সুবর্ণচরে কেন এত ধর্ষণ? by জিয়া চৌধুরী
নোয়াখালীর
মেঘনা উপকূলে সবুজ-শ্যামল জনপদ সুবর্ণচর। প্রায় পৌনে ছয় শ’ বর্গকিলোমিটার
আয়তনের এ জনপদে তিন লাখেরও বেশি মানুষের বসতি। ২০০৫ সালে উপজেলা গঠিত হওয়ার
পর শান্ত-নিরিবিলি জনপদে এক সময়ে জল ও বনদস্যুর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে
সুবর্ণচর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় কমে আসে দস্যুদের উৎপাত।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনায় উপকূলের এই
জনপদের নাম। সুবর্ণচরের বাসিন্দারা বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ও কয়েকজন
জনপ্রতিনিধির ছত্রছাত্রায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে কৃষিপ্রধান
সুবর্ণচরে। উপজেলার আটটি ইউনিয়নে কোন না কোনটিতে প্রায়শই গণধর্ষণ, ধর্ষণ,
খুন ও অন্যান্য অপরাধের ঘটনা ঘটছে।
গত কয়েক বছরে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সুবর্ণচর এলাকা থেকে ফৌজদারী মামলাও দায়ের হচ্ছে তুলনামূলক বেশি। এক সময়ের শান্ত-নিরিবিলি জনপদ কেন হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠলো? গত দুই দিন ধরে সুবর্ণচরের কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নেপথ্যে কাহিনী।
স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহলের দাপটে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন গ্রামের মানুষজন। নির্যাতন, হয়রানি ও লুটপাটের শিকার হয়েও মুখ খুলছেন না অনেকে। স্থানীয়দের নিজেদের নিয়মে করা শালিস ও বিচারেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষকে। থানা-পুলিশ ও আদালতে যাওয়ার ব্যাপারেও ভীতি আছে নির্যাতন-হয়রানির শিকার পরিবারগুলোতে।
গত বুধবার সুবর্ণচরের চর জুবলী ইউনিয়নের অন্তত বিশটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য। গত ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন রাতে এক নারীকে তার স্বামী ও ছয় সন্তানের সামনে গণধর্ষণ করে স্থানীয় কয়েকজন। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করলেও বাকি পাঁচ অভিযুক্ত আসামি হানিফ, চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন, মিন্টু ও সোহেলকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ। স্থানীয় চর জব্বার থানা পুলিশ ও ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের সহায়তায় আসামিরা অধরা বলে অভিযোগ ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের।
পাঁচ আসামির মধ্যে হানিফ স্থানীয় চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও গ্রেপ্তার রুহুল আমিনের আত্মীয়। তার দোকানে বসেই এমন সংঘদ্ধ অপরাধের চক্রান্ত হয় বলে ভাষ্য আশেপাশের মানুষদের। এছাড়া আরেক আসামি চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে বনদস্যু ও জলদস্যু ছিল এমন কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব ক্যাডার গ্রুপ চৌধুরী বাহিনী। মামলার বাকি তিন আসামি মোশাররফ হোসেন, মিন্টু ও সোহেল চৌধুরী এই বিশেষ বাহিনীতে কাজ করে বলে জানান নির্যাতনের শিকার ওই নারী। মোটরসাইকেল ও দেশীয় নানা অস্ত্র দিয়ে মহড়া দেয় এই বাহিনী। তাদের দাপটে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকতে হয় স্থানীয় মানুষদের। আর ৩০শে ডিসেম্বর গণধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ও সাবেক ইউপি সদস্য রুহুল আমিন এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও মানবজমিনকে জানান অন্তত দশটি পরিবারের সদস্যরা।
গণধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার থাকলেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে বলেও স্থানীয়দের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে রুহুল আমিনের পরিবার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। নিজেদের ভিটেমাটিতে থাকতে এখন ভয় পাচ্ছেন অনেকে। গণধর্ষণের শিকার ওই নারী ও স্বামী গতকাল চট্টগ্রাম থেকে মুঠোফোনে মানবজমিনকে জানান, মামলার পর থেকে আমাদের নানা রকমের হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলায় শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না বলেও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
রুহুল আমিন জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা। নির্যাতনের শিকার নারীর বাড়ির আশেপাশের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, হেন কোন অপকর্ম নেই রুহুল আমিন ও তার নিয়ন্ত্রণে থাকা চৌধুরী বাহিনীর সদস্যরা করে না। রুহুল আমিন মাঝি নামে স্থানীয় একজন জানান, এই বাহিনীর ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে হয় আমাদের। আমি নিজেও কয়েকবার তাদের নির্যাতন-হয়রানির শিকার হয়েছি। এখন কথা বলতেও ভয় পাই।
স্থানীয় একজন নারী জানান ৩০ ডিসেম্বর গণর্ধষণের ঘটনার পরদিনও ইসমাইল নামে এক যুবককে বেদম নির্যাতন করে রুহুল আমিন ও তার বাহিনীর সদস্যরা। ইসমাইলকে উদোম করে রুহুল আমিনের আত্মীয় ও মামলার আসামি হানিফের দোকানে নিয়ে প্রকাশ্যে বেঁধে রাখা হয়। ইসমাইলকে মারধরের পর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও তারা এ বিষয়ে কারো কাছে মুখ খোলেনি। ধর্ষণের শিকার নারী ওই যুবককে হাসপাতালে দেখেছেন বলেও মানবজমিনকে জানান।
স্থানীয় এনজিও কর্মী মুন্নি জানান, ৩০শে ডিসেম্বরের গণধর্ষণ শুধু নয় রুহুল আমিনের হাতে এমন অন্তত আরো অর্ধশত নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। তবে অনেকেই ভয়ে মুখ খুলছে না। নিজে নির্যাতিত হলেও অনেকে কখনো থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হয়নি। স্থানীয় নারীরা রুহুল আমিনের কুনজরের শিকার হলে তাদের বিশাল বাগানবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো বলেও জানান মুন্নি। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ২০১০ সালের দিকেও এমন ছিলো না রুহুল আমিন। এর আগে কোর্ট মোহরার ও ব্রিকফিল্ডে কাজ করলেও ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে চর জুবলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার দাপট বেড়ে যায়। চর জুবলীতে শুরু হয় রুহুল আমিনের রাজত্ব। মানুষের জমি দখল, শালিসের নামে টাকা নেয়া, সকালে বিয়ে বিকালে ডিভোর্সের আদেশ, গাছ কেটে নেয়া, জমির ফসল জোর করে কেড়ে নেয়ার মতো নানা অপকর্ম করতো তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এলাকায় রুহুল আমিনই ছিলো বিচারক। তার আদেশই ছিলো শিরোধার্য। অনেক পরিবারের জমিজমার মীমাংসা করে দেবে বলে তাদের থেকে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
