‘আগে দেশ বাঁচাও’ by মেহেদী হাসান পিয়াস
আগে দেশ বাঁচাও। আমাকে নিয়ে রিপোর্ট করার
দরকার নেই। আমার বাঁচা-মরাতে কিছু যায় আসে না। এখন সবার দেশের জন্য কাজ করা
দরকার। শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলানিউজ প্রতিনিধিকে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান
ল্যাব এইড হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন
‘নিউক্লিয়াস’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, রাষ্ট্র-চিন্তক সিরাজুল আলম খান।
এ সময় সপ্তাহ খানেকের ভেতর তিনি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন বলেও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন রাজনীতিক তৈরির এ কারিগর।
এ সময় কোন রাজনীতিবিদ দেখতে এসেছিলো কি না জানতে চাইলে দেশের সঙ্কট নিরসনে তাদের মনোযোগী হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
শ্বাসকষ্টজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তাকে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করেন ছোট ভাই ফেরদৌস আলম খান এবং তার স্ত্রী আশরাফুন্নেসা।
বর্তমানে তিনি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। ডা. সাইদুল ইসলাম ও অধ্যাপক বরেণ চক্রবর্তীও নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন তার।
ডা. মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, সিরাজুল আলম খান হার্টের রোগী, তার শ্বাসকষ্টজনিত রোগ (সিওপিডি) আছে। সমস্যা আছে কিডনিতে। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
সিরাজুল আলম খানের বয়স বর্তমানে ৭৪ বছর।
বৃহস্পতিবার রাত একটার দিকে হঠাৎ কাশি শুরু হয় সিরাজুল আলম খানের। সে সময় বুকেও ব্যথা অনুভব করেন তিনি। অচেতন হয়ে পড়েন মিনিট খানেকের জন্য। তখনই তাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়।
সিরাজুল আলম খানের বড় ভাই আখতার আলম খান ও ছোট ভাই ফেরদৌস আলম খানের সঙ্গেও কথা হয় হাসপাতালে।
জানা যায়, ২০০২ সালে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্টের অপারেশন হয় সিরাজুল আলম খানের। বাংলানিউজ প্রতিনিধির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে সিরাজুল আলম খানও দেন সেই তথ্য।
ল্যাব এইড কার্ডিয়াক হসপিটালের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, “সিরাজুল আলম খান সিসিইউতে রয়েছেন। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত। এছাড়াও ব্লাড প্রেসারের সমস্যা রয়েছে তার।”
সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৪-৬৫ এই দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তিনি বাঙালির ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষে ১৯৬২ সনে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। এই উদ্যোগে তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ।
১৯৬২-৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’।
আন্দোলনের এক পর্যাযে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াসে’র রাজনৈতিক উইং বি.এল.এফ. এবং সামরিক ‘জয় বাংলা বাহিনী’।
স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে ‘জয় বাংলা’-সহ সব স্লোগান নির্ধারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে “...এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বাক্যসমূহের সংযোজনের কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসে’র। এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভুমিকা ছিল মূখ্য।
৬৯-৭০ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াসে’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র-ব্রিগেড, যুব-ব্রিগেড, শ্রমিক-ব্রিগেড, নারী-ব্রিগেড, কৃষক-ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী।
এদের সদস্যরা ভেঙেপড়া পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টিমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানা উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খ্লা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে।
নিউক্লিয়াসের সদস্যদের এইসব দুরহ কাজ সম্পাদনের জন্য কৌশল ও পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র।
১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ বি.এল.এফ.-এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে। এদের প্রত্যেকেই মুক্তি্যুদ্ধ চলাকালে উন্নত সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত হন এবং ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ ১১টি সেক্টরের পাশাপাশি ৪টি সেক্টরে বিভক্ত করে বি.এল.এফ.-এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল কেবল ভিন্ন ধরণের নয়, অনেক উন্নতমানের এবং বিজ্ঞানসম্মত।
বি.এল.এফ.-এর চার প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ।
১৯৭১ সনের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় উদ্বোধনী সভা স্থগিত ঘোষণার পর পরই ২ মার্চ বাংলাদেশর প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণসহ ৩ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলার ইশতেহার’ ঘোষণার পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষে এই দুটি কাজ ছিল প্রথম দিকনির্দেশনা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যূত্থান’-এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং কর্নেল আবু তাহের।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্কশাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সঙ্গীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে ওঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা।
সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ১৯৯৬-৯৭ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়।
মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে’র আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেন তিনি।
