এক যে ছিল ফেসবুক by পিয়াস মজিদ
শায়লা আর রিমনের কথা হতো ফেসবুকে। এতটাই হতো যে আগেকার দিনে হলে এতবার প্রত্যক্ষ দেখাসাক্ষাৎ করে করে হয়তো কুলিয়েও উঠতে পারত না তারা। ফেসবুকে পরিচিত হয়ে নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগা চ্যাটে কয়েক সপ্তাহ শেয়ার করতে করতে তাদের অবস্থা এমন যে এর মধ্যে কেউ কারও ফোন নম্বরটা নিতেও ভুলে গিয়েছিল। এই ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগটা ‘প্রেম’ নামক পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল হয়তো। জাকারবার্গ মহাশয় তাঁর ফেসবুক-কেরামতির দ্বারা শায়লা আর রিমনের দ্বিধাথরথর চূড়াকে যেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার মতোই সাতটি অমরাবতীতে প্রায় ভর করিয়েই ফেলেছিল। বেঁচে থাকুন মার্ক জাকারবার্গ, বেঁচে রহো ফেসবুক। এদিকে যেদিন ওরা দুজনেই ভাবছে কথাকে দেখায় রূপ দেবে, সেদিনই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল ফেসবুক! দুজনের কারও কাছেই কারোর মোবাইল নম্বর নেই যে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এমন নয় যে সম্ভাব্য প্রেমটা চিরতরে মুছে গেল। কিন্তু যেখানে এক মিনিটও শায়লা আর রিমন চ্যাটে কথা না বলে থাকতে পারত না, সেখানে অবশ্যই একটা ফেসবুকজনিত শূন্যতা তৈরি হলো। ফেসবুক নিশ্চয়ই আবার চালু হবে। ততক্ষণে শায়লা আর রিমনের মনে দুজনের জন্য তৈরি হলো আকুলিবিকুলি। এত দিন যেন এই অনুভূতিটাই গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু মুহুর্মুহু এফবি ম্যাসেজ বিনিময় হওয়ায় সেই সুযোগ ছিল না। যাক, তবে ফেসবুক সামান্য বন্ধের কল্যাণে শায়লা আর রিমনের দেখা হওয়ার আগে একটা বাঞ্ছিত নীরবতার অবকাশ তো পাওয়া গেল। তারা তাদের প্রেমের প্রস্তুতিতে থাকার সুযোগে ফেসবুকও একটু বিশ্রাম নিয়ে নিল যেন।
দুই. বন্ধুমহলে শর্মির নাম ‘সেলফিশর্মি’। অফিশিয়াল কিংবা পারিবারিক যে অনুষ্ঠানই হোক, সবার আগে তার সেলফি তোলা চাই। কদিন আগে বন্ধুরা মিলে কক্সবাজারে গেল ঘুরতে। ইরা, পিঙ্কি, মেঘলা—সবাই ঝিনুক কুড়াচ্ছিল সাগরবেলায়। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই সমুদ্রের নানা বিভঙ্গে নিজেকে বন্দী করতে ব্যস্ত আমাদের শর্মি। ঢেউভীতি আছে তার। হঠাৎ এক জোর-ঢেউয়ের ধাক্কায় তাল না রাখতে পেরে কদিন আগে কেনা দামি মোবাইলটির সলিলসমাধি ঘটাল সে। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ লক্ষ করা গেল না; বরং মোবাইলটির ডুবে-ভেসে ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার দৃশ্যের সঙ্গে পারলে সে যেন একটা সেলফি তুলতে চায়—এমন অবস্থা। এহেন শর্মি এই হালকা শীতের প্রথম ভাগে অফিসের পিকনিকে এসে সম্পূর্ণ আশাহত। না না, আয়োজনের কোনো ঘাটতি বা অন্য কিছু নয়। হঠাৎ ফেসবুক বন্ধ হওয়ায় সে কোনো সেলফিই আপলোড দিতে পারছিল না। ঢাকা থেকে তারা যাচ্ছে সোনারগাঁ। অন্যদিন হলে বাসে উঠতে গিয়ে সেলফি দিত এফবিতে। বাসের সদ্য পাওয়া সিটটার সঙ্গে তাকে কেমন মানিয়েছে, সেটাও জানান দিত তার সাম্প্রতিকতম ছবি। বাসে বসে নাশতা খাওয়ার বাহারি ছবি, বাস থেকে নেমে পানামনগরের দালানকোঠা কিংবা লোকশিল্প