এসব ভুক্তভোগী পরিবার এখন ধীরে ধীরে এসব বিষয় সামনে আনতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালে এরকম এক সালিসে ছোট্ট একটি বাছুর চুরির অভিযোগে স্থানীয় চারজনের দশ লাখ টাকা জরিমানা করে রুহুল আমিন। ঘটনার সময় ওমানে থাকলেও ফাঁসানো হয় নূরনবী নামে এক প্রবাসীকে। জহির, রাশেদ ও মনি ঘটনায় জড়িত না থাকলেও দিতে হয় জরিমানা। চার জনে মিলে সেই সালিশে প্রায় ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা দেন। যার সিংহভাগই নিজের পকেটে ভরে নেন রুহুল আমিন। নানা সময় রুহুলের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে মুন্নি নামে ওই এনজিওকর্মীকে মাদকের মামলায় ফাঁসানোরও হুমকি দেয় সে। জাতীয় নির্বাচনের পর মুন্নিকে জবাই করে হত্যার হুমকি দেয় বলেও মানবজমিনকে অভিযোগ করেন এই নারী। এছাড়া নির্বাচনের পর ১১টি পরিবারকে দেখে নেয়ার জন্য পরিকল্পনাও করা হয় বলে অভিযোগ করেন ষাটোর্ধ্ব মীনা বেগম। স্বামী ও ছেলে সন্তান না থাকায় চার মেয়েকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে থাকতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, ‘কোনখানে যাওনের জায়গা নাই। থাকলে কবেই চইল্যা যাইতাম। মাঝে মাঝে মনে লয় আমরা মনে হয় রোহিঙ্গা, বার্মার মতো এখানে আমাদের নির্যাতন করা হচ্ছে।’ প্রায় আট বছর ধরে চর জুবলী ইউনিয়নে থাকছেন বাবুল চৌধুরী নামের একজন। ৩০শে ডিসেম্বর গণধর্ষণের ঘটনার পর প্রথম ওই নারীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তিনি। মানবজমিনকে বলেন, সুবর্ণচর ও চর জুবলী ইউনিয়নজুড়েই প্রতিহিংসার রাজনীতি। এখানে শিক্ষার হারও কম।
বেশিরভাগ পুরুষ বছরের প্রায় ছয় মাস কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে ইট ভাটায় কাজ করে। আর যারা সুবর্ণচরে থাকে তারাও শ্রমিক না হয় কৃষিকাজ করে। পুরুষরা ছয় মাস বাড়িতে না থাকার সুযোগ নেয় রুহুল আমিন ও তার চৌধুরী বাহিনীর সদস্যরা। দুর্বল শ্রেণির এসব মানুষকে দিন দিন শুষে খাচ্ছে এখানকার চক্রটি। আমরা মাঝে মাঝে কেউ প্রতিবাদ করলেও ভয়ে পিছিয়ে যাই। সন্ত্রাসীদের কাছে আধুনিক অস্ত্র না থাকলেও লাঠিসোটা, কিরিচ ও বল্লমের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। কারও উপর নির্যাতন করলেও অন্য কেউ এগিয়ে আসে না। কেউ ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না। কোন পরিবারই চায় না তার নিজের ক্ষতি হোক। কিন্তু দিনশেষে প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
চর জব্বর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মো. মানিক রতন বলেন, এখানকার প্রতিনিধিরা একেবারে নিম্ন পর্যায় থেকে উঠে আসেন। রাজনীতিতে কোন ভালো মানুষের জায়গা নেই। শ্রমিকরা এখন মানুষের বিচার আচার করছেন। ব্রিকফিল্ডে কাজ করেন সাদ্দাম হোসেন, এমডি বেলাল হোসেন, কবির ও ইসমাইল। তারাও অভিযোগ করেন বাড়িতে না থাকায় তাদের পরিবার ও স্বজনদের নানা সময়ে হয়রানি নির্যাতন করেছে চক্রটি।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণচর শিক্ষার্থী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামশেদ উদ্দিন বলেন, এখানকার বাসিন্দা হিসেবে আমাদের জন্য এটা অন্তত দুঃখের। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নব্য রাজনীতিবিদদের দাপটে সুবর্ণচর আবারো অশান্ত হয়ে উঠছে। জামশেদ উদ্দিনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও চর জুবলী ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সিদ্দিক উল্ল্যাহ বলেন, আমরাও এক সময় রাজনীতি করেছি। অথচ আমার একখান ঘরও নাই। অথচ রুহুল আমিন এক মেয়াদে ইউপি সদস্য হয়েই কোটিপতি বনে গেছে। এসব মানুষের নির্যাতন আর হয়রানি আর কামানো টাকা। আল্লাহর কাছে বিচার দেয়া ছাড়া আমগো আর কিছুই করনের নাই।
