বিপন্ন তুরস্কের গণতন্ত্র by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একরেম ইমামোগলুকে জেলে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে বিপন্ন করে তুলেছেন তুরস্কের গণতন্ত্রকে। তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করে বলা যায়, মেয়র একরেম ইমামোগলু তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) প্রার্থী। তার দল বলছে, প্রায় দেড় কোটি ভোটার আছে তার। সামনের নির্বাচনে তিনি বিরোধী দলের তারকা রাজনীতিক। তার নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু তাকে দমিয়ে রাখতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বিচারবিভাগকে ব্যবহার করছেন। গ্রেপ্তারের পর তাকে পাঠানো হয়েছে জেলে। এই জেল কয়েক মাসের হতে পারে। আবার কয়েক বছরেরও হতে পারে। তাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৩শে মার্চ ইস্তাম্বুলের সিটি হলের বাইরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে বিপুল সংখ্যক মানুষ।

ইমামোগলুকে আরও অনেক সময় জেলে থাকতে হতে পারে। কয়েকদিন আগে আদালতের আদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচার রয়েছে মুলতবি। বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে দীর্ঘ কয়েক বছর সাজা হতে পারে তার। ওদিকে সিটি কাউন্সিল আগামী ২৬শে মার্চ নতুন একজন মেয়ার নির্বাচন করবে। এই সিটি কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সিএইচপি’র। গত সপ্তাহে সিএইচপি প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়। এরপরই অনেক প্রার্থী আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার মধ্যে প্রাইমারিতে একটিমাত্র নাম ব্যালটে উঠে আসে। সেই নামটি হলো একরেম ইমামোগলু। ইকোনমিস্ট লিখেছে, তুরস্ক এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। গত সপ্তাহে এ দেশটির সরকারকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রতিযোগিতামূলক এক কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর বলে অভিহিত করছিলেন। দেশের নির্বাহী ক্ষমতায় একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল প্রেসিডেন্ট এরদোগানের। আদালত এবং বেশির ভাগ মিডিয়ার ওপর ছিল অবাধ নিয়ন্ত্রণ। তা সত্ত্বেও তুরস্কের নির্বাচন কিছুটা অবাধ ছিল। কিন্তু ১৯শে মার্চ একরেম ইমামোগলুকে পুলিশ আটক করে। তিনিই অন্য কয়েকডজন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন।
দেশটিতে এখন যা আছে তা হলো নগ্ন স্বৈরতন্ত্রের কাছাকাছি।  দেশটিতে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৮ সালে বা তারও আগে। আসন্ন ওই নির্বাচনের আগে যদি একরেম ইমামোগলু মুক্তিও পান, তবু তাকে অপরিসীম বাধার মুখোমুখি হতে হবে। তাকে আটক করার আগের দিন কর্তৃপক্ষ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা ডিগ্রি বাতিল করেছে। তুরস্কের আইন অনুযায়ী, কাউকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হলে ন্যূনতম এই ডিগ্রি থাকতেই হবে। এর নিচে ডিগ্রি থাকলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। একরেম ইমামোগলুর বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপকে নিতান্তই রাজনৈতিক বলে বর্ণনা করছেন বিরোধীরা ও স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা। তারা আরও বলছেন, এই মেয়রের বিরুদ্ধে একই কারণে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে সন্ত্রাসী সংগঠনে জড়িয়ে পড়া, দুর্নীতি এবং সরকারি টেন্ডারে জালিয়াতি। তাকে গ্রেপ্তারের ফলে তুরস্কে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের। এ সময় পুলিশ জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করেছে। কোনোই সুযোগ দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে কমপক্ষে ৩৪০ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। এক সপ্তাহের জন্য গণজমায়েত নিষিদ্ধ করে নির্দেশ জারি করেছে সরকার। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তা তোয়াক্কাই করছে না। বহু সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর গলা টিপে ধরা হয়েছে। এ অবস্থায় ইস্তাম্বুলের গভর্নর সতর্ক করে বলেছে, প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিতে বিক্ষোভকারীদের শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে বা বের হতে দেয়া হবে না।

কয়েক বছর ধরে আদালতে অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন একরেম ইমামোগলু। ২০১৯ সালের মেয়র নির্বাচনে এরদোগানের প্রার্থীকে তিনি পরাজিত করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ফলকে উল্টে দেয়। এর ফলে কয়েক মাস পরে আবারো তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য হন। তাতে তিনি বড় ব্যবধানে জয়ী হন। প্রথমবার তার জয় কেড়ে নেয়া ব্যক্তিদের তিনি ‘বোকা’ বলে অভিহিত করেন। এ কারণে তাকে কমপক্ষে দুই বছরের জেল দেয়া হয় ২০২২ সালে। এ ছাড়া কয়েক ডজন অভিযোগের তদন্ত চলছে তার বিরুদ্ধে। গত বছর স্থানীয় নির্বাচনে তিনি বড় ব্যবধানে জয় পান। ১৯৭০-এর দশকের পর সিএইচপি সবচেয়ে ভালো ফল দেখায় এ সময়।
দীর্ঘদিন লড়াইয়ে টিকে আছেন ইমামোগলু। ফলে তুরস্কের নেতা এরদোগানের জন্য তিনি খুব বেশি বিপজ্জনক বলে পরিগণিত হতে থাকেন। কয়েক মাস ধরে জনমত জরিপে এরদোগানের চেয়ে স্বস্তিদায়কভাবে এগিয়ে ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তার আছে বিপুল শক্তি। তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের প্রার্থী। ইউরোপের সবচেয়ে বড় শহর চালান তিনি। তার আছে বিপুল ক্যারিশমা। আমেরিকান থিংক-ট্যাংক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ছোনার ক্যাগাপটায় বলেন, এরদোগান এবং তার লোকজন ইমামোগলুকে দেখেছে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে। শীর্ষ একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিয়ে তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য বড় ক্ষতি করবেন। এটা জেনেই বড় রকমের ঝুঁকি নিয়েছেন এরদোগান। অন্তত একইভাবে বলা যায়, তিনি সঠিক। সেটা হলো ইউরোপ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। এর কারণ আছে। তা হলো ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির পর সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে চায় ইউরোপিয়ান শক্তিধররা। তাতে তুরস্কের অংশগ্রহণ চায় তারা। মনে করে ইউরোপের নিরাপত্তায় তুরস্ক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও তার পক্ষ থেকে খুব কমই প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। ২১শে মার্চ ফক্স নিউজ রিপোর্টে বলেছে, তুরস্কের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি বন্ধ না করার কথা বিবেচনা করছেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। আগামী মাসে হোয়াইট হাউস সফরের আশা করছেন এরদোগান। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করা নিয়ে ট্রাম্পের যেহেতু কমই উদ্বেগ আছে, তাই তুরস্কের স্ট্রংম্যান এরদোগান তার কৌশল প্রয়োগের টিকিট হাতে পেয়ে গেছেন।

ওদিকে একরেম ইমামোগলুকে গ্রেপ্তারের ফলে অর্থবাজার এলার্ম বাজিয়ে দিয়েছে। ইমামোগলুকে আটকের তিন দিন পর তুরস্কের  শেয়ারবাজারের সূচকের পতন হয়েছে শতকরা ১৬.৩ ভাগ। তুরস্কের মুদ্রা লিরা’র অবনমন হচ্ছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাব করছে ২৬০০ কোটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়তে পারে।

(দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)

mzamin

No comments

Powered by Blogger.