রফিক আজাদ ও তাঁর কবিতা ॥ সাগরজামান by রফিক আজাদ

ষাটের দশকের নন্দিত কবি। স্পন্দিত তারুণ্যে এ দশকের যে ক’জন কবি-যোদ্ধা কবি হিসেবে খ্যাতিমান তাঁদের মধ্যে রফিক আজাদ অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর কবিতায় প্রবহমান। স্বাধীনতার স্বপ্ন যেমন তাকে আন্দোলিত করেছে তেমনি স্বাধীনতা উত্তর সময়ে দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলাদেশের মানুষের হাহাকার তাকে পীড়িত ও সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে।


তিনি তাঁর কবিতার বিপুল উচ্চারণে নিরণœ মানুষের জন্য ভাতের দাবি তুলেছেন বলিষ্ঠভাবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বিনষ্ট হতে দেখে আহত হয়েছেন। তার কবিতাগুলো প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। রফিক আজাদ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দুঃখ দুর্দশা তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। তিনি কবিতার হাতিয়ার দিয়ে স্বদেশের সঙ্কট দূর করতে চেয়েছেন। চিরাচরিত ভাবনার গ-ি থেকে তিনি কবিতাকে বের করে এনেছেন। স্বদেশের চেহারা, ক্ষুধা, প্রেম, নিসর্গ প্রভৃতি বিষয় তাঁর কবিতায় আবর্তিত হয়। বিষয় বৈচিত্র্যে অনন্য রফিক আজাদের কবিতার জগত। গতানুগতিক রীতি পরিহার করে তিনি তাঁর সৃষ্টি কুশলতা দিয়ে কবিতার নতুন অবয়ব উন্মোচন করেন। বিচিত্র প্রতিভার নিদর্শন তাঁর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। উপমা উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প আর শব্দের ব্যবহারে রফিক আজাদের কবিতা কৃষ্ণচূড়া গাছের মতো অগ্নিময় অপরূপ হয়ে ওঠে। কখনও হতাশা প্রকট হয়ে ওঠে। ব্যর্থতায় ভেসে যায় কবিতার শব্দ। কথা রাখতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেন :

একদিন কথা দিয়ে ছিলাম তোমাকে
উপহার দেবো এমন একটি ঘর
যে ঘরের দাওয়ায় বসে পড়বে এমন দৈনিক
যে কাগজে কোনো দুঃসংবাদ ছাপা হবে না কোনোদিনই
এই যুদ্ধ শেষ হলে আর কোনো গুলির শব্দ
তোমাকে শুনতে হবে না কোনো দিনই।

কথা রাখতে না পারার যন্ত্রণা তিনি তাঁর কবিতায় ব্যক্ত করেছেন জাগতিক জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বিজয় এবং পরাজয়ের সব ধরনের অনুভূতির কথা রফিক আজাদ অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে কবিতাবদ্ধ করেছেন। হতাশার পাশাপাশি প্রত্যাশার কথা তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে। সহিংসতা নয় সংঘাতহীন নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন আবিষ্টতায় আক্রান্ত কবি রফিক আজাদ এভাবে কবিতার অপার সমুদ্রজলে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর কবিতায় নানা ধরনের বিষয়ের অভিষেক ঘটে। তিনি প্রেম বন্দনায় ব্রতী হয়েছেন। তাঁর কবিতায় প্রেমের বাণী বৃষ্টির মতো ঝরে পড়েছে। আবার তিনি নস্টালজিয়ায় মগ্ন হয়েছেন। তাঁর স্মৃতি কখনও আনন্দের কখনও বিষাদের হয়ে এসেছে। তাঁর কবিতায় ভাবনার বহুমাত্রিকতা ও বক্তব্যের প্রগাঢ় গভীরগামিতা লক্ষণীয়। রফিক আজাদ একটি স্বতন্ত্র ধারার স্রষ্টা। তিনি কবিতার বচনাশৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। রফিক আজাদ একই সাথে শান্তিবাদী ও যুদ্ধবাজ কবি। তাঁর কবিতায় আগ্রাসন বিরোধী বক্তব্যের সেøাগান যেমন ঘুরে ফিরে ফিরে আসে তেমনি অন্যায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা সশস্ত্র ও প্রতিবাদমুখর। একটি যুদ্ধের মধ্যে উদয়াস্ত কাটছে তবু স্বপ্নতার শান্তিময় আগামীর। এ দিন শেষ হলে আর সন্তানহারা কোন মাকে দেখতে হবে না এক বিন্দু রক্তও আর ঝরবে না বাংলাদেশের মানচিত্রে। মানুষের চোখে মুখে সুখ তৃপ্তি আর আনন্দ ছাড়া কিছুই থাকবে না। এরকম স্বপ্ন রফিক আজাদের কবিতায় উম্মীলিত হয়। আঁধার আসে আলোর আবির্ভাব ঘটাতে তিনি হয়তো এরকম বিশ্বাস নিয়ে লেখেন :

