অন্তরঙ্গ আলোকে রবীন্দ্রনাথের আপন ভুবন রাশেদা খালেক

পূর্ব প্রকাশের পর) আশ্বিনের শেষদিক রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবি শিলাইদহে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা শিলাইদহে রথীন্দ্রনাথের কর্মের রথ...চালাতে হবে। মাঘোৎসবের তিন দিন পর ১৩১৬ সালের ১৪ মাঘ তারিখে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে হলো গগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নি বিনয়িনী দেবীর বিধবা কন্যা প্রমীলা দেবীর সাথে। বিধবা বিবাহ ঠাকুরবাড়িতে এই প্রথম।


সুতরাং সামাজিক দিক থেকে আদি ব্রহ্ম সমাজের পক্ষে এ এক বিল্পব বটে। এই ঘটনার পর আদি সমাজের অনেক সংস্কার একে একে ভেঙে যায়।
রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা যাবার কিছুকাল আগেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আটাশি বছর বয়সে লোকান্তরিত হন (১৯ জানুয়ারি ১৯০৫)। দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব রবীন্দ্র জীবনকে অনেকটাই প্রভাবান্বিত করেছিল। পিতার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ গভীর শোক অনুভব করেন। মহর্ষির দেহত্যাগের পর তাঁর ইচ্ছানুসারে শান্তিনিকেতনে কোন ছবি, মূর্তি বা স্মৃতিচি??হ্ন রাখা হয়নি।
কবির জ্যেষ্ঠ কন্যা বেলা মৃত্যুশয্যায়। দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগছে। তাঁর নিঃসন্তান জীবনের ব্যর্থতা ও পরিণাম কবির মনে বহু রেখাপাত করেছিল। বেলা আজ মৃত্যুপথযাত্রী, তাঁর না বলা মনের কষ্ট কথা কবি ঠিকই অনুভব করেছিলেন, তাই তাঁর কোন কোন কবিতায় তা আপনা আপনি প্রকাশ পেয়েছে। কবির নিজ মনের কথাটি প্রকাশ পেয়েছে ‘মালা’ কবিতায়। অনেক কষ্টভোগের পর ১৬ মে ১৯১৮ তারিখে জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা বেলার মৃত্যু হয়। অসুস্থ বেলাকে দেখতে কবি প্রায়ই দুপুর বেলায় কন্যার বাসায় যেতেন। ১৬ মে তারিখে যথারীতি কন্যাকে দেখতে গিয়ে শুনলেন বেলার মৃত্যু হয়েছে। কবি মৃত কন্যাকে না দেখেই ফিরে এলেন। বিকেলে অন্যদিনের মত অন্যান্য সকলের সাথে কথাবার্তা বলছেন। শোকের কোন চিহ্ন বাইরে নেই। অথচ কবি বেলাকে যে কী ভালবাসতেন তা পরিবারের সকলেই জানতো।
বেলার মৃত্যুর কয়েক দিনের মধ্যে কবি শান্তিনিকেতনে ফিরে গেলেন। তখন বিদ্যালয় বন্ধ। দারুণ গরম। তার মধ্যে কবি উঠলেন ‘দেহলির’ ছোট্টঘরে। চারদিক নিরালা নিঝুম। তবু ভাল লাগছে। এবার তিনি ছাত্র পড়াবেন। বিদ্যালয় খুললে ছাত্র পড়াতে শুরু করলেন। মন ক্লান্ত থাকলেও তাতে সমস্ত দিনটা কেটে যায়, মনটা সুস্থ থাকে। এ সময় প্রমথ চৌধুরীকে লিখছেনÑ“আমি যে চুপচাপ বসে থাকি তা মনে করো না। আমার কাজ চলছে। সকালে তিন ক্লাসের পড়ানো আছে। তারপরে স্নান করে খেয়ে যেদিন চিঠি