রিও+২০ : প্রত্যাশা পূরণ হলো নাকাওসার রহমান

সুদীর্ঘ ২০ বছর পর অনেক প্রত্যাশা নিয়েই শুরু হয়েছিল জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সম্মেলন। ক্ষুধামুক্ত একটি ধরিত্রী গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল, সকল দেশ একযোগে সবুজ অর্থনীতির মাধ্যমে এ ধরিত্রীর টেকসই উন্নয়নের অঙ্গীকার করবে; যেখানে একটি মানুষও ক্ষুধামুক্ত থাকবে না।


সেই প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে? পূরণ হলে কতটা পূরণ হয়েছে, নাকি কোন প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি। রিও সম্মেলনপরবর্তী এ প্রশ্নগুলোরই এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বাংলাদেশও এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। তাহলে বাংলাদেশ কি অর্জন করেছে?
প্রথমে বাংলাদেশের বিষয়টি পরিষ্কার করে নিই। এটি ছিল একটি বৈশ্বিক সম্মেলন। এ ধরনের সম্মেলনে এককভাবে কোন দেশের কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই। সমষ্টিগতভাবে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব হয়। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) গ্রুপের সদস্য। কোন কিছু পেলে এই এলডিসি গ্রুপই পাবে। আর তার অংশ হিসাবে বাংলাদেশ কিছু পেতে পারে। তবে এলডিসি গ্রুপ পেলেই যে বাংলাদেশ কিছু পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ বাংলাদেশের স্বার্থ ও অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থ এক নাও হতে পারে।
এবারের সম্মেলনের ব্যাপ্তি ছিল আরও ব্যাপক। বাংলাদেশ ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রুপে। অর্থাৎ এ সম্মেলনে দুটি পক্ষ ছিল। একটি উন্নত বিশ্ব। অন্যপক্ষে ছিল উন্নয়নশীল দেশসমূহ। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ছিল জি-৭৭ ও চীন গ্রুপে। এ গ্রুপে মোট দেশের সংখ্যা আছে ১৩৭টি। এত বিশাল পরিসরে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করা খুবই কঠিন।
দীর্ঘ ২০ বছর আগে রিও সম্মেলনে তথা ধরিত্রী সম্মেলনের যাত্রা শুরু হলেও এ বিশ্বের পরিবেশ সংরক্ষণে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রথম একত্রিত হয়েছিল ৪০ বছর আগে স্টকহোমে। তখনই মূলত এই সবুজ অর্থনীতির ধারণাটি অগ্রসর হতে থাকে। ৪০ বছর আগের কথা বাদ দিলেও ১৯৯২ সালে এই রিওডি জেনিরো শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন থেকে এই ২০ বছরে বিশ্বে টেকসই উন্নয়নের কি কোন অগ্রগতি হয়েছে? এক কথায় না বলাটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ এই ২০ বছরে পৃথিবীতে তখনকার চেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় এক শ’ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। আর আরও এক শ’ কোটি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে না। অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের কারণে এ ধরণী ক্রমেই উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, বিষয়গুলো নিরসনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি এবারের সম্মেলনে। টেকসই উন্নয়নের জন্য সবুজ অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো কিভাবে তাদের অর্থনীতিকে সবুজ অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করবে সে ব্যাপারে কোন সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতা করবে। কিন্তু উন্নয়ন উপযোগী পরিবেশ অর্থাৎ সবুজ অর্থনীতি গড়তে হলে যে অর্থ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে সে ব্যাপারে তারা কোন কথা বলেনি। ফলে প্রযুক্তি ও অর্থ সহায়তা না পেলে কোনভাবেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে ব্যয়বহুল সবুজ অর্থনীতিতে রূপান্তর সম্ভব হবে না। আর অর্থ দিলেও হবে না, সেই অর্থ হতে হবে শর্তহীন।
