আলোচনা- 'খানিক ছফানামা' by কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

আহমদ ছফার প্রতি একধরনের মোহাবিচ্ছিন্নতা যে কখন থেকে আমার শুরু হয়েছিল তা নির্ণয় করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। আমার এ কথকতার শুরুতেই বলে নিতে চাই, দীর্ঘদিন তার প্রতি ছিল আমার দারুণ মোহগ্রস্ততা। তা হয়ত প্রায় একই রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে হতে পারে, তার সৃজনকৃত মুগ্ধতার সমান্তরাল কোনো আকাঙ্ক্ষা থেকেও হতে পারে, নাকি বিকল্প ভাষাগত কোনো চৈতন্য থেকে আমার বোধে এল তা এই মুহূর্তে নির্ণয় করা মুশকিলই। তার লেখালেখির অনুভব থেকে চিন্তা করলে আমি একধরনের প্রেমে পড়ি তার গ্রন্থ বঙ্কিমচন্দ্র: শতবর্র্ষের ফেরারী পাঠ করে। বঙ্কিমকে যে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে একেবারে মুক্তচিন্তার সমাজতাত্ত্বিক চৈতন্য থেকে এভাবেও দেখা যায় তা আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আমি এর প্রতি এতই আকর্ষণ বোধ করি যে তার এ গ্রন্থটি নিয়ে রীতিমতো একটা লেখাই নির্মাণ করে ফেলি এবং তা স্থানীয় দৈনিক আজাদীর সাময়িকীতে ছাপতেও দিই।



এ লেখাটি যখন বের হয় তখন ছফা তখন নবউত্থান পর্বের (!) কর্ণধার। আমি সেইসময় গ্রন্থসংগ্রহের নিমিত্তে আজিজ সুপার মার্কেটে যাই। আমি তখন চাইলেই বিকালে তথায় তার সাথে দেখাও করতে পারতাম। কিন্তু ব্যক্তিগত নির্লিপ্ততার জায়গায় নিজেকে সঁপে দিয়ে আর সেখানে গেলাম না। এ ব্যাপারে আমার সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমি আমার ভালো লাগা থেকে একটি কিছু লিখে ফেলেছি, তা আবার নিজ উদ্যোগে তাকে তা জানাব কেন?! কিন্তু তাতে এটাই হল যে, এ লোকটির সাথে আমার আর সরাসরি দেখা হল না।

যাই হোক, ছফা বিষয়ে আমার আরও একটা আগ্রহের কারণ হচ্ছে, আবদুর রাজ্জাক বিষয়ে তার অতি আগ্রহ, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, বাঙালী মুসলমান সম্পর্কে কিছু নতুন কথাবার্তা বলা, স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা চালানো, তার বলার ভিতরে নিজস্ব রাগ-জেদ-চৈতন্য লালনের চেষ্টা, কথাসাহিত্য চর্চায় তার একধরনের ব্যাকুলতা, ফাউস্ট অনুবাদকরণ।

বাঙালী মুসলমানের মন পড়তে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে তিনি আসলে কোন্ বাঙালির মননকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন, তা তার প্রবন্ধে স্পষ্ট হয়নি। তার দেখার বাঙালিত্বে কি তিনি নিজেও আছেন? একটা সময়ে মনে হয়েছে তিনি নিজেকেও তার দেখা বাঙালিত্ব থেকে মুক্ত করতে পারেননি। তার সৃষ্ট বাঙালির মনের গভীরে একধরনের সংস্কার আছে। তার দেখা মুসলমান কখনও পবিত্রতা দেখতে ভুল করেন না। এরা সঠিক দিশা পাচ্ছে না। এই মুসলমান সমাজ সংস্কারের প্রতি ব্যাকুলতা প্রকাশ করে, তারা তাদের মননে একধরনের আদিমতা জারি রাখে। তার সৃষ্ট ‌’বাঙালী মুসলমানের মন’-এ কখনও ভাববাদী প্রাবল্যমুখর প্রবণতাকে দেখেন না, তার সৃষ্ট বা দেখাতে সমস্যা শুধু একটাই, এই মুসলমানগণ যথার্থ শিক্ষিত-সংস্কারমুক্ত মুসলমান হতে পারেনি। এবং তিনি চাইতেন মুসলমানদের মননের যথোচিত সাধন-ভজন করে মহান কিছু কার্য সিদ্ধি করা যায় কিনা। তিনি এও বিশ্বাস করতেন, এই কাজটি আমাদের দেশের ভাষাভিত্তিক বুর্জোয়া দলটি করতে পারবে না; কারণ তারা মুসলমানদেরকে দেশজ অনুসঙ্গ থেকে বিচার করতে জানে না।

তাই তো তিনি একধরনের সাধনায় নামেন, শেষজীবনে তিনি লিবিয়ার অনুসরণে ইসলামি সমাজবাদ কায়েম করতে চান, ইসলামি নানাবিধ জলসায় গমন করেন, ওয়াজ মাহফিলের প্রতিও অনুরক্ত হতে থাকেন। এখানে একটা প্রশ্ন রাখা যায়; যে রাগ, গোস্বা, অভিমান থেকে আবুল ফজল কর্তৃক সরকারি প্রাপ্তিযোগে প্রয়োজিত সিরাত মাহফিলে যোগদান কল্পে ইসলামি কার্যকলাপের নমুনা দেখে তিনি অতিশয় বিস্মিত হন, এবং স্বল্পসময়ের ভিতর ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ (আসলে এটির শিরোনাম হতে পারত, বাঙালী শহুরে মধ্যবিত্ত মুসলমানের মন) লিখে ফেলেন। ছফা যে মনোবেদনা নিয়ে এটি সৃজন করেন, একই কার্যবিধিতে তিনি নিজেও কি একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েননি? আসলে তার মনোভাবের বড়ো শক্তি হচ্ছে তার তাৎক্ষণিক মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা বা মনোপীড়াই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। যার ফলে মাণিকের পদ্মানদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া, যিনি হয়ত-বা যান্ত্রিক সমাজবাদের ধারক, বেয়াদব পুঁজির পূজারি, অপব্যবসার অংশীদার, কুবেরের মতো সরল-সোজা মানুষটাকে চোর-পুলিশের ধাঁধায় ফেলে ময়নাদ্বীপে পাচার করার মেইন হোতা, সেই তিনিই ছফার দৃষ্টিতে হয়ে পড়েন নব্য মেঘনাদ! তার কারণ ছফার কাছে মনে হয়, হোসেন মিয়া মুক্তচিন্তার ধারক! অথচ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, হোসেন মিয়ার যাবতীয় কর্মে আছে শ্রেণীস্বার্থের নিবিড় লালন। শ্রেণীদ্বন্দ্ব বা শ্রেণীর পূজারিদেরকে সেইভাবে চিনতে চান না বলেই ছফা ‘৭২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে থাকেন খুবই উৎফুল্ল।

আসলে ছফাকে পাঠ করার জায়গাটাই তার মুগ্ধতা বা বিমোহিত ভাবকে আমাদের মনে রাখা খুবই দরকার। এটা আমাদের চৈতন্য বিকাশের একটা দায়ও বটে।
========================
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
লেখক

জন্ম
বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ ৩১/১/১৯৬৩

গল্পগ্রন্থ
মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম
স্বপ্নবাজি

উপন্যাস
পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী

সম্পাদনা
কথা (কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ)

পেশা
রেলওয়ের মেডিক্যাল অফিসার
editorkatha@yahoo.com
============================



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.