রুহুল আমিনের কথিত বাগানবাড়িতে গিয়ে সাবেক ইউপি সদস্য সিদ্দিক উল্লাহর কথার সত্যতা পাওয়া যায়। স্থানীয় চির খালের পাড়ে কয়েক একর জায়গায় বিশাল বাড়ি, সামনে পুকুর। খালের ওপরে সরকারি তহবিলের টাকায় বানানো হয়েছে বিশাল সেতু। বাড়ির সামনে দিয়ে চওড়া রাস্তা ও ভেতরের দালান গাজীপুরের বিভিন্ন বাগানবাড়ির কথাই মনে করিয়ে দেয়। পথে দেখা হওয়া একজন বাসিন্দা বলেন, ক্ষমতার দাপটে কাউকে পরোয়া করতো না রুহুল আমিন। তার দীর্ঘশ্বাস বলে দেয় বাগানবাড়িকে ঘিরে আছে সুবর্ণচর ও চরজুবলীর হাজারো মানুষের দুঃখ।
গত কয়েক বছরে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সুবর্ণচর এলাকা থেকে ফৌজদারী মামলাও দায়ের হচ্ছে তুলনামূলক বেশি। এক সময়ের শান্ত-নিরিবিলি জনপদ কেন হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠলো? গত দুই দিন ধরে সুবর্ণচরের কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নেপথ্যে কাহিনী।
স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহলের দাপটে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন গ্রামের মানুষজন। নির্যাতন, হয়রানি ও লুটপাটের শিকার হয়েও মুখ খুলছেন না অনেকে। স্থানীয়দের নিজেদের নিয়মে করা শালিস ও বিচারেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষকে। থানা-পুলিশ ও আদালতে যাওয়ার ব্যাপারেও ভীতি আছে নির্যাতন-হয়রানির শিকার পরিবারগুলোতে।
গত বুধবার সুবর্ণচরের চর জুবলী ইউনিয়নের অন্তত বিশটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য। গত ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন রাতে এক নারীকে তার স্বামী ও ছয় সন্তানের সামনে গণধর্ষণ করে স্থানীয় কয়েকজন। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করলেও বাকি পাঁচ অভিযুক্ত আসামি হানিফ, চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন, মিন্টু ও সোহেলকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ। স্থানীয় চর জব্বার থানা পুলিশ ও ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের সহায়তায় আসামিরা অধরা বলে অভিযোগ ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের।
পাঁচ আসামির মধ্যে হানিফ স্থানীয় চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও গ্রেপ্তার রুহুল আমিনের আত্মীয়। তার দোকানে বসেই এমন সংঘদ্ধ অপরাধের চক্রান্ত হয় বলে ভাষ্য আশেপাশের মানুষদের। এছাড়া আরেক আসামি চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে বনদস্যু ও জলদস্যু ছিল এমন কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব ক্যাডার গ্রুপ চৌধুরী বাহিনী। মামলার বাকি তিন আসামি মোশাররফ হোসেন, মিন্টু ও সোহেল চৌধুরী এই বিশেষ বাহিনীতে কাজ করে বলে জানান নির্যাতনের শিকার ওই নারী। মোটরসাইকেল ও দেশীয় নানা অস্ত্র দিয়ে মহড়া দেয় এই বাহিনী। তাদের দাপটে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকতে হয় স্থানীয় মানুষদের। আর ৩০শে ডিসেম্বর গণধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ও সাবেক ইউপি সদস্য রুহুল আমিন এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও মানবজমিনকে জানান অন্তত দশটি পরিবারের সদস্যরা।
গণধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার থাকলেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে বলেও স্থানীয়দের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে রুহুল আমিনের পরিবার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। নিজেদের ভিটেমাটিতে থাকতে এখন ভয় পাচ্ছেন অনেকে। গণধর্ষণের শিকার ওই নারী ও স্বামী গতকাল চট্টগ্রাম থেকে মুঠোফোনে মানবজমিনকে জানান, মামলার পর থেকে আমাদের নানা রকমের হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলায় শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না বলেও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