জাদুঘরের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রহ—কোনো কিছুই বাদ যেত না শর্মির সেলফি-আগ্রাসন থেকে। তবে এর মধ্যেও ছবি সে তুলছে। জমিয়ে রাখছে। ফেসবুক খুললেই অ্যালবাম আকারে সেলফিসমগ্র ঢালা হবে। কিন্তু একটা সিঙ্গেল ছবিকে ঘিরে আলাদাভাবে কোনো আলোচনা হবে না ভেবে ভীষণ বিষণ্ন শর্মি। ছবি তোলার গতিতে তাই আজ কিছুটা ক্ষান্তি দিয়ে শর্মি চারপাশের গাছপালা, নদী-নালা আর ওপরের আকাশটা ভালো করে দেখল। হঠাৎই তার মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কোনো এক ফটোগ্রাফিক সোসাইটির বিজ্ঞাপনে সাঁটা বিনয় মজুমদারের সেই কবিতা—‘আরও কিছু দৃশ্যাবলি দেখেছি জীবিতকালে যারা চিত্রায়িত হতে পারতো’। আজ সেলফি তোলার শ্লথ গতিতে শর্মি হঠাৎ ভাবার সুযোগ পেল, এত সুন্দর সকাল-দুপুরময়, নিসর্গ-মানুষময় পৃথিবীর কতটুকুই আসে সেলফি কিংবা যেকোনো আলোকচিত্রে! সেলফির মোহে পড়ে সে নিজের মনের ক্যামেরাটা এত দিন যেন নিজের অজান্তেই বন্ধ রেখেছিল। আজ ফেসবুক বন্ধ হওয়ার সুবাদে সেটা খোলার সুযোগ পেল যেন। সেলফি কিংবা ফেসবুক তো চলে গিয়েই ফিরে আসবে, কিন্তু এই যে নদীর জলের কাঁপন, পাখির কলতান, বাতাসের নাচন, সৌন্দর্যে ভরা এই মুহূর্তেরা তো আর ফিরে আসবে না। ফেসবুকের ছুটি কাটানোর সুযোগে এক অনন্য অনুভবের মুখোমুখি হয়ে আনশিডিউলি ভালোলাগায় ভরে গেল শর্মির মন।
তিন. স্ট্যাটাস সুমন। স্ট্যাটাস তো অনেকেই দেয় ফেসবুকে। তবে সুমনকে কেন এই বিশেষ বিশেষণে ভূষিত করা? কেউ কেউ আবার সুমনের স্ট্যাটাস দেওয়াকে ব্যঙ্গ করে ওর ওয়ালে লেখে, ‘আমার কোনো স্ট্যাটাস নেই, সুমনের আছে।’ কথাটা শুনে হাসি পেলেও সুমনের নামের আগে ‘স্ট্যাটাস’ শব্দ যোগ হওয়ার একটা বাস্তব ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। সুমনের সকালের আলো ফোটে ফেসবুকের পাতায়। ঘুম থেকে উঠেই সুমনের প্রথম স্ট্যাটাস, ‘শুভ সকাল। জীবনের আরেকটা সকাল তবে শুরু...’
এরপর হয়তো মা নাশতা খেতে ডাকছে। দ্বিতীয় স্ট্যাটাস, ‘যাই, নাশতা খাব—পরোটা, ভাজি, হালুয়া।’ আর ফেসবুক বন্ধুরা একটু ভাগ্যবান হলে প্রভাতি এই স্ট্যাটাসের সঙ্গে নাশতার চেহারা-ছবিও দেখে উঠতে পারেন। একটু পরে মুভি দেখতে শুরু করে সুমন। কিছুক্ষণ দেখার পর তার স্ট্যাটাস, ‘প্রেম কেন বিপন্ন ছবিটা দেখছি। নায়িকার এক্সপ্রেশন ভালো না। নায়কের ডায়ালগ মোটের ওপর। ছবির স্টোরিটা এককথায় বোগাস।’ তার এই স্ট্যাটাস নিয়ে ফিল্মবোদ্ধা বন্ধুরা কিছুক্ষণ বাদানুবাদে ব্যস্ত রইল। হঠাৎ সুমনের মনে হলো, একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এই ইস্যুটাকে। নতুন কিছু দরকার। তাই স্ট্যাটাসে নতুন এক কমেন্ট দিল, ‘এনাফ ইজ এনাফ। এই বিষয়টা এখানেই শেষ হলো।’ কিছুক্ষণ পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হলো। চেক ইন দিল ফেসবুকে, ‘নাউ ইন তরঙ্গ বাস।’ পাবলিক বাসে যাত্রী-কন্ডাক্টর ভাড়া নিয়ে গন্ডগোল, সিটে বসা কিংবা দাঁড়ানো; এইসবের মাঝেই সিট না পাওয়া সুমন স্ট্যাটাস আকারে লিখে ফেলল নগর ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে গিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে কাপযুক্ত সচিত্র স্ট্যাটাস, ‘কফিটা দারুণ ছিল কিন্তু!’
