ভারত-চীন সম্পর্ক: চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি

চারটি প্রতিবেশী দেশ ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ছাড়াও রয়েছে মালদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা। সমপ্রতি এই দেশগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে। যার মূলে চীন। যে দেশগুলোর কথা উল্লেখ করা হলো সেগুলোর প্রতিটিই চীনমুখী রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী। কেননা, তাদের ভূখণ্ডে দিল্লির আধিপত্য ঠেকাতে বেইজিংই তাদের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বিষয়টিতে গভীর মনোযোগ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ যখন চীনমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে আগ্রহী তখন মোদির বেইজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনার বরফ না গলিয়ে আর উপায় থাকে না। বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সম্পর্কে এখন ইতিবাচকতা চান মোদি। তবে এটা কতোটা সম্ভব?

বৃটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিতে প্রকাশিত মাইকেল কুগেলম্যানের এক লেখায় বলা হয়েছে, সমপ্রতি সাক্ষাৎকারে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক সুরে কথা বলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত-চীন সীমান্ত নিয়ে যে উত্তেজনা ছিল তা এখন স্বাভাবিক হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এর ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। উত্তর লাদাখের সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকেই উত্তেজনা চলছে। ২০২০ সালে ওই অঞ্চলে ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষে জড়ায় দুই দেশ। যা ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে মারাত্মক। এই ইতিহাস সামনে রেখে বিবেচনা করলে মোদির মন্তব্যগুলো বেশ আকর্ষণীয়। মোদির কথায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং। বলেছেন, দুই দেশের এমন অংশীদার হওয়া উচিত যারা একে অপরের সাফল্যে অবদান রাখে। দিল্লি-বেইজিংয়ের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগত অংশীদারিত্বের জন্য মোদির প্রস্তাব যত বড় বলে মনে হলেও বিষয়টা এত সহজ নয়। কেননা, সম্পর্কের মধ্যে এখনো টানাপড়েন রয়েছে। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উপভোগ করতে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গা রয়েছে। যেমন দিল্লি এবং বেইজিংয়ের বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী। লাদাখ সংঘর্ষের পরেও চীনের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। এর মাধ্যমে এশিয়াতে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশ বড় ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া পশ্চিমা অর্থনৈতিক মডেল প্রসার রোধ, ইসলামী চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং মার্কিন মোরাল ক্রসেডিং প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে দুই দেশের আগ্রহের মিল রয়েছে। লাদাখে সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে কয়েক দশক ধরে সম্পর্কের মজবুতি তলানিতে ঠেকলেও উভয় দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। এতে তারা কিছুটা সফলতাও পেয়েছে। যেমন গত অক্টোবরে লাদাখ সীমান্তে পুনরায় টহল শুরু করার বিষয়ে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। সে সময় রাশিয়া অনুষ্ঠিত ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মোদি। নিজেদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেন উভয় নেতা। এ ছাড়া জানুয়ারি থেকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরুতে সম্মত হন তারা।

এরপরেও চীন ও ভারতের সম্পর্কে বেশ কিছু সমস্যা আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রতিটি দেশেই একে অপরের প্রধান শত্রু রাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। চীনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে ভারতের ক্ষেত্রে পাকিস্তান। এখানে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক থাকলেও ভারতের ওয়াশিংটনের বেশ সখ্যতা রয়েছে। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ক থাকলেও ইসলামাবাদ ভারতের চীর শত্রু। এই সমস্যার পাশাপাশি কাশ্মীর নিয়েও ভারতে সম্পর্ক বেশ জটিল। কেননা, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিরোধিতা করে চীন। অন্যদিকে পারমাণবিক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে ভারতের সদস্যপদ ঠেকাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ আটকে দিয়েছে বেইজিং। যাতে নয়াদিল্লির পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আশাহত হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের বৃহত্তর সামুদ্রিক এলাকায় চীনের বিশাল নৌ উপস্থিতি এবং একমাত্র বিদেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এশিয়া প্রভাব বিস্তারে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়েও বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির উত্তেজনা চলছে। এখানেই শেষ নয়। দুই দেশের সম্পর্কের জটিলতা আরও গভীর। যেমন চীনের বিদ্রোহী প্রদেশ হিসেবে চিহ্নিত তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে ভারত। যা কখনই ভালোভাবে নেয় না চীন। এর সঙ্গে তিব্বতের দালাই লামার বিষয়েও বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক বেশ খারাপ। অন্যদিকে ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির বিষয়ে আলোচনা করছে। এসব অস্ত্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। ভারত যে কয়েকটি বৈশ্বিক ফোরামের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াড এবং মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর; যা চীনের প্রভাব প্রতিহত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে বেইজিং। দুই দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে জানতে আরও বেশ কয়েকটি বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে সীমান্ত আলোচনা। ২১০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তের পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এখন সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সীমান্ত পরিস্থিতি। লাদাখ সংঘর্ষ দুই দেশের অনাস্থা জাগিয়ে দিয়েছে। যদিও গত বছরের টহল চুক্তি তা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে। উভয় পক্ষ আরও আস্থা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তবে এটি সম্পর্কের জন্য ভালো হবে।

এ বছর মোদি-শি’র মধ্যে সাক্ষাতের বেশ কয়েকটি সুযোগ রয়েছে। যেমন জুলাইতে ব্রিকস সম্মেলন, নভেম্বরে জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলন এবং বছর শেষে সাংহাই কো-অপারেশন গ্রুপের (এসসিও) সম্মেলন। এসব সম্মেলনে উভয় দেশের নেতাই অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তারা চাইলে সম্মেলনগুলোর ফাঁকে বৈঠক করতে পারেন। যেখানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে বিশেষ জোর দেয়া যেতে পারে। কেননা, এগুলো দুই দেশের ভবিষ্যতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চীনের বিনিয়োগ। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সম্পর্কগুলোও উল্লেখযোগ্য। ভারতের চার প্রতিবেশী হচ্ছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা। সমপ্রতি দেশগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। যারা তাদের পূর্বসূরিদের তুলনায় অধিক চীনঘেঁষা। যদিও এখন পর্যন্ত, উক্ত দেশগুলো চীনের সঙ্গে জোট বাঁধার পরিবর্তে বেইজিং ও দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বেইজিংয়ের প্রভাব সম্পর্কে দিল্লির উদ্বেগ কিছুটা কমতে পারে। উপরন্তু, যদি চীন ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব থেকে সরে আসে তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটবে, যা বেইজিংয়ের ওপর মস্কোর নির্ভরতা আরও গভীর করবে। এটি ভারত-চীন সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। দুই দেশের সম্পর্কের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও এখন বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছেন। চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা সত্ত্বেও বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়েছে দিল্লি। এক্ষেত্রে ট্রাম্প যদি শুল্ক নীতিতে অটল থাকেন তাহলে চীনের বিরুদ্ধে ভারত ওয়াশিংটনের সহায়তা পাবে না বলেই ধরে নেয়া যায়। এতে ভারত চীনের সঙ্গেই সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.