বিকল্প জ্বালানির উৎস সন্ধানে by হাসান কামরুল
বিশ্বব্যাপী
জ্বালানি তেলের দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্যবৃদ্ধির ফলে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল
দেশগুলোর অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া জীবাশ্ম তেলের
চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে এর মজুদও ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিশ্বব্যাপী
জ্বালানি তেলের মজুদ আগামী এক শতকের মধ্যেই প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে আসবে
বলে আশংকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা
বিবেচনা করে ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নিতে হবে।
বর্তমানে দেশে গ্যাস মজুদও আশাব্যঞ্জক নয়। এসব কারণে বিকল্প জ্বালানির উৎস
অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিকল্প জ্বালানির উৎস হিসেবে নবায়নযোগ্য জাট্রোফা
থেকে বায়োডিজেল উৎপাদন দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখতে পারে। বায়োডিজেল বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও বহুল
আলোচিত একটি বিষয়। জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা, বায়োডিজেল
তৈরিতে ব্যবহƒত গাছের প্রজাতি, জাট্রোফা প্রজাতির চাষ পদ্ধতি, চারা
সংগ্রহ, ফল সংগ্রহ ও ফল থেকে তেল উৎপাদনের পদ্ধতি, উৎপাদিত তেলের
বাজারজাতকরণ ও নীতিনির্ধারণ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল
উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ২০০৬ সালে একটি
বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটি ২০০৭ সালে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন
মন্ত্রণালয়ে দাখিল করলেও অদ্যাবধি এ বিষয়ে সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
অথচ জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল পরিবেশসম্মত উপায়ে উৎপাদন করে বাংলাদেশের
অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে দেয়া সম্ভব। উদ্ভিদ হিসেবে জাট্রোফা বাংলাদেশে
নতুন নয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ উদ্ভিদ যত্রতত্র জায়গা। বাংলাদেশে এটা ‘সাদা
মান্দার’ হিসেবে পরিচিত। জাট্রোফার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে : জাট্রোফা
কারকাস, পুনগাম, জজবা, কুসুম, মহুয়া, নিম, সাল ও সিমারওবা অন্যতম।
বাংলাদেশের বায়ু, মাটি, আবহাওয়া জাট্রোফা উৎপাদনের সহায়ক। জাট্রোফার আদি
নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। উষ্ণমণ্ডলীয় উদ্ভিদ হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকায় এটি
প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। স্বল্প উচ্চতাবিশিষ্ট এ উদ্ভিদ সাধারণত তিন থেকে
পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। জাট্রোফার প্রতিটি গাছে ৮শ’ থেকে ৯শ’ ফল
পাওয়া যায়। প্রতিটি ফলে ৩ থেকে ৪টি বীজ হয়। প্রতিটি বীজের ওজন শূন্য দশমিক ৮
গ্রাম থেকে ১ গ্রাম। সে হিসাবে প্রতিটি গাছ থেকে বছরে গড়ে ৪ থেকে ৫ কেজি
ফল পাওয়া যায়।
জাট্রোফার চারাগুলো প্রতি ২ থেকে ২ দশিক ৫ মিটার দূরত্বে রোপণ করলে প্রতি হেক্টরে ১০ থেকে ১২ টন বীজ পাওয়া যায়। প্রতিটি শুকনা বীজ থেকে ৩০-৪০ শতাংশ বায়োডিজেল পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রতি হেক্টরে প্রায় প্রতিবছর ৩-৪ হাজার লিটার বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। গাছ লাগানোর পর ৯ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যেই ফলন শুরু হয়। গাছগুলোর আয়ুষ্কাল গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জাট্রোফা ফুল ও ফল দেয়। এর ফল হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। তেল নিষ্কাশনের জন্য ফলের বীজ রোদে শুকানো হয়। উৎপাদিত বীজ সাধারণ তেল উৎপাদনের ঘানি দিয়ে বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে উৎপাদিত বায়োডিজেল কৃষি পাম্পসহ বাতি জ্বালানোর ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যবহার করা যায়। তবে যানবাহনে ব্যবহারের জন্য ঘানিতে উৎপাদিত বায়োডিজেল পরিশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। সেক্ষেত্রে রিফাইনারি প্লান্ট