ই-সিগারেট নিষিদ্ধকরণ: বিধিবিধান নিয়ে দ্বিধায় ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় by চন্দন নন্দী
ভারতের
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ই-সিগারেটসহ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম
(ইএনডিএস-এন্ডস) বিক্রি, উৎপাদন, বিতরণ, বাণিজ্য আমদানি ও বিজ্ঞাপন
সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার তিন মাস পর দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষ গত বছরের
নভেম্বরে নড়েচড়ে বসে। সব মূখ্য চিফ কমিশনার ও রাজস্ব গোয়েন্দা অধিদফতরকে
এসব পণ্যের পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় পরোক্ষ শুল্ক বিভাগের চোরাচালন দমন ইউনিট ভারতের তামাক ও এন্ডস লবির মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্র করেছে। এই দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে এন্ডস লবিগুলোর বৈষম্যের শিকার হওয়ার বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপনের ফলে। তাদের দাবি, সিগারেট, জর্দার মতো (দেশীয় ও আমদানি করা উভয় ধরনের) তামাকজাত পণ্য কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই বিক্রি অব্যাহত থাকার পরও তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে, প্রমাণহীন এই ধারণা যে বড় বড় সিগারেট প্রস্তুকারী কোম্পানি (এন্ডস ভারতের বড় বাজারে প্রবেশ করলে তারা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বে) কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করাতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় (২৮ আগস্ট, ২০১৮) নিষেধাজ্ঞার পক্ষে কিছু যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে যে ই-সিগারেট, উত্তাপ সৃষ্টি না হওয়া সরঞ্জাম, ভেপ, ই-শিসা, ই-নিকোটিন গন্ধী হুক্কাসহ এন্ডস এবং যে নামেই এ ধরনের সরঞ্জাম ও পণ্য পাওয়া যাক না কেন, সবই সাধারণভাবে সবার জন্য ও বিশেষভাবে শিশু, কিশোর, গর্ভবতী নারী, প্রজনন বয়সী নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করে। আরো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এন্ডস ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিক্স অ্যাক্টের আওতাধীন নিকোটিন প্রতিস্থাপন থেরাপির মতো অনুমোদিত নয়। আর এ কারণে এই বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।
ঘোষণায় এন্ডস নিষিদ্ধ করার আরো কিছু প্রস্তাব তুলে ধরার হয়েছে। বিশেষ করে তামাকবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট সীমা সেগাল গত বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে নিষিদ্ধ করার যেসব যুক্তি পেশ করেছিলেন, তা সামনে আনা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চলতে থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার তোতা পাখির মতো বলে চলেছে, এন্ডস প্রচলিত তামাক পণ্যের মতোই মানুষের জন্য ক্ষতিকর এবং এর কোনো স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নেই।
সেগাল বিক্রি ও বিতরণের ওপর কিছু বিধিনিষেধ কামনা করলেও অতি-উৎসাহী সরকার এক পা এগিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারির পথ ধরেছে, যদিও তারা স্বীকার করেছে যে ই-তরলযুক্ত নিকোটিন ধারাবাহিক গ্রহণের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা/ক্ষতি এখন পর্যন্ত জানা নেই। এর ফলে এন্ডসের ওপর নিষিষেধাজ্ঞা আরোপের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছাড়াও ই-সিগারেট ও সিগারেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশ্বিক ই-সিগারেট ও হিটস্টিক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা (তাদের একজন ভবিষ্যতে ধুমপানমুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছন) স্বীকার করেছেন যে তাদের পণ্যরাজি ‘ক্ষতিকর।’ কয়েকজন প্রতিনিধি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন যে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভালো বা খারাপের মধ্যে আপস করা যায় না। তবে তারা আরো বলেন, ভোক্তা-তাড়িত বাজারে লোকজনের কাছে খারাপ ও আরো খারাপের মধ্যে কিছু বিকল্প বেছে নেয়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন।
ভারতের বাজারে বিক্রি হওয়া এন্ডস ও সিগারেট ও অন্যান্য তামাকভিত্তিক পণ্যরাজি ‘সমানভাবে ক্ষতিকর’- উল্লেখ করে কলকাতাভিত্তিক ক্যান্সার ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ড. এম সিদ্দিকি (তিনি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণা করেছেন) বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত আগে সিগারেট ও জর্দার মতো সমান পর্যায়ে সব ধরনের এন্ডস পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা। কেবল তখনই সিগারেট ও অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, এন্ডসের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা কেবল সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া তাদের পণ্যরাজি বিক্রি অব্যাহত রাখতেই সহায়তা করবে। এক হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ১০০ মিলিয়নের বেশির ধূমপায়ী রয়েছে, যদিও সবার জানা আছে যে ভারতে প্রতিরোধযোগ্য আগাম মৃত্যু ও রোগের অন্যতম কারণ হলো ধূমপান।
এন্ডস নিষিদ্ধ করার যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে গত আগস্টে দিল্লি হাইকোর্টে দাখিল করা এক হলফনামায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ই-সিগারেট ও অন্যান্য ভেপিং পণ্য বিক্রি ও বিতরণ অনুমোদন করার ফলে ভোক্তারা প্রচলিত তামাক পণ্য চেষ্টা করতে পারে। এর ফলে এগুলো ধূমপানের পথ তৈরি করতে পারে। তবে হলফনামায় পরস্পর সাঙ্ঘর্ষিক যুক্তি ছিল। বলা হয়েছে, তামাক ও সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সরকার সিগারেট ও অন্যান্য তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে ২০০৩ সালে আইন প্রণয়ন করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল তামাক ব্যবহার ও ভোগ নিরুৎসাহিত করা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ২০১৪ সালের জুলাই মাসে একটি জাতীয় পরামর্শ/সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাস্থ্য ও মাদক বিভাগের চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, কর্মকর্তারা উপসংহার টানেন যে প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণে দেখা যাচ্ছে, এন্ডস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে এর উৎপাদন ও বিক্রি হ্রাস করার জন্য গঠনমূলক প্রয়াস গ্রহণ প্রয়োজন। এরপরপরই ভারতে এন্ডস নিষিদ্ধ/নিয়ন্ত্রিত করার ইস্যুটি বিবেচনার করার বিষয়টি সামনে আসে। এন্ডস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মুম্বাইভিত্তিক শেখসারিয়া ইনস্টটিউট ফর পাবলিক হেলথের পরিচালক ড. পি সি গুপ্ত বলেন, এসব পণ্য বিস্ফোরকে পরিণত হয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে ফেলেছে।