তারপর ক্লাসে বসে নতুন স্ট্যাটাস, ‘টিউটোরিয়াল-ক্লাস টেস্ট-নোট-ল্যাব ইত্যাদি ইত্যাদি...এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়া আমরা কী করিব?’ এবার তার স্ট্যাটাসে হামলে পড়ল শিক্ষানুরাগী বন্ধুবান্ধব। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতি পথে পুরান ঢাকায় গিয়ে নান্নার মোরগ-পোলাও খেতে খেতে যথারীতি মোরগ-পোলাও এবং আনুষঙ্গিক খাবার নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিল। স্ট্যাটাসে জনৈক ভোজনরসিক বন্ধুর কমেন্ট, ‘সুমন, মোরগ-পোলাও যখন খেয়েছিস, তখন বেচারাম দেউড়ি থেকে জনসন রোডে গিয়ে বিউটির ফালুদা খেয়ে আসলে মন্দ হতো না।’ তারপর আবার সুমনের স্ট্যাটাস—নতুন ও পুরান ঢাকার ফালুদার তুলনামূলক পর্যালোচনাবিষয়ক। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক ফালুদার ফলে কী পরিমাণ ফরমালিন থাকে, সে বিষয়ে একটা পরিসংখ্যানও দেওয়া গেল। যা হোক, খানাপিনার পর্ব পেরিয়ে বাসায় গিয়ে একটু ঘুম দিল। ঘুম থেকে জেগেই স্ট্যাটাস-বিরহের অনলে পুড়তে লাগল সুমন। পরমুহূর্তে স্ট্যাটাস, ‘দিবানিদ্রা স্বাস্থ্যের পক্ষে লাভজনক নাকি ক্ষতিকর? বন্ধুরা কী বলেন?’ এই স্ট্যাটাস দিতে দিতে ফোনে কথা হলো শিলুর সঙ্গে, ‘তুমি আছ তোমার স্ট্যাটাস আপডেট নিয়ে। শেষ কবে ঘুরতে বেরিয়েছি মনে পড়ে তোমার?’ শিলুর সঙ্গে আজ কোথাও ঘুরতে যাবে কি না, সেই মীমাংসা হওয়ার আগেই স্ট্যাটাস, ‘প্রেমে শুধু পড়লেই হয় না, প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরতেও বের হতে হয়।’
স্ট্যাটাস দেখে রেগে শিলুর ফোন, ‘তোমার স্ট্যাটাস আমি বের করছি প্রেমিকপ্রবর। তোমার সঙ্গে এই আমার ব্রেকআপ ঘোষণা করলাম।’ বেচারা সুমনের ব্রেকআপ-পরবর্তী আপডেট, ‘প্রেম করলে ব্রেকআপ ডিক্লারেশন শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।’ এই নিয়ে কিছুক্ষণ যুগপৎ প্রেম ও বিরহ-অভিজ্ঞ বন্ধুবান্ধবের কমেন্ট বিনিময় চলল আগের আপডেটে। তারপর শিলুর বিরহ ভুলতে সন্ধ্যায় দলবেঁধে ঘুরতে গেল মিউজিক ফেস্টে। গিয়ে দেশের সমৃদ্ধ সংগীত ভান্ডার নিয়ে স্ট্যাটাস দিল। তারপর এই ফেস্টিভ্যালের ভালোমন্দ নিয়ে নিজের অভিমত যুক্ত করে সংগীতানুরাগী বন্ধুমহলের ব্যাপক প্রশংসা কুড়াল স্ট্যাটাস সুমন। মিউজিক ফেস্ট থেকে রাত করে বাসায় ফিরল। মা বলল, ‘এই তোর আসার সময় হলো? নে, খেয়ে নে।’ সারা দিনের এত কিছুর পর মায়ের অনাবিল স্নেহঝরা মুখ বিষয়ে একটা নৈতিক স্ট্যাটাস দিতে না দিতেই বাবার হুংকার, ‘সুমন, পড়াশোনা কিছু করছিস? নাকি সারা দিন ফেসবুক আর ফেসবুক?’ বাবার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারার দুঃখে নৈশকালীন স্ট্যাটাস, ‘জেনারেশন গ্যাপটা খুব ভয়াবহ। আজকালকার বাবারা বুঝতেই পারে না ছেলের মন।’ যাক, বাবার উত্তর সরাসরি দেওয়া না গেলেও স্ট্যাটাসে তো এক হাত নেওয়া গেল। এরপর ঘুমাতে গিয়ে মশার কামড় খেতে খেতে দিনের শেষ স্ট্যাটাসটি পড়ল ফেসবুকে, ‘মশা জ্বালাচ্ছে বড়। ভালো না লাগলেও মশারি টাঙাতে হবে। নয়তো ডেঙ্গু হবে হয়তো। হায় মশা! হায় ডেঙ্গু!! হায় প্রিয় ঢাকা নগরীর পরিচ্ছন্নতা!!!’
