১৪ দল বিস্মিত, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম অসন্তুষ্ট, ভুক্তভোগীরা ক্ষুব্ধ- মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় হতাশা, ক্ষোভ
হঠাৎ যেন ঘোরমুক্ত হলো মুক্তিযুদ্ধের
বাংলাদেশ। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে করা মামলার রায় গতকাল দুপুরে যে হতাশার
জন্ম দিয়েছে, বিকেলে তার প্রকাশ ঘটতে শুরু করে ক্ষোভ হিসেবে।
আর সন্ধ্যায় তরুণ প্রজন্ম ঢাকায় শুরু করে প্রকাশ্য প্রতিবাদ। ১৯৭১ সালে
‘কসাই কাদের’ হিসেবে পরিচিত কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় প্রতিবাদ
হয়েছে সারা দেশে। জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লাকে দেওয়া যাবজ্জীবন
কারাদণ্ডের রায়ে হতাশা আর বিস্ময় প্রকাশ করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগও। হতাশ
মহাজোটভুক্ত ১৪ দল। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এসব দলের নেতারা
বলছেন, যে রায় হয়েছে, তা তাদের ‘প্রত্যাশা’ পূরণ করেনি। অসন্তোষের কথা
জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরাও। আর ভুক্তভোগী শহীদ পরিবার ও মামলার
সাক্ষীদের হতাশা-ক্ষোভ কান্না হয়ে ঝরেছে। তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি
যথারীতি নিশ্চুপ, কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দলটি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সব যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবিতে আজ বুধবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে।
রায় প্রত্যাখ্যান করে এবং কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। কুমিল্লায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাংশ বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিল থেকে জামায়াতের নেতাদের মালিকানাধীন ভবন ভাঙচুর করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে হরতালে পিকেটিংরত জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের রায়ের পর আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
গতকাল রায় ঘোষণার সময় ১৪ দলের বৈঠক চলছিল ধানমন্ডিতে আ.লীগের সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে।
সেখানেই এই রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ১৪ দলের নেতারা। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতারাও রায়ের তথ্য শুনে অবাক হয়েছেন। সবাই বলছেন, ‘রায় কাউকে খুশি করতে পারেনি।’
আওয়ামী লীগের মাঝারি পর্যায়ের ও সহযোগী সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের রায় ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। রায় ঘোষণার পর আনন্দ মিছিল বের করা হবে—এমন প্রস্তুতি ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ধানমন্ডির কার্যালয়ে। কিন্তু তা আর হয়নি।
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আজ বুধবার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে বিশিষ্ট নাগরিক, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসীরা নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। তবে অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রথমে প্রতিবাদ আর অসন্তোষের প্রকাশ ঘটায় তরুণ প্রজন্ম। বিকেলে তারা শাহবাগের মোড়ে জমায়েত হয় এবং মোমবাতি জালিয়ে, মশাল মিছিল করে, প্রতিবাদী গানে-স্লোগানে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। লাগাতার চলার ঘোষণা দেওয়া এই কর্মসূচিতে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একাত্মতা জানিয়েছে।
১৪ দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া: ১৪ দলের বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তিনি বলেন, ‘যিনি নিজ হাতে মানুষ খুন করেছেন, ১৪ দল ও জাতি আশা করেছিল, তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে। আদালতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমরা জেনেছি, এই রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল করবেন। আমরা প্রত্যাশা করছি, সেখানে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, ‘রায়ে আপনি সন্তুষ্টও হতে পারেন, অসন্তুষ্টও হতে পারেন। তবে আমরা মনে করি, রায় আমাদের প্রত্যাশামতো হয়নি। কারণ, নিজ হাতে মানুষ খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ গুরুতর অপরাধ করেছেন কাদের মোল্লা। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও পুরো জাতি এই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছিল।’
তিন সাক্ষীর প্রতিক্রিয়া: কবি কাজী রোজী ছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চুতর্থ সাক্ষী। কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যা করা শহীদ কবি মেহেরুননিসার বন্ধু ছিলেন কাজী রোজী। তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘প্রচণ্ড রকম হতাশ হয়েছি রায় শুনে। এ রায় আমি চাইনি। এটি জনতার রায় নয়। এই রায় কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সরকারের যদি সুযোগ থাকে, তাহলে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী। তিনি বলেন, ‘কাদের মোল্লার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে এই শাস্তি অতি নগণ্য। এ রায় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কাদের মোল্লার কারণে আমার বাবা প্রাণ হারিয়েছেন। এরপর আমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাকি জীবন তাঁকে এভাবেই কাটাতে হয়। আমরা আশা করেছিলাম, কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হবে। তাহলে হয়তো বাবা হারানোর শোক, মায়ের অসুস্থতার ব্যথা কিছুটা কাটাতে পারতাম। কিন্তু এই রায় আমাদের হতাশ করেছে।’
রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী ও একাত্তরের মামা গেরিলা বাহিনীর প্রধান শহীদুল হক মামা বলেন, ‘একাত্তরে যাঁরা কাদের মোল্লাকে দেখেছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন কতটা নিষ্ঠুর ছিল সে।’ বিদেশ থেকে এসে এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদুল হক। আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আইন ও দেশের স্বাধীনতার চেয়ে রাজাকারের জীবন রক্ষা করা কি বড় হয়ে গেল?’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারী সেক্টর কামান্ডারস ফোরামও রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে ফোরামের চেয়ারম্যান এ কে খোন্দকার, কে এম সফিউল্লাহ, আবু ওসমান চৌধুরী ও হারুন হাবীব বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ হতাশা ও চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে।
প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও যে রায় দেওয়া হয়েছে, তা জাতির প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। অবিলম্বে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার দাবি জানায় ফোরাম।
আরও প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রায়কে গুরু অপরাধে লঘু শাস্তি অবিহিত করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের সভাপতি কামাল লোহানী ও সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার বলেন, ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও কেন কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো না, তা তাঁদের কাছে বোধগম্য নয়।
সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চ মনে করে, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বিচারিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) রায়ে মর্মাহত, অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ বলে উল্লেখ করেছে। কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবিতে আজ বুধবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে দল দুটি।
শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি: ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন একটিভিস্ট নেটওয়ার্কের কর্মীদে ডাকে শাহবাগে বিকেল থেকে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ কর্মসূচি। জমায়েতে সরব উপস্থিতি দেখা গেছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও নারীবাদী সংগঠনের কর্মীদের। তাঁরা গানে গানে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। তাঁদের হাতে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি-সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন। মোমবাতি জ্বালিয়ে ও মশাল হাতে প্রতিবাদ করেছেন তাঁরা।
সন্ধ্যায় সেখানে এসে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, গণ-ঐক্যের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আজ বুধবারও তাঁরা রাস্তায় থাকবেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। এতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) অন্যরাও অংশ নেবে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আজ শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাবে।
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, প্রজন্ম ’৭১, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, পেশাজীবী নারী সমাজ, বাংলাদেশ নারী মুক্তি আন্দোলন, জাসদ ছাত্রলীগ, বিশ্ব কবিতাকণ্ঠ পরিষদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, গণ-অধিকার পার্টি প্রভৃতি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সব যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবিতে আজ বুধবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে।
রায় প্রত্যাখ্যান করে এবং কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। কুমিল্লায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাংশ বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিল থেকে জামায়াতের নেতাদের মালিকানাধীন ভবন ভাঙচুর করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে হরতালে পিকেটিংরত জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের রায়ের পর আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
গতকাল রায় ঘোষণার সময় ১৪ দলের বৈঠক চলছিল ধানমন্ডিতে আ.লীগের সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে।
সেখানেই এই রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ১৪ দলের নেতারা। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতারাও রায়ের তথ্য শুনে অবাক হয়েছেন। সবাই বলছেন, ‘রায় কাউকে খুশি করতে পারেনি।’
আওয়ামী লীগের মাঝারি পর্যায়ের ও সহযোগী সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের রায় ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। রায় ঘোষণার পর আনন্দ মিছিল বের করা হবে—এমন প্রস্তুতি ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ধানমন্ডির কার্যালয়ে। কিন্তু তা আর হয়নি।
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আজ বুধবার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে বিশিষ্ট নাগরিক, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসীরা নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। তবে অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রথমে প্রতিবাদ আর অসন্তোষের প্রকাশ ঘটায় তরুণ প্রজন্ম। বিকেলে তারা শাহবাগের মোড়ে জমায়েত হয় এবং মোমবাতি জালিয়ে, মশাল মিছিল করে, প্রতিবাদী গানে-স্লোগানে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। লাগাতার চলার ঘোষণা দেওয়া এই কর্মসূচিতে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একাত্মতা জানিয়েছে।
