সন্ত্রাসী ও অপরাধীর মধ্যে পার্থক্য কী?
পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক মিল আছে। তাঁরা উভয়ই মানবীয় ভুলের শিকার হন। তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক যেন অনেকটা মূল গাছ ও পরজীবী উদ্ভিদের সম্পর্কের মতো। আর আমি মনে করি, এটা একরকম স্বাভাবিক যে অপরাধের ব্যাপারে তাঁদের উভয়ের অবস্থানও এক। কয়েক বছর ধরে দেখছি, অপরাধ দুই ধরনের হয়, একটি সাধারণ অপরাধ, আরেকটি ‘সন্ত্রাসী অপরাধ’। ধরুন, কোনো বন্দুকধারী যদি হঠাৎ করে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলে, তাহলে সেটা সাধারণ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আর ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হচ্ছে সেই প্রকৃতির হামলা, যেখানে হামলাকারীদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষুব্ধ ও কোনো ধর্মের দলছুট গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকতে হয়। সন্ত্রাসী অপরাধীদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, তাদের নিপীড়ক, অসুস্থ বা কোনো ‘মৃত প্রথার’ মধ্যযুগীয় সদস্য হতে হয়। এটা বলার প্রয়োজন নেই যে এই দ্বিতীয় প্রকৃতির মানুষেরা ‘ঘরেই বেড়ে ওঠা চরমপন্থী’, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শক্তি হস্তক্ষেপ করেছে বলে যারা যেকোনো ধর্মের মানুষকে কতল করতে প্রস্তুত। বাস্তবে এই বিভাজনের কারণে মনে হয়, ‘সাধারণ’ অপরাধ একরকম স্বাভাবিক ব্যাপার, মানুষ পয়সা, লোভ, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও মাদকের কারণে মানুষকে হত্যা করে। কিন্তু ‘সন্ত্রাসী’ অপরাধের মাজেজা হচ্ছে, মুসলমানরা সব সময় অপরাধী। অন্য কথায়, অপরাধীরা তো আমাদের ভাই-ব্রাদার, যেখানে সন্ত্রাসীরা হচ্ছে অশ্বেতাঙ্গ মুসলমান, যারা আমাদের মূল্যবোধ ঘৃণা করে, ওরা আমাদের মাথা কাটতে চায়, যারা দৃশ্যতই পাগলাটে। ক্যালিফোর্নিয়াতে ১৪ জন নিরপরাধ মার্কিনকে হত্যা করার পর আমরা এই অর্থহীন ধারণার নড়বড়ে প্রকৃতিটা দেখলাম। প্রথমত, মার্কিন পুলিশ বলল যে তারা জানে না, এটা ‘সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত’ অপরাধ কি না। তারা এটার নাম দিল গণ-গুলিবর্ষণ। বিভিন্ন তরফ থেকে আমাদের বলা হলো,
এই হত্যাকাণ্ডটি একটি বাদবিসংবাদের ফল হিসেবে ঘটেছে। বন্দুকধারী এই ১৪ জন খুন হওয়া মানুষের একজনের হাতে নিগৃহীত হয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এরপর দেখা গেল, নামে তিনি মুসলমান, আর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাড়িতে এক অস্ত্রভান্ডারও গড়ে তুলেছিলেন। আর দৃশ্যত তিনি আইএসের প্রতি ‘আনুগত্যও’ প্রদর্শন করেছেন। এই গণ-গুলিবর্ষণের ঘটনা তখন ‘সন্ত্রাসী কাণ্ডের’ আখ্যা পেল। এই নতুন সংজ্ঞাকে আরও বিভ্রান্ত করে দিতে পুলিশ বলল, তারা বিশ্বাস করে না যে এই দম্পতির সঙ্গে আইএসের কোনো যোগাযোগ আছে, যদিও গোষ্ঠীটি সেই দায় স্বীকার করেছে। এরপর দেখা গেল, এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছর আগে ‘চরমপন্থায়’ দীক্ষিত হয়েছিল, মাফিয়াদের বেলায় যেটা ঘটে না। কয়েক সপ্তাহ আগে লন্ডনের টিউব স্টেশনে যে ছুরিকাঘাতের ঘটনা সংঘটিত হলো, তখন যে কথা বলা হলো তা-ও একইভাবে বিভ্রান্তিকর। প্রথমত, পুলিশ লেটনস্টোনে একটি ‘ছুরিকাঘাতের ঘটনার’ তদন্ত