সা ক্ষা ৎ কা র-আত্মজীবনী লেখার সাহস হয় না
আল মাহমুদ বাংলা ভাষার সেরা কবিদের একজন। ১১ জুলাই ছিল তাঁর ৭৭তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে কবির মুখোমুখি হয়েছিলেন মাসউদ আহমাদ ও আবিদ আজম প্রশ্ন: মানুষ তো অসম্ভব স্মৃতিধর। ৯০ বছর বয়সের মানুষও তাঁর প্রথম জীবনের কথা হুবহু মনে করতে পারেন।
১১ জুলাই আপনার জন্মদিন। জীবনের এই গোধূলি সন্ধ্যায় এসে আপনার অনুভূতি কেমন?
আল মাহমুদ: এখন তো আবেগ তেমন নেই। অতীত স্মৃতি-বিস্মৃতি—এসব আছে। অনেক পরিচিত মানুষের মুখ মনে পড়ে। জন্মদিনে মানুষ আসে, শুভেচ্ছা জানায়। আমার ভালোই লাগে। একটা ব্যাপার মনে হয়, আমি যে সাহিত্যের চর্চা করেছি, এত দূর এসেছি, আল্লাহর অশেষ করুণা। মানুষ আমাকে ভালোবাসে। ভালো লাগে। অনেকে এই ভেবে বিস্মিত যে আমি এখনো বেঁচে আছি।
প্রশ্ন: গোটা জীবন তো আপনি কবিতা নিয়েই কাটিয়ে দিলেন, এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
আল মাহমুদ: এটা খুব স্বাভাবিক কারণেই হয়েছে। কারণ, আমি তো কবিতাই লিখি। কবিতা নিয়ে চিন্তা করতাম, কবিতা ভাবতাম। আমার সমস্ত অনুরাগ জড়িয়েছিল কবিতার পেছনে। কবিতা আমাকে খ্যাতি দিয়েছে। সম্মান দিয়েছে। আর কী দেবে? কবিতা অর্থবিত্ত সেভাবে দেয় না হয়তো, কিন্তু আমি যা পেয়েছি, তা অনেক বেশি পেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি একসময় বলেছিলেন কবিরা পরাজিত হয় না।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, এটার ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। কবিরা তো প্রকৃতপক্ষে কখনো হার মানে না। যত দিন সে বেঁচে থাকে, তত দিন সে লিখতে চায়। লেখেও। তার সঙ্গী-সাথিরা হয়তো ঝরে যায়। মরে যায়। এই পরাজিত না হওয়াটা কেবল জীবনের কাছেই নয়, সব ব্যাপারেই।
প্রশ্ন: আপনি গ্রামের ছেলে, মোড়াইল নামের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে কবি হতে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন; তারপর আপনার খ্যাতি, সুনাম ও সৃজনশীল প্রজ্ঞার অলৌকিক ঐশ্বর্য বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল। এই মাধুরী-সৌভাগ্যকে কীভাবে দেখেন?
আল মাহমুদ: মোড়াইলটা একেবারে গাঁ নয়, আধা গ্রাম, আধা শহর বলতে পারো। আমি কবি হওয়ার জন্য সাধনা করেছিলাম। এক হিসেবে বলা যায়, আমি জেনেশুনেই এই জগতে এসেছিলাম। এটা এ কারণে যে আমি কী করতে পারব আর কী পারব না, সেসব আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। এবং আমি যা করতে পারব না ভেবেছিলাম, সেটাও আমি করে ফেলেছি। আর সেটা হচ্ছে সাহিত্য—সাহিত্যের জন্য খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ। একটা পরিচিতি বলতে যা বোঝায়, সেটা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হয়েছে আমার। এটাকে আমার খুব বড় পাওয়া মনে হয়। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে?
প্রশ্ন: কবি না হলে অন্য কী হতেন?
