ব্যাংকিং খাতে হতাশার বছর by হামিদ বিশ্বাস
আর্থিক
কেলেঙ্কারি, বিনিয়োগে স্থবিরতা, লেনদেনে মন্থর গতি ও সার্বিক হতাশা নিয়ে
২০১৫ সাল পার করল ব্যাংকিং খাত। চলতি বছরের প্রথম তিন মাস কেটেছে
হরতাল-অবরোধে। এ সময় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সম্মেলন যথাসময়ে করতে
পারেনি ব্যাংকগুলো। একপর্যায়ে দৈনিক লেনদেন নেমে আসে প্রায় ৩০ শতাংশের
নিচে। এরপর লেনদেনে কিছুটা গতি এলেও বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটেনি। কিছু ব্যাংক
বাঁচার তাগিদে আগ্রাসি ব্যাংকিংয়ের পথ বেছে নেয়। একটা অংশ জড়িয়ে পড়ে নানা
আর্থিক কেলেঙ্কারিতে। খেলাপি ঋণে জর্জরিত পুরো ব্যাংকিং খাত। খেলাপি থেকে
ছাড় পেতে বিপদকালীন সময়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে করা হয় আবেদন। কেন্দ্রীয়
ব্যাংক বলল- ৫০০ কোটি টাকার উপরে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা ছাড় পাবেন। সে
সুযোগে ঢুকে পড়ল সুবিধাবাদীরা। বিশেষ ছাড়ের আওতায় এসে গেল বিপদকালীন সময়ের
আগে ও পরের অনেক খেলাপি। বিষয়টি অর্থনীতিবিদরা ভালো চোখে দেখেননি।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ক্ষমা সব সময় দয়া অর্থে ব্যবহার হয় না। অন্তত ব্যাংকিং খাতে নয়। খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দেয়ার অর্থই হচ্ছে নতুন ক্রাইমের জন্ম দেয়া। বিদায়ী বছরকে ব্যাংকিং খাতের জন্য হতাশার উল্লেখ করে ড. জাহিদ আরও বলেন, প্রফিট কম হয়েছে। ব্যাংকে কর প্রদানের পরিমাণ কমেছে। ফোর্টপোলিও সংকট কাটেনি। ব্যালেন্স শিটে মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। করপোরেট গভার্নেন্সের উন্নতি হয়নি।
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম: ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে নতুন অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক। সমপ্রতি ব্যাংকটির ৬টি শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ পরিদর্শন চালিয়ে ঋণ বিতরণে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। ঋণ অনুমোদনে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ‘নেতিবাচক’ মন্তব্য থাকলেও নির্বাহী কমিটির ‘ঋণ প্রদান করুন’ নির্দেশনায় অর্থ ছাড় দেয়া হয়েছে, যা ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। ব্যাংকের গুলশান করপোরেট, মতিঝিল, ইমামগঞ্জ, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও শেরপুর শাখায় ৯টি পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়। উদঘাটিত অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে- অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ, অন্য ব্যাংকের খেলাপিঋণ অধিগ্রহণ ও প্রকল্পের জামানত বাজার মূল্যের চেয়েও কম দেখানো। অনিয়মের মাত্রা দেখে গত ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ফারমার্স ব্যাংকের সব শাখাতেই বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যাংকের অবস্থা যেন আরও খারাপের দিকে না যায়, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, এখন যদি কোনো ব্যাংক ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে, তাহলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যবেক্ষক নিয়োগ না করে তো উপায় থাকে না। তিনি বোর্ডে বসে ব্যাংকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধান করবেন এবং তারই পরামর্শের ভিত্তিতে ব্যাংকটিকে নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, গুলশান শাখার গ্রাহক এমআরএল ফুডের প্রস্তাবে ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতিবাচক মন্তব্য সত্ত্বেও নির্বাহী কমিটি ঋণ অনুমোদন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির জামানতের মূল্য নির্ণয়ে কাল্পনিক দর দেখানো হয়েছে। পরিদর্শনে আরও দেখা যায়, মতিঝিল শাখার ঋণগ্রহীতা ২৫টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এসব ঋণ বিতরণে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ব্যাপক হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় ২০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল ২৫ কোটি টাকার ঋণ ফেরত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ‘রয়্যাল শিপ ব্রেকিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া এ ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে ঋণটি দেয়া হয়েছে, সে খাতে ব্যয় না হয়ে উপকারভোগীর অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণের দায় মেটানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, হলমার্ক-বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় কেলেঙ্কারির