স্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশ বছরে গড়ে প্রায় ৩৭ লাখ টন (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এর প্রায় ২৪ লাখ টনই ডিজেল, যার মোট আমদানি মূল্য ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিপিসি বেশি দামে ডিজেল কিনে কম মূল্যে জনগণকে সরবরাহ করে। ফলে বিপিসিকে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে বায়োডিজেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আÍপ্রকাশ করতে পারে। মোট আমদানির ১০ ভাগও যদি জাট্রোফা থেকে উৎপাদন করা যায়, তাহলেও দেশে অন্তত ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং বছরে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর। এর ৪৫ ভাগ অর্থাৎ ১১ লাখ হেক্টর নিবিড় বা গহিন বনাঞ্চল। বাকি ৫৫ ভাগ বনভূমিতে জাট্রোফা চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দেশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ হেক্টর, যার অন্তত ৫ ভাগ অর্থাৎ ৩.৫ লাখ হেক্টর আইল হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। এ আইলগুলোকে জাট্রোফা চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। দেশের পার্বত্যাঞ্চল, রাস্তা, রেল লাইনের দু’পাশ ও উপকূলীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যাপক হারে জাট্রোফা চাষ করা যেতে পারে। রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চল ক্ষয়জাত ও পতিত জমি। এসব পতিত জমিতে এমনিতেই চাষাবাদ হয় না। এসব জায়গায় বায়োডিজেল উৎপাদনকারী জাট্রোফা চাষ করা যেতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচন ও বিকল্প জ্বালানি হিসেবে জাট্রোফা চাষ করে বিপ্লব আনা সম্ভব। দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উন্নয়ন, পরিবেশের ভারসাম্য এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জাট্রোফা কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হতে পারে। জাট্রোফা গাছের শিকড় ভূমির সমান্তরালে বৃদ্ধি পায় বলে এর শিকড় মাটিকে আটকে রাখে। ফলে ভূমি ক্ষয়রোধে একে দারুণভাবে কাজে লাগানো যায়। লম্বা শিকড় থাকায় এটি নদীভাঙন রোধে এবং সমুদ্র উপকূলের ভূমি উদ্ধার ও রক্ষা করার কাজে ব্যবহার করা যায়। এটি মাটির বাঁধ হিসেবেও কাজ করে। দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ৫ মিটার হওয়ায় সমুদ্র পাড়ে ঝড় রোধে এ গাছ লাগানো যায়।
বিকল্প জ্বালানির উৎসের সন্ধান পাওয়া না গেলে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা সম্ভব নয়। প্রচলিত জ্বালানি ব্যবস্থার বাইরে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানির উৎপাদন নিয়েই উন্নত বিশ্ব চিন্তিত। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির আধার দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশকেও এ বিষয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশে অতি সহজেই বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। সরকার এমনিতেই সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি পালন করে আসছে, যদি সামাজিক বনায়নেও জাট্রোফা রোপণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বায়োডিজেলের দ্বার উš§ুুক্ত হবে। সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রণীত সুপারিশমালাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে দেশের যে কোনো অঞ্চলে জাট্রোফার উৎপাদনে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার। পাইলট প্রকল্প সফল হলে পরে তা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।
হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