আল মাহমুদ: কবি না হলে আমি হয়তো কিছুই হতাম না। কবি হওয়ার কারণে একবার আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। ওই ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে। ভাবি ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও নিশ্চয়ই এখনো বেঁচেবর্তে আছে এই সংসারে।
প্রশ্ন: পরে স্ত্রী হিসেবে যাঁকে পেলেন, দীর্ঘ একটা জীবন কেটেছে তাঁর সঙ্গে...।
আল মাহমুদ: আমার স্ত্রীর কথা আমার মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। আমার জীবনে, আমার অগোছালো কবিজীবনকে দারুণভাবে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। একধরনের পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছিলাম। আমার তেমন কোনো অতৃপ্তি ছিল না।
প্রশ্ন: এখন আপনি একধরনের নিঃসঙ্গই...কোনো অতৃপ্তি বা বেদনা কাজ করে?
আল মাহমুদ: আমি হয়তো মনের দিক থেকে একা। সারা দিন আমার কাছে নানাজন ছুটে আসে। শরীর ভালো থাকলে একটা-দুটো অনুষ্ঠানে যাই। তবে এখন আমার জীবনে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। আর অতৃপ্তি কিছু তো আছেই। মানুষের অনেক কিছু চাওয়ার থাকে, মানুষ প্রতিনিয়তই চায়; মনে মনে চায়। না পেলে চুপ করে থাকে। আমিও সেই—যাকে বলে না-পাওয়ার বেদনাটা চুপ করে কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আর এসব নিয়ে তেমন ভাবি না।
প্রশ্ন: কবি পরিচয়কে সামনে রেখেও গল্প-উপন্যাস এবং অন্যান্য রচনায়ও আপনি বিপুল শক্তিমান। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে আত্মজীবনী লেখার কথা মনে হয়নি, কবি হিসেবে আপনার জীবন তো কম বর্ণাঢ্য নয়?
আল মাহমুদ: সাহিত্যের সব শাখাতেই লিখতে চেষ্টা করেছি, লিখেছি। আত্মজীবনী লেখার কথা মনে আসে, কিন্তু সাহস হয় না। এত খুঁটিনাটি লিখতে হবে, লিখেও হয়তো শেষ করতে পারব না। এমন একটা ভয়ও আছে। আমি তো গদ্য-পদ্য পাশাপাশি লিখে গেছি। সবাই বলত, আমার গদ্যও ভালো। আমার একটা গল্পের বই আছে—পানকৌড়ির রক্ত; এটা লিখতে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। এবং গদ্যটা বেশ ভালোই লিখেছিলাম। আমার অন্যান্য গদ্যের তুলনায় আমি মনে করি সেটি অতুলনীয় ছিল।
প্রশ্ন: আপনার গল্প নিয়ে কলকাতা থেকে সিনেমা এবং নাটক হচ্ছে, জানেন?
আল মাহমুদ: কলকাতা থেকে আমার ‘জলবেশ্যা’ গল্প নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। সম্ভবত এতদিনে শেষও হয়ে গেছে। একটা ফুললেন্থ সিনেমা। হ্যাঁ, আমার গল্প নিয়ে অনেকগুলো নাটকও হয়েছে। ওই আর কি। নতুন কিছু হলে ভালো লাগে।
প্রশ্ন: আপনি তো এখন ডিকটেশন দিয়ে লেখান। কাজেই এমন কি হয় না যে আপনার লেখার খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু কাউকে দিয়ে যে লেখাবেন সেরকম কেউ নেই কাছে?
আল মাহমুদ: সাধারণত এমন হয় না। আমি যখন লিখতে চাই, লেখার মানুষও পেয়ে যাই। তবে কোনো কোনো সময় যায় ঘুম আর জাগরণের মধ্যে, তখন কিছু মাথায় এলেও তা আর লেখা সম্ভব হয় না। জেগে ওঠে মনে করতে পারি না।
প্রশ্ন: আপনি বলেন—কবি হতে গেলে গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করতে হয়, আপনি নিজে তা করেছেনও; কিন্তু শুধু কবিতা নিয়েও থাকেন নি গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন?