সরকার তার হলফনামায় এন্ডসের মতো নতুন সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলায় কোনো নির্দেশিকা নেই জানিয়ে স্বীকার করে যে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, কেরালা, কর্নাটক, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, মিজোরাম, জম্মু ও কাশ্মিরের মতো কোনো কোনো রাজ্য এন্ডস বা ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র টেকনিক্যাল উপদেষ্টা ড. রানা জে সিং বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ই-সিগারেট ও এন্ডসের বিপণন, সচেতনতা ও ব্যবহার দ্রুত বাড়ায় উদ্বিগ্ন, যদি নিরাপত্তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রদর্শিত হয়নি এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এখনো শনাক্তহীনই রয়ে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিহারের মতো কোনো কোনো রাজ্যে এন্ডস বন্ধে তড়িঘড়ি করে আইন করা হয়েছে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সাউথ এশিয়ান মনিটর’র কাছে বিহারের স্বাস্থ্য দফতরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে রাজ্য প্রশাসন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করার কথা। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনায় কিন্তু এন্ডস নিষিদ্ধ করার কোনো কথা ছিল না। রাজ্য সরকার কেবল এন্ডস বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারত।
কিন্তু এন্ডস নিষিদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করে, ফরমালডিহাইডের মতো রাসায়নিক ছাড়াও সীসা, ক্রোমিয়াম, নিকেলের মতো অনেক ধাতু এতে পাওয়া গেছে। আর এন্ডসে যে পরিমাণ ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে, তা প্রচলিত সিগারেটেও নেই।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করিডোরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী শক্তিশালী তামাক লবির বিরুদ্ধে থাকার ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থেকে বহুজাতিক একটি এন্ডস কোম্পানির এক প্রতিনিধি ইউকে রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্সের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ই-সিগারেটের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকি যথাযথভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব পণ্য ধোঁয়া সৃষ্টিকারী তামাক পণ্যের সৃষ্ট ক্ষতির চেয়ে ৫ ভাগের চেয়ে বেশি হবে না এবং তা এই সংখ্যার চেয়ে বেশ কমও হতে পারে। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ দফতরও (২০১৬ সালে) স্বীকার করেছে যে ই-সিগারেট ধোঁয়া সৃষ্টিকারী যেসব তামাক পণ্য বর্তমানে যেসব রোগ সৃষ্টি করে, ই-সিগারেট সেগুলোর প্রকোপ কমাতে পারে।
ই-সিগারেট ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে সাঙ্ঘর্ষিক দাবি (এন্ডস প্রচলিত সিগারেটের চেয়ে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ কিনা) অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে ই-সিগারেটের তথাকথিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিচার বিভাগের রায়ের ওপর। দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান আবেদনকারী সীমা সেগালের আইনজীবী ভুবনেশ সেগালের মতে, এন্ডস নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণলয়কে দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসতে হবে (মামলাটি আগামী মার্চে শুনানি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে) কিছু সুনির্দিষ্ট, সময়োচিত নির্দেশিকা নিয়ে। কারণ এসব পণ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিক্রি হচ্ছে, কিশোরেরা এগুলো গ্রহণ করছে।
কেন্দ্রীয় পরোক্ষ শুল্ক বিভাগের চোরাচালন দমন ইউনিট ভারতের তামাক ও এন্ডস লবির মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্র করেছে। এই দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে এন্ডস লবিগুলোর বৈষম্যের শিকার হওয়ার বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপনের ফলে। তাদের দাবি, সিগারেট, জর্দার মতো (দেশীয় ও আমদানি করা উভয় ধরনের) তামাকজাত পণ্য কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই বিক্রি অব্যাহত থাকার পরও তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে, প্রমাণহীন এই ধারণা যে বড় বড় সিগারেট প্রস্তুকারী কোম্পানি (এন্ডস ভারতের বড় বাজারে প্রবেশ করলে তারা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বে) কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করাতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় (২৮ আগস্ট, ২০১৮) নিষেধাজ্ঞার পক্ষে কিছু যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে যে ই-সিগারেট, উত্তাপ সৃষ্টি না হওয়া সরঞ্জাম, ভেপ, ই-শিসা, ই-নিকোটিন গন্ধী হুক্কাসহ এন্ডস এবং যে নামেই এ ধরনের সরঞ্জাম ও পণ্য পাওয়া যাক না কেন, সবই সাধারণভাবে সবার জন্য ও বিশেষভাবে শিশু, কিশোর, গর্ভবতী নারী, প্রজনন বয়সী নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করে। আরো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এন্ডস ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিক্স অ্যাক্টের আওতাধীন নিকোটিন প্রতিস্থাপন থেরাপির মতো অনুমোদিত নয়। আর এ কারণে এই বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।
ঘোষণায় