আরজিকর কাণ্ডে রায় দিতে গিয়ে বললেন বিচারক: 'দেখে মনে হয়নি বিরলতম ঘটনা, তাই ফাঁসি নয়' by সেবন্তী ভট্টাচার্য্য
আরজিকরে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ-খুন মামলায় ১৬৪ দিনের মাথায় দোষী সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণা করলেন শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণের জন্য মৃত্যু), ১০৩ (১) (খুন) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে। বিচারক জানিয়েছেন, আরজি করের ঘটনাকে ‘বিরল থেকে বিরলতম অপরাধ’ বলে মনে করছেন না। তাই আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে সঞ্জয়কে। জরিমানাও করা হয়েছে। সেইসঙ্গে নির্যাতিতা চিকিৎসকের পরিবারকে ১৭ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্য সরকারকে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে সঞ্জয় এবং নির্যাতিতার পরিবারের সামনে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। শিয়ালদহ আদালতের ২১০ নম্বর কোর্টরুম। কোর্টরুমে সঞ্জয়ের আইনজীবীরা দাবি করেন, এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা নয়। মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে সওয়ালও করেন তারা। সঞ্জয় তখন নির্লিপ্ত ভাবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফের দাবি করতে থাকল সে নির্দোষ। ফাঁসানো হয়েছে তাকে। বিচারক সঞ্জয়ের কাছে জানতে চান, 'আপনি আপনার কথা আগেও বলেছেন। যা হয়েছে, আপনার থেকে ভাল আর কেউ জানেন না। বাড়িতে কে আছেন আপনার?' উত্তরে সঞ্জয় বলে, 'মা'। বিচারক জানতে চান, 'বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?' সঞ্জয় জানায়, সে ব্যারাকে থাকত। মায়ের- তার কোনও যোগাযোগই ছিল না। এরপরই বিচারক জানতে চান, 'আপনি যে নির্দোষ সেটা ছাড়া আর কিছু বলতে চান?' সঞ্জয় জানায়, 'যে কাজটা আমি করিনি তাতে দোষী বলা হচ্ছে। আরজি কর মামলার শুনানি শুরু হওয়ার পর একদিনও সঞ্জয়ের মা শুনানিতে যাননি। এই নিয়ে তার মন্তব্য, ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি মিথ্যে হত, তাহলে হয়তো তিনি যেতেন। কিন্তু দোষ প্রমাণ হয়েছে। তাই নির্যাতিতার বাবা-মার মতো তিনিও তার কঠোর শাস্তি চাইছেন। সঞ্জয়ের মায়ের কথায়, ‘নিহত চিকিৎসক আমার মেয়ের মতোই। তাই তার মায়ের যন্ত্রণা আমি অনুভব করতে পারি।’ গত বছরের ৯ আগস্ট, হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ, ধর্ষণ করে খুন করা হয় তাকে। তদন্তে নামে কলকাতা পুলিশ। ১০ আগস্ট এই ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়।
কলকাতায় চাঞ্চল্যকর নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাবাস
কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ারকে আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি দিযেছেন শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারক অনির্বাণ দাস। সোমবার বিচারক এই শাস্তির রায় ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে তিনি নির্যাতিতার পরিবারকে ১৭ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছেন। সাজা ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, এটি বিরলতম অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। এর আগে গত শনিবার বিচারক নারী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণে যুক্ত থাকার অভিযোগে এককভাবে কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করেন। সেদিনই তিনি জানিয়েছিলেন, সোমবার শাস্তির রায় ঘোষণা করবেন।
গত বছরের ৯ আগস্ট কলকাতার আরজি কর হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার হল থেকে এক নারী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। তাকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। গত ৪ নভেম্বর মামলায় চার্জ গঠনের পরে ১১ নভেম্বর থেকে দীর্ঘ শুনানি চলে। গত ১৮ জানুয়ারি ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণের পর মৃত্যু) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে।
সোমবার রায় ঘোষণার আগে বিচারক অভিযুক্তের বক্তব্য শোনেন। আগের দিনের মতই অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় দাবি করেন, তিনি নির্দোষ। তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তবে সিবিআইয়ের আইনজীবী অভিযুক্তের কঠোরতম শাস্তির দাবি জানান। নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবীও অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করেন।
