ভারতে যুবরাজ সালমানঃ যুদ্ধ এড়াতে মোদির হাতে বিকল্প কী?

পুলওয়ামা হামলার পরে ভারত এখন ক্ষোভে উত্তাল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর চাপ বাড়ছে। জনগণ থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের দাবি, ‘পাকিস্তানকে যুদ্ধের মাধ্যমে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’
তবে মোদি যুদ্ধে যাবেন না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এর বড় কারণ, দুটি দেশেরই পরমাণু অস্ত্রের বিশাল মজুত রয়েছে। যুদ্ধ থেকে একটি ‘পারমাণবিক ভুল সিদ্ধান্ত’ এই অঞ্চলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, এটি সবাই জানে। ফলে যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেওয়ার মোদির হাতে কী কী বিকল্প আছে, সেটি নিয়ে চলছে এখন বিচার–বিশ্লেষণ।
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক প্রায় তিন বছর ধরে জমে বরফ হয়ে আছে। অথচ মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছর পর্যন্ত সম্পর্কে বরফ গলার আভাসই মিলেছিল। মোদি তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বছর গড়াতেই আকস্মিক সফরে গিয়েছিলেন লাহোরে। কিন্তু লাহোরে মোদি–নওয়াজের শান্তি আলোচনার দিন কয়েক পরই পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ছয় সেনাকে হত্যা করে জেইএম।
একে একে অনেক ঘটনার পর ২০১৬ সালের জুলাইয়ে দিল্লির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ে। পুলওয়ামায় হামলার পর ভারত এখন কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে চাচ্ছে।
ভারত ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানকে বাণিজ্যসুবিধা দিতে মোস্ট ফেভারড নেশন (এমএফএন) হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পুলওয়ামায় হামলার পর সেটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে তারা। পাকিস্তানের পণ্যের ওপর আরোপ করেছে ২০০ শতাংশ শুল্ক। ক্রিকেট ভারত ২০০৭ সাল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলে না। এতে পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ড অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে।
১৯৬০ সালের সিন্ধুর পানি চুক্তি বাতিল করার দাবি উঠেছে ভারতে। এটি করলে অবশ্য চড়া মূল্য দিতে হবে ভারতকে। প্রতিবেশী চীন, নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে। ওই চুক্তির আওতায় তারাও রয়েছে। ভারত পাকিস্তানকে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের কালো তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ওই তালিকায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া রয়েছে।
ভারতে যুবরাজ সালমান: ‘সন্ত্রাসবাদই ভারত-সৌদির বড় দুশ্চিন্তা’
পুলওয়ামা প্রসঙ্গ উচ্চারণ করলেন না, সন্ত্রাস প্রসঙ্গে পাকিস্তানের নামও নিলেন না। কিন্তু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জানালেন, সন্ত্রাসবাদই ভারত ও সৌদি আরবের বড় দুশ্চিন্তা। এই দুশ্চিন্তা দূর করতে ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সৌদি আরব সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে তথ্যের আদান-প্রদানও করবে।
ভারত সফরে এসে বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ বিন সালমান এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের পৃথিবীকে নিরাপদ করতে এই সহযোগিতা জরুরি। যেসব দেশ সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার করছে, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে।
ভারতে আসার আগে দুই দিনের সফরে সৌদি যুবরাজ পাকিস্তান গিয়েছিলেন। সেই সফরের ঠিক আগেই ঘটে যায় কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদী হামলা। মারা যান ৪৯ জন ভারতীয় আধা সামরিক নিরাপত্তারক্ষী। পাকিস্তানে ২০ বিলিয়ন ডলারের লগ্নির কথা ঘোষণা করে দেশে ফিরে সৌদি যুবরাজ গতকাল মঙ্গলবার রাতে ভারতে আসেন। এই সফরে তিনি পুলওয়ামা-কাণ্ড ও সন্ত্রাস প্রসঙ্গে পাকিস্তানের নাম নেন কি না, সেই আগ্রহ দানা বেঁধেছিল। সৌদি যুবরাজ দুটি ক্ষেত্রেই নীরব থাকলেন।
তবে সৌদি অতিথিকে পাশে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পুলওয়ামা-কাণ্ডের অবতারণা করেন। বলেন, ‘পুলওয়ামায় নারকীয় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এই বিপদের আরও একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। এর মোকাবিলায় আমরা দুই দেশই একমত। সন্ত্রাসবাদের চরিত্র যেমনই হোক, তাকে কোনোভাবেই মদদ দেওয়া উচিত নয়। যারা সন্ত্রাসীদের সমর্থক, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা দরকার। সন্ত্রাসীদের অবকাঠামো ধ্বংস করা ও তার সমর্থকদের শাস্তি দেওয়া অতি প্রয়োজনীয়, যাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাতে অস্ত্র তুলে না নেয়।’ মোদি আরও বলেন, ‘আমি খুশি, এই বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সৌদি আরব একমত।’
সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু দেশ পাকিস্তান। তবু ভারতে এসে সৌদি যুবরাজ বলেন, আরব দেশসমূহের ‘ডিএনএ’-তেই আছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্ক কতটা গভীর ও আন্তরিক তা বোঝাতে গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রটোকল ভেঙে নরেন্দ্র মোদি দিল্লি বিমানবন্দরে যান মোহাম্মদ বিন সালমানকে স্বাগত জানাতে। ৩৩ বছর বয়সী অতিথিকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন।
অবশ্য পাকিস্তানে বসবাসকারী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের নেতা মাসুদ আজহারকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জঙ্গি তালিকাভুক্ত করার প্রচেষ্টায় সৌদি সমর্থন ভারত আদায় করতে পারেনি। বরং দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টির ‘রাজনীতিকরণ এড়ানোর’ প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
মাসুদ আজহারকে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার চেষ্টায় বারবার বাধা দিচ্ছে চীন। বিপক্ষে সৌদি আরবও। ভারত তবুও হাল ছাড়েনি। ফ্রান্স এই বিষয়ে জাতিসংঘে নতুন করে প্রস্তাব আনার কথা জানিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সেই উদ্যোগকে সমর্থন করছে।
এই সফরে ভারত ও সৌদি আরবের মধ্যে লগ্নি, পর্যটন, গৃহনির্মাণ ও তথ্য-সম্প্রচার ক্ষেত্রে পাঁচটি অনুচুক্তি ও বোঝাপড়া সই হয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও সহযোগিতা বাড়াতে একমত হয়েছে দুই দেশ। ভারত-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী বছর ৩ হাজার কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বহরের নিরিখে সৌদি আরব চতুর্থ বৃহৎ দেশ।

No comments

Powered by Blogger.