমূলক কাজ।
প্রথমে মনোবিজ্ঞনীরা তার এই পরীক্ষা তুমুল উৎসাহ-আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরে তার এই নতুন পাওয়া জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেও একটি শিশুর মানসিকতায় ভয় সৃষ্টি করে দিয়ে, একজন স্নাতক পড়ূয়া সোনার ছাত্রকে দিয়ে যে অননুমোদিত পরীক্ষা করেছিলেন, সেটি নৈতিকতার প্রশ্ন রেখে যায়। তার ওপর, ওয়াটসনের স্ত্রী আবিষ্কার করলেন তার স্বামী সহকারী রোসাইল রাইনারের সঙ্গে একে অপরের যৌন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছেন। ফলে ওয়াটসনের ক্যারিয়ার ও সংসার দুটোই ভেঙে গেল। আধুনিক আদর্শে ওয়াটসনের শিশুর মাঝে ভয় সৃষ্টির পরীক্ষা নিঃসন্দেহে বেশকিছু কারণে অমানবিক। কিন্তু এ গবেষণাটি আসলে এমন একটি সময়ে করা হয়েছিল, যখন ছিল মনোবিজ্ঞানের 'বয়ঃসন্ধি' যুগ। এ সময়টিতে তাই যাকে নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে, তার ভালোমন্দের চেয়ে বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি অর্জনই ছিল বড়। তা ছাড়া এ পরীক্ষাটি পদ্ধতিগতভাবেও ছিল ত্রুটিপূর্ণ, যেটি আসলে সুনিশ্চিত কোনো ফল দিতে পারেনি। যেমন, এ পরীক্ষার গবেষকরা শুধু একটি বিষয় নিয়ে, তার কেবল নেতিবাচক উত্তেজনা নিয়ে কাজ করেছিলেন, যেটা আসলে পরীক্ষার কার্যক্রমগুলোকে এক ধরনের হঠকারিতায় পরিণত করেছিল। যদিও ওয়াটসন স্বীকার করেছিলেন, তার পরীক্ষাটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তার এ পরীক্ষার ফলগুলোকে তিনি বিজ্ঞানের জগতে গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, এই পরীক্ষাটি দেখাতে পারে_ কোনো কিছুর প্রতি সৃষ্ট শর্তসাপেক্ষ আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার অন্য কিছুতেও সঞ্চায়িত হওয়ার ব্যাপারটি এক মাসেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়। যদিও প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পায় এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বও এ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। যার প্রভাব সারা জীবনই থেকে যায়।
আজ সেই 'ছোট্ট আলবার্টকে নিয়ে পরীক্ষা' মনোবিজ্ঞান জগতের একটি কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটির সেই ১৯২০ সালের প্রথম প্রকাশের পর থেকে আজ অবধি বহুবার পরীক্ষা, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। যদিও এ কথা সত্য_ অনেক মৌলিক ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি এমন এক ধরনের পরীক্ষা, যেটি শুধু কৌতূহল জাগায়; কিন্তু তাকে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। যদিও ওয়াটসন তার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন ভিন্ন কোনো ফলের জন্য গবেষণা করে। কিন্তু তার সারাজীবনের কষ্টার্জিত তথ্যগুলো থেকে আসলে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। শুধু একটি সিদ্ধান্তই নিশ্চিত হয়েছিল যে, কেউ যেন তার বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য কোনো মনোবিজ্ঞান গবেষককে নিয়োগ না দেয়।
যেমন, আলবার্টের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সে এবং তার মা অনিশ্চয়তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। যেটি কখনও জনসমক্ষে চিহ্নিত হয়নি। কেউ জানে না অবিচারের শিকার সেই শিশুটির কী হয়েছিল? তুলতুলে লোমশ পশুর প্রতি তার সেই ভয় বড় হওয়ার পরও তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করেছে কি-না কে জানে! হ