আল মাহমুদ: গদ্য লেখাতেও যেহেতু আমার উৎসাহ ছিল, হাতও ছিল ভালো, তাই লিখে গেছি আর কি। আমার মনে হয় খুব খারাপ লিখিনি। কবিরা ভালো গদ্য লিখতে পারে, আমি বোধ হয় তার প্রমাণ কিছুটা দিতে পেরেছি।
তবে এই পেরে ওঠাটা একটা বড় ব্যাপার। আমার উপমহাদেশ বা কাবিলের বোন—এসব আমার একধরনের সার্থক রচনা আমি মনে করি।
উপমহাদেশ লেখা হয়েছে আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি আলাদা বই লেখার ইচ্ছা ছিল, এখনও আছে, জানি না কতটুকু পারব।
প্রশ্ন: কবিতার সঙ্গে সারা জীবন বসত করে গেছেন, আপনার নিজের বিবেচনায় কবিতা আসলে কী?
আল মাহমুদ: কবিতা হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতরে কিছুটা পরিভ্রমণ। বাস্তবতার সঙ্গে এই স্বপ্নের সম্পর্কটা হতে পারে—বাস্তবতায় পা রেখে স্বপ্নের ভেতর উড়াল দেওয়ার মতো। কবির প্রকৃত কাজ হলো মানুষকে, তাঁর জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। এটা আমি সব সময় বলেও এসেছি। আমি এই স্বপ্নটা দেখাতে চেষ্টা করেছি। এখনকার কবিরা এ কাজটি করতে পারছে কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
প্রশ্ন: একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, এখনকার কবিরা কোথায়? এই অভিব্যক্তির তাৎপর্যটা একটু খুলে বলবেন?
আল মাহমুদ: কথাটা বলেছি—কারণ কবিদের কোলাহল তো শুনি না। নিশ্চয়ই তাঁরা আছেন। কিন্তু আগে যেমন আমি আজিজ মার্কেটে ঘুরে কিংবা নানা জায়গা থেকে কবিতার বই সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম, লিটল ম্যাগাজিন পড়তাম, এখন তো সেসব পারি না। আমার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষ। আমি চোখেও দেখি না। যাইও না কোথাও। একসময় আমরা বন্ধুরা, যেমন—শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিয়েছি, দাপিয়ে বেড়িয়েছি গোটা শহরটায়। তখন আমাদের শোরগোলটা কিন্তু ছিল চারদিকে। এখন কি কবিদের সেরকম সদর্প পদচারণা আছে! বুঝতে পারি না।
প্রশ্ন: বাংলা ছোটগল্প অনেক দূর এগিয়েছে। তবু এখনো, রবীন্দ্রনাথের ছোটপ্রাণ ছোট ব্যথাকে গল্পের পরিচয় নির্ণয়ে সামনে আনা হয়। আপনি, কবি আবার গল্পকার আল মাহমুদও কম শক্তিশালী নয়; ওই সংজ্ঞা আজও কতটুকু প্রাসঙ্গিক মনে করেন?
আল মাহমুদ: (মৃদু হেসে) না, আমি কবি হিসেবেই কাজ করেছি। গল্পকার হিসেবে যারা বড় করে দেখে আমাকে, তারা ভালোবেসে বলে। তবে রবীন্দ্রনাথের সেই কথাকে এখন আর আমি মানি না। তিনি ছোটগল্পের যে ফর্মের কথা বলেছেন, এটা তো মানা যায় না। এটা এখন আমাদের ওপর চাপানো উচিত না। উনি আমার প্রিয় লেখক, তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রাচুর্য আছে। নজরুলও আমার প্রিয়। বাংলা ভাষার জন্য অত্যন্ত দরকারি ছিল কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। এটা আমি অনুভব করি। তাঁর একটা কবিতা আছে—‘বল বীর, বল উন্নত মম শির...’; কবিতাটির সমতুল্য কবিতা ওই সময়ে বা পরেও দেখা যায় না। এসব একবারই হয়। বাংলা সাহিত্যে এটা অসাধারণ সৃষ্টি।
প্রশ্ন: কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতখানি?
আল মাহমুদ: আরে, ছন্দ ছাড়া কি কবিতা হয়? আমি তো লিরিকের মানুষ। গীতিপ্রবণতা আমার স্বভাবগত। আমি আসলে ছন্দে আছি, গন্ধেও আছি।
প্রশ্ন: কবির জীবন কি হবে শুধু উদাসীন, ছন্নছাড়া আর পাগলটে?