যে রূপে আলোর চেয়ে উত্তাপ অধিক
সেই রূপ খুঁজি না কখনো
আমি চাই শান্ত স্নিগ্ধ ভোর সকালের আলো
স্নিগ্ধতার চেয়ে বড় রূপ খুঁজে কাজ নেই।
রফিক আজাদের কবিতা রকমারি বিষয়, শৈল্পিক তত্ত্ব ও শব্দ যোজনায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

তিনি এমন একটা আলোময় ভোর দেখতে চান যে আলোয় সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিভাস থাকবে। তাপদগ্ধ, খররৌদ্র কোন আলোর উৎসব তাঁর প্রত্যাশিত নয়। লাবণ্যহীন ফর্সা প্রেমিকা তাঁর চাওয়া নয়। তিনি চেয়েছেন জলপাই লাবণ্যময় শ্যামল শরীর। তাঁর পঙ্ক্তিমালা সুনিবিড় স্নিগ্ধতায় প্লাবিত হয়। কোমল আলোয় রফিক আজদের কবিতা অবগাহিত। শিল্পরূপে সমৃদ্ধ। মাইন নামের এক বন্ধুর আত্মহত্যার পর রফিক আজাদ থ্রোয়িং নাইফ ছেড়ে অহঙ্কারের বস্তু কবিতার প্রয়োজনে কলম ধরেন। কলমই কবিদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য অস্ত্র। কলম এবং শব্দ কবিদের শক্তিময় করে। রফিক আজাদ মনে করেন শব্দ বোবা কালা নয়। জড়ভরত নয়। পঙ্ক্তির মধ্যে স্তবকের মধ্যে পুরোপুরি একটি পদ্যের মধ্যে শব্দ নড়েচড়ে বসে। শব্দের এই নড়াচড়া তাঁর কাছে নানাভাবে অর্থময় মনে হয়। রফিক আজাদ ১৩৫০ সালের ১ ফাল্গুন টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, হাতুরীর নীচে জীবন, সশস্ত্র সুন্দর। অপর অরণ্য, করো অশ্রুপাত, ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস প্রভৃতি।
রফিক আজাদ বাবার অনুকরণে থ্রিলার পড়তে পড়তে বঙ্কিমচন্দ্রের কপাল কু-লা পড়ে সাহিত্যে আকৃষ্ট হন। এবং সাড়ে আট বছর বয়সে প্রথম কবিতা রচনা করেন। বসন্তের আগমন বিষয়ক কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন। বসন্ত বিদায় নামের একটি সনেট প্রথম প্রকাশিত হয়। ময়মনসিংহের ‘তকবীরে’ এরপর ‘আগামী’ নামের একটি সাহিত্য কাগজে বাংলা কাব্যের দেহবাদ নামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ রচনা পাঠক মহলের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এরপর থেকে রফিক আজাদের অব্যাহত রচনা সর্বজনবিদিত। তিনি পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেন। তাঁর লেখালেখির সৃজনশীলতা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি ছিলেন দুর্দান্ত সাহসী বেপরোয়া। ছুরি চালনা, লাঠিখেলা, মারামারিতে ছিল তাঁর অসীম দক্ষতা। থ্রোয়িং নাইফে নিপুণ ছিলেন তিনি। কিছু হীরক স্বপ্ন রফিক আজাদের কবিতায় অনির্বাণ প্রজ্বলিত। তাঁর কবিতায় বিশাল স্বপ্নমগ্নতা রূপায়িত। যে সোনালি সম্ভাবনার স্বপ্ন তিনি লালন করেন তা কবিতায় নির্মাণের শ্রেষ্ঠ উপকরণ হয়ে ওঠে। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি সাহসী যোদ্ধা। দিন বদলের দৃঢ় প্রত্যয়ে রফিক পবিত্র স্বপ্নকে কবিতায় বিস্তৃত করেন। অসফল স্বপ্ন তাঁকে অপরাধী করে দেয়। তিনি ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে উচ্চারণ করেন :

দুঃখিত ও অনুতপ্ত আমি করোজোরে ক্ষমা চাই
ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস
ক্ষমা চাই-লতাগুল্মময় বনভূমি, ক্ষমা করো।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ দূষিত করেছি আমি
এই গ্রহ ব্যেপে আছে আমারতো সহদর সব
মানব সন্তান আমি নিজে নিধন করেছি বৃক্ষ
উজাড় করেছি বন, পৃথিবীর প্রিয় ফুসফুস।

রফিক আজাদ স্বপ্নের সীমানায় পৌঁছতে পারেননি পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার জন্য, মানুষের আগ্রাসী রূপ, বর্বরতা, নির্মমতা, অসততা এবং স্বার্থপরতার জন্য সুন্দর সবুজ অরণ্যক শোভার ধারাবাহিক মৃত্যুর জন্য। বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অকপটে অপরাধ স্বীকার করেছেন। এই যে পৃথিবীর দূষণ, হরিণ স্বপ্নের মৃত্যু। তবুও তাঁর সত্তায় সবুজ অরণ্যের রূপ ও লাবণ্যময় স্বপ্ন উদ্ভাসিত হয়। তিনি নতুন স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হয়ে কবিতা রচনা করেন। তাঁর আগমন স্বপ্নে অসংখ্য কবিতা নির্মিত হয়। তিনি স্বপ্ন প্রবণতায় সমর্পিত হন। সাফল্যের সম্ভাবনার দূষণমুক্ত পৃথিবীর সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ঘেরাটোপ থেকে স্বদেশের মানচিত্র মুক্ত করার স্বপ্ন রফিক আজাদের কবিতায় সংযোজিত হয়। স্বদেশের মানচিত্র আর প্রাণের পতাকার প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে বাংলাদেশের সব গৌরব গাথা বুকের গভীরে তিনি লালন করেন। তাঁর লালিত গৌরবদীপ্ত গাথা স্বদেশের মুখ তাঁর কবিতায় উঠে আসে। বৈদেশিক সৌন্দর্যের মধ্যে নয়। প্রিয় মানচিত্রের বর্ণিল ভুবনে রফিক আজাদ তাঁর অস্তিত্বের প্রকাশ করেন নানাভাবে। তিনি বলেন :
ভুল করে অন্ধ গলি-ঘুজি পার হয়ে
যদি এই আঁধার প্রকোষ্ঠে আসো
দেখবে উপুড় হয়ে বাঙলার এই মানচিত্রে
মুখ থুবড়ে পড়ে আছি একুশ বছর
আমার তৃষ্ণার্ত ঠোট ঠেকে আছে পদ্মার ওপর
এবং আমার দু’চোখের অবিরল ধারা বয়ে গিয়ে
কানায় কানায় ভরে যাচ্ছে সব ক’টি শুষ্ক নদী
এবং দেখতে পাবে শ্যামল শস্যের মাঠ
আমার বুকের নিচে আগলে রেখেছি।
রফিক আজাদ স্বপ্নতাড়িত কবি। তিনি স্বপ্নময় কবিতার শব্দ দিয়ে বিজয়ের বিপন্নতা ঠেকাতে প্রয়াসী থেকেছেন। তাঁর অনুগত শব্দমালা আর কবিতার সব মৌল উপাদানে তিনি বিধ্বস্ত বিদীর্ণ, মানচিত্রকে পুনরুদ্ধারে তৎপর। তাঁর লৈখিক শক্তি, সাহসী স্বপ্ন, চেতনাগ্রস্ত দৃঢ়তা তাঁর কবিতাকে সজীব শক্তিময় করে তোলে। সবুজের সংসার ভাঙ্গার প্রক্রিয়াকে তিনি ভেঙ্গে ফেলার স্বপ্ন তাঁর কবিতায় তুলে ধরেন। রফিক আজাদের স্বপ্নের লেলিহান শিখা দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বাংলাদেশের সব সাফল্য এবং অমল অর্জন অম্লান রাখার অঙ্গীকার নিয়ে কবিতার সাথে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.