১৯২০ সালে ওয়াটসন তার পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের এক নার্সের স্বাস্থ্যবান এবং তখন পর্যন্ত প্রায় আবেগবোধহীন ৯ মাসের শিশুকে ঠিক করলেন, যার নাম ছিল আলবার্ট বি। তার সহকারী ছিলেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যলয়ের এক স্নাতক শিক্ষার্থী রোসাইল রাইনার। এই গবেষকদ্বয়ের গবেষণার প্রথম লক্ষ্য ছিল মনোবিজ্ঞানের একটি ভিত্তিরেখা স্থাপন করা। তারা আলবার্টকে সাদা ইঁদুর, খরগোশ, কুকুর এবং বানর দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। শিশুটি বেশ আগ্রহভরেই প্রতিটি পশুর দিকেই এগিয়ে গিয়েছিল। তার পর গবেষকরা পশমি মুখোশ, ক্লাম্প ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষা করলেন। এগুলোও শিশুটি ঔৎসুক্যের সঙ্গেই নাড়াচাড়া করতে লাগল। এবার তারা আলবার্টের মাথার পেছনে হাতুড়ি দিয়ে শব্দ করলেন। তখন শিশুটি ভয়ে কেঁপে উঠল। শিশুটির প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিরেখা ঠিকমতোই চিহ্নিত করে রাখা হলো। এর দুই মাস পর শিশুটির ওপর যৌথ উদ্দীপনার অদ্ভুত একটি পরীক্ষা চালানো হলো।
ডক্টর ওয়াটসনের নোট থেকে তার পরীক্ষার অগ্রগতির কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় :
বয়স :১১ মাস ৩ দিন
ঝুড়ি থেকে হঠাৎ একটি ইঁদুর বের করে আলবার্টের সামনে নেওয়া হলো। শিশুটি যখনই হাত দিয়ে পশুটিকে স্পর্শ করল, সঙ্গে সঙ্গেই তার পেছনে ঘণ্টা বাজানো হলো। অমনি সে ভয়ে লাফিয়ে উঠে বিছানায় মাথা গুঁজে নিল। যেই না তার ডান হাতটি ইঁদুরের গায়ে লাগল, সাথে সাথে আবার ঘণ্টা বাজানো হলো। আবারও শিশুটি ভয়ে লাফিয়ে উঠে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
বয়স :১১ মাস ১০ দিন
কোনো শব্দ ছাড়াই একটা ইঁদুর আলবার্টের সামনে আনা হলো। ইঁদুরটা যখন তার বাম হাত নিজের নাকে লাগিয়ে ঘ্রাণ নিতে গেল, অমনি সে হাত সরিয়ে নিল। এতে বোঝা গেল যে, গত সপ্তাহের যৌথ উদ্দীপনার পরীক্ষা বৃথা যায়নি।
এরপর আবার তার ওপর এই যৌথ উদ্দীপনার পরীক্ষা চালানো হলো। শব্দ আর ইঁদুর একসঙ্গে আসতেই সে ডান দিয়ে ঘুরে শুয়ে কাঁদতে শুরু করল।
এবার শুধু ইঁদুর আনা হলো। ইঁদুর দেখেই শিশুটি কাঁদতে শুরু করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে বাম দিকে ঘুরে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেল।
এখন বিজ্ঞানী ওয়াটসনের সন্দেহ হলো, আলবার্টের এই ভয় অন্য প্রাণীর প্রতিও কাজ করে কি-না। দশ দিন বিরতির পর আরও কিছু বাড়তি পরীক্ষা করা হলো :
বয়স :১১ মাস ২০ দিন
শুধু ইঁদুর আনা হলো। বামদিকে ঘুরল। কিন্তু এবার আর কাঁদল না। বরং একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তখন ওয়াটসন ভাবলেন, এখন আরেকটি যৌথ উদ্দীপক দিয়ে তার সংবেদনশীলতাকে পুনর্জাগ্রত করা যাক।
যেই-না ইঁদুরের হাতের ওপরে রড দিয়ে শব্দ করা হলো, অমনি সে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখাল।
এবার শুধু খরগোশ আনা হলো। সে এটা দেখে বামে ঘুরে যথাসম্ভব দূরে সরে গেল আর কাঁদতে লাগল।