করছিল, কিন্তু তারা যখন একটি ভিডিওতে শুনতে পেল যে একজন মানুষ জোরে জোরে বলছে, ‘এটা সিরিয়ার জন্য’ এবং একজন বেসামরিক নাগরিক বলছেন, ‘ভাই, তুমি মুসলমানও নও’, তখন পুলিশ বলে বসল, এটা ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’। এরপর একজন মানুষের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এসবই কিছুটা উদ্ভট ব্যাপার। সেই ১৯৮০-এর দশকে যখন ব্রিটিশ সেনা ও আইআরএ উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রাণপণ যুদ্ধ করছিল, তখন যুক্তরাজ্য সরকার আইআরএকে অপরাধী, মারাত্মক সন্ত্রাসী, বেপরোয়া সন্ত্রাসী ও এমনকি সন্ত্রাসী অপরাধী হিসেবে আখ্যা দিতে তৎপর ছিল। কিন্তু সর্বোপরি সাধারণ অপরাধীদের তো আইনের মুখোমুখি করে বহু বছরের জন্য জেলে পুরতে হবে, সে তাদের সহিংস প্রচারণার কারণ যা-ই হোক না কেন। তখন আইআরএ সিদ্ধান্ত নিল, তারা নিজেদের ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসেবে আখ্যা দেবে, যেটা কিনা ‘সন্ত্রাসীর’ ভদ্রোচিত রূপ। কারণ, তারা চেয়েছিল নিজেদের ডাকাতি, খুন, ভীতি প্রদর্শন—প্রভৃতি অপরাধ সাধারণ অপরাধের বাইরে ‘রাজনৈতিক অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাক। আইআরএ ‘রাজনৈতিক’ মর্যাদা লাভ করতে এতটা উৎসাহী ছিল যে তারা আমরণ অনশন শুরু করে। কিন্তু থ্যাচারের শীতল মনোভাবের কারণে তাদের ১০ জন সহযোদ্ধা মারা যায়। কিন্তু তখন ব্রিটিশ সরকার আইআরএর প্রায় সব দাবিই মেনে নেয়। ফলে আইআরএর বন্দীরা ‘রাজনৈতিক’ তকমা পেয়ে যায়, আর যখন ‘শান্তি’ ঘোষিত হলো, তারা তখন বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলো। তবে খুনি ও অসৎ মানুষেরা রানির আতিথ্যেই থাকল।
তাহলে ‘সন্ত্রাসী’ বা সাধারণ অপরাধী হলে কি কোনো লাভ আছে? আমার মনে হয়, এটা নির্ভর করে আপনার জীবনের মূল্য কতটা। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আইএস যোদ্ধা রেয়াদ খান ও রুহুল আমিন যে ড্রোন হামলায় নিহত হলেন, তাঁদের যে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তা মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড, যেটা ডেভিড ক্যামেরনের মতে, ‘যুক্তরাজ্যের ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ও যথাযথ’ ছিল। তাঁরা ব্রিটেনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। অন্য কথায় বললে, ডেভ তো আর লেস্টারে স্কুলছাত্রদের খুনিকে মারার জন্য ড্রোন হামলার আদেশ দিতেন না, বা লন্ডনের পূর্বাঞ্চলের কাউকে মারার জন্য তিনি হামলার নির্দেশ দিতেন না, এমনকি তাঁরা যদি ব্রিটেনে হামলার পরিকল্পনা করেও থাকেন। তারপরও এই অপরাধী/সন্ত্রাসী দ্বি-বিভাজন চলছেই। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরোধীরা সর্বশেষ দাবি করেছেন, বাশার আইএসের চেয়েও বড় সন্ত্রাসী। কারণ, তিনি এই ইসলামি গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছেন (চ্যানেল ফোর–এর ভাষ্য অনুসারে, আইএসের চেয়ে ছয় গুণ বেশি মানুষ)। এতে বোঝা যায়, আপনার হাতে কত মানুষ মরল, তার সংখ্যা দিয়েই নির্ধারণ করা হবে আপনি সন্ত্রাসী নাকি অপরাধী। অথবা এর মাজেজা এ রকম হতে পারে যেকোনো ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীর খুনের আকাঙ্ক্ষা যদি ‘পরিমিত’ হয়, তাহলে তারা অত ভয়ংকর নয়, যাদের বন্দুকের নলে বেশি খাঁজ আছে, তাদের