জীবনের সন্ধিক্ষণে by বেলাল চৌধুরী

আমাদের জীবনে এমন একটি সময় আসে, যখন নিজের কাছেই নিজেকে অজানা মনে হয়। সব কিছু কেমন রহস্যময় লাগে। ভয়, বিহ্বলতা, বিমূঢ়তা ঘিরে ধরে। চারপাশের মানুষ ও বোঝাপড়াগুলোর সাথে নিজের অন্তর্গত এক যুদ্ধে লিপ্ত হয় মন। জয়-পরাজয় নিয়ে শঙ্কা আর নিজেরই অন্তরালে, জীবনে প্রথম ব্যক্তিত্বের উন্মেষে ভাবিত হয় ভেতর জগৎ।


জীবনের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পেঁৗছার, এ যেন এক অনিবার্য স্টেশন_ বয়ঃসন্ধিকাল। জীবনের এ স্টেশনে ট্রেন আসে জীবন ও প্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী নিয়মে। তবু সে ট্রেনে উঠে পড়তে মনে জাগে নানা দ্বিধা, কত সংশয়। উঠবো কি উঠবো না কিংবা কোথায় যাবো, কী করবো? এমন হাজারো প্রশ্নের জাল বুনে যায় মন।
তবে কৌতূহলেরও তো কমতি থাকে না!
এ সময়ে সবারই, নিজের ভেতরের পরিবর্তনে চারপাশের পরিবর্তনকে মেনে নিতে হয়তো ভয় লাগে। কিন্তু জীবনের এ সময়টাতে আমার দিনগুলো কেটেছে, মাতৃহীন এক একলা একলা জগতে। সেখানে অনেকেই ছিল তবু কখনও কখনও মনে হতো যেন কেউ নেই। স্নেহ নেই, মমতা নেই। আছে এক উন্মুক্ত আড়ালসম বাহির জগৎ।
তবে সে জীবনে ভয়-সংশয়ের উপস্থিতি ছিল না কিংবা এসব ভাবার সময়ই ছিল না আমার। আমি শুধু ঘুরে বেড়াতাম নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়।
এলোমেলো একলা স্বাধীন।

'চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভিতরে আসি
কে আমাকে নুইয়ে দেয় মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

পানা পুকুরের পাড়ে জলের আয়না আছে, মুখ ধুই
আমি কাকে নুইয়ে দিই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

নাসারল্প্রেব্দ নিমের ফুলের ঘ্রাণ, খয়েরী দুপুরে আমি
আলোর আঁধারে কেন ভেসে যাই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

আমার সুন্দর হতে ভালোই লাগে না; আমি ভয় পাই!

আমার শরীরে এই অসহবিসহ আলো, বিচ্ছুরণ তেলেসমাতির খেল
আমার শরীরে এই সোনালি ত্বকের ছটা বুক জোড়া উঁচু শিহরণ!

কোথায় লুকাবো মা? ভয় লাগে, আমার ভীষণ ভয় লাগে!'