জাট্রোফার চারাগুলো প্রতি ২ থেকে ২ দশিক ৫ মিটার দূরত্বে রোপণ করলে প্রতি হেক্টরে ১০ থেকে ১২ টন বীজ পাওয়া যায়। প্রতিটি শুকনা বীজ থেকে ৩০-৪০ শতাংশ বায়োডিজেল পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রতি হেক্টরে প্রায় প্রতিবছর ৩-৪ হাজার লিটার বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। গাছ লাগানোর পর ৯ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যেই ফলন শুরু হয়। গাছগুলোর আয়ুষ্কাল গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জাট্রোফা ফুল ও ফল দেয়। এর ফল হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। তেল নিষ্কাশনের জন্য ফলের বীজ রোদে শুকানো হয়। উৎপাদিত বীজ সাধারণ তেল উৎপাদনের ঘানি দিয়ে বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে উৎপাদিত বায়োডিজেল কৃষি পাম্পসহ বাতি জ্বালানোর ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যবহার করা যায়। তবে যানবাহনে ব্যবহারের জন্য ঘানিতে উৎপাদিত বায়োডিজেল পরিশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। সেক্ষেত্রে রিফাইনারি প্লান্ট স্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশ বছরে গড়ে প্রায় ৩৭ লাখ টন (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এর প্রায় ২৪ লাখ টনই ডিজেল, যার মোট আমদানি মূল্য ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিপিসি বেশি দামে ডিজেল কিনে কম মূল্যে জনগণকে সরবরাহ করে। ফলে বিপিসিকে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে বায়োডিজেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আÍপ্রকাশ করতে পারে। মোট আমদানির ১০ ভাগও যদি জাট্রোফা থেকে উৎপাদন করা যায়, তাহলেও দেশে অন্তত ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং বছরে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর। এর ৪৫ ভাগ অর্থাৎ ১১ লাখ হেক্টর নিবিড় বা গহিন বনাঞ্চল। বাকি ৫৫ ভাগ বনভূমিতে জাট্রোফা চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দেশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ হেক্টর, যার অন্তত ৫ ভাগ অর্থাৎ ৩.৫ লাখ হেক্টর আইল হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। এ আইলগুলোকে জাট্রোফা চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। দেশের পার্বত্যাঞ্চল, রাস্তা, রেল লাইনের দু’পাশ ও উপকূলীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যাপক হারে জাট্রোফা চাষ করা যেতে পারে। রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চল ক্ষয়জাত ও পতিত জমি। এসব পতিত জমিতে এমনিতেই চাষাবাদ হয় না। এসব জায়গায় বায়োডিজেল উৎপাদনকারী জাট্রোফা চাষ করা যেতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচন ও বিকল্প জ্বালানি হিসেবে জাট্রোফা চাষ করে বিপ্লব আনা সম্ভব। দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উন্নয়ন, পরিবেশের ভারসাম্য এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জাট্রোফা কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হতে পারে। জাট্রোফা গাছের শিকড় ভূমির সমান্তরালে বৃদ্ধি পায় বলে এর শিকড় মাটিকে আটকে রাখে। ফলে ভূমি ক্ষয়রোধে একে দারুণভাবে কাজে লাগানো যায়। লম্বা শিকড় থাকায় এটি নদীভাঙন রোধে এবং সমুদ্র উপকূলের ভূমি উদ্ধার ও রক্ষা করার কাজে ব্যবহার করা যায়। এটি মাটির বাঁধ হিসেবেও কাজ করে। দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ৫ মিটার হওয়ায় সমুদ্র পাড়ে ঝড় রোধে এ গাছ লাগানো যায়।
বিকল্প জ্বালানির উৎসের সন্ধান পাওয়া না গেলে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা সম্ভব নয়। প্রচলিত জ্বালানি ব্যবস্থার বাইরে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানির উৎপাদন নিয়েই উন্নত বিশ্ব চিন্তিত। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির আধার দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশকেও এ বিষয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশে অতি সহজেই বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। সরকার এমনিতেই সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি পালন করে আসছে, যদি সামাজিক বনায়নেও জাট্রোফা রোপণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বায়োডিজেলের দ্বার উš§ুুক্ত হবে। সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রণীত সুপারিশমালাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে দেশের যে কোনো অঞ্চলে জাট্রোফার উৎপাদনে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার। পাইলট প্রকল্প সফল হলে পরে তা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।
হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
No comments