স্ট্যাটাস দিতে দিতে ঘুমিয়ে গিয়ে সুমন স্বপ্ন দেখে কয়েক দিনের জন্য ফেসবুক বন্ধ থাকবে। ফেসবুক বন্ধ থাকলে দেশের কী অবস্থা হতে পারে, এই নিয়ে ঘুমের ঘোরেই একটা স্ট্যাটাসের খসড়া তৈরি করে ফেলল সে। ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে ফেসবুকবিহীন কয়েক দিনের আশঙ্কাবিষয়ক স্বপ্নে পাওয়া স্ট্যাটাসটি দিতে গিয়ে দেখে কোনোভাবেই আর কাজ করছে না তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। নেট তো আছেই। তাহলে?
পাশের ঘর থেকে বাবার কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। বাবা মাকে বলছে, ‘শুনছ সুমনের মা? খুব ভালো হলো। কয়েক দিনের জন্য ফেসবুক বন্ধ থাকবে। এইবার যদি তোমার ছেলের মতি ফেরে। সারা দিন খালি ফেসবুক আর ফেসবুক।’ ফেসবুকবিষয়ক বাবার এই বিকৃত বক্তব্য নিয়ে জেনারেশন গ্যাপকেন্দ্রিক একটা শাণিত স্ট্যাটাস দেবে ভাবতেই মনে পড়ল ফেসবুক আপাতত বন্ধ!
চার. বাহাত্তর ঘণ্টা পরে ফেসবুক আবার ফিরে এল। শায়লা, রিমন, শর্মি, সুমনের কী হলো, আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের বন্ধু হিমেল সৌরভ এই নিয়ে একটা কবিতাই লিখে ফেলল। বলা বাহুল্য, কবিতাটিতে বহু পূর্বজ কবির প্রভাব থাকলেও বিষয়টা ইউনিক বলে তাকে একটা বাহবা দেওয়াই যায়। কবিতাটি সবার জন্য নিচে দিয়ে দিচ্ছি—
ফেসবুক
মানবের আশ্চর্য আবিষ্কার!