দৃশ্যমান কোনো বিচার না হওয়ায় বেসিক কেলেঙ্কারির উদ্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকও অনিয়মে জড়িয়েছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, আগ্রাসী ব্যাংকিং ও খেলাপি ঋণে জড়িয়েছে তা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে হঠাৎ চলতি বছরের নভেম্বরে সরকারি ৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯ ধারা অনুযায়ী, এর আগে সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক বসানো হয়। এ ছাড়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে পরিবর্তিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বসানো হয়েছে পর্যবেক্ষক। সব মিলিয়ে ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংকেই পর্যবেক্ষক রয়েছে। এ ছাড়া প্রক্রিয়ায় রয়েছে নতুন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক।
ব্যাংকার ও বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ব্যাংকিং খাত কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এর থেকে বের হতে হবে। বের হতে না পারলে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। সুদের হার কমানোর সুযোগ থাকলেও গেল বছরে তা কমাতে পারেনি। একযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ কিসের আলামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো ভালো চলছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সন্তোষজনক। তবে আরও ভালো করতে হবে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা কম থাকায় সরকারি ব্যাংকে অনিয়ম হয়েছে। এটি সমাধান করা দরকার। এর বাইরে ২০১৫ সালে ক্রেডিট গ্রোথ কমে যাওয়া ছাড়া খুব বেশি অসংঘতি চোখে পড়েনি।
২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যত ধরনের অনিয়ম করা যায়, তার প্রায় সবই হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধ্যানে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য বের হলেও প্রকৃত বিচারে পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। দুদক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। ইতিমধ্যে শাখা থেকে ক্রেডিট লাইন প্রস্তাব (সিএলপি) পাওয়ার আগেই ঋণ অনুমোদন, একই সম্পদ একাধিক ঋণের জামানত হিসেবে দেখানোসহ ১৩টি ভয়াবহ অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে স্বতন্ত্র নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিন। এসব অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে ব্যাংকটির প্রয়োজনীয় মূলধন পর্যাপ্ততার হার ঝুঁকি-ভরযুক্ত সম্পদের নেগেটিভ ২৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ব্যাসেল-২ অনুসারে ১০ শতাংশ হওয়ার কথা।
সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষা করেছে একনাবিন। নিরীক্ষায় বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, জালিয়াতির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া গেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের একটি সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর জন্য তৈরি করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে দেখা গেছে, ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বড় বড় অঙ্কের ঋণ ও অগ্রিম অনুমোদন এবং বিতরণ করা হয়। এসব ঋণ ও অগ্রিমের পরতে পরতে রয়েছে অনিয়ম। অর্থ মন্ত্রণালয় এসব অনিয়ম বিশ্লেষণ করে চারটি পরামর্শ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। এগুলো হলো ঋণ কেস যাচাই; অনুমোদন, ঋণ ও অগ্রিম বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ও অভ্যন্তরীণ নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে পালন; পরিচালন ব্যয় কমানো এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি করা। অডিট প্রতিবেদনটি বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময়সীমা ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত হলেও ঘটনাটি সব চেয়ে আলোচিত হয় ২০১৫ সালে। এ সময় একের পর এক তদন্ত, মূল হোতাদের বাদ দেয়া, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর পদত্যাগ, এমডি, ডিএমডিসহ প্রায় ৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী তসলিম বলেন, দেশের অর্থনীতি শ্লো এবং স্থবির। এর পেছনে রয়েছে ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বিমুখতাকেও দুষছেন তিনি। তবে পুরো অর্থনীতির বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংকিং সেক্টর। সে কারণে অর্থনীতি উত্থান-পতনে ব্যাংক খাতের দায় বেশি। ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাশুল জনগণের ঘাড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ তসলিম আরও বলেন, সরকারি ব্যাংকে লুটপাট হচ্ছে জরিমানা দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে দুর্নীতির কারণে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে কয়েকবার। প্রতিবারই সরকার তাদের মূলধন ঘাটতি পূরণ করেছে। আর সরকারের ফান্ড থেকে যে টাকা ঘাটতি পূরণে যাচ্ছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষের করের টাকা।