তারপর যখন খরগোশটিকে তার পায়ের ওপর অনেকক্ষণ ধরে রাখা হলো, সে প্রথমে এটিকে ধরতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু পরে আঙুল দিয়ে খরগোশের লোমগুলো টানতে লাগল। ঠিক তখনই ঘণ্টা বাজানো হলো। অমনি সে প্রচণ্ড কান্না শুরু করল। এবার যখন শুধু খরগোশ আনা হলো। সে ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠল, কিন্তু কাঁদল না।
খরগোশের প্রতি আলবার্টের এই চরম নেতিবাচক আচরণই প্রমাণ করে যে, তার ভয় এখন অন্য প্রাণীর প্রতিও কাজ করতে শুরু করেছে। আলবার্ট এখন কুকুর দেখেও ভয় পায়। এমনকি তুলার তৈরি কোনো জিনিসেও তার ভয়। কিন্তু যখন ওয়াটসন আলবার্টকে তার কাঠের খেলনার বাক্স দিলেন, সে দিব্যি এটা নিয়ে খেলতে লাগল।
এখন ওয়াটসন দেখতে চাইলেন, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই ভয় স্থায়ী হয় কি-না। এর পর তারা এক মাসের বিরতি নিয়ে আবার আলবার্টের এই 'লোমভয়' নিয়ে কাজ শুরু করলেন।
বয়স :১২ মাস ২১ দিন
এবার আনা হলো সান্তাক্লজ মুখোশ। প্রথমে সে এটাকে সরিয়ে দিল। তারপর এটা না ধরেই এটাতে দিল চড়। তার পর সে কাঁদতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সে সামান্য একটা মুখোশ দেখেও কাঁদছে। তখন পশমি কোট আনা হলো তার সামনে। সে প্রথমে নাক সিঁটকে এটাকে দুই হাত দিয়ে সরিয়ে দিল। যখন এটা আবার তার কাছে আনা হলো, সে তখন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক পাশে সরে গেল। তারপর দুর্ঘটনাবশত তার হাতটা একটু এটাতে লাগতেই সে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। এবার ইঁদুর দিয়ে পরীক্ষা। সে ইঁদুরটিকে সরিয়ে না দিয়ে বরং তার কাছে আসতে দিল। এমনকি ইঁদুরটা তার বুকের ওপর উঠে গেল, তবুও সে কিছুই করল না।
এবার খরগোশ। খরগোশ আনা হলে কয়েক সেকেন্ড পর সে মুখ তুলে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরীক্ষকের দিকে দেখতে লাগল। তারপর সে একটু দূরে গিয়ে হাত বাড়িয়ে খরগোশটির গায়ে স্পর্শ করল। তখন পরীক্ষক তার হাত ধরে খরগোশের পিঠে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলবার্ট হাত সরিয়ে নিয়ে বুড়ো আঙুল চুষতে লাগল। তারপর খরগোশটিকে তার কোলে শুইয়ে দেওয়া হলো। তখন সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল।
জন বি. ওয়াটসন_'নিঃসন্দেহে একটি শিশুর মনে সৃষ্ট ভয় দূর করার জন্য মাত্র এক মাস বিরতি যথেষ্ট নয়।' তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়_ তারা কি এই আবেগীয় প্রতিক্রিয়া দূর করতে ল্যাবরেটরি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন? ওয়াটসন মূলত পরে শিশুটির মনে নতুন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আগে সৃষ্ট ভয়টাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার পরীক্ষা থেকে এই অংশটি বাদ দিতে হয় সময়স্বল্পতার কারণে। যখন তিনি তার পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেন, তখন তিনি পরামর্শ দিলেন, এই ভয় দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আবার সেই ধাতুতে আঘাত করে শব্দ সৃষ্টি করে ভয়টাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। তবে সেটা হতে হবে ইতিবাচক উদ্দীপক দিয়ে। যেমন :ক) শারীরিক উদ্দীপনা সৃষ্টি, যেমন প্রথমে ঠোঁট, স্তনবৃন্ত, শেষে যৌনাঙ্গ খ) ক্যান্ডি অথবা খাবার গ) গঠনমূলক কাজ।