রুহুল আমিন জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা। নির্যাতনের শিকার নারীর বাড়ির আশেপাশের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, হেন কোন অপকর্ম নেই রুহুল আমিন ও তার নিয়ন্ত্রণে থাকা চৌধুরী বাহিনীর সদস্যরা করে না। রুহুল আমিন মাঝি নামে স্থানীয় একজন জানান, এই বাহিনীর ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে হয় আমাদের। আমি নিজেও কয়েকবার তাদের নির্যাতন-হয়রানির শিকার হয়েছি। এখন কথা বলতেও ভয় পাই।
স্থানীয় একজন নারী জানান ৩০ ডিসেম্বর গণর্ধষণের ঘটনার পরদিনও ইসমাইল নামে এক যুবককে বেদম নির্যাতন করে রুহুল আমিন ও তার বাহিনীর সদস্যরা। ইসমাইলকে উদোম করে রুহুল আমিনের আত্মীয় ও মামলার আসামি হানিফের দোকানে নিয়ে প্রকাশ্যে বেঁধে রাখা হয়। ইসমাইলকে মারধরের পর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও তারা এ বিষয়ে কারো কাছে মুখ খোলেনি। ধর্ষণের শিকার নারী ওই যুবককে হাসপাতালে দেখেছেন বলেও মানবজমিনকে জানান।
স্থানীয় এনজিও কর্মী মুন্নি জানান, ৩০শে ডিসেম্বরের গণধর্ষণ শুধু নয় রুহুল আমিনের হাতে এমন অন্তত আরো অর্ধশত নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। তবে অনেকেই ভয়ে মুখ খুলছে না। নিজে নির্যাতিত হলেও অনেকে কখনো থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হয়নি। স্থানীয় নারীরা রুহুল আমিনের কুনজরের শিকার হলে তাদের বিশাল বাগানবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো বলেও জানান মুন্নি। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ২০১০ সালের দিকেও এমন ছিলো না রুহুল আমিন। এর আগে কোর্ট মোহরার ও ব্রিকফিল্ডে কাজ করলেও ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে চর জুবলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার দাপট বেড়ে যায়। চর জুবলীতে শুরু হয় রুহুল আমিনের রাজত্ব। মানুষের জমি দখল, শালিসের নামে টাকা নেয়া, সকালে বিয়ে বিকালে ডিভোর্সের আদেশ, গাছ কেটে নেয়া, জমির ফসল জোর করে কেড়ে নেয়ার মতো নানা অপকর্ম করতো তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এলাকায় রুহুল আমিনই ছিলো বিচারক। তার আদেশই ছিলো শিরোধার্য। অনেক পরিবারের জমিজমার মীমাংসা করে দেবে বলে তাদের থেকে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
এসব ভুক্তভোগী পরিবার এখন ধীরে ধীরে এসব বিষয় সামনে আনতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালে এরকম এক সালিসে ছোট্ট একটি বাছুর চুরির অভিযোগে স্থানীয় চারজনের দশ লাখ টাকা জরিমানা করে রুহুল আমিন। ঘটনার সময় ওমানে থাকলেও ফাঁসানো হয় নূরনবী নামে এক প্রবাসীকে। জহির, রাশেদ ও মনি ঘটনায় জড়িত না থাকলেও দিতে হয় জরিমানা। চার জনে মিলে সেই সালিশে প্রায় ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা দেন। যার সিংহভাগই নিজের পকেটে ভরে নেন রুহুল আমিন। নানা সময় রুহুলের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে মুন্নি নামে ওই এনজিওকর্মীকে মাদকের মামলায় ফাঁসানোরও হুমকি দেয় সে। জাতীয় নির্বাচনের পর মুন্নিকে জবাই করে হত্যার হুমকি দেয় বলেও মানবজমিনকে অভিযোগ করেন এই নারী। এছাড়া নির্বাচনের পর ১১টি পরিবারকে দেখে নেয়ার জন্য পরিকল্পনাও করা হয় বলে অভিযোগ করেন ষাটোর্ধ্ব মীনা বেগম। স্বামী ও ছেলে সন্তান না থাকায় চার মেয়েকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে থাকতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, ‘কোনখানে যাওনের জায়গা নাই। থাকলে কবেই চইল্যা যাইতাম। মাঝে মাঝে মনে লয় আমরা মনে হয় রোহিঙ্গা, বার্মার মতো এখানে আমাদের নির্যাতন করা হচ্ছে।’ প্রায় আট বছর ধরে চর জুবলী ইউনিয়নে থাকছেন বাবুল চৌধুরী নামের একজন। ৩০শে ডিসেম্বর গণধর্ষণের ঘটনার পর প্রথম ওই নারীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তিনি। মানবজমিনকে বলেন, সুবর্ণচর ও চর জুবলী ইউনিয়নজুড়েই প্রতিহিংসার রাজনীতি। এখানে শিক্ষার হারও কম।
বেশিরভাগ পুরুষ বছরের প্রায় ছয় মাস কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে ইট ভাটায় কাজ করে। আর যারা সুবর্ণচরে থাকে তারাও শ্রমিক না হয় কৃষিকাজ করে। পুরুষরা ছয় মাস বাড়িতে না থাকার সুযোগ নেয় রুহুল আমিন ও তার চৌধুরী বাহিনীর সদস্যরা। দুর্বল শ্রেণির এসব মানুষকে দিন দিন শুষে খাচ্ছে এখানকার চক্রটি। আমরা মাঝে মাঝে কেউ প্রতিবাদ করলেও ভয়ে পিছিয়ে যাই। সন্ত্রাসীদের কাছে আধুনিক অস্ত্র না থাকলেও লাঠিসোটা, কিরিচ ও বল্লমের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। কারও উপর নির্যাতন করলেও অন্য কেউ এগিয়ে আসে না। কেউ ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না। কোন পরিবারই চায় না তার নিজের ক্ষতি হোক। কিন্তু দিনশেষে প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
চর জব্বর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মো. মানিক রতন বলেন, এখানকার প্রতিনিধিরা একেবারে নিম্ন পর্যায় থেকে উঠে আসেন। রাজনীতিতে কোন ভালো মানুষের জায়গা নেই। শ্রমিকরা এখন মানুষের বিচার আচার করছেন। ব্রিকফিল্ডে কাজ করেন সাদ্দাম হোসেন, এমডি বেলাল হোসেন, কবির ও ইসমাইল। তারাও অভিযোগ করেন বাড়িতে না থাকায় তাদের পরিবার ও স্বজনদের নানা সময়ে হয়রানি নির্যাতন করেছে চক্রটি।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণচর শিক্ষার্থী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামশেদ উদ্দিন বলেন, এখানকার বাসিন্দা হিসেবে আমাদের জন্য এটা অন্তত দুঃখের। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নব্য রাজনীতিবিদদের দাপটে সুবর্ণচর আবারো অশান্ত হয়ে উঠছে। জামশেদ উদ্দিনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও চর জুবলী ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সিদ্দিক উল্ল্যাহ বলেন, আমরাও এক সময় রাজনীতি করেছি। অথচ আমার একখান ঘরও নাই। অথচ রুহুল আমিন এক মেয়াদে ইউপি সদস্য হয়েই কোটিপতি বনে গেছে। এসব মানুষের নির্যাতন আর হয়রানি আর কামানো টাকা। আল্লাহর কাছে বিচার দেয়া ছাড়া আমগো আর কিছুই করনের নাই।
রুহুল আমিনের কথিত বাগানবাড়িতে গিয়ে সাবেক ইউপি সদস্য সিদ্দিক উল্লাহর কথার সত্যতা পাওয়া যায়। স্থানীয় চির খালের পাড়ে কয়েক একর জায়গায় বিশাল বাড়ি, সামনে পুকুর। খালের ওপরে সরকারি তহবিলের টাকায় বানানো হয়েছে বিশাল সেতু। বাড়ির সামনে দিয়ে চওড়া রাস্তা ও ভেতরের দালান গাজীপুরের বিভিন্ন বাগানবাড়ির কথাই মনে করিয়ে দেয়। পথে দেখা হওয়া একজন বাসিন্দা বলেন, ক্ষমতার দাপটে কাউকে পরোয়া করতো না রুহুল আমিন। তার দীর্ঘশ্বাস বলে দেয় বাগানবাড়িকে ঘিরে আছে সুবর্ণচর ও চরজুবলীর হাজারো মানুষের দুঃখ।
No comments