আল মাহমুদ: কবিদের জীবনযাপন পাগলের মতো কেন হবে? তারা তো পাগল না। হ্যাঁ, বড়জোর বলতে পারো—উদাসীন। উদাসীনতা কবিদের স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। এটাকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। কবিতার কারণে জীবন সফল হয় না, তা নয়। আমি একবার বলেছিলাম, যারা সাহিত্যচর্চা করে, আমি তো দেখি না কেউ খালি হাতে ফিরেছে। একটা প্রাপ্তি নিশ্চয়ই আছে।
প্রশ্ন: সোনালি কাবিনে আপনি বলেছেন—পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা। আবার আপনার একটা বইয়ের নাম—সৌরভের কাছে পরাজিত!
আল মাহমুদ: সৌরভের কাছে পরাজিত বইটি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। না হলে তো গোলমাল হয়ে যায়। আগেই বলেছি, পরাজিত হয় না কবিরা। আমার সব সময় তা-ই মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমি পরাজিত নই। আই অ্যাম নট ডিফিটেড। সত্য-সুন্দর ও কল্যাণের পথেই তো কবিরা হাঁটেন।
প্রশ্ন: কবিতায় গল্প-উপন্যাসে আপনি প্রেমের নানা রকম চিত্রায়ণ করেছেন। প্রেম বা ভালোবাসাটা কী ব্যাখা করতে পারেন?
আল মাহমুদ: ভালোবাসা কী—এটা তো আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। এটুকু বুঝি ভালোবাসা একটা অবস্থা। যখন মানুষ কাউকে ভালোবাসে, তখন সেই ভালোবাসার মধ্যেই জিনিসটা উপলব্ধি করা যায়।
প্রশ্ন: কবিরা তো ভালোবাসা ভাঙিয়েই খান, এটাই তাঁদের মূল শক্তি। এটা কতখানি সত্য?
আল মাহমুদ: একটা কবিতা আছে—‘গাছ তোলে বুক ফুল তোলে বুক, সন্ধ্যা ভোরের আলোর বীণায়; সবাই মিলে গান ধরেছে, প্রেমের মতো আর কিছু নয়।’ এটা আমার মনে হয়। ভালোবাসার অপর নাম। জীবনে, এখন কবিতাই আমার একমাত্র ভালোবাসা।
প্রশ্ন: আপনি এখনো তো প্রেমের কবিতা লিখছেন। এই বয়সে আপনার কি প্রেমে পড়তে বা ভালোবাসতে ইচ্ছে করে?
আল মাহমুদ: এটা তো ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, অবস্থার ওপর হয়ে থাকে (স্বতঃস্ফূর্ত দীর্ঘ হাসি)...। এটা আসলে অনুভবের বিষয়। কেউ কেউ এখনো এসে বলে, ‘আপনাকে ভালোবাসি।’ কী আশ্চর্যের বিষয়!
প্রশ্ন: সাহিত্যে—কবিতা বা গল্পে নিরীক্ষার যে প্রয়াস, এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আল মাহমুদ: নিরীক্ষা-ফিরিক্ষা কী আবার? নিরীক্ষার ধার ধারি না আমি। সাহিত্য হচ্ছে চর্চার বিষয়। চর্চা করে যারা, তারা এর স্বাদ গ্রহণ করে। ভেতরে কী আছে, সেটা তারা উপলব্ধি করে। আর কবিতার জন্য পুরো জীবন কাজ করে যেতে হয়।
আমি মনে করি সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জন্য। সাহিত্য ব্যক্তিজীবনের জন্য স্বপ্ন। আমি সব সময় জীবন, মানুষ ও স্বদেশকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আমি কল্যাণ চাই। চাই সুন্দর-স্বপ্নময় স্বদেশ। আমার লেখা পড়লেও সেটাই বোঝা যাবে।
প্রশ্ন: আপনার অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষ কেবল সোনালি কাবিন-এর কথাই বলে। এটাকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন?
আল মাহমুদ: এটা তো হতেই পারে। এটার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল।
প্রশ্ন: কিছু লিখছেন? সময় কাটে কীভাবে?
আল মাহমুদ: এই তো, ঘরে বসে থাকি। বাইরে তেমন যাই না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকি। শুয়ে থাকি। এই তো।
আল মাহমুদ: এখন তো আবেগ তেমন নেই। অতীত স্মৃতি-বিস্মৃতি—এসব আছে। অনেক পরিচিত মানুষের মুখ মনে পড়ে। জন্মদিনে মানুষ আসে, শুভেচ্ছা জানায়। আমার ভালোই লাগে। একটা ব্যাপার মনে হয়, আমি যে সাহিত্যের চর্চা করেছি, এত দূর এসেছি, আল্লাহর অশেষ করুণা। মানুষ আমাকে ভালোবাসে। ভালো লাগে। অনেকে এই ভেবে বিস্মিত যে আমি এখনো বেঁচে আছি।
প্রশ্ন: গোটা জীবন তো আপনি কবিতা নিয়েই কাটিয়ে দিলেন, এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
আল মাহমুদ: এটা খুব স্বাভাবিক কারণেই হয়েছে। কারণ, আমি তো কবিতাই লিখি। কবিতা নিয়ে চিন্তা করতাম, কবিতা ভাবতাম। আমার সমস্ত অনুরাগ জড়িয়েছিল কবিতার পেছনে। কবিতা আমাকে খ্যাতি দিয়েছে। সম্মান দিয়েছে। আর কী দেবে? কবিতা অর্থবিত্ত সেভাবে দেয় না হয়তো, কিন্তু আমি যা পেয়েছি, তা অনেক বেশি পেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি একসময় বলেছিলেন কবিরা পরাজিত হয় না।
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, এটার ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। কবিরা তো প্রকৃতপক্ষে কখনো হার মানে না। যত দিন সে বেঁচে থাকে, তত দিন সে লিখতে চায়। লেখেও। তার সঙ্গী-সাথিরা হয়তো ঝরে যায়। মরে যায়। এই পরাজিত না হওয়াটা কেবল জীবনের কাছেই নয়, সব ব্যাপারেই।
প্রশ্ন: আপনি গ্রামের ছেলে, মোড়াইল নামের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে কবি হতে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন; তারপর আপনার খ্যাতি, সুনাম ও সৃজনশীল প্রজ্ঞার অলৌকিক ঐশ্বর্য বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল। এই মাধুরী-সৌভাগ্যকে কীভাবে দেখেন?
আল মাহমুদ: মোড়াইলটা একেবারে গাঁ নয়, আধা গ্রাম, আধা শহর বলতে পারো। আমি কবি হওয়ার জন্য সাধনা করেছিলাম। এক হিসেবে বলা যায়, আমি জেনেশুনেই এই জগতে এসেছিলাম। এটা এ কারণে যে আমি কী করতে পারব আর কী পারব না, সেসব আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। এবং আমি যা করতে পারব না ভেবেছিলাম, সেটাও আমি করে ফেলেছি। আর সেটা হচ্ছে সাহিত্য—সাহিত্যের জন্য খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ। একটা পরিচিতি বলতে যা বোঝায়, সেটা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হয়েছে আমার। এটাকে আমার খুব বড় পাওয়া মনে হয়। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে?
প্রশ্ন: কবি না হলে অন্য কী হতেন?
আল মাহমুদ: কবি না হলে আমি হয়তো কিছুই হতাম না। কবি হওয়ার কারণে একবার আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। ওই ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে। ভাবি ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও নিশ্চয়ই এখনো বেঁচেবর্তে আছে এই সংসারে।
প্রশ্ন: পরে স্ত্রী হিসেবে যাঁকে পেলেন, দীর্ঘ একটা জীবন কেটেছে তাঁর সঙ্গে...।
আল মাহমুদ: আমার স্ত্রীর কথা আমার মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। আমার জীবনে, আমার অগোছালো কবিজীবনকে দারুণভাবে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। একধরনের পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছিলাম। আমার তেমন কোনো অতৃপ্তি ছিল না।
প্রশ্ন: এখন আপনি একধরনের নিঃসঙ্গই...কোনো অতৃপ্তি বা বেদনা কাজ করে?