তবে বিচারকের শাস্তির রায়কে সকলে স্বাগত জানালেও নির্য়াতিতা নারী চিকিৎসকের পরিবারসহ নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশ মনে করেন, অভিযুক্তের একার পক্ষে এই নারকীয় কাজ করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত। তাদের কন্যার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ন্যায় বিচার না পাওয়া পর্যন্ত নির্যাতিতার পিতা-মাতা লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন। তারা বলেন , আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না। আমরা বিচার চাই। ইতিমধ্যেই তারা সুপ্রিম কোর্টেও আবেদন করেছেন। নির্যাতিতার পিতা জানান, তারা যে ৬৭টি প্রশ্ন তুলেছেন তার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তারা থামবেন না।
প্রথমে ঘটনার তদন্তে নেমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করেছিল কলকাতা পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একাধিক ‘বায়োলজিক্যাল’ এবং ‘ডিজিটাল’ তথ্যপ্রমাণও সংগ্রহ করেছিল তারা। পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআইও তদন্ত চালিয়ে আটক সিভিক ভলান্টিয়ারকেই ‘একমাত্র অভিযুক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করে আদালতে চার্জশিট পেশ করে।
তার দু’মাস পর রায় ঘোষণা হলো। তবে ধর্ষণ-খুনের মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেপ্তার করে সিবিআই। যদিও তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ফলে ওই মামলায় সন্দীপ এবং অভিজিৎ দু’জনেই জামিন পেয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে কবে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেয়া হবে তা এখনও জানা যায়নি।
অভিযুক্তের শাস্তি প্রসঙ্গে আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের বক্তব্য, জুনিয়র ডাক্তার থেকে সিনিয়র ডাক্তার ,সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই বলেছি, একটা বৃহত্তর প্রমাণ লোপাটের ষড়যন্ত্র এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। বারে বারে তা প্রমাণিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট সিবিআই জমা দিতে পারেনি। অনেক প্রশ্নচিহ্ন এখনও রয়ে গিয়েছে। যার উত্তর আমাদের কাছে অজানা।
আরজিকর কাণ্ডে অভিযুক্ত সঞ্জয়ের আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজায় অসন্তুষ্ট মমতা
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সোমবার ২০ জানুয়ারি দোষী সঞ্জয় রায়ের আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে শিয়ালদহ কোর্ট। কিন্তু এই সাজাতে খুশি নন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।আরজি কর -কাণ্ডে প্রথম দিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী দোষীর ফাঁসির সাজা দাবি করেছিলেন। আজ আদালতের রায় ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ”ফাঁসি হলে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম।”সোমবার মালদায় তিনি বলেন, ‘আমাদের হাত থেকে ইচ্ছে করে কেসটা কেড়ে নিয়ে চলে গেল। আগেই বলেছিলাম না পারলে সিবিআইকে কেসটা দিন, আপত্তি নেই। আমরা চাই বিচার হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই নরপিশাচদের চরমতম শাস্তি চেয়েছিলাম।’ আরজি করের তদন্ত প্রথমে করছিল কলকাতা পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় সঞ্জয় রায়কে। তবে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সেই তদন্তের ভার যায় সিবিআই-এর হাতে। তা নিয়ে আগেও আক্ষেপ শোনা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। বলেছিলেন, “আমি মা-বাবাকে বলেছিলাম সময় দিন। তারপর না হলে সিবিআই দিতেন। কিন্তু তার আগেই সিবিআই-এর হাতে চলে গেল তদন্তভার।” এরপর সময় যত গড়িয়েছে, তদন্ত নিয়ে সিবিআই-কে আক্রমণ করতেও শোনা গিয়েছে মমতাকে। কখনও বলেছেন, কলকাতা পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছে তারপর সিবিআই কাউকে নতুন করে ধরতে পারেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংযোজন, ‘আপনারা দেখেছেন আমরা ৫৪ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফাঁসির অর্ডার করিয়ে দিয়েছি। এই কেসে আমাদের ফাঁসির দাবি সকলের ছিল। সেক্ষেত্রে বিচারের রায় নিয়ে কিছু বলব না। আমাদের হাতে কেস থাকলে অনেকদিন আগেই ফাঁসির অর্ডার করিয়ে দিতে পারতাম। প্রথম দিন থেকেই ফাঁসি চেয়েছি। 'সিবিআই তদন্তে গাফিলতি রয়েছে কি না, তা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি মমতা।

No comments