ডিজিটালি কদিন না থেকে
তুমি দিয়ে গেলে
অ্যানালগ বিরহের ধ্রুপদি ধারণা।
দুই. বন্ধুমহলে শর্মির নাম ‘সেলফিশর্মি’। অফিশিয়াল কিংবা পারিবারিক যে অনুষ্ঠানই হোক, সবার আগে তার সেলফি তোলা চাই। কদিন আগে বন্ধুরা মিলে কক্সবাজারে গেল ঘুরতে। ইরা, পিঙ্কি, মেঘলা—সবাই ঝিনুক কুড়াচ্ছিল সাগরবেলায়। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই সমুদ্রের নানা বিভঙ্গে নিজেকে বন্দী করতে ব্যস্ত আমাদের শর্মি। ঢেউভীতি আছে তার। হঠাৎ এক জোর-ঢেউয়ের ধাক্কায় তাল না রাখতে পেরে কদিন আগে কেনা দামি মোবাইলটির সলিলসমাধি ঘটাল সে। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ লক্ষ করা গেল না; বরং মোবাইলটির ডুবে-ভেসে ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার দৃশ্যের সঙ্গে পারলে সে যেন একটা সেলফি তুলতে চায়—এমন অবস্থা। এহেন শর্মি এই হালকা শীতের প্রথম ভাগে অফিসের পিকনিকে এসে সম্পূর্ণ আশাহত। না না, আয়োজনের কোনো ঘাটতি বা অন্য কিছু নয়। হঠাৎ ফেসবুক বন্ধ হওয়ায় সে কোনো সেলফিই আপলোড দিতে পারছিল না। ঢাকা থেকে তারা যাচ্ছে সোনারগাঁ। অন্যদিন হলে বাসে উঠতে গিয়ে সেলফি দিত এফবিতে। বাসের সদ্য পাওয়া সিটটার সঙ্গে তাকে কেমন মানিয়েছে, সেটাও জানান দিত তার সাম্প্রতিকতম ছবি। বাসে বসে নাশতা খাওয়ার বাহারি ছবি, বাস থেকে নেমে পানামনগরের দালানকোঠা কিংবা লোকশিল্প জাদুঘরের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রহ—কোনো কিছুই বাদ যেত না শর্মির সেলফি-আগ্রাসন থেকে। তবে এর মধ্যেও ছবি সে তুলছে। জমিয়ে রাখছে। ফেসবুক খুললেই অ্যালবাম আকারে সেলফিসমগ্র ঢালা হবে। কিন্তু একটা সিঙ্গেল ছবিকে ঘিরে আলাদাভাবে কোনো আলোচনা হবে না ভেবে ভীষণ বিষণ্ন শর্মি। ছবি তোলার গতিতে তাই আজ কিছুটা ক্ষান্তি দিয়ে শর্মি চারপাশের গাছপালা, নদী-নালা আর ওপরের আকাশটা ভালো করে দেখল। হঠাৎই তার মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কোনো এক ফটোগ্রাফিক সোসাইটির বিজ্ঞাপনে সাঁটা বিনয় মজুমদারের সেই কবিতা—‘আরও কিছু দৃশ্যাবলি দেখেছি জীবিতকালে যারা চিত্রায়িত হতে পারতো’। আজ সেলফি তোলার শ্লথ গতিতে শর্মি হঠাৎ ভাবার সুযোগ পেল, এত সুন্দর সকাল-দুপুরময়, নিসর্গ-মানুষময় পৃথিবীর কতটুকুই আসে সেলফি কিংবা যেকোনো আলোকচিত্রে! সেলফির মোহে পড়ে সে নিজের মনের ক্যামেরাটা এত দিন যেন নিজের অজান্তেই বন্ধ রেখেছিল। আজ ফেসবুক বন্ধ হওয়ার সুবাদে সেটা খোলার সুযোগ পেল যেন। সেলফি কিংবা ফেসবুক তো চলে গিয়েই ফিরে আসবে, কিন্তু এই যে নদীর জলের কাঁপন, পাখির কলতান, বাতাসের নাচন, সৌন্দর্যে ভরা এই মুহূর্তেরা তো আর ফিরে আসবে না। ফেসবুকের ছুটি কাটানোর সুযোগে এক অনন্য অনুভবের মুখোমুখি হয়ে আনশিডিউলি ভালোলাগায় ভরে গেল শর্মির মন।
তিন. স্ট্যাটাস সুমন। স্ট্যাটাস তো অনেকেই দেয় ফেসবুকে। তবে সুমনকে কেন এই বিশেষ বিশেষণে ভূষিত করা? কেউ কেউ আবার সুমনের স্ট্যাটাস দেওয়াকে ব্যঙ্গ করে ওর ওয়ালে লেখে, ‘আমার কোনো স্ট্যাটাস নেই, সুমনের আছে।’ কথাটা শুনে হাসি পেলেও সুমনের নামের আগে ‘স্ট্যাটাস’ শব্দ যোগ হওয়ার একটা বাস্তব ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। সুমনের সকালের আলো ফোটে ফেসবুকের পাতায়। ঘুম থেকে উঠেই সুমনের প্রথম স্ট্যাটাস, ‘শুভ সকাল। জীবনের আরেকটা সকাল তবে শুরু...’