আল মাহমুদ: আমি হয়তো মনের দিক থেকে একা। সারা দিন আমার কাছে নানাজন ছুটে আসে। শরীর ভালো থাকলে একটা-দুটো অনুষ্ঠানে যাই। তবে এখন আমার জীবনে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। আর অতৃপ্তি কিছু তো আছেই। মানুষের অনেক কিছু চাওয়ার থাকে, মানুষ প্রতিনিয়তই চায়; মনে মনে চায়। না পেলে চুপ করে থাকে। আমিও সেই—যাকে বলে না-পাওয়ার বেদনাটা চুপ করে কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আর এসব নিয়ে তেমন ভাবি না।
প্রশ্ন: কবি পরিচয়কে সামনে রেখেও গল্প-উপন্যাস এবং অন্যান্য রচনায়ও আপনি বিপুল শক্তিমান। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে আত্মজীবনী লেখার কথা মনে হয়নি, কবি হিসেবে আপনার জীবন তো কম বর্ণাঢ্য নয়?
আল মাহমুদ: সাহিত্যের সব শাখাতেই লিখতে চেষ্টা করেছি, লিখেছি। আত্মজীবনী লেখার কথা মনে আসে, কিন্তু সাহস হয় না। এত খুঁটিনাটি লিখতে হবে, লিখেও হয়তো শেষ করতে পারব না। এমন একটা ভয়ও আছে। আমি তো গদ্য-পদ্য পাশাপাশি লিখে গেছি। সবাই বলত, আমার গদ্যও ভালো। আমার একটা গল্পের বই আছে—পানকৌড়ির রক্ত; এটা লিখতে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। এবং গদ্যটা বেশ ভালোই লিখেছিলাম। আমার অন্যান্য গদ্যের তুলনায় আমি মনে করি সেটি অতুলনীয় ছিল।
প্রশ্ন: আপনার গল্প নিয়ে কলকাতা থেকে সিনেমা এবং নাটক হচ্ছে, জানেন?
আল মাহমুদ: কলকাতা থেকে আমার ‘জলবেশ্যা’ গল্প নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। সম্ভবত এতদিনে শেষও হয়ে গেছে। একটা ফুললেন্থ সিনেমা। হ্যাঁ, আমার গল্প নিয়ে অনেকগুলো নাটকও হয়েছে। ওই আর কি। নতুন কিছু হলে ভালো লাগে।
প্রশ্ন: আপনি তো এখন ডিকটেশন দিয়ে লেখান। কাজেই এমন কি হয় না যে আপনার লেখার খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু কাউকে দিয়ে যে লেখাবেন সেরকম কেউ নেই কাছে?
আল মাহমুদ: সাধারণত এমন হয় না। আমি যখন লিখতে চাই, লেখার মানুষও পেয়ে যাই। তবে কোনো কোনো সময় যায় ঘুম আর জাগরণের মধ্যে, তখন কিছু মাথায় এলেও তা আর লেখা সম্ভব হয় না। জেগে ওঠে মনে করতে পারি না।
প্রশ্ন: আপনি বলেন—কবি হতে গেলে গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করতে হয়, আপনি নিজে তা করেছেনও; কিন্তু শুধু কবিতা নিয়েও থাকেন নি গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন?
আল মাহমুদ: গদ্য লেখাতেও যেহেতু আমার উৎসাহ ছিল, হাতও ছিল ভালো, তাই লিখে গেছি আর কি। আমার মনে হয় খুব খারাপ লিখিনি। কবিরা ভালো গদ্য লিখতে পারে, আমি বোধ হয় তার প্রমাণ কিছুটা দিতে পেরেছি।
তবে এই পেরে ওঠাটা একটা বড় ব্যাপার। আমার উপমহাদেশ বা কাবিলের বোন—এসব আমার একধরনের সার্থক রচনা আমি মনে করি।
উপমহাদেশ লেখা হয়েছে আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি আলাদা বই লেখার ইচ্ছা ছিল, এখনও আছে, জানি না কতটুকু পারব।
প্রশ্ন: কবিতার সঙ্গে সারা জীবন বসত করে গেছেন, আপনার নিজের বিবেচনায় কবিতা আসলে কী?
আল মাহমুদ: কবিতা হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতরে কিছুটা পরিভ্রমণ। বাস্তবতার সঙ্গে এই স্বপ্নের সম্পর্কটা হতে পারে—বাস্তবতায় পা রেখে স্বপ্নের ভেতর উড়াল দেওয়ার মতো। কবির প্রকৃত কাজ হলো মানুষকে, তাঁর জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। এটা আমি সব সময় বলেও এসেছি। আমি এই স্বপ্নটা দেখাতে চেষ্টা করেছি। এখনকার কবিরা এ কাজটি করতে পারছে কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
প্রশ্ন: একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, এখনকার কবিরা কোথায়? এই অভিব্যক্তির তাৎপর্যটা একটু খুলে বলবেন?
আল মাহমুদ: কথাটা বলেছি—কারণ কবিদের কোলাহল তো শুনি না। নিশ্চয়ই তাঁরা আছেন। কিন্তু আগে যেমন আমি আজিজ মার্কেটে ঘুরে কিংবা নানা জায়গা থেকে কবিতার বই সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম, লিটল ম্যাগাজিন পড়তাম, এখন তো সেসব পারি না। আমার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষ। আমি চোখেও দেখি না। যাইও না কোথাও। একসময় আমরা বন্ধুরা, যেমন—শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিয়েছি, দাপিয়ে বেড়িয়েছি গোটা শহরটায়। তখন আমাদের শোরগোলটা কিন্তু ছিল চারদিকে। এখন কি কবিদের সেরকম সদর্প পদচারণা আছে! বুঝতে পারি না।
প্রশ্ন: বাংলা ছোটগল্প অনেক দূর এগিয়েছে। তবু এখনো, রবীন্দ্রনাথের ছোটপ্রাণ ছোট ব্যথাকে গল্পের পরিচয় নির্ণয়ে সামনে আনা হয়। আপনি, কবি আবার গল্পকার আল মাহমুদও কম শক্তিশালী নয়; ওই সংজ্ঞা আজও কতটুকু প্রাসঙ্গিক মনে করেন?
আল মাহমুদ: (মৃদু হেসে) না, আমি কবি হিসেবেই কাজ করেছি। গল্পকার হিসেবে যারা বড় করে দেখে আমাকে, তারা ভালোবেসে বলে। তবে রবীন্দ্রনাথের সেই কথাকে এখন আর আমি মানি না। তিনি ছোটগল্পের যে ফর্মের কথা বলেছেন, এটা তো মানা যায় না। এটা এখন আমাদের ওপর চাপানো উচিত না। উনি আমার প্রিয় লেখক, তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রাচুর্য আছে। নজরুলও আমার প্রিয়। বাংলা ভাষার জন্য অত্যন্ত দরকারি ছিল কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। এটা আমি অনুভব করি। তাঁর একটা কবিতা আছে—‘বল বীর, বল উন্নত মম শির...’; কবিতাটির সমতুল্য কবিতা ওই সময়ে বা পরেও দেখা যায় না। এসব একবারই হয়। বাংলা সাহিত্যে এটা অসাধারণ সৃষ্টি।
প্রশ্ন: কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতখানি?
আল মাহমুদ: আরে, ছন্দ ছাড়া কি কবিতা হয়? আমি তো লিরিকের মানুষ। গীতিপ্রবণতা আমার স্বভাবগত। আমি আসলে ছন্দে আছি, গন্ধেও আছি।
প্রশ্ন: কবির জীবন কি হবে শুধু উদাসীন, ছন্নছাড়া আর পাগলটে?
