শিক্ষকদের ‘আত্ম-মর্যাদার’ লড়াই by মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন
আষ্টম
বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের সাথে সাথে দেশের শিক্ষাঙ্গণে নেমে এসেছে কালো
ছায়া। দেশের সব কটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় নিস্তব্দ হয়ে গেছে শিক্ষকদের
আন্দোলনে। শিক্ষকরা আত্ম-মর্যাদার সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের এ আন্দোলনে নৈতিক
জোর আছে কিনা সেটি ভাববার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসাবে
আমার বিবেকে প্রশ্নজাগে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কেন নষ্ট হলো? অথবা
শিক্ষকদের নিয়ে আজ এমন ছেলে খেলার সাহস আমলা ও স্বঘোষিত স্বশিক্ষিত
রাজনীতিবিদরা কোথায় পেল? শিক্ষকরা এমনভাবে আর কতদিন লাঞ্ছিত হবেন?
সোজা উত্তর শিক্ষাকরা ততদিনই লাঞ্ছিত হবেন যতদিন বুঝতে অক্ষম থাকবেন তিনি একজন শিক্ষক, তার কাজ অমানুষকে মানুষ করা। তার কাজ বই খাতার আড়ালে ব্যক্তিস্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে একজন ছাত্রকে তোয়াজ করা নয় অথবা একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে দমন পীড়নের জন্য ব্রত হওয়া নয়। তিনি ততদিন লাঞ্ছিত হবেন যতদিন নিজে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠে সমাজে সাম্যের পথে শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন না। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাবের কথা বলে নেহাত ভুল করেছেন বলে আমি বিশ্বাস করিনা, কেননা জ্ঞানের পরিভাষ্য বুঝার ক্ষমতাই আমরা হারিয়ে ‘শিক্ষাআমলা ও শিক্ষাবাজে’ পরিণত হয়েছি। আমরা শিক্ষকরা যখন অশিক্ষিত রাজনৈতিক আমলাদের কথার সাথে সুর মিলিয়ে ধর্মকে কেবল সাম্প্রদায়িক বলে সমাজে স্পষ্ট বিভক্তি তৈরি করি তখন আমাদের জ্ঞানের দৈন দশা ছাড়া আর কীভাবে একে মূল্যায়ন করতে পারি?
শিক্ষকদের মাঝে মানবতাবোধ ও নৈতিকতাবোধ বা মূল্যবোধ কি জাগ্রত? শিক্ষকরা প্রায় ভুলে গেছেন সমাজ বিনির্মাণে তার দায়িত্ব কী? ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদ মারা যাবার পর তার আত্ম-জীবনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ পত্রিকায় পড়ে হতভাগ হয়ে যাই। তিনি তার গুরু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ইচ্ছাতেই সরকারী আমলা না হয়ে শিক্ষক হয়েছেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানতেন ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদের মত নিবেদিত প্রাণরা শিক্ষকতায় না আসলে জাতির আলো দিনে দিনে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
বর্তমান সময়ে এমন কোন শিক্ষক কি রয়েছেন যিনি একজন গরীব মেধাবীকে তার শ্রম অর্থের বিনিময়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করছেন। বরং স্কুল ও কলেজ শিক্ষদের কাছে টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়তে না পারলে তাকে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লেগে যাবার পরামর্শ দেন। একজন শিক্ষক শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে বাসায় টাকার বিনিময়ে ছাত্রদের পড়তে বাধ্য করেন, তখন আমরা সমাজের বিবেকবান হয়ে ওঠতে পারিনা কেন? সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার যোগ্যতা হিসাবে ছাত্রাবস্থাতেই খেয়াল করেন শিক্ষাজীবন শেষ হবার হবার সময় কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকতে পারেন অথবা কোন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অনুষদের ডীন থাকতে পারে, তার তোয়াজ করা এবং অন্যদের দমিয়ে রাখার কাজে লিপ্ত হওয়া। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া বর্তমানে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন কেউ দেখে কিনা প্রশ্ন জাগে। আর কেউ শিক্ষক হলেও তাকে একঘরে করে রাখা হয়। কিন্তু এর প্রতিবাদে অন্য শিক্ষকরা এগিয়ে আসেন না। কেন? একজন শিক্ষকের লাঞ্ছনা মানেই তো সবার হবার কথা ছিল।
আজ বাংলাদেশে নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে ছাত্ররা শিক্ষদের গায়ে হাত তুলে। এতে যে শিক্ষকদের একটি অংশের সমর্থন আছে অথবা তাদের সরাসরি মদদ রয়েছে তাতে বোধ করি কারো সন্দেহ থাকতে পারে না। আর লাঞ্ছিত শিক্ষকও এক সময় আত্মসমর্পন করেন। হায়রে শিক্ষক ও তার আত্ম মর্যাদা!
শিক্ষকের হাতে শত শত ছাত্রী লাঞ্ছিত হয়। হারায় নিজের জীবনের সব কিছু। যৌন প্ররোচিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি পেতে সহযোগীতা করে। অথবা সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকের বইয়ের সেলফে ছাত্রীর সন্ধানের যাবার ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অথবা ছাত্রের কাছে শিক্ষক যখন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন এবং তা গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রমান দেয়া হয়, তখনতো শিক্ষকরা আত্ম-মর্যাদার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করিনি এসব শিক্ষকরূপী নরপশুদের বিরুদ্ধে। তবে কেন আজ মর্যাদার কথা বলছেন?
শিক্ষক কি সত্যি জানে মর্যাদা কী? যদি জানতো, প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্মান প্রদানের নামের শিক্ষকদের যে অপমান করে তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা ছিল না। এমনকি এদেশের অন্তত নিরানব্বইভাগ শিক্ষকই জানেনা কবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত এবং কেন? অথবা বাষট্রির শিক্ষা আন্দোলন এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি পরিবর্তন এনেছিল।
আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তব সত্য হলো যিনি অন্যকোন চাকুরি পেতে ব্যর্থ হন তিনি শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে স্থানীয় রাজনৈতিক আমলাদের মাধ্যমে ও অর্থকড়ির বিনিময়ে স্থানীয় বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকতার চাকুরীটি নিয়ে থাকেন। নিজের পারেন বা না পারেন, নানা কৌশলে তিনি প্রাইভেট পড়ানোর যে মহোৎসব চালু করেছেন, তাতে শিক্ষকতা এখন কেবল অর্থ উৎপাদনের সহজলভ্য পথ হিসাবে পরিণত হয়েছে, মানবিকতা ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার কোন কাজে সে শিক্ষা কাজে লাগে না। যে ছাত্র একদিন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়েছেন, তিনি আমলা হয়ে কেন শিক্ষকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নজর দিবেন?
আর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের দিনে দিনে অনেকটাই সাম্প্রদায়িক করে তুলেছেন। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবনায় তারাই কেবল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও যোগ্য শিক্ষক। অন্যদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে সমাজের উচু আসন কেবল তাদের প্রাপ্য। আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তাদের ভাবনায় আসে ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্র নিয়োগ দিয়ে শিক্ষক বানালে তাকে বা তাদেরকে নিজেদের প্রয়োজনে পাবে কিনা প্রশ্ন থেকেই যায়। অতএব, যোগ্য বা অযোগ্য, মেধা বা অমেধা বিবেচনা না করে কেবল দলীয় ও ব্যক্তিগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যে বার্তা আমাদের দিচ্ছেন তা সত্যি লজ্জ¦ার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক আমলা, মুন্সী ও অস্ত্রবাজ ছাত্রদের গুণগানকেই মূখ্য করে তোলেন, তখন মর্যাদার দাবীতে লড়াই করা কতটুকু মানয়? শিক্ষায় ভ্যাট আরোপে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন মাঠে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে একবারো কি এসব অসহায় ছাত্রদের মর্মকথা অনুভব করে তাদের সান্তনা দিয়েছে? না, দেয়নি। কারণ, এসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই গায়ত্রী স্পিভাকের মতে ‘সাবঅলর্টান’। অতএব, এদের পক্ষে কথা বলার মানেই হলো শ্রেণিবিভাজনকে দূর করে সমমর্যদার কথা বলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন বিভিন্ন সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পদমর্যাদার চেয়ে ছোট কোন পদে যোগদান করেন কেবল নগদ কিছু অর্থের জন্য এবং কেউ কেউ গর্ববোধ করেন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা সম্পন্ন লিখে তখন কোথায় থাকে আমাদের বিবেক?
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একারের জন্যও মুখ ফুটে বলেননি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুন্দর ও যুগোপযোগী করার জন্য কমিউনিটি বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকসহ সব স্তরের শিক্ষকদের পদমর্যাদা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সমন্বয় করে জাতিকে এগিয়ে নিতে হবে।তারা কেবল নিজেদর কথাই চিন্তা করেছেন এবং যেসব শিক্ষতদের হাতে খড়ি নিয়েছেন তাদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক হবার পরও এ নেতিবাচক কথাগুলো বলতে বাধ্য হয়েছি, কেননা যখন দেখি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রয়েছেন নিজে কোন মৌলক কাজ না করে কেবল অন্যের কাজের সাথে নিজের নাম যুক্ত করে পদায়িত হন এবং একজন অধ্যাপক হবার পরও তার বাসায় অথবা টেবিলে কোন বইয়ের অস্থিত্ব থাকেনা, তখন সত্যি নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয়। আবার কখনো যখন দেখি যে সব শিক্ষক পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক না রেখে কেবল বাজারের বিভিন্ন ধরণের তেলের সাথে সম্পর্ক রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং মেধাবীদের ফুটবল বানিয়ে খেলার আয়োজন করেন তখন প্রশ্ন জাগে শিক্ষক কি সত্যি (আত্ম)-মর্যাদা বুঝেন না ক্ষমতা ও টাকা বোঝেন?
লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
সোজা উত্তর শিক্ষাকরা ততদিনই লাঞ্ছিত হবেন যতদিন বুঝতে অক্ষম থাকবেন তিনি একজন শিক্ষক, তার কাজ অমানুষকে মানুষ করা। তার কাজ বই খাতার আড়ালে ব্যক্তিস্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে একজন ছাত্রকে তোয়াজ করা নয় অথবা একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে দমন পীড়নের জন্য ব্রত হওয়া নয়। তিনি ততদিন লাঞ্ছিত হবেন যতদিন নিজে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠে সমাজে সাম্যের পথে শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন না। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাবের কথা বলে নেহাত ভুল করেছেন বলে আমি বিশ্বাস করিনা, কেননা জ্ঞানের পরিভাষ্য বুঝার ক্ষমতাই আমরা হারিয়ে ‘শিক্ষাআমলা ও শিক্ষাবাজে’ পরিণত হয়েছি। আমরা শিক্ষকরা যখন অশিক্ষিত রাজনৈতিক আমলাদের কথার সাথে সুর মিলিয়ে ধর্মকে কেবল সাম্প্রদায়িক বলে সমাজে স্পষ্ট বিভক্তি তৈরি করি তখন আমাদের জ্ঞানের দৈন দশা ছাড়া আর কীভাবে একে মূল্যায়ন করতে পারি?
শিক্ষকদের মাঝে মানবতাবোধ ও নৈতিকতাবোধ বা মূল্যবোধ কি জাগ্রত? শিক্ষকরা প্রায় ভুলে গেছেন সমাজ বিনির্মাণে তার দায়িত্ব কী? ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদ মারা যাবার পর তার আত্ম-জীবনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ পত্রিকায় পড়ে হতভাগ হয়ে যাই। তিনি তার গুরু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ইচ্ছাতেই সরকারী আমলা না হয়ে শিক্ষক হয়েছেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানতেন ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদের মত নিবেদিত প্রাণরা শিক্ষকতায় না আসলে জাতির আলো দিনে দিনে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
বর্তমান সময়ে এমন কোন শিক্ষক কি রয়েছেন যিনি একজন গরীব মেধাবীকে তার শ্রম অর্থের বিনিময়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করছেন। বরং স্কুল ও কলেজ শিক্ষদের কাছে টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়তে না পারলে তাকে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লেগে যাবার পরামর্শ দেন। একজন শিক্ষক শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে বাসায় টাকার বিনিময়ে ছাত্রদের পড়তে বাধ্য করেন, তখন আমরা সমাজের বিবেকবান হয়ে ওঠতে পারিনা কেন? সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার যোগ্যতা হিসাবে ছাত্রাবস্থাতেই খেয়াল করেন শিক্ষাজীবন শেষ হবার হবার সময় কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকতে পারেন অথবা কোন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অনুষদের ডীন থাকতে পারে, তার তোয়াজ করা এবং অন্যদের দমিয়ে রাখার কাজে লিপ্ত হওয়া। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া বর্তমানে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন কেউ দেখে কিনা প্রশ্ন জাগে। আর কেউ শিক্ষক হলেও তাকে একঘরে করে রাখা হয়। কিন্তু এর প্রতিবাদে অন্য শিক্ষকরা এগিয়ে আসেন না। কেন? একজন শিক্ষকের লাঞ্ছনা মানেই তো সবার হবার কথা ছিল।
আজ বাংলাদেশে নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে ছাত্ররা শিক্ষদের গায়ে হাত তুলে। এতে যে শিক্ষকদের একটি অংশের সমর্থন আছে অথবা তাদের সরাসরি মদদ রয়েছে তাতে বোধ করি কারো সন্দেহ থাকতে পারে না। আর লাঞ্ছিত শিক্ষকও এক সময় আত্মসমর্পন করেন। হায়রে শিক্ষক ও তার আত্ম মর্যাদা!
শিক্ষকের হাতে শত শত ছাত্রী লাঞ্ছিত হয়। হারায় নিজের জীবনের সব কিছু। যৌন প্ররোচিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি পেতে সহযোগীতা করে। অথবা সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকের বইয়ের সেলফে ছাত্রীর সন্ধানের যাবার ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অথবা ছাত্রের কাছে শিক্ষক যখন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন এবং তা গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রমান দেয়া হয়, তখনতো শিক্ষকরা আত্ম-মর্যাদার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করিনি এসব শিক্ষকরূপী নরপশুদের বিরুদ্ধে। তবে কেন আজ মর্যাদার কথা বলছেন?
শিক্ষক কি সত্যি জানে মর্যাদা কী? যদি জানতো, প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্মান প্রদানের নামের শিক্ষকদের যে অপমান করে তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা ছিল না। এমনকি এদেশের অন্তত নিরানব্বইভাগ শিক্ষকই জানেনা কবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত এবং কেন? অথবা বাষট্রির শিক্ষা আন্দোলন এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি পরিবর্তন এনেছিল।
আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তব সত্য হলো যিনি অন্যকোন চাকুরি পেতে ব্যর্থ হন তিনি শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে স্থানীয় রাজনৈতিক আমলাদের মাধ্যমে ও অর্থকড়ির বিনিময়ে স্থানীয় বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকতার চাকুরীটি নিয়ে থাকেন। নিজের পারেন বা না পারেন, নানা কৌশলে তিনি প্রাইভেট পড়ানোর যে মহোৎসব চালু করেছেন, তাতে শিক্ষকতা এখন কেবল অর্থ উৎপাদনের সহজলভ্য পথ হিসাবে পরিণত হয়েছে, মানবিকতা ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার কোন কাজে সে শিক্ষা কাজে লাগে না। যে ছাত্র একদিন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়েছেন, তিনি আমলা হয়ে কেন শিক্ষকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নজর দিবেন?
আর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের দিনে দিনে অনেকটাই সাম্প্রদায়িক করে তুলেছেন। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবনায় তারাই কেবল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও যোগ্য শিক্ষক। অন্যদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে সমাজের উচু আসন কেবল তাদের প্রাপ্য। আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তাদের ভাবনায় আসে ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্র নিয়োগ দিয়ে শিক্ষক বানালে তাকে বা তাদেরকে নিজেদের প্রয়োজনে পাবে কিনা প্রশ্ন থেকেই যায়। অতএব, যোগ্য বা অযোগ্য, মেধা বা অমেধা বিবেচনা না করে কেবল দলীয় ও ব্যক্তিগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যে বার্তা আমাদের দিচ্ছেন তা সত্যি লজ্জ¦ার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক আমলা, মুন্সী ও অস্ত্রবাজ ছাত্রদের গুণগানকেই মূখ্য করে তোলেন, তখন মর্যাদার দাবীতে লড়াই করা কতটুকু মানয়? শিক্ষায় ভ্যাট আরোপে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন মাঠে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে একবারো কি এসব অসহায় ছাত্রদের মর্মকথা অনুভব করে তাদের সান্তনা দিয়েছে? না, দেয়নি। কারণ, এসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই গায়ত্রী স্পিভাকের মতে ‘সাবঅলর্টান’। অতএব, এদের পক্ষে কথা বলার মানেই হলো শ্রেণিবিভাজনকে দূর করে সমমর্যদার কথা বলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন বিভিন্ন সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পদমর্যাদার চেয়ে ছোট কোন পদে যোগদান করেন কেবল নগদ কিছু অর্থের জন্য এবং কেউ কেউ গর্ববোধ করেন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা সম্পন্ন লিখে তখন কোথায় থাকে আমাদের বিবেক?
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একারের জন্যও মুখ ফুটে বলেননি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুন্দর ও যুগোপযোগী করার জন্য কমিউনিটি বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকসহ সব স্তরের শিক্ষকদের পদমর্যাদা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সমন্বয় করে জাতিকে এগিয়ে নিতে হবে।তারা কেবল নিজেদর কথাই চিন্তা করেছেন এবং যেসব শিক্ষতদের হাতে খড়ি নিয়েছেন তাদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক হবার পরও এ নেতিবাচক কথাগুলো বলতে বাধ্য হয়েছি, কেননা যখন দেখি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রয়েছেন নিজে কোন মৌলক কাজ না করে কেবল অন্যের কাজের সাথে নিজের নাম যুক্ত করে পদায়িত হন এবং একজন অধ্যাপক হবার পরও তার বাসায় অথবা টেবিলে কোন বইয়ের অস্থিত্ব থাকেনা, তখন সত্যি নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয়। আবার কখনো যখন দেখি যে সব শিক্ষক পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক না রেখে কেবল বাজারের বিভিন্ন ধরণের তেলের সাথে সম্পর্ক রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং মেধাবীদের ফুটবল বানিয়ে খেলার আয়োজন করেন তখন প্রশ্ন জাগে শিক্ষক কি সত্যি (আত্ম)-মর্যাদা বুঝেন না ক্ষমতা ও টাকা বোঝেন?
লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
No comments