মূলত ২০ জুন তিন দিনের এ সম্মেলন শুরু হলেও, সম্মেলনের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে ১৯ জুন কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকের শেষ দিনে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে টানা তিন দিনের দরকষাকষিতে অগ্রগতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ১৮ জুন আয়োজক দেশ হস্তক্ষেপ করে। সম্মেলনকে যে কোন উপায়ে সফল করার জন্য তাদের হস্তক্ষেপে ১৯ জুন একটি খসড়া ঘোষণা (টেক্সট) চূড়ান্ত করা হয়। যা কোনরূপ কাটছাঁট ছাড়ই শেষ দিন সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত হয়।
সকলের প্রত্যাশা পূরণ না হলেও সমাপনী অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবেই গৃহীত হয়েছে সম্মেলনের ঘোষণা ‘দ্যা ফিউচার উই ওয়ান্ট’। এতে টেকসই উন্নয়নের মৌলিক নীতিগুলোকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলো প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতি নবায়ন করেছে। আর সেই সঙ্গে দেয়া হয়েছে টেকসই উন্নয়নের নতুন দিক নির্দেশনা। তবে টেকসই উন্নয়নের জন্য যে সবুজ অর্থনীতি গড়তে হবে, সেই অর্থনীতি গড়তে উন্নত দেশগুলো নতুন কোন অর্থায়ন এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি প্রদানের কোন প্রতিশ্রুতি প্রদান করেনি। অথচ স্বল্পোন্নত তথা গরিব দেশগুলোর এটাই মূল দাবি ছিল। তবে টেকসই উন্নয়নের প্রযুক্তি ও অর্থায়নের বিষয়টি ছেড়ে দেয়া হয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের হাতে।
জাতিসংঘের এমডিজির লক্ষ্য অর্জনের মেয়াদ হচ্ছে ২০১৫ সাল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এমডিজির অনেক লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু অনেক দেশই এর লক্ষ্য থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এবারের ধরিত্রী সম্মেলনে ২০১৫ সালে এমডিজি শেষ হওয়ার পর সেখানে এসডিজি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্মেলনের খসড়া চুক্তিতে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে এনজিওরাও বেশ অসন্তুষ্ট। তারা চেয়েছিল, চলমান ধরিত্রী সম্মেলনেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক। ইউরোপীয় ইউনিয়নও চেয়েছিল ধরিত্রী সম্মেলনের চুক্তিতেই এসডিজিকে অন্তর্ভুক্ত করতে। তবে এসডিজির ব্যাপারে বাংলাদেশসহ জি-৭৭ গ্রুপের অভিমত হলো-উন্নত দেশগুলো অর্থায়ন করলেই কেবল উন্নয়নশীল দেশগুলো এটা বাস্তবায়ন করবে। ভারত অবশ্য এসডিজি বাধ্যতামূলন না হওয়ায় খুশি। তারাও মনে করে, উন্নত দেশ থেকে অর্থ প্রাপ্তির ভিত্তিতেই এটা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
এ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশসমূহের চাহিদা পূরণ হয়নি। সম্মেলনে ঘোষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ইস্যু ভালভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বরং ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশগুলোর চাহিদা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বাস্তবায়নের বিষয়ে যে প্রত্যাশা ছিল সেটাও প্রতিফলিত হয়নি ঘোষণায়। তবে তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
ট্রান্সবাউন্ডারি নদীর পানি বন্টনের ইস্যুটিও শেষ পর্যন্ত ঠাঁই পায়নি ঘোষণায়। এটা নিয়ে বাংলাদেশ, সুইজারল্যা-সহ বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষোভ রয়েছে। তবে ইতিবাচক বিষয় হলো উন্নত দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের দশমিক সাত শতাংশ অর্থ প্রদানের বিষয়ে পুনরায় অঙ্গীকার করেছে।