এরপর হয়তো মা নাশতা খেতে ডাকছে। দ্বিতীয় স্ট্যাটাস, ‘যাই, নাশতা খাব—পরোটা, ভাজি, হালুয়া।’ আর ফেসবুক বন্ধুরা একটু ভাগ্যবান হলে প্রভাতি এই স্ট্যাটাসের সঙ্গে নাশতার চেহারা-ছবিও দেখে উঠতে পারেন। একটু পরে মুভি দেখতে শুরু করে সুমন। কিছুক্ষণ দেখার পর তার স্ট্যাটাস, ‘প্রেম কেন বিপন্ন ছবিটা দেখছি। নায়িকার এক্সপ্রেশন ভালো না। নায়কের ডায়ালগ মোটের ওপর। ছবির স্টোরিটা এককথায় বোগাস।’ তার এই স্ট্যাটাস নিয়ে ফিল্মবোদ্ধা বন্ধুরা কিছুক্ষণ বাদানুবাদে ব্যস্ত রইল। হঠাৎ সুমনের মনে হলো, একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এই ইস্যুটাকে। নতুন কিছু দরকার। তাই স্ট্যাটাসে নতুন এক কমেন্ট দিল, ‘এনাফ ইজ এনাফ। এই বিষয়টা এখানেই শেষ হলো।’ কিছুক্ষণ পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হলো। চেক ইন দিল ফেসবুকে, ‘নাউ ইন তরঙ্গ বাস।’ পাবলিক বাসে যাত্রী-কন্ডাক্টর ভাড়া নিয়ে গন্ডগোল, সিটে বসা কিংবা দাঁড়ানো; এইসবের মাঝেই সিট না পাওয়া সুমন স্ট্যাটাস আকারে লিখে ফেলল নগর ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে গিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে কাপযুক্ত সচিত্র স্ট্যাটাস, ‘কফিটা দারুণ ছিল কিন্তু!’
তারপর ক্লাসে বসে নতুন স্ট্যাটাস, ‘টিউটোরিয়াল-ক্লাস টেস্ট-নোট-ল্যাব ইত্যাদি ইত্যাদি...এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়া আমরা কী করিব?’ এবার তার স্ট্যাটাসে হামলে পড়ল শিক্ষানুরাগী বন্ধুবান্ধব। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতি পথে পুরান ঢাকায় গিয়ে নান্নার মোরগ-পোলাও খেতে খেতে যথারীতি মোরগ-পোলাও এবং আনুষঙ্গিক খাবার নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিল। স্ট্যাটাসে জনৈক ভোজনরসিক বন্ধুর কমেন্ট, ‘সুমন, মোরগ-পোলাও যখন খেয়েছিস, তখন বেচারাম দেউড়ি থেকে জনসন রোডে গিয়ে বিউটির ফালুদা খেয়ে আসলে মন্দ হতো না।’ তারপর আবার সুমনের স্ট্যাটাস—নতুন ও পুরান ঢাকার ফালুদার তুলনামূলক পর্যালোচনাবিষয়ক। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক ফালুদার ফলে কী পরিমাণ ফরমালিন থাকে, সে বিষয়ে একটা পরিসংখ্যানও দেওয়া গেল। যা হোক, খানাপিনার পর্ব পেরিয়ে বাসায় গিয়ে একটু ঘুম দিল। ঘুম থেকে জেগেই স্ট্যাটাস-বিরহের অনলে পুড়তে লাগল সুমন। পরমুহূর্তে স্ট্যাটাস, ‘দিবানিদ্রা স্বাস্থ্যের পক্ষে লাভজনক নাকি ক্ষতিকর? বন্ধুরা কী বলেন?’ এই স্ট্যাটাস দিতে দিতে ফোনে কথা হলো শিলুর সঙ্গে, ‘তুমি আছ তোমার স্ট্যাটাস আপডেট নিয়ে। শেষ কবে ঘুরতে বেরিয়েছি মনে পড়ে তোমার?’ শিলুর সঙ্গে আজ কোথাও ঘুরতে যাবে কি না, সেই মীমাংসা হওয়ার আগেই স্ট্যাটাস, ‘প্রেমে শুধু পড়লেই হয় না, প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরতেও বের হতে হয়।’