হামিদ বিশ্বাস
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ক্ষমা সব সময় দয়া অর্থে ব্যবহার হয় না। অন্তত ব্যাংকিং খাতে নয়। খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দেয়ার অর্থই হচ্ছে নতুন ক্রাইমের জন্ম দেয়া। বিদায়ী বছরকে ব্যাংকিং খাতের জন্য হতাশার উল্লেখ করে ড. জাহিদ আরও বলেন, প্রফিট কম হয়েছে। ব্যাংকে কর প্রদানের পরিমাণ কমেছে। ফোর্টপোলিও সংকট কাটেনি। ব্যালেন্স শিটে মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। করপোরেট গভার্নেন্সের উন্নতি হয়নি।
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম: ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে নতুন অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক। সমপ্রতি ব্যাংকটির ৬টি শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ পরিদর্শন চালিয়ে ঋণ বিতরণে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। ঋণ অনুমোদনে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ‘নেতিবাচক’ মন্তব্য থাকলেও নির্বাহী কমিটির ‘ঋণ প্রদান করুন’ নির্দেশনায় অর্থ ছাড় দেয়া হয়েছে, যা ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। ব্যাংকের গুলশান করপোরেট, মতিঝিল, ইমামগঞ্জ, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও শেরপুর শাখায় ৯টি পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়। উদঘাটিত অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে- অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ, অন্য ব্যাংকের খেলাপিঋণ অধিগ্রহণ ও প্রকল্পের জামানত বাজার মূল্যের চেয়েও কম দেখানো। অনিয়মের মাত্রা দেখে গত ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ফারমার্স ব্যাংকের সব শাখাতেই বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যাংকের অবস্থা যেন আরও খারাপের দিকে না যায়, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, এখন যদি কোনো ব্যাংক ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে, তাহলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যবেক্ষক নিয়োগ না করে তো উপায় থাকে না। তিনি বোর্ডে বসে ব্যাংকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধান করবেন এবং তারই পরামর্শের ভিত্তিতে ব্যাংকটিকে নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, গুলশান শাখার গ্রাহক এমআরএল ফুডের প্রস্তাবে ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতিবাচক মন্তব্য সত্ত্বেও নির্বাহী কমিটি ঋণ অনুমোদন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির জামানতের মূল্য নির্ণয়ে কাল্পনিক দর দেখানো হয়েছে। পরিদর্শনে আরও দেখা যায়, মতিঝিল শাখার ঋণগ্রহীতা ২৫টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এসব ঋণ বিতরণে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ব্যাপক হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় ২০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল ২৫ কোটি টাকার ঋণ ফেরত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ‘রয়্যাল শিপ ব্রেকিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া এ ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে ঋণটি দেয়া হয়েছে, সে খাতে ব্যয় না হয়ে উপকারভোগীর অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণের দায় মেটানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, হলমার্ক-বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় কেলেঙ্কারির দৃশ্যমান কোনো বিচার না হওয়ায় বেসিক কেলেঙ্কারির উদ্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকও অনিয়মে জড়িয়েছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, আগ্রাসী ব্যাংকিং ও খেলাপি ঋণে জড়িয়েছে তা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে হঠাৎ চলতি বছরের নভেম্বরে সরকারি ৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯ ধারা অনুযায়ী, এর আগে সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক বসানো হয়। এ ছাড়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে পরিবর্তিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বসানো হয়েছে পর্যবেক্ষক। সব মিলিয়ে ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংকেই পর্যবেক্ষক রয়েছে। এ ছাড়া প্রক্রিয়ায় রয়েছে নতুন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক।