১৪ দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া: ১৪ দলের বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তিনি বলেন, ‘যিনি নিজ হাতে মানুষ খুন করেছেন, ১৪ দল ও জাতি আশা করেছিল, তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে। আদালতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমরা জেনেছি, এই রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল করবেন। আমরা প্রত্যাশা করছি, সেখানে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, ‘রায়ে আপনি সন্তুষ্টও হতে পারেন, অসন্তুষ্টও হতে পারেন। তবে আমরা মনে করি, রায় আমাদের প্রত্যাশামতো হয়নি। কারণ, নিজ হাতে মানুষ খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ গুরুতর অপরাধ করেছেন কাদের মোল্লা। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও পুরো জাতি এই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছিল।’
তিন সাক্ষীর প্রতিক্রিয়া: কবি কাজী রোজী ছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চুতর্থ সাক্ষী। কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যা করা শহীদ কবি মেহেরুননিসার বন্ধু ছিলেন কাজী রোজী। তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘প্রচণ্ড রকম হতাশ হয়েছি রায় শুনে। এ রায় আমি চাইনি। এটি জনতার রায় নয়। এই রায় কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সরকারের যদি সুযোগ থাকে, তাহলে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী। তিনি বলেন, ‘কাদের মোল্লার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে এই শাস্তি অতি নগণ্য। এ রায় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কাদের মোল্লার কারণে আমার বাবা প্রাণ হারিয়েছেন। এরপর আমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাকি জীবন তাঁকে এভাবেই কাটাতে হয়। আমরা আশা করেছিলাম, কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হবে। তাহলে হয়তো বাবা হারানোর শোক, মায়ের অসুস্থতার ব্যথা কিছুটা কাটাতে পারতাম। কিন্তু এই রায় আমাদের হতাশ করেছে।’
রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী ও একাত্তরের মামা গেরিলা বাহিনীর প্রধান শহীদুল হক মামা বলেন, ‘একাত্তরে যাঁরা কাদের মোল্লাকে দেখেছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন কতটা নিষ্ঠুর ছিল সে।’ বিদেশ থেকে এসে এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদুল হক। আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আইন ও দেশের স্বাধীনতার চেয়ে রাজাকারের জীবন রক্ষা করা কি বড় হয়ে গেল?’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারী সেক্টর কামান্ডারস ফোরামও রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে ফোরামের চেয়ারম্যান এ কে খোন্দকার, কে এম সফিউল্লাহ, আবু ওসমান চৌধুরী ও হারুন হাবীব বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ হতাশা ও চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে।
প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও যে রায় দেওয়া হয়েছে, তা জাতির প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। অবিলম্বে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার দাবি জানায় ফোরাম।
আরও প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রায়কে গুরু অপরাধে লঘু শাস্তি অবিহিত করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের সভাপতি কামাল লোহানী ও সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার বলেন, ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও কেন কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো না, তা তাঁদের কাছে বোধগম্য নয়।
সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চ মনে করে, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বিচারিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) রায়ে মর্মাহত, অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ বলে উল্লেখ করেছে। কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবিতে আজ বুধবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে দল দুটি।
শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি: ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন একটিভিস্ট নেটওয়ার্কের কর্মীদে ডাকে শাহবাগে বিকেল থেকে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ কর্মসূচি। জমায়েতে সরব উপস্থিতি দেখা গেছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও নারীবাদী সংগঠনের কর্মীদের। তাঁরা গানে গানে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। তাঁদের হাতে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি-সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন। মোমবাতি জ্বালিয়ে ও মশাল হাতে প্রতিবাদ করেছেন তাঁরা।
সন্ধ্যায় সেখানে এসে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, গণ-ঐক্যের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আজ বুধবারও তাঁরা রাস্তায় থাকবেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। এতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) অন্যরাও অংশ নেবে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আজ শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাবে।
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, প্রজন্ম ’৭১, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, পেশাজীবী নারী সমাজ, বাংলাদেশ নারী মুক্তি আন্দোলন, জাসদ ছাত্রলীগ, বিশ্ব কবিতাকণ্ঠ পরিষদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, গণ-অধিকার পার্টি প্রভৃতি।
No comments