স্ট্যাটাস দেখে রেগে শিলুর ফোন, ‘তোমার স্ট্যাটাস আমি বের করছি প্রেমিকপ্রবর। তোমার সঙ্গে এই আমার ব্রেকআপ ঘোষণা করলাম।’ বেচারা সুমনের ব্রেকআপ-পরবর্তী আপডেট, ‘প্রেম করলে ব্রেকআপ ডিক্লারেশন শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।’ এই নিয়ে কিছুক্ষণ যুগপৎ প্রেম ও বিরহ-অভিজ্ঞ বন্ধুবান্ধবের কমেন্ট বিনিময় চলল আগের আপডেটে। তারপর শিলুর বিরহ ভুলতে সন্ধ্যায় দলবেঁধে ঘুরতে গেল মিউজিক ফেস্টে। গিয়ে দেশের সমৃদ্ধ সংগীত ভান্ডার নিয়ে স্ট্যাটাস দিল। তারপর এই ফেস্টিভ্যালের ভালোমন্দ নিয়ে নিজের অভিমত যুক্ত করে সংগীতানুরাগী বন্ধুমহলের ব্যাপক প্রশংসা কুড়াল স্ট্যাটাস সুমন। মিউজিক ফেস্ট থেকে রাত করে বাসায় ফিরল। মা বলল, ‘এই তোর আসার সময় হলো? নে, খেয়ে নে।’ সারা দিনের এত কিছুর পর মায়ের অনাবিল স্নেহঝরা মুখ বিষয়ে একটা নৈতিক স্ট্যাটাস দিতে না দিতেই বাবার হুংকার, ‘সুমন, পড়াশোনা কিছু করছিস? নাকি সারা দিন ফেসবুক আর ফেসবুক?’ বাবার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারার দুঃখে নৈশকালীন স্ট্যাটাস, ‘জেনারেশন গ্যাপটা খুব ভয়াবহ। আজকালকার বাবারা বুঝতেই পারে না ছেলের মন।’ যাক, বাবার উত্তর সরাসরি দেওয়া না গেলেও স্ট্যাটাসে তো এক হাত নেওয়া গেল। এরপর ঘুমাতে গিয়ে মশার কামড় খেতে খেতে দিনের শেষ স্ট্যাটাসটি পড়ল ফেসবুকে, ‘মশা জ্বালাচ্ছে বড়। ভালো না লাগলেও মশারি টাঙাতে হবে। নয়তো ডেঙ্গু হবে হয়তো। হায় মশা! হায় ডেঙ্গু!! হায় প্রিয় ঢাকা নগরীর পরিচ্ছন্নতা!!!’
স্ট্যাটাস দিতে দিতে ঘুমিয়ে গিয়ে সুমন স্বপ্ন দেখে কয়েক দিনের জন্য ফেসবুক বন্ধ থাকবে। ফেসবুক বন্ধ থাকলে দেশের কী অবস্থা হতে পারে, এই নিয়ে ঘুমের ঘোরেই একটা স্ট্যাটাসের খসড়া তৈরি করে ফেলল সে। ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে ফেসবুকবিহীন কয়েক দিনের আশঙ্কাবিষয়ক স্বপ্নে পাওয়া স্ট্যাটাসটি দিতে গিয়ে দেখে কোনোভাবেই আর কাজ করছে না তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। নেট তো আছেই। তাহলে?
পাশের ঘর থেকে বাবার কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। বাবা মাকে বলছে, ‘শুনছ সুমনের মা? খুব ভালো হলো। কয়েক দিনের জন্য ফেসবুক বন্ধ থাকবে। এইবার যদি তোমার ছেলের মতি ফেরে। সারা দিন খালি ফেসবুক আর ফেসবুক।’ ফেসবুকবিষয়ক বাবার এই বিকৃত বক্তব্য নিয়ে জেনারেশন গ্যাপকেন্দ্রিক একটা শাণিত স্ট্যাটাস দেবে ভাবতেই মনে পড়ল ফেসবুক আপাতত বন্ধ!
চার. বাহাত্তর ঘণ্টা পরে ফেসবুক আবার ফিরে এল। শায়লা, রিমন, শর্মি, সুমনের কী হলো, আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের বন্ধু হিমেল সৌরভ এই নিয়ে একটা কবিতাই লিখে ফেলল। বলা বাহুল্য, কবিতাটিতে বহু পূর্বজ কবির প্রভাব থাকলেও বিষয়টা ইউনিক বলে তাকে একটা বাহবা দেওয়াই যায়। কবিতাটি সবার জন্য নিচে দিয়ে দিচ্ছি—
ফেসবুক
মানবের আশ্চর্য আবিষ্কার!
ডিজিটালি কদিন না থেকে
তুমি দিয়ে গেলে
অ্যানালগ বিরহের ধ্রুপদি ধারণা।
No comments