প্রথমে মনোবিজ্ঞনীরা তার এই পরীক্ষা তুমুল উৎসাহ-আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরে তার এই নতুন পাওয়া জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেও একটি শিশুর মানসিকতায় ভয় সৃষ্টি করে দিয়ে, একজন স্নাতক পড়ূয়া সোনার ছাত্রকে দিয়ে যে অননুমোদিত পরীক্ষা করেছিলেন, সেটি নৈতিকতার প্রশ্ন রেখে যায়। তার ওপর, ওয়াটসনের স্ত্রী আবিষ্কার করলেন তার স্বামী সহকারী রোসাইল রাইনারের সঙ্গে একে অপরের যৌন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছেন। ফলে ওয়াটসনের ক্যারিয়ার ও সংসার দুটোই ভেঙে গেল। আধুনিক আদর্শে ওয়াটসনের শিশুর মাঝে ভয় সৃষ্টির পরীক্ষা নিঃসন্দেহে বেশকিছু কারণে অমানবিক। কিন্তু এ গবেষণাটি আসলে এমন একটি সময়ে করা হয়েছিল, যখন ছিল মনোবিজ্ঞানের 'বয়ঃসন্ধি' যুগ। এ সময়টিতে তাই যাকে নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে, তার ভালোমন্দের চেয়ে বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি অর্জনই ছিল বড়। তা ছাড়া এ পরীক্ষাটি পদ্ধতিগতভাবেও ছিল ত্রুটিপূর্ণ, যেটি আসলে সুনিশ্চিত কোনো ফল দিতে পারেনি। যেমন, এ পরীক্ষার গবেষকরা শুধু একটি বিষয় নিয়ে, তার কেবল নেতিবাচক উত্তেজনা নিয়ে কাজ করেছিলেন, যেটা আসলে পরীক্ষার কার্যক্রমগুলোকে এক ধরনের হঠকারিতায় পরিণত করেছিল। যদিও ওয়াটসন স্বীকার করেছিলেন, তার পরীক্ষাটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তার এ পরীক্ষার ফলগুলোকে তিনি বিজ্ঞানের জগতে গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, এই পরীক্ষাটি দেখাতে পারে_ কোনো কিছুর প্রতি সৃষ্ট শর্তসাপেক্ষ আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার অন্য কিছুতেও সঞ্চায়িত হওয়ার ব্যাপারটি এক মাসেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়। যদিও প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পায় এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বও এ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। যার প্রভাব সারা জীবনই থেকে যায়।
আজ সেই 'ছোট্ট আলবার্টকে নিয়ে পরীক্ষা' মনোবিজ্ঞান জগতের একটি কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটির সেই ১৯২০ সালের প্রথম প্রকাশের পর থেকে আজ অবধি বহুবার পরীক্ষা, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। যদিও এ কথা সত্য_ অনেক মৌলিক ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি এমন এক ধরনের পরীক্ষা, যেটি শুধু কৌতূহল জাগায়; কিন্তু তাকে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। যদিও ওয়াটসন তার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন ভিন্ন কোনো ফলের জন্য গবেষণা করে। কিন্তু তার সারাজীবনের কষ্টার্জিত তথ্যগুলো থেকে আসলে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। শুধু একটি সিদ্ধান্তই নিশ্চিত হয়েছিল যে, কেউ যেন তার বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য কোনো মনোবিজ্ঞান গবেষককে নিয়োগ না দেয়।
যেমন, আলবার্টের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সে এবং তার মা অনিশ্চয়তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। যেটি কখনও জনসমক্ষে চিহ্নিত হয়নি। কেউ জানে না অবিচারের শিকার সেই শিশুটির কী হয়েছিল? তুলতুলে লোমশ পশুর প্রতি তার সেই ভয় বড় হওয়ার পরও তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করেছে কি-না কে জানে! হ
No comments