লিখবার থাকে চিঠি লিখি। তারপর বিকেলে খাবার দেবার আগ পর্যন্ত ছেলেদের যা পড়াতে হয় তা তৈরি করে রাখি। তারপর সন্ধ্যার সময়ে ছাদে চুপচাপ বসে থাকি। কিন্তু এক একদিন ছেলেরা আমার কাছে কবিতা শুনতে আসে। তারপর অন্ধকার হয়ে আসে। তারাগুলিতে আকাশ ছেয়ে যায়Ñদিনুর ঘর থেকে হারমোনিয়াম এবং বাঁশির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গানের ধ্বনি উঠতে থাকে। ক্রমে রাত্রি আরো গভীর হয়। তখন ছেলেদের ঘরের গানও বন্ধ হয়ে যায়। আর দূরে গ্রামের রাস্তার ভেতর দিয়ে দুই একটা আলো চলতে দেখতে পাই। তারপর সে আলোও থাকে না, কেবলমাত্র আকাশজোড়া তারার আলো। তারপরে বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে আসে তখন আস্তে আস্তে উঠে শুতে যাই। তারপরে কখন এক সময়ে আমার পূর্বদিকের দরজার সম্মুখে আকাশের অন্ধকার অল্প অল্প ফিকে হয়ে আসে, দুটো একটা শালিখ পাখি উসখুস করে ওঠে, মেঘের গায়ে গায়ে সোনালি আভা ফোটে, খানিক বাদেই সাড়ে চারটার সময় আদ্যবিভাগে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকে অমনি আমি উঠে পড়ি। মুখ ধুয়ে এসে আমার সেই পূর্বদিকের বারান্দার পাথরের চৌকির ওপর আসন পেতে উপাসনায় বসি। সূর্য ধীরে ধীরে উঠে তার আলোকের স্পর্শে আমাকে আশীর্বাদ করে।” কি চমৎকার বর্ণনা। কবির জীবনচিত্র কী দারুণভাবে উঠে এসেছে। পড়লে বেদনায় মন ছেয়ে যায়। বুক ভেঙে কান্না নামে। বেলার মৃত্যুর পর দূরের ও কাছের আরো অনেক শোক কবিকে বইতে হয়েছে। তবে শেষ বয়সে দারুণ আঘাত হানে তাঁর আদরের একমাত্র নাতি নীতুÑনীতিন্দ্রনাথ। কনিষ্ঠা কন্যা মীরার একমাত্র পুত্র। মাত্র ২০ বছর বয়সে (শ্রাবণ ১৩৩৯) জার্মানিতে লেখাপড়া করতে গিয়ে মারা যায়। নীতু ছিল রবীন্দ্রনাথের চোখের মণি। প্রাণের আলো। তাও দপ্ করে নিভে গেল।
রবীন্দ্রনাথের ৫ সন্তানের মধ্যে বেলা ও রথীন্দ্র ছিল নিঃসন্তান, রেণুকা ও শমীন্দ্র শৈশবেই মারা যায়। একমাত্র কন্যা মীরার ছিল দুই সন্তানÑকন্যা নন্দিতা, পুত্র নীতিন্দ্র। সেই নীতিন্দ্র চলে গেল। রবীন্দ্রনাথের একান্ত জীবনে চারপাশ জুড়ে একটি একটি করে যে তারা ফুটে উঠেছিল, একটি একটি করে যে প্রদীপ জ্বলে উঠে তাঁর জীবনকে চঞ্চল-উচ্ছল, আলোকিত মহিমান্বিত করে তুলেছিল তা কালের অমোঘ নিয়মে একটি একটি করে প্রায় সব ডুবে গিয়েছিল, নিভে গিয়েছিল। এ যেন একটি একটি করে নিভেছে দেউটি। তাতে কবির ভেতরটা হয়েছে নিঃস্ব রিক্ত শূন্য। বাইরে থেকেছেন সৌম্য শান্ত ধ্যান বুদ্ধ। সৃষ্টির অমীয়ধারা তাতে স্তব্ধ হয়নি। নিরন্তর ফল্গুধারার মত তা বহমান থেকেছে ২২ শ্রাবণ ১৯৪১ কবির জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া পর্যন্ত। ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫১তম জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.