‘রাইত জাগি পাহারা দেই...’ by তুহিন ওয়াদুদ

গত কয়েক দিনের বন্যায় দেশের অনেক স্থানেই জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে। সরেজমিনে বন্যা-পরিস্থিতি দেখার জন্য বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন প্রতিবেদকসহ গিয়েছিলাম রংপুর-নীলফামারী-লালমনিরহাটের বন্যাদুর্গত এলাকায়। লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার দহগ্রামের সরদারপাড়ায় গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে অশ্রু সংবরণ করাÿ কঠিন। বেশ কিছু বাড়ি, একরের পর একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। টিন ও শণের কয়েকটি ঘর ঘেঁষে ভাঙনপ্রবণ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভয় হয়। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। তারপরও টিন-শণের ঘরের মানুষগুলো শিশুদের নিয়ে আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম তারা কেন এখনো অন্যত্র সরে যায়নি। আনোয়ারা নামের এক মধ্যবয়সী নারী জবাব দিলেন, ‘এই ছয় শতক জমি ছাড়া হামার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। রাস্তায় গিয়ে উঠমো সে রকম রাস্তাও নাই। সারা রাইত জাগি পাহারা দেই, কখন নদী ভাঙে। ঘুমাইলে যদি ছাওয়াল ডুবি যায়, সেই ভয়ে ঘুমাই না।’
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা জাহাঙ্গীর আঙুল তুলে দেখাচ্ছিলেন, ‘ওই-ই যে কী যেন একটা ভাসি যায়, ওইখানে হামার বাড়ি আছলো।’ ভাসমান বস্তু দেখে আর একজন বলে, ‘ও রকম করি হামার বাড়িও ভাসি গেইছে।’ একজন অশীতিপর বৃদ্ধ করুণ চোখে তাকাচ্ছিলেন, এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছিলেন। তাঁর কাছে জানতে পারলাম তাঁদের সব জমিই নদীতে। ছেলেরাও অভাবী, তাঁদের ঠিকমতো খাবার জোটে না, বৃদ্ধের তো নয়ই। একজন গণমাধ্যমকর্মী তাঁর হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, কিছু যেন কিনে খান। বৃদ্ধের চোখে বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতার চিহ্ন লক্ষ করলাম। গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে যাচ্ছে, মাইলের পর মাইল জমি বন্যায় ডুবে যাচ্ছে। বন্যা প্রতিরোধে না আছে ব্যবস্থা গ্রহণ, না আছে বন্যার্তদের পাশে পর্যাপ্ত সাহায্যের হাত।
বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রতিবছর বন্যা হয়। তার মধ্যে তিস্তা ও যমুনার তীরবর্তী এলাকায় বেশি হয়। যে বন্যা প্রতিবছর হয়, সেই বন্যা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা সরকারি পর্যায় থেকে গ্রহণ করা হয় না। অথচ এতে গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যায়, ভেঙে যায় নদীগর্ভে। কৃষিনির্ভর মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত-বিত্তহীনেরা চরম অসহায় অবস্থায় পতিত হয়। স্থানীয় পর্যায়ে যারা দিনমজুরি খাটতে সংকোচ বোধ করে, তারা চলে যায় ঢাকা-সিলেট-কুমিল্লা-নারায়ণগঞ্জ। সেখানে রিকশা চালায়, দিনমজুরি খাটে। নদীভাঙনে প্রতিবছর কত লাখ মানুষ গৃহহীন হচ্ছে, তার হিসাব আমরা রাখি না। ২৭ আগস্ট বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির করা মানচিত্রে দেখানো হয়েছে রংপুর বিভাগ সবচেয়ে বেশি দরিদ্র। এর অন্যতম কারণ, প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের গৃহহীন হয়ে পড়া। কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার বেশি হওয়ার প্রধান কারণ তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-ধরলা-দুধকুমারসহ ১৬টি নদীর ভাঙন ও বন্যা। শুধু নদীগুলোর নাব্যতা বাড়ানো গেলে এই দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল, অতিরিক্ত বৃষ্টি, বাংলাদেশে ঘনবর্ষণ ইত্যাদি ছাড়াও বন্যার কারণ নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস। তিস্তা ব্যারাজের গেজ রিডার মাহবুবুল ইসলাম বসুনিয়া জানালেন, ‘১৯৯০ সালে যখন তিস্তা ব্যারাজ চালু হয়, তখন ব্যারাজসংলগ্ন এলাকার গভীরতা ছিল ২০-২২ ফুট। এখন সেই গভীরতা অনেক স্থানে মাত্র দুই ফুট থেকে পাঁচ ফুট।’ নদী ভরাট হওয়ার কারণেই সামান্য পানিতেই তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
তিস্তা ব্যারাজের উপসহকারী প্রকৌশলী সুরতুজ্জামান বললেন, ‘এখন যে সামান্য পানির প্রবাহ তাতে নদীর গভীরতা ঠিক থাকলে বন্যা হতো না।’ নদীর প্রতি যত্ন না নেওয়ার কারণেই বন্যা হচ্ছে। খরস্রোতা নদী তিস্তায় প্রতিবছর লাখ লাখ টন বালু জমা হয়, সেই সঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে গিয়ে সেই মাটি ভরাট করে নদীর বুক। নদী যদি নিয়মিত খনন করা হতো তাহলে সামান্য বর্ষণে বন্যা হতো না।
এখন পর্যন্ত বন্যাদুর্গত ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়নি। শরতে এবার বন্যা হওয়ার কারণে নতুন করে আর ধান লাগানোর কোনো উপায়ও থাকবে না। বন্যার সময়ে প্রচুর পানিবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। সে জন্য দুর্গত এলাকার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দুর্গত মানুষগুলোর সহায়তার পাশাপাশি সরকারের উচিত বন্যার কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আনোয়ারার যাওয়ার জায়গা নেই। যদি তাঁর ঘরটি নদী কেড়ে নেয় তাহলে ছোট ছোট শিশুকে নিয়ে কোথায় উঠেছেন জানি না। এ রকম অসংখ্য পরিবার নদীভাঙনে শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে ফেলছে। চোখের সামনে বাড়িঘর যাদের ভেঙে পড়ে, যাদের জীবন-জীবিকার আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়, তাদের বাঁচার কোনো অবলম্বনই থাকে না। গত কয়েক দিনে খবরের কাগজে কিংবা টিভিতে বন্যাদুর্গত মানুষের ছবি দেখলেও তাদের দুরবস্থা কিছুটা অনুমান করা যায়। প্রথম আলোয় ২৫ আগস্ট আলোকচিত্রী মঈনুল ইসলামের তোলা সে রকম একটি ছবি প্রকাশিত হয়। ছবিতে এক কৃষকের লাগানো ধানখেত ডুবে গেছে। সেই কৃষক পানির নিচে হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন ধানগাছগুলো বেঁচে আছে না মারা গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কি ওই কৃষকের ক্ষত উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন?
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.