ব্যাংকার ও বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ব্যাংকিং খাত কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এর থেকে বের হতে হবে। বের হতে না পারলে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। সুদের হার কমানোর সুযোগ থাকলেও গেল বছরে তা কমাতে পারেনি। একযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ কিসের আলামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো ভালো চলছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সন্তোষজনক। তবে আরও ভালো করতে হবে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা কম থাকায় সরকারি ব্যাংকে অনিয়ম হয়েছে। এটি সমাধান করা দরকার। এর বাইরে ২০১৫ সালে ক্রেডিট গ্রোথ কমে যাওয়া ছাড়া খুব বেশি অসংঘতি চোখে পড়েনি।
২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যত ধরনের অনিয়ম করা যায়, তার প্রায় সবই হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধ্যানে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য বের হলেও প্রকৃত বিচারে পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। দুদক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। ইতিমধ্যে শাখা থেকে ক্রেডিট লাইন প্রস্তাব (সিএলপি) পাওয়ার আগেই ঋণ অনুমোদন, একই সম্পদ একাধিক ঋণের জামানত হিসেবে দেখানোসহ ১৩টি ভয়াবহ অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে স্বতন্ত্র নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিন। এসব অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে ব্যাংকটির প্রয়োজনীয় মূলধন পর্যাপ্ততার হার ঝুঁকি-ভরযুক্ত সম্পদের নেগেটিভ ২৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ব্যাসেল-২ অনুসারে ১০ শতাংশ হওয়ার কথা।
সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষা করেছে একনাবিন। নিরীক্ষায় বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, জালিয়াতির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া গেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের একটি সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর জন্য তৈরি করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে দেখা গেছে, ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বড় বড় অঙ্কের ঋণ ও অগ্রিম অনুমোদন এবং বিতরণ করা হয়। এসব ঋণ ও অগ্রিমের পরতে পরতে রয়েছে অনিয়ম। অর্থ মন্ত্রণালয় এসব অনিয়ম বিশ্লেষণ করে চারটি পরামর্শ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। এগুলো হলো ঋণ কেস যাচাই; অনুমোদন, ঋণ ও অগ্রিম বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ও অভ্যন্তরীণ নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে পালন; পরিচালন ব্যয় কমানো এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি করা। অডিট প্রতিবেদনটি বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময়সীমা ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত হলেও ঘটনাটি সব চেয়ে আলোচিত হয় ২০১৫ সালে। এ সময় একের পর এক তদন্ত, মূল হোতাদের বাদ দেয়া, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর পদত্যাগ, এমডি, ডিএমডিসহ প্রায় ৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী তসলিম বলেন, দেশের অর্থনীতি শ্লো এবং স্থবির। এর পেছনে রয়েছে ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বিমুখতাকেও দুষছেন তিনি। তবে পুরো অর্থনীতির বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংকিং সেক্টর। সে কারণে অর্থনীতি উত্থান-পতনে ব্যাংক খাতের দায় বেশি। ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাশুল জনগণের ঘাড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ তসলিম আরও বলেন, সরকারি ব্যাংকে লুটপাট হচ্ছে জরিমানা দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে দুর্নীতির কারণে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে কয়েকবার। প্রতিবারই সরকার তাদের মূলধন ঘাটতি পূরণ করেছে। আর সরকারের ফান্ড থেকে যে টাকা ঘাটতি পূরণে যাচ্ছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষের করের টাকা।
হামিদ বিশ্বাস
No comments