শ্রীচিন্ময়ের গান -স্মরণ by নাসিমা খান
সাহিত্যিক-সাংবাদিক আনিসুল হক একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শ্রীচিন্ময়ের কাছ থেকে আপনি কী পেয়েছেন?’ প্রশ্নটি সর্বজনীন প্রাথমিক প্রশ্ন। এই হাইস্পিড অনলাইন যুগে ওম শান্তির ধ্যান শ্রীচিন্ময় আমাকে বিশেষ কী দিতে পারে? দিতে পারার সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িত আছে—নিতে পারা। এই যে দুই—দেওয়া-নেওয়া, তোমার-আমার শ্রীচিন্ময় তাঁদের মধ্যে তৈরি করে দেন অনাদিকালের এক অটুট বন্ধুত্ব, যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘ওয়াননেস’।
‘ওয়াননেস’-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য শ্রীচিন্ময় অনুশীলিত কতগুলো চর্চা আছে, যা যেকোনো ব্যক্তিকে যেমন যুগোপযোগী হাইস্পিড করে তুলতে পারে, আবার একই সঙ্গে নিভৃতচারী শান্ত-ধীর করে রাখতে পারে। শ্রীচিন্ময়ের দর্শনে ধ্যানী হওয়ার অর্থ চক্ষু বন্ধ করে বাস্তবকে বর্জন করা নয়, বরং বাস্তবতাকে স্বীকার করে এর ওপর নিজের চর্চিত শিক্ষাকে কাজে লাগানো—সেই ‘ওয়াননেসের’ পক্ষে।
এই ওয়াননেস, এই একাত্মতা কার সঙ্গে? তোমার সঙ্গে আমার, হিন্দুর সঙ্গে বৌদ্ধের, ইহুদির সঙ্গে মুসলিমের, পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের, উঁচুর সঙ্গে নিচুর ঘুরে ঘুরে এলে বৃত্তের কেন্দ্র স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, মানুষের সঙ্গে বিধাতার। তাই শ্রীচিন্ময়ের পথে চলতে হলে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে আসতে হবে, তিনি আছেন—তিনি এক, অদ্বিতীয়। তারপর শ্রীচিন্ময় বলেন বাকিটা। স্রষ্টা কেন ভালোবাসবেন না তাঁর সৃষ্টিকে, কেন বারবার ক্ষমা করে দেবেন, কেন ফিরে ফিরে আসেন সাত আসমানের নিচে মানুষের হূদয়ে হূদয়ে, কেন এই ক্ষণিকের আতিথ্য নিয়ে এত বাড়াবাড়ি? এত বিচ্ছিন্নতার দরকার নেই। কীভাবে খুঁজে পেতে হবে বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য, কীভাবে শান্ত হয়ে শান্তি-প্রগতির জন্য কাজ করতে হবে। আরও কত কী!
পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামের ছেলে শ্রীচিন্ময়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩০ সালে। ১০ বছর বয়সে ভারতের পণ্ডিচেরীতে গিয়ে শ্রীঅরবিন্দের আশ্রমে বড় হন। ১৯৬৪ সালে প্রবাসী হন আমেরিকার নিউইয়র্কে। আশ্রমের শিক্ষা আর নিজের সৃজনশীলতা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে অকৃতদার এই পুরুষ প্রতিদিন বিকশিত হয়েছেন কেবলই মানুষের জন্য। তিনি একই সঙ্গে কবি, শিল্পী, আঁকিয়ে, সমাজসেবক। অসংখ্য কবিতা, গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। ১৩ হাজার বাংলা গান আছে তাঁর রচনায় ও সুরে। আছে আট হাজার ইংরেজি গানও। বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, খেলতেন, ম্যারাথন দৌড়াতেন, ভারোত্তোলন করতেন, আর সবার ওপরে যা করতেন তা হলো, মেডিটেশনের মাধ্যমে মানুষকে সত্যান্বেষী করে তোলা, সহজ মানুষে পরিণত করা।
তিনি বলতেন, মানুষের জন্মগত অধিকার আছে ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার। পাপী-পুণ্যি—সবার জন্যই তাঁর দুয়ার খোলা সব সময়। আমরা তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র কোনো ভুলে কখনো ছিন্ন করে ফেলি। তিনি কিন্তু তা করেন না। তাঁর সঙ্গে আমার, আমাদের এই সম্পর্কের এক ঝলকের একটু আলো যে একবার চোখে দেখতে পায়, সে আর জেগে ঘুমাতে পারে না। তার পথ চলা শুরু হয় সীমার মধ্যে অসীমের দিকে। চিন্ময়ের ভাষায়, ‘সুপ্রিম’কে ভালোবাসতে পারার অপার আনন্দ চিন্ময়ের দর্শনে, সৃষ্টিতে প্রকাশিত হয়েছে বারবার। এ ভালোবাসার রং মনে ধরলে কে আর হিংসা করে কাকে? কোনো হিটলার হত্যা করবে কোনো ইহুদিকে? কোনো মার্কিন কোনো আফগানকে? কারণ সে তো জেগে উঠে দেখতে পেয়েছে—মোরা যাত্রী একই তরণীর।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শ্রীচিন্ময় সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৪ সালের পর থেকেই। সেখানে চিন্ময়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অগণিত মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষিত করেছেন তাঁর দর্শনে। নানা দেশের নানা শহরে চিন্ময় বহুবার গান করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। এবার তাঁর গান হবে, তাঁর জন্মস্থান বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। আজ ১৩ ডিসেম্বর, রোববার, তাঁর রচিত গান গাইবেন তাঁরই ছাত্রছাত্রীরা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র মিলনায়তনে। গান চিন্ময়ের প্রাণ। গানের জগতে, সুরের বাণীর জাদুতে তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে পেতেন। মনের সহজ আনন্দে তাই লিখেছেন অজস্র গান। পরে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো গেয়ে, প্রকাশ করে পরিচিত ও প্রিয় করেছেন অন্যদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের গানের বাণীর সঙ্গে শ্রীচিন্ময়ের গানের বাণীর মিল রয়েছে। ঈশ্বরকে রবীন্দ্রনাথ যতভাবে ভালোবেসেছেন, শ্রীচিন্ময় তার চেয়ে কম বাসেননি, এ যেন প্রিয়তমকে ভালোবেসে কে কত গান উত্সর্গ করতে পারেন!
ঈশ্বর বা স্রষ্টা, তাঁকে কাছে পাই, না পাই, আলো-অন্ধকারে যাই অথবা না যাই, যে যেই বোধ নিয়ে হাঁটি পৃথিবীর এই পথ—সবার জন্যই চিন্ময়ের গান দর্শন আর শিক্ষা অবারিত। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় শ্রীচিন্ময় দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এখন জ্যামাইকা সেন্টারকে মূল কেন্দ্র ধরে তাঁর কাজ করে চলেছে। বলাই বাহুল্য, সব ধর্মের-শ্রেণীর মানুষের জন্য এই সেন্টারের দরজা রাত-দিন খোলা।
‘ওয়াননেস’-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য শ্রীচিন্ময় অনুশীলিত কতগুলো চর্চা আছে, যা যেকোনো ব্যক্তিকে যেমন যুগোপযোগী হাইস্পিড করে তুলতে পারে, আবার একই সঙ্গে নিভৃতচারী শান্ত-ধীর করে রাখতে পারে। শ্রীচিন্ময়ের দর্শনে ধ্যানী হওয়ার অর্থ চক্ষু বন্ধ করে বাস্তবকে বর্জন করা নয়, বরং বাস্তবতাকে স্বীকার করে এর ওপর নিজের চর্চিত শিক্ষাকে কাজে লাগানো—সেই ‘ওয়াননেসের’ পক্ষে।
এই ওয়াননেস, এই একাত্মতা কার সঙ্গে? তোমার সঙ্গে আমার, হিন্দুর সঙ্গে বৌদ্ধের, ইহুদির সঙ্গে মুসলিমের, পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের, উঁচুর সঙ্গে নিচুর ঘুরে ঘুরে এলে বৃত্তের কেন্দ্র স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, মানুষের সঙ্গে বিধাতার। তাই শ্রীচিন্ময়ের পথে চলতে হলে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে আসতে হবে, তিনি আছেন—তিনি এক, অদ্বিতীয়। তারপর শ্রীচিন্ময় বলেন বাকিটা। স্রষ্টা কেন ভালোবাসবেন না তাঁর সৃষ্টিকে, কেন বারবার ক্ষমা করে দেবেন, কেন ফিরে ফিরে আসেন সাত আসমানের নিচে মানুষের হূদয়ে হূদয়ে, কেন এই ক্ষণিকের আতিথ্য নিয়ে এত বাড়াবাড়ি? এত বিচ্ছিন্নতার দরকার নেই। কীভাবে খুঁজে পেতে হবে বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য, কীভাবে শান্ত হয়ে শান্তি-প্রগতির জন্য কাজ করতে হবে। আরও কত কী!
পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামের ছেলে শ্রীচিন্ময়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩০ সালে। ১০ বছর বয়সে ভারতের পণ্ডিচেরীতে গিয়ে শ্রীঅরবিন্দের আশ্রমে বড় হন। ১৯৬৪ সালে প্রবাসী হন আমেরিকার নিউইয়র্কে। আশ্রমের শিক্ষা আর নিজের সৃজনশীলতা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে অকৃতদার এই পুরুষ প্রতিদিন বিকশিত হয়েছেন কেবলই মানুষের জন্য। তিনি একই সঙ্গে কবি, শিল্পী, আঁকিয়ে, সমাজসেবক। অসংখ্য কবিতা, গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। ১৩ হাজার বাংলা গান আছে তাঁর রচনায় ও সুরে। আছে আট হাজার ইংরেজি গানও। বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, খেলতেন, ম্যারাথন দৌড়াতেন, ভারোত্তোলন করতেন, আর সবার ওপরে যা করতেন তা হলো, মেডিটেশনের মাধ্যমে মানুষকে সত্যান্বেষী করে তোলা, সহজ মানুষে পরিণত করা।
তিনি বলতেন, মানুষের জন্মগত অধিকার আছে ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার। পাপী-পুণ্যি—সবার জন্যই তাঁর দুয়ার খোলা সব সময়। আমরা তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র কোনো ভুলে কখনো ছিন্ন করে ফেলি। তিনি কিন্তু তা করেন না। তাঁর সঙ্গে আমার, আমাদের এই সম্পর্কের এক ঝলকের একটু আলো যে একবার চোখে দেখতে পায়, সে আর জেগে ঘুমাতে পারে না। তার পথ চলা শুরু হয় সীমার মধ্যে অসীমের দিকে। চিন্ময়ের ভাষায়, ‘সুপ্রিম’কে ভালোবাসতে পারার অপার আনন্দ চিন্ময়ের দর্শনে, সৃষ্টিতে প্রকাশিত হয়েছে বারবার। এ ভালোবাসার রং মনে ধরলে কে আর হিংসা করে কাকে? কোনো হিটলার হত্যা করবে কোনো ইহুদিকে? কোনো মার্কিন কোনো আফগানকে? কারণ সে তো জেগে উঠে দেখতে পেয়েছে—মোরা যাত্রী একই তরণীর।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শ্রীচিন্ময় সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৪ সালের পর থেকেই। সেখানে চিন্ময়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অগণিত মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষিত করেছেন তাঁর দর্শনে। নানা দেশের নানা শহরে চিন্ময় বহুবার গান করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। এবার তাঁর গান হবে, তাঁর জন্মস্থান বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। আজ ১৩ ডিসেম্বর, রোববার, তাঁর রচিত গান গাইবেন তাঁরই ছাত্রছাত্রীরা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র মিলনায়তনে। গান চিন্ময়ের প্রাণ। গানের জগতে, সুরের বাণীর জাদুতে তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে পেতেন। মনের সহজ আনন্দে তাই লিখেছেন অজস্র গান। পরে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো গেয়ে, প্রকাশ করে পরিচিত ও প্রিয় করেছেন অন্যদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের গানের বাণীর সঙ্গে শ্রীচিন্ময়ের গানের বাণীর মিল রয়েছে। ঈশ্বরকে রবীন্দ্রনাথ যতভাবে ভালোবেসেছেন, শ্রীচিন্ময় তার চেয়ে কম বাসেননি, এ যেন প্রিয়তমকে ভালোবেসে কে কত গান উত্সর্গ করতে পারেন!
ঈশ্বর বা স্রষ্টা, তাঁকে কাছে পাই, না পাই, আলো-অন্ধকারে যাই অথবা না যাই, যে যেই বোধ নিয়ে হাঁটি পৃথিবীর এই পথ—সবার জন্যই চিন্ময়ের গান দর্শন আর শিক্ষা অবারিত। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় শ্রীচিন্ময় দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এখন জ্যামাইকা সেন্টারকে মূল কেন্দ্র ধরে তাঁর কাজ করে চলেছে। বলাই বাহুল্য, সব ধর্মের-শ্রেণীর মানুষের জন্য এই সেন্টারের দরজা রাত-দিন খোলা।
No comments