বয়ঃসন্ধি : আবুল হাসান

২.
শৈশবেই মাকে ছেড়ে আমাকে দ্বীপান্তরে যেতে হয়েছিল। বখে যাচ্ছি_ এমন সন্দেহে মা আমাকে সুদূর সন্দ্বীপে পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
ঘটনাটা ছিল এমন_ আমাদের গ্রামের স্কুলে আমার কাকা সম্পর্কের একজন ছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসার ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকতেন। আর তার বদলে আমাকে উপঢৌকন হিসেবে দিতেন ডোরা কাটা মার্বেলের মতো এক ধরনের লজেন্স; যাতে আমি কাউকে না বলি। আমি কাকার হাত ধরে লজেন্স চুষতে চুষতে হাঁটি আর কাকা বিড়ি ফোঁকেন। একদিন বাড়িতে ঘরের কোণে বিড়ি টানছেন; সে সময় হুজুর এসে ঢুকলেন। হুজুর এ রকম হঠাৎ করে পড়াতে চলে আসায় কাকা দিশেহারা হয়ে বিড়িটা ফেলে না দিয়ে, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পড়তে চলে গেলেন। আমি তো এবার ভীষণ মজা পেয়ে কৌতুহলবশত বিড়িতে টান দিয়ে বসলাম আর সে কী কাশি। কিন্তু ঝামেলা হয়েছে কিছু না বুঝে আগুন নিভিয়ে সে বিড়িটা জামার পকেটে রেখে দেওয়ায়। পরদিন জামা ধুতে গিয়ে সেই আধখানা সিগারেট পেয়ে গেলেন মা। কিন্তু এ ঘটনায় মা আর আমাকে কিচ্ছু বললেন না। ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে। সে সময়ে বাড়িতে বেড়াতে এলেন আমার পিসি মা আর পিসেমশাই। পিসি থাকতেন সুদূর সন্দীপ। তাদের সাথে পরামর্শ করে, মা শেষমেশ পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন সন্দ্বীপ। এর কারণ_ পিসেমশাই ছিলেন তখনকার এন্ট্রান্স পাস। শিক্ষা-দীক্ষা আর জ্ঞানেও ছিলেন অতুলনীয়। তার তত্ত্বাবধানে আমার পড়ালেখা তথা ভবিষ্যৎ জীবন যদি সুগম হয়!
অপরাধ না করেও বখে যাওয়ার দায়ে সেই শৈশবেই পিসিমার সঙ্গে আমি সন্দ্বীপের পথে পাড়ি জমালাম।
সন্দ্বীপের কারগিল হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। আজ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে ঘুরেও কারগিল হাই স্কুলের মতো সুন্দর স্কুল আমি পাইনি। এ স্কুলের দেবতুল্য শিক্ষক, সন্দ্বীপের তখনকার অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ আর পিসেমশাইয়ের মমতায় মাতৃস্নেহের অভাবটা ভুলেই গিয়েছিলাম। যদিও আমার পিসি আমার ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন। বেশ কয়েকবার সন্তান মারা গিয়ে একটা ছেলে, একটা মেয়ে ছিল তার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন।
আড়াই বছর পর পিসেমশাই বদলি হয়ে যাওয়ায় আমরা চলে এলাম কুমিল্লায়। আমার বয়স তখন ১২ কী ১৩। দস্যি স্বভাবের উৎসুক বালক হওয়ায় কোনো পরিবর্তনই আমাকে পীড়া দেয়নি তেমন। আর সন্দ্বীপের সুন্দর জীবনের তুলনায় কুমিল্লার শিল্প-সংস্কৃতির জমজমাট জগৎটাও কম ছিল না। কুমিল্লায় এসেই প্রথম লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া শুরু হলো। স্কুল, বন্ধু-বান্ধব, সিনেমা হল, টাউন হল_ সবকিছু মিলিয়ে ভাবনার চেয়ে সময়টাই চলত দ্রুত গতিতে। বয়ঃসন্ধিকালের সেসব দোলাচলে দুলে ওঠার ফুরসত পাইনি আমরা। কিন্তু সেই দ্বিধাহীন দুরন্ত দিন বেশি দিন থাকল না। যখন পিসেমশাই মারা গেলেন, পারিবারিকভাবে কেমন একটা দূরত্ব রচিত হলো। আমার মন তখন বিষিয়ে উঠতে থাকল। আমি এই সময়েই প্রথম বাড়ি থেকে পালাতে শুরু করলাম। বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করে না। বাঙালি ঘরানার আর দশটা কিশোরের মতো একটা অভিমান বুকে বাসা বাঁধতে শুরু করল। যে অভিমানের কোনো হদিস আসলে পাওয়া যায় না। কেন, কার বিরুদ্ধে, কিসের এ অভিমান_ জানা নেই।
এ সময়ে প্রায়ই কাউকে কিছু না বলে আমি ঢাকা চলে আসতাম, এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু কেমন এক অভিমানে বাড়িতে মায়ের কাছে যেতাম না। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পথে কৈশোরকালীন অবশ্যম্ভাবী অস্থিরতা আমাকে উড়নচণ্ডী করে তুলেছিল। এভাবে পিসির বাড়িতে নানা ধরনের বৈষম্য, মাতৃস্নেহহীনতা আমাকে বাইরের জগতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ক্রমেই ঘরবিমুখ হয়ে গেলাম। পড়াশোনা থেকেও মন উঠে যেতে থাকল। তবে বই পড়তাম। কিন্তু মনটা কেবলই মমতা খুঁজে বেড়ায়। তখন কুমিল্লায় অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল; তাদের সঙ্গে এ বাড়ি ও বাড়ি যেতাম। এমন অনেকেই ছিল যাদের কাছে থাকতে ভালো লাগত। তাদের কাছে যেতাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশার একপর্যায়ে কখন জানি কমিউনিস্ট পার্টি কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। এ জন্য জেলেও যেতে হয়েছে। থাকতে হয়েছিল প্রথমে নোয়াখালী জেলখানায়, পরে ঢাকা থেকে ছাড়া পাই।
বয়ঃসন্ধিকালের অর্থাৎ শৈশবের এমন উড়নচণ্ডী জীবনই এক সময় ধাওয়া করতে করতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কলকাতার দিকে। সেখানে যৌবনের অন্য এক জীবন। সে দিকে আজ না যাওয়াই শ্রেয়। কারণ আজ লিখছি জীবনের বিচলিত এক সন্ধিক্ষণের অস্থির বৃত্তান্ত।
বয়ঃসন্ধিকাল। জীবন বিকাশের পথে অন্যদের পৃথিবীতে নিজেকে স্বয়ং নিজেই আবিষ্কার করে নেওয়ার কাল। বয়সের ব্যবধানে, এ তো শুধু পরিবর্তনের ইশারায় মনোজাগতিক হাতছানি নয়_ এ তো জীবনেরই এক সন্ধিক্ষণ। যে সন্ধিক্ষণে সবাই হয়ে ওঠে নিজের মধ্যে একা। আপন মনোদৈহিক ওলটপালটের শব্দে তখন নিজেই এক নিঃসঙ্গ শ্রোতা হয়ে শুনতে হয় নিজেরই গান। ঝামেলা বাধে এখানেই। বাইরের জগতের সঙ্গে আপন পৃথিবীর বোঝাপড়ার এক সংকটে বিমূঢ় হয়ে থাকে মন। সেই সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তনের কোনো এক রহস্যময় পালক পরশ বুলিয়ে যায় দ্বিধার দেয়ালজুড়ে। কেবলই পরাজয়ের ভয় তটস্থ করে রাখতে চায় দিন-রাত। তবু নিজের জন্যই জেগে উঠতে হয় ভয়কে ডিঙিয়ে, জীবনের এই সন্ধিক্ষণে। হ
 

No comments

Powered by Blogger.