ফলে সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা তথা টেক্সট অনুমোদন করে দিলেও, অনেক দেশই তাদের এ ব্যাপারে তাদের ‘রিজার্ভেশনের’ কথা তুলে ধরেছে। তারা বলেছেন, সর্বসম্মতভাবে সম্মেলনের ঘোষণা গৃহীত হলেও এটা অনেক দেশের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। রিওতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে একটি সুযোগ এসেছিল। সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ সব আপত্তির প্রসঙ্গে জাতিসংঘের তরফ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন দেশ যে সকল আপত্তির কথা তুলেছে সেগুলো সম্মেলনের ঘোষণায় প্রতিফলিত হবে।
দীর্ঘ ২০ বছর পর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও বিশ্ব রিও+২০ সম্মেলন থেকে নতুন কিছু পায়নি। পুরনো বিষয়গুলোই ঘুরেফিরে প্রতিশ্রুতি আকারে এসেছে। এ কারণে এনজিওরা ‘এই সম্মেলনকে নেতৃত্বের ব্যর্থতা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। গত ২০ বছরে বিশ্বে ক্ষুধা বেড়েছে, দারিদ্র্য বেড়েছে, বেড়েছে বৈষম্য ও বৈশ্বিক উষ্ণতা। বিশ্ব একটি ঝুঁকিপূর্ণ গোলার্ধে পরিণত হয়েছে। এটা হয়েছে মূলত উন্নত দেশগুলোর অটেকসই উন্নয়নের কারণে। কিন্তু সেই ঝুঁকি নিরসনে উন্নত দেশগুলো অনেকটাই নির্বিকার থেকেছে। শুধু কথার ফুলঝুরি ছাড়া এ সম্মেলন থেকে আর তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। ফলে এবারের ধরিত্রী সম্মেলনকে ‘পর্বতের মূসিক প্রসব’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
তবে জাতিসংঘপ্রধান বান কি মুন এ সম্মেলন নিয়ে হতাশ হতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘এ সম্মেলনে আমাদের অনেক অর্জন হয়েছে। তবে আমাদের এখনও অনেক দূর যেতে হবে। সে যাত্রাপথে আমরা রিও থেকে একটি প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। আমাদের কথা বলার সময় শেষ, এখন কাজের সময় শুরু’।
সংস্থার এ্যাসিসটেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি শাহ জুকাং বলেন, এ ধরিত্রীর মানব জাতির ভবিষ্যতের একমাত্র উপায় হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। রিও’র প্রতিশ্রুতি আমাদের সঙ্গে আছে। সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা টেকসই ভবিষ্যত গড়ার পথে নতুন যাত্রা শুরু করব।
এবারের সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতো হাইপ্রোফাই রাষ্ট্রনায়করা যোগ না দিলেও বিশ্বের ১৯৩টি দেশের এক শ’রও বেশি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এ সম্মেলনে এসেছেন। সেই সঙ্গে সরকারী, বেসরকারী, এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মিলিয়ে ৪০ হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি যোগ দিয়েছে। এছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বের আরও প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এ সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বড় আশা ছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে যোগ দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যোগ দেননি। তিনি যোগ দিলে তার দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতায় এ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইমেজ আরও বৃদ্ধি পেত। তবে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এ সম্মেলনে অংশ নিয়ে খুব খারাপ করেনি। বাংলাদেশ তার স্বভাবসুলভ বলিষ্ঠ ভূমিকাই রেখেছে।
আটলান্টিকের তীরবর্তী পাহাড়ঘেরা এই রিও নগরীতে ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকার, ব্যবসায়ী, শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সাত শতাধিক প্রতিশ্রুতি এসেছে। টেকসই জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও সমুদ্র ব্যবস্থাপনার জন্য ৫১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এ সম্মেলন থেকে প্রমাণিত হয়েছে, সরকারগুলোর বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা থেকে শুরু করে যুব সমাজ ভবিষ্যত প্রজন্ম -সকলেই এ ধরিত্রীর পরিবর্তন চায়।
ব-সধরষ: শধংিবৎথৎধযসধহ@ুধযড়ড়.পড়স

No comments

Powered by Blogger.