চিরাচরিত সংসদীয় ধাঁচের ‘অঞ্চল ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের ‘বিষয়ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত ‘দুইকক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও সিরাজুল আলম খানের চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অবিবাহিত সিরাজুল আলম খান এখন দেশে-বিদেশে ‘রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে পরিচিত।
এ সময় সপ্তাহ খানেকের ভেতর তিনি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন বলেও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন রাজনীতিক তৈরির এ কারিগর।
এ সময় কোন রাজনীতিবিদ দেখতে এসেছিলো কি না জানতে চাইলে দেশের সঙ্কট নিরসনে তাদের মনোযোগী হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
শ্বাসকষ্টজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তাকে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করেন ছোট ভাই ফেরদৌস আলম খান এবং তার স্ত্রী আশরাফুন্নেসা।
বর্তমানে তিনি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। ডা. সাইদুল ইসলাম ও অধ্যাপক বরেণ চক্রবর্তীও নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন তার।
ডা. মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, সিরাজুল আলম খান হার্টের রোগী, তার শ্বাসকষ্টজনিত রোগ (সিওপিডি) আছে। সমস্যা আছে কিডনিতে। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
সিরাজুল আলম খানের বয়স বর্তমানে ৭৪ বছর।
বৃহস্পতিবার রাত একটার দিকে হঠাৎ কাশি শুরু হয় সিরাজুল আলম খানের। সে সময় বুকেও ব্যথা অনুভব করেন তিনি। অচেতন হয়ে পড়েন মিনিট খানেকের জন্য। তখনই তাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়।
সিরাজুল আলম খানের বড় ভাই আখতার আলম খান ও ছোট ভাই ফেরদৌস আলম খানের সঙ্গেও কথা হয় হাসপাতালে।
জানা যায়, ২০০২ সালে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্টের অপারেশন হয় সিরাজুল আলম খানের। বাংলানিউজ প্রতিনিধির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে সিরাজুল আলম খানও দেন সেই তথ্য।
ল্যাব এইড কার্ডিয়াক হসপিটালের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, “সিরাজুল আলম খান সিসিইউতে রয়েছেন। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত। এছাড়াও ব্লাড প্রেসারের সমস্যা রয়েছে তার।”
সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৪-৬৫ এই দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তিনি বাঙালির ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষে ১৯৬২ সনে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। এই উদ্যোগে তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ।
১৯৬২-৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’।
আন্দোলনের এক পর্যাযে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াসে’র রাজনৈতিক উইং বি.এল.এফ. এবং সামরিক ‘জয় বাংলা বাহিনী’।
স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে ‘জয় বাংলা’-সহ সব স্লোগান নির্ধারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে “...এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বাক্যসমূহের সংযোজনের কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসে’র। এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভুমিকা ছিল মূখ্য।
৬৯-৭০ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াসে’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র-ব্রিগেড, যুব-ব্রিগেড, শ্রমিক-ব্রিগেড, নারী-ব্রিগেড, কৃষক-ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী।
এদের সদস্যরা ভেঙেপড়া পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টিমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানা উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খ্লা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে।
নিউক্লিয়াসের সদস্যদের এইসব দুরহ কাজ সম্পাদনের জন্য কৌশল ও পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র।
১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ বি.এল.এফ.-এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে। এদের প্রত্যেকেই মুক্তি্যুদ্ধ চলাকালে উন্নত সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত হন এবং ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ ১১টি সেক্টরের পাশাপাশি ৪টি সেক্টরে বিভক্ত করে বি.এল.এফ.-এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল কেবল ভিন্ন ধরণের নয়, অনেক উন্নতমানের এবং বিজ্ঞানসম্মত।
বি.এল.এফ.-এর চার প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ।
১৯৭১ সনের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় উদ্বোধনী সভা স্থগিত ঘোষণার পর পরই ২ মার্চ বাংলাদেশর প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণসহ ৩ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলার ইশতেহার’ ঘোষণার পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষে এই দুটি কাজ ছিল প্রথম দিকনির্দেশনা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যূত্থান’-এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং কর্নেল আবু তাহের।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্কশাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সঙ্গীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে ওঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা।
সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ১৯৯৬-৯৭ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়।
মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে’র আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেন তিনি।
চিরাচরিত সংসদীয় ধাঁচের ‘অঞ্চল ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের ‘বিষয়ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত ‘দুইকক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও সিরাজুল আলম খানের চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অবিবাহিত সিরাজুল আলম খান এখন দেশে-বিদেশে ‘রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে পরিচিত।
No comments