আল মাহমুদ: কবিদের জীবনযাপন পাগলের মতো কেন হবে? তারা তো পাগল না। হ্যাঁ, বড়জোর বলতে পারো—উদাসীন। উদাসীনতা কবিদের স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। এটাকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। কবিতার কারণে জীবন সফল হয় না, তা নয়। আমি একবার বলেছিলাম, যারা সাহিত্যচর্চা করে, আমি তো দেখি না কেউ খালি হাতে ফিরেছে। একটা প্রাপ্তি নিশ্চয়ই আছে।
প্রশ্ন: সোনালি কাবিনে আপনি বলেছেন—পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা। আবার আপনার একটা বইয়ের নাম—সৌরভের কাছে পরাজিত!
আল মাহমুদ: সৌরভের কাছে পরাজিত বইটি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। না হলে তো গোলমাল হয়ে যায়। আগেই বলেছি, পরাজিত হয় না কবিরা। আমার সব সময় তা-ই মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমি পরাজিত নই। আই অ্যাম নট ডিফিটেড। সত্য-সুন্দর ও কল্যাণের পথেই তো কবিরা হাঁটেন।
প্রশ্ন: কবিতায় গল্প-উপন্যাসে আপনি প্রেমের নানা রকম চিত্রায়ণ করেছেন। প্রেম বা ভালোবাসাটা কী ব্যাখা করতে পারেন?
আল মাহমুদ: ভালোবাসা কী—এটা তো আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। এটুকু বুঝি ভালোবাসা একটা অবস্থা। যখন মানুষ কাউকে ভালোবাসে, তখন সেই ভালোবাসার মধ্যেই জিনিসটা উপলব্ধি করা যায়।
প্রশ্ন: কবিরা তো ভালোবাসা ভাঙিয়েই খান, এটাই তাঁদের মূল শক্তি। এটা কতখানি সত্য?
আল মাহমুদ: একটা কবিতা আছে—‘গাছ তোলে বুক ফুল তোলে বুক, সন্ধ্যা ভোরের আলোর বীণায়; সবাই মিলে গান ধরেছে, প্রেমের মতো আর কিছু নয়।’ এটা আমার মনে হয়। ভালোবাসার অপর নাম। জীবনে, এখন কবিতাই আমার একমাত্র ভালোবাসা।
প্রশ্ন: আপনি এখনো তো প্রেমের কবিতা লিখছেন। এই বয়সে আপনার কি প্রেমে পড়তে বা ভালোবাসতে ইচ্ছে করে?
আল মাহমুদ: এটা তো ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, অবস্থার ওপর হয়ে থাকে (স্বতঃস্ফূর্ত দীর্ঘ হাসি)...। এটা আসলে অনুভবের বিষয়। কেউ কেউ এখনো এসে বলে, ‘আপনাকে ভালোবাসি।’ কী আশ্চর্যের বিষয়!
প্রশ্ন: সাহিত্যে—কবিতা বা গল্পে নিরীক্ষার যে প্রয়াস, এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আল মাহমুদ: নিরীক্ষা-ফিরিক্ষা কী আবার? নিরীক্ষার ধার ধারি না আমি। সাহিত্য হচ্ছে চর্চার বিষয়। চর্চা করে যারা, তারা এর স্বাদ গ্রহণ করে। ভেতরে কী আছে, সেটা তারা উপলব্ধি করে। আর কবিতার জন্য পুরো জীবন কাজ করে যেতে হয়।
আমি মনে করি সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জন্য। সাহিত্য ব্যক্তিজীবনের জন্য স্বপ্ন। আমি সব সময় জীবন, মানুষ ও স্বদেশকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আমি কল্যাণ চাই। চাই সুন্দর-স্বপ্নময় স্বদেশ। আমার লেখা পড়লেও সেটাই বোঝা যাবে।
প্রশ্ন: আপনার অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষ কেবল সোনালি কাবিন-এর কথাই বলে। এটাকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন?
আল মাহমুদ: এটা তো হতেই পারে। এটার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল।
প্রশ্ন: কিছু লিখছেন? সময় কাটে কীভাবে?
আল মাহমুদ: এই তো, ঘরে বসে থাকি। বাইরে তেমন যাই না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকি। শুয়ে থাকি। এই তো।
No comments