তুলনায়। কিন্তু পাঠক, ক্ষণিকের জন্য দাঁড়ান। বাশারের বিরোধীদের কথার যৌক্তিক সারসংক্ষেপ দাঁড় করালে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে বুশ ও ব্লেয়ার আইএস ও বাশারের চেয়ে বেশি বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছেন। ২০০৩ সালে অবৈধভাবে ইরাক আগ্রাসন করে তাঁরা এ কাজ করেছেন। তাহলে বুশ ও ব্লেয়ারকে কি অতি-সন্ত্রাসী আখ্যা দেবেন, নাকি শুধু অপরাধী হিসেবে? যদিও তাঁরা যুদ্ধাপরাধী হিসেবেও আখ্যায়িত হতে পারেন, যাঁদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে তোলা যেতে পারে। তাঁরা কিন্তু ড্রোন হামলার আশঙ্কা থেকে একেবারেই মুক্ত, আর তাঁদের কখনোই ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া হবে না।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
তাহলে ‘সন্ত্রাসী’ বা সাধারণ অপরাধী হলে কি কোনো লাভ আছে? আমার মনে হয়, এটা নির্ভর করে আপনার জীবনের মূল্য কতটা। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আইএস যোদ্ধা রেয়াদ খান ও রুহুল আমিন যে ড্রোন হামলায় নিহত হলেন, তাঁদের যে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তা মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড, যেটা ডেভিড ক্যামেরনের মতে, ‘যুক্তরাজ্যের ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ও যথাযথ’ ছিল। তাঁরা ব্রিটেনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। অন্য কথায় বললে, ডেভ তো আর লেস্টারে স্কুলছাত্রদের খুনিকে মারার জন্য ড্রোন হামলার আদেশ দিতেন না, বা লন্ডনের পূর্বাঞ্চলের কাউকে মারার জন্য তিনি হামলার নির্দেশ দিতেন না, এমনকি তাঁরা যদি ব্রিটেনে হামলার পরিকল্পনা করেও থাকেন। তারপরও এই অপরাধী/সন্ত্রাসী দ্বি-বিভাজন চলছেই। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরোধীরা সর্বশেষ দাবি করেছেন, বাশার আইএসের চেয়েও বড় সন্ত্রাসী। কারণ, তিনি এই ইসলামি গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছেন (চ্যানেল ফোর–এর ভাষ্য অনুসারে, আইএসের চেয়ে ছয় গুণ বেশি মানুষ)। এতে বোঝা যায়, আপনার হাতে কত মানুষ মরল, তার সংখ্যা দিয়েই নির্ধারণ করা হবে আপনি সন্ত্রাসী নাকি অপরাধী। অথবা এর মাজেজা এ রকম হতে পারে যেকোনো ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীর খুনের আকাঙ্ক্ষা যদি ‘পরিমিত’ হয়, তাহলে তারা অত ভয়ংকর নয়, যাদের বন্দুকের নলে বেশি খাঁজ আছে, তাদের তুলনায়। কিন্তু পাঠক, ক্ষণিকের জন্য দাঁড়ান। বাশারের বিরোধীদের কথার যৌক্তিক সারসংক্ষেপ দাঁড় করালে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে বুশ ও ব্লেয়ার আইএস ও বাশারের চেয়ে বেশি বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছেন। ২০০৩ সালে অবৈধভাবে ইরাক আগ্রাসন করে তাঁরা এ কাজ করেছেন। তাহলে বুশ ও ব্লেয়ারকে কি অতি-সন্ত্রাসী আখ্যা দেবেন, নাকি শুধু অপরাধী হিসেবে? যদিও তাঁরা যুদ্ধাপরাধী হিসেবেও আখ্যায়িত হতে পারেন, যাঁদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে তোলা যেতে পারে। তাঁরা কিন্তু ড্রোন হামলার আশঙ্কা থেকে একেবারেই মুক্ত, আর তাঁদের কখনোই ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া হবে না।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments