সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতির যন্ত্রণা-বিভিন্ন ছুতায় অচল কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রোগীদের ছুটতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে নেপথ্যে 'রেফারেল ফি by তৌফিক মারুফ

রাজধানীর মহাখালীতে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পুরনো ভবনের সামনে একটি মাইক্রোবাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকা ষাটোর্ধ্ব মোবারক আলী ঘন ঘন কাশি দিচ্ছেন। একই হারে তাঁর বুক ওঠানামা করছে শ্বাসকষ্টের কারণে। পাশে দাঁড়ানো মোবারক আলীর ছেলে সোলায়মান বলেন, 'ধানমণ্ডির বাংলাদেশ মেডিক্যাল থেকে একজন ডাক্তার এইখানে


পাঠাইছে সিপিইটি টেস্ট করতে। কিন্তু আইসা শুনি ওই টেস্ট হয় না। টেস্টের মেশিন অনেক দিন ধইরা পইরা আছে।'
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এ হাসপাতালের সিপিইটি (কার্ডিও-পালমোনারি এক্সারসাইজ টেস্ট) মেশিনটি অত্যাধুনিক এবং খুবই দামি। মূল্য প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু মেশিনটি কিভাবে চালাতে হয় তা এ হাসপাতালের কেউ জানে না। ফলে এক বছরের বেশি সময় ধরে যন্ত্রটি পড়ে আছে।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক রাশেদুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সিপিইটি যন্ত্রটি আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। কিন্তু এত দিন ধরে এটি পড়ে ছিল কেবল প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন এটি চালুর জন্য জনবল কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছি।'
দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর আস্থা বেশির ভাগ মানুষের। কিন্তু এ হাসপাতালে এক রোগীর স্বজন মনোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, 'দেশের একমাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালটিতে এমআরআই করা যায় না, রোগীদের বাইরে নিয়ে যেতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি অকেজো হয়ে আছে ২০০৫ সাল থেকে।
এ ছাড়া ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিওথেরাপির দুটি কোবল্ট-৬০ মেশিনের (ব্রেকি থেরাপি) একটি অচল হয়ে আছে গত বছর থেকে। হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, এ হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক হাতিরপুলে অবস্থিত একটি হাসপাতাল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা রোগীদের ভাগিয়ে ওই হাসপাতালে এমআরআই করতে পাঠানোর কৌশল হিসেবে এখানকার এমআরআই যন্ত্রটি অচল করে ফেলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এমআরআই মেশিনটি বিকল থাকায় অনেক দিন ধরেই রোগীদের ভোগান্তি হচ্ছে। তবে এখন আবার অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিন কেনা হয়েছে, যা স্থাপনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ সংযোগ-সংক্রান্ত কাজ চলছে। তা শেষ হলে রোগীরা আবার এখানে এমআরআই করার সুযোগ পাবেন। ব্রেকি থেরাপি মেশিনটিও মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার চিকিৎসার কোবল্ট মেশিনটিও এখন চলছে না। এই হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এ জন্য এক্সপার্ট ডাকা হয়েছে। তিনি জানান, অন্য আরো কিছু যন্ত্রও মাঝেমধ্যেই খারাপ হয়ে পড়ে, যা নিজেদেরই মেরামত করে নিতে হয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগে থাকা দেশের সরকারি পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর মধ্যে একমাত্র সিটি এনজিওগ্রাম মেশিনটি প্রায় ১৫ দিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। এটি সারানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা চলছে ধীরগতিতে।
কেবল এ কয়েকটি হাসপাতালই নয়, দেশের বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালেই দিনের পর দিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে মূল্যবান অনেক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি। উন্নত চিকিৎসাসেবার জন্য এসব যন্ত্র কেনা হলেও তা থেকে রোগীরা সেবা পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ছুটে যেতে হয় বাইরের প্রাইভেট বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ অনেক বেশি। এসবের পেছনে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ বহু পুরনো। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাঝেমধ্যেই এসব বিষয়ে তদন্ত পর্যবেক্ষণ করা হলেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির দাম সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের কিংবা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ের দায়িত্বশীল মহলের সঠিক ধারণা না থাকায় এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতির সুযোগ থাকে। এসব যন্ত্রপাতি আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের সঙ্গে সরকারি দপ্তরের বিশেষ চক্রের যোগসাজশের ফলে যখন তখন এমন কিছু যন্ত্র কেনা হয়, যা সময়মতো চিকিৎসার কাজে লাগানোও যায় না।
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ'-এর আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকীম লালা কালের কণ্ঠকে বলেন, যন্ত্রপাতি কেনাকাটার নামে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে। এতে চিকিৎসা ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকেন। তিনি জানান, চিকিৎসকদের কমিশন নেওয়ার অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় এখন কমিশন শব্দটি পাল্টে 'রেফারেল ফি' করা হয়েছে। এ 'রেফারেল ফি' পাওয়ার জন্য সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণীর চিকিৎসক রোগীদের বাইরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠানোর কৌশল হিসেবে বলে থাকেন, এখানে পরীক্ষা করিয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে না, মেশিন ভালো নেই। পরে রোগীকে তাঁর সহকারীরা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল পর্যায়ের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্য সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত একটি ব্যবসায়ী চক্র কেবল বাণিজ্যের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। সরকারের তরফ থেকেও রোগীদের স্বার্থের কথা বলে ব্যয়বহুল এসব যন্ত্রপাতি কেনার ব্যবস্থা করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব যন্ত্র পরিচালনার কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোক থাকে না, কিংবা প্রযুক্তিগত নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি রেখেই কোনোমতে এসব যন্ত্র কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়ে টাকা-পয়সা তুলে নেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও তাদের আর নাগাল পায় না। এ ছাড়া কোথাও কোথাও আগের যন্ত্রটি চালু না হওয়ার অজুহাতে আরেকটি নতুন যন্ত্র কেনার প্রবণতাও রয়েছে।
একই সূত্র জানায়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও প্রয়োজনের চেয়ে বেশিসংখ্যক যন্ত্রপাতি কিনে ফেলে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়ম ভঙ্গ করে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের অগোচরেই কেনা হয়ে থাকে একেকটি ব্যয়বহুল যন্ত্র।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন পঞ্চ বার্ষিকী স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ আইটেমের চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কেনার জন্য প্রকল্প প্রস্তাব গত জানুয়ারিতে পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংকের কাছে। এখন ওই প্রকল্পের আওতায় সরঞ্জামাদি কেনা হচ্ছে। এর বেশির ভাগ কেনাকাটার ঠিকাদারি নিয়েই নানা অভিযোগ রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে যেমন কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে বা দুর্নীতি করার সুযোগ ছিল, এখন তেমনটা নেই। বিশেষ করে এখন বেশির ভাগ কেনাকাটার ক্ষেত্রেই দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে পালন করতে হয়। এ ছাড়া কোনো যন্ত্র কেনার আগে এর ব্যবহারবিষয়ক চাহিদা ও কারিগরি দিক নিশ্চিত করার কথা। যদি কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মোমতাজ উদ্দীন ভুঁইয়া এ বিষয়ে বলেন, বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মেডিক্যাল মেশিনারিজ কেনা হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি কেনা হয়ে থাকে সিএমএসডির মাধ্যমে। তবে এর সব কিছু মনিটরিংয়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবহিত থাকে। কোথাও কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের সাবেক হেলথ নিউট্রেশন অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রাম- এইচএনপিএসপি প্রকল্পের আওতায় জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুসারে, ২০০৯ সালে দেশের আটটি প্রতিষ্ঠানে এইডস রোগীর অবস্থা নির্ণয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য 'সিডি-৪ কাউন্টার' মেশিন কেনা হয় প্রায় দেড় কোটি টাকায়। চুক্তি অনুসারে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ মেশিনগুলো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করে তা চালু এবং এর সঙ্গে যুক্ত জনবলের প্রশিক্ষণ-সংরক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ের পরে ২০১০ সালের বিভিন্ন সময়ে মেশিনগুলো স্থাপন করা হলেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি চালু করা যায়নি।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির পরিচালক ডা. আবদুল ওয়াহিদ বলেন, 'আটটি সিডি-৪ কাউন্টার মেশিন কেনা হয়েছিল। তবে এর কয়েকটি এখন পর্যন্ত ব্যবহারের আওতায় আসেনি। এ ছাড়া কোনো কোনো মেশিনের কার্যকারিতা উৎস (সোর্স) মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছিল, আবার উপযুক্ত জনবলেরও সংকট ছিল। এখন আবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো পুরোপরি সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
এর নাম স্বাস্থ্যসেবা?

No comments

Powered by Blogger.