আন্তর্জাতিক গুম দিবস ও দেশের শাসনব্যবস্থা by শাহদীন মালিক
‘শাসন ব্যবস্থা’ শব্দ দুটো
ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো ষাটের দশকে গত শতাব্দীতে। তার আগেও ব্যবহৃত হতো,
যেমন ব্রিটিশরা আমাদের শাসন করত। মোগল শাসন করত। সেসব আমলে আইনগুলোর নামও
ছিল ‘শাসনমুখী’। যেমন ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫। পাকিস্তান আমলে দুটি
শাসনতন্ত্র ছিল, ১৯৫৬ সালের যেটা পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল
আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর বাতিল করেন। পরে ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান
পাকিস্তানের জন্য নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। ১৯৬২তে গণপরিষদ ছিল না, ছিল
না সংসদ, তাই খোদ আইয়ুব সাহেব নিজে পাকিস্তানের জন্য একটা শাসনতন্ত্র
রচনা করে বলে দিয়েছিলেন তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন। তাঁর উৎখাত অর্থাৎ
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সেই শাসনতন্ত্র বহাল ছিল। পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে আমরা
যারা অর্থাৎ যাঁদের জন্ম হয়েছিল এ দেশে ১৯৭১-এর আগে, তাঁরা ওই সব
শাসনতন্ত্র অনুযায়ী শাসিত হতাম।
বাংলাদেশ মুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমরা বেছে নিলাম ‘সংবিধান’ শব্দটা শাসনতন্ত্রের পরিবর্তে। কথা ছিল নির্বাচনে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশ পরিচালনা করবে। তাও শুধু কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে। স্থানীয়ভাবে প্রায় সবকিছু পরিচালনা করবে স্থানীয়ভাবে স্থানীয় জনগণ দ্বারা নির্বাচিত স্থানীয় সরকার। নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা আর কিছু সিটি করপোরেশন আছে। ঢাকায় অর্থাৎ দেশের এক-দশমাংশ নাগরিকের কোনো স্থানীয় সরকার নেই। জেলা পরিষদ নেই। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো নেই। এসব নির্বাচন হয়নি। পাছে সরকারি দল আবার হেরে যায়।
যেসব নির্বাচিত স্থানীয় সরকার আছে অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ইত্যাদি—সেগুলো প্রায় ঠুঁটো জগন্নাথ। তারা তাদের এলাকা পরিচালনা করে না বা করতে পারে না বললেই চলে। শাসন করেন ইউএনও, ডিসি আর স্থানীয় সাংসদ।
তাই বলছিলাম, দেশ এখন শাসন করা হয়; পরিচালনা করা হয় না। শাসনটাও আরও পাকাপোক্ত করতে আসছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী। পঞ্চদশ আর ষোড়শ সংশোধনী মিলিয়ে যে অবস্থা দাঁড়াবে, তাতে ভাবতে হবে যে আমরা এখন সংবিধান শব্দটা বাদ দিয়ে ‘শাসনতন্ত্র’তে ফিরে যাব কি না। এ প্রসঙ্গ আরেক দিনের জন্য।
আজকের বিষয় গুম। যাঁরা দেশ পরিচালনা করেন, তাঁদের গুম করতে হয় না। শাসন করতে হলে দেশে গুম হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়, হয় অপহরণ আর নির্যাতন। ৩০ আগস্ট হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম দিবস। ইংরেজিতে এই দিবসের পুরো নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ভিকটিমস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ অর্থাৎ গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের আন্তর্জাতিক দিবস। সাধারণ পরিষদ ২০১১ সাল থেকে এই দিবসটি পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে সব দেশকে।
ঐতিহাসিকভাবে গুমের উৎপত্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী দ্বারা। প্রথমে খোদ জার্মানিতে গুম হওয়া থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতো লোকেরা জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান। আর তারপর ক্রমান্বয়ে পোল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়ার (তৎকালীন) মতো সব বিজিত দেশের লাখো মানুষকে গুম করে এবং পরে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সবচেয়ে বেশি গুমের শিকার হয় ইউরোপের ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা এবং হিটলার নিঃসন্দেহে সর্বকালের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গণহত্যাকারী।
পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে, বিশেষত সামরিক শাসকেরা হাজার হাজার গুম ও গুপ্তহত্যার হোতারূপে আবির্ভূত হন। গুয়াতেমালা, এল সালভাদরের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট দেশ থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের মতো দক্ষিণ আমেরিকার বড় বড় দেশে—গুম, অপহরণ, হত্যা চলেছিল নির্বিচারে ১৯৭০ আর ১৯৮০ এর দশকগুলোতে। কলম্বিয়া, চিলি, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া—প্রায় কোনো দেশই বাদ যায়নি শাসকগোষ্ঠীর গুম অভিযান থেকে।
গুম, অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মদদে-সহায়তায় ছোট ছোট দলের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং গোপন স্থানে আটকে রাখা, কাউকে কোনো খবর না দেওয়া বা আটকের ঘটনা অস্বীকার করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অল্প দিন বা অনেক দিন পরে ধরে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ পাওয়া। বা কখনোই কোনো খোঁজ না পাওয়া—এসবই হলো বর্বরদের রাষ্ট্র শাসন করার বহুল প্রয়োগ করা পদ্ধতি।
অনেক ক্ষেত্রে গুমের শুরু যুদ্ধাবস্থায় (যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি), গৃহযুদ্ধ বা স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় (১৯৭১ এর বাংলাদেশ, ষাটের দশকের আলজেরিয়া, সত্তরের দশকের অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক—ফিরিস্তি অনেক লম্বা) এবং সামরিক শাসনামলে এবং সর্বশেষ সংস্করণ ‘গণতান্ত্রিক শাসন আমলে’—ভারত (কাশ্মীর, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ইত্যাদি), পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ, অতীতে এবং বর্তমানেও।
গুমের টার্গেট গোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন। কিন্তু সার্বিক যুক্তি একটাই—এরা দেশ ও সমাজের জন্য হুমকি, ক্ষতিকারক, ধ্বংসাত্মক। অতএব এদের নির্মূল করা ‘জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য’। এ ধরনের ‘শত্রুরা’ বিচারেরও অযোগ্য। তাদের খতম করলে দেশ ও জাতি বাঁচবে।
খতম করা—গুম, অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা—হয়েছে ডজন ডজন দেশে লাখ লাখ মানুষ। দেশোদ্ধার হয়নি। দেশ-সমাজ বর্বর থেকে বর্বরতর হয়েছে। গুম, অপহরণ, হত্যার দশকের পর তিন-চার দশক পেরিয়ে গেছে এল সালভাদর, গুয়াতেমালার। এসব দেশে এখনো সবচেয়ে বেশি খুন হয়। যেখানে খুন বেশি, গুম বেশি।
সহিংসতা বেশি যেখানে, সেখানে (ব্যতিক্রম দু-একটা আছে) শাসকের স্থায়িত্ব তত বেশি। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ মাস দুয়েক আগে তৃতীয়বারের মতো আরও সাত বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সিরিয়ায় গত তিন বছরে প্রায় দুই লাখ লোক নিহত হয়েছে। জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের শাসনামলের বয়স এখন প্রায় ৩০ বছর। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে আসা কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন নির্বাচিত হচ্ছেন বিপুল ভোটে ক্রমাগতভাবে ১৯৮৫ থেকে।
৩.
সারা বিশ্বের গুমের প্রকোপে উদ্বিগ্ন হয়ে জাতিসংঘ ২০০২ থেকে কাজ শুরু করে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে। ইংরেজিতে নাম—ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স। এই আন্তর্জাতিক সনদটা কার্যকর হয়েছে ২১ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে আর ২০১১ থেকে ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
এ পর্যন্ত ৪৩টি দেশ সনদটি গ্রহণ করেছে, ৯৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। বলা বাহুল্য, যেসব রাষ্ট্র গুম করে তারা এই সনদ গ্রহণ করেনি। যেমন, বাংলাদেশ।
৪
যাকে হত্যা করা হয় তার জীবননাশ হয়, তার প্রিয়জনেরা বিধ্বস্ত হয়, দুর্দশাগ্রস্ত হয়, হয় সংকটাপন্ন। ব্যথিত হয়। তবে সত্য হলো, জীবন থেমে থাকে না। রাষ্ট্র সদয় হলে হত্যাকারীর বিচার হয়। শাস্তি হয়।
কিন্তু যে গুম হচ্ছে শুধু সেই যে শিকার হচ্ছে, তা নয়। তার পরিবার-পরিজনও একইভাবে অপরাধের শিকার হয়। দিনের পর দিন মাসের পর মাস তারা জানতে পারে না যে তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, মানত করে, বছরের পর বছর আশায় বুক বেঁধে থাকে—ছেলে, বাবা, স্বামী, ভাই এবং ক্ষেত্রবিশেষে বোন-স্ত্রী ফিরে আসবে। অনন্ত প্রতীক্ষা।
আন্তর্জাতিক সনদটিতে তাই গুমের শিকার শুধু গুম হওয়া ব্যক্তিটিই নয়, তার প্রিয়জনেরা গুমের শিকার হিসেবে স্বীকৃত।
৩০ আগস্ট—এই আন্তর্জাতিক গুম দিবসে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে আমরা গুমের শিকার আত্মীয়-পরিবারবর্গের কথা শুনব সকাল ১০টা থেকে, ‘স্বজনদের ব্যথা—গুম, খুন, নির্যাতন আর না’ ব্যানারে।
৫
গুম আমাদের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির (পেনাল কোড) বিভিন্ন ধারায় অপরাধ, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে অপরাধ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১৯৯৫-এ অপরাধ, সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯-এর অধীনেও অপরাধ, ঘাঁটাঘাঁটি না করে স্মৃতির ওপর ভর করে বলছি—আর্মি অ্যাক্টের ৫১ ধারা অনুযায়ী কোনো সেনাসদস্য যদি কোনো নাগরিককে আটক করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ না করেন, সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শত শত লোককে যেখানে নির্বিচারে হত্যা, গুম করা হচ্ছে, সেখানে অবশ্য এই ৫১ ধারার কথা বলা হাস্যকর, স্বীকার করছি।
গুম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ২০০২ (রোম স্টাটুট)-এর অধীনেও অপরাধ। কোনো দেশে যদি এই রোম স্টাটুটের অধীন অপরাধের বিচার না হয়, তাহলে রোমে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিচারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম উহুরু মুগাই কেনিয়াত্তা। তাঁর বাবার নাম জমো কেনিয়াত্তা। বাবা ছিলেন কেনিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা, জাতির জনক, প্রথম প্রেসিডেন্ট। জমো কেনিয়াত্তা প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। ২০১৩ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তাঁর সুযোগ্য পুত্র উহুরু এখন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট।
তাঁর একটা ছোট্ট কিন্তু আছে। উহুরু এবং তাঁর নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট উভয়ে গণহত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি অভিযোগে ২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারাধীন। বেচারা ভাইস প্রেসিডেন্ট বেশ কিছুদিন আন্তর্জাতিক আদালতের জেলে ছিলেন। এখন জামিনে থেকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান বিচারক বাংলাদেশে এসেছিলেন কয়েক মাস আগে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল। রোমের সে আদালত কেনিয়া থেকে অনেক দূর, বাংলাদেশ থেকেও।
গুম, খুন আর অপহরণ আর না। মানুষ মেরে সমস্যার সমাধান হবে—এই চিন্তা শুধু পশুরাই করতে পারে। আমরা মানুষ।
পশুদের নিবৃত্ত করতে এই সনদটা আমাদের দরকার। সনদটা অনুস্বাক্ষর করে সংসদে অনুমোদন করে চলুন আমরা ঘোষণা দিই যে নাৎসি জার্মানি বা তার অনুসারীদের মতো আমরা দেশ শাসন করব না। আমরা সভ্য-গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালনা করব। স্বজনদের ব্যথা শুনব আর উপলব্ধি করব কেন গুম, খুন, নির্যাতন আর না।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, অধ্যাপক ও পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
বাংলাদেশ মুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমরা বেছে নিলাম ‘সংবিধান’ শব্দটা শাসনতন্ত্রের পরিবর্তে। কথা ছিল নির্বাচনে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশ পরিচালনা করবে। তাও শুধু কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে। স্থানীয়ভাবে প্রায় সবকিছু পরিচালনা করবে স্থানীয়ভাবে স্থানীয় জনগণ দ্বারা নির্বাচিত স্থানীয় সরকার। নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা আর কিছু সিটি করপোরেশন আছে। ঢাকায় অর্থাৎ দেশের এক-দশমাংশ নাগরিকের কোনো স্থানীয় সরকার নেই। জেলা পরিষদ নেই। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো নেই। এসব নির্বাচন হয়নি। পাছে সরকারি দল আবার হেরে যায়।
যেসব নির্বাচিত স্থানীয় সরকার আছে অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ইত্যাদি—সেগুলো প্রায় ঠুঁটো জগন্নাথ। তারা তাদের এলাকা পরিচালনা করে না বা করতে পারে না বললেই চলে। শাসন করেন ইউএনও, ডিসি আর স্থানীয় সাংসদ।
তাই বলছিলাম, দেশ এখন শাসন করা হয়; পরিচালনা করা হয় না। শাসনটাও আরও পাকাপোক্ত করতে আসছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী। পঞ্চদশ আর ষোড়শ সংশোধনী মিলিয়ে যে অবস্থা দাঁড়াবে, তাতে ভাবতে হবে যে আমরা এখন সংবিধান শব্দটা বাদ দিয়ে ‘শাসনতন্ত্র’তে ফিরে যাব কি না। এ প্রসঙ্গ আরেক দিনের জন্য।
আজকের বিষয় গুম। যাঁরা দেশ পরিচালনা করেন, তাঁদের গুম করতে হয় না। শাসন করতে হলে দেশে গুম হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়, হয় অপহরণ আর নির্যাতন। ৩০ আগস্ট হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম দিবস। ইংরেজিতে এই দিবসের পুরো নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ভিকটিমস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ অর্থাৎ গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের আন্তর্জাতিক দিবস। সাধারণ পরিষদ ২০১১ সাল থেকে এই দিবসটি পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে সব দেশকে।
ঐতিহাসিকভাবে গুমের উৎপত্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী দ্বারা। প্রথমে খোদ জার্মানিতে গুম হওয়া থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতো লোকেরা জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান। আর তারপর ক্রমান্বয়ে পোল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়ার (তৎকালীন) মতো সব বিজিত দেশের লাখো মানুষকে গুম করে এবং পরে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সবচেয়ে বেশি গুমের শিকার হয় ইউরোপের ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা এবং হিটলার নিঃসন্দেহে সর্বকালের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গণহত্যাকারী।
পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে, বিশেষত সামরিক শাসকেরা হাজার হাজার গুম ও গুপ্তহত্যার হোতারূপে আবির্ভূত হন। গুয়াতেমালা, এল সালভাদরের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট দেশ থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের মতো দক্ষিণ আমেরিকার বড় বড় দেশে—গুম, অপহরণ, হত্যা চলেছিল নির্বিচারে ১৯৭০ আর ১৯৮০ এর দশকগুলোতে। কলম্বিয়া, চিলি, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া—প্রায় কোনো দেশই বাদ যায়নি শাসকগোষ্ঠীর গুম অভিযান থেকে।
গুম, অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মদদে-সহায়তায় ছোট ছোট দলের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং গোপন স্থানে আটকে রাখা, কাউকে কোনো খবর না দেওয়া বা আটকের ঘটনা অস্বীকার করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অল্প দিন বা অনেক দিন পরে ধরে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ পাওয়া। বা কখনোই কোনো খোঁজ না পাওয়া—এসবই হলো বর্বরদের রাষ্ট্র শাসন করার বহুল প্রয়োগ করা পদ্ধতি।
অনেক ক্ষেত্রে গুমের শুরু যুদ্ধাবস্থায় (যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি), গৃহযুদ্ধ বা স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় (১৯৭১ এর বাংলাদেশ, ষাটের দশকের আলজেরিয়া, সত্তরের দশকের অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক—ফিরিস্তি অনেক লম্বা) এবং সামরিক শাসনামলে এবং সর্বশেষ সংস্করণ ‘গণতান্ত্রিক শাসন আমলে’—ভারত (কাশ্মীর, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ইত্যাদি), পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ, অতীতে এবং বর্তমানেও।
গুমের টার্গেট গোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন। কিন্তু সার্বিক যুক্তি একটাই—এরা দেশ ও সমাজের জন্য হুমকি, ক্ষতিকারক, ধ্বংসাত্মক। অতএব এদের নির্মূল করা ‘জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য’। এ ধরনের ‘শত্রুরা’ বিচারেরও অযোগ্য। তাদের খতম করলে দেশ ও জাতি বাঁচবে।
খতম করা—গুম, অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা—হয়েছে ডজন ডজন দেশে লাখ লাখ মানুষ। দেশোদ্ধার হয়নি। দেশ-সমাজ বর্বর থেকে বর্বরতর হয়েছে। গুম, অপহরণ, হত্যার দশকের পর তিন-চার দশক পেরিয়ে গেছে এল সালভাদর, গুয়াতেমালার। এসব দেশে এখনো সবচেয়ে বেশি খুন হয়। যেখানে খুন বেশি, গুম বেশি।
সহিংসতা বেশি যেখানে, সেখানে (ব্যতিক্রম দু-একটা আছে) শাসকের স্থায়িত্ব তত বেশি। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ মাস দুয়েক আগে তৃতীয়বারের মতো আরও সাত বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সিরিয়ায় গত তিন বছরে প্রায় দুই লাখ লোক নিহত হয়েছে। জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের শাসনামলের বয়স এখন প্রায় ৩০ বছর। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে আসা কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন নির্বাচিত হচ্ছেন বিপুল ভোটে ক্রমাগতভাবে ১৯৮৫ থেকে।
৩.
সারা বিশ্বের গুমের প্রকোপে উদ্বিগ্ন হয়ে জাতিসংঘ ২০০২ থেকে কাজ শুরু করে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে। ইংরেজিতে নাম—ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স। এই আন্তর্জাতিক সনদটা কার্যকর হয়েছে ২১ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে আর ২০১১ থেকে ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
এ পর্যন্ত ৪৩টি দেশ সনদটি গ্রহণ করেছে, ৯৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। বলা বাহুল্য, যেসব রাষ্ট্র গুম করে তারা এই সনদ গ্রহণ করেনি। যেমন, বাংলাদেশ।
৪
যাকে হত্যা করা হয় তার জীবননাশ হয়, তার প্রিয়জনেরা বিধ্বস্ত হয়, দুর্দশাগ্রস্ত হয়, হয় সংকটাপন্ন। ব্যথিত হয়। তবে সত্য হলো, জীবন থেমে থাকে না। রাষ্ট্র সদয় হলে হত্যাকারীর বিচার হয়। শাস্তি হয়।
কিন্তু যে গুম হচ্ছে শুধু সেই যে শিকার হচ্ছে, তা নয়। তার পরিবার-পরিজনও একইভাবে অপরাধের শিকার হয়। দিনের পর দিন মাসের পর মাস তারা জানতে পারে না যে তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, মানত করে, বছরের পর বছর আশায় বুক বেঁধে থাকে—ছেলে, বাবা, স্বামী, ভাই এবং ক্ষেত্রবিশেষে বোন-স্ত্রী ফিরে আসবে। অনন্ত প্রতীক্ষা।
আন্তর্জাতিক সনদটিতে তাই গুমের শিকার শুধু গুম হওয়া ব্যক্তিটিই নয়, তার প্রিয়জনেরা গুমের শিকার হিসেবে স্বীকৃত।
৩০ আগস্ট—এই আন্তর্জাতিক গুম দিবসে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে আমরা গুমের শিকার আত্মীয়-পরিবারবর্গের কথা শুনব সকাল ১০টা থেকে, ‘স্বজনদের ব্যথা—গুম, খুন, নির্যাতন আর না’ ব্যানারে।
৫
গুম আমাদের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির (পেনাল কোড) বিভিন্ন ধারায় অপরাধ, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে অপরাধ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১৯৯৫-এ অপরাধ, সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯-এর অধীনেও অপরাধ, ঘাঁটাঘাঁটি না করে স্মৃতির ওপর ভর করে বলছি—আর্মি অ্যাক্টের ৫১ ধারা অনুযায়ী কোনো সেনাসদস্য যদি কোনো নাগরিককে আটক করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ না করেন, সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শত শত লোককে যেখানে নির্বিচারে হত্যা, গুম করা হচ্ছে, সেখানে অবশ্য এই ৫১ ধারার কথা বলা হাস্যকর, স্বীকার করছি।
গুম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ২০০২ (রোম স্টাটুট)-এর অধীনেও অপরাধ। কোনো দেশে যদি এই রোম স্টাটুটের অধীন অপরাধের বিচার না হয়, তাহলে রোমে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিচারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম উহুরু মুগাই কেনিয়াত্তা। তাঁর বাবার নাম জমো কেনিয়াত্তা। বাবা ছিলেন কেনিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা, জাতির জনক, প্রথম প্রেসিডেন্ট। জমো কেনিয়াত্তা প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। ২০১৩ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তাঁর সুযোগ্য পুত্র উহুরু এখন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট।
তাঁর একটা ছোট্ট কিন্তু আছে। উহুরু এবং তাঁর নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট উভয়ে গণহত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি অভিযোগে ২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারাধীন। বেচারা ভাইস প্রেসিডেন্ট বেশ কিছুদিন আন্তর্জাতিক আদালতের জেলে ছিলেন। এখন জামিনে থেকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান বিচারক বাংলাদেশে এসেছিলেন কয়েক মাস আগে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল। রোমের সে আদালত কেনিয়া থেকে অনেক দূর, বাংলাদেশ থেকেও।
গুম, খুন আর অপহরণ আর না। মানুষ মেরে সমস্যার সমাধান হবে—এই চিন্তা শুধু পশুরাই করতে পারে। আমরা মানুষ।
পশুদের নিবৃত্ত করতে এই সনদটা আমাদের দরকার। সনদটা অনুস্বাক্ষর করে সংসদে অনুমোদন করে চলুন আমরা ঘোষণা দিই যে নাৎসি জার্মানি বা তার অনুসারীদের মতো আমরা দেশ শাসন করব না। আমরা সভ্য-গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালনা করব। স্বজনদের ব্যথা শুনব আর উপলব্ধি করব কেন গুম, খুন, নির্যাতন আর না।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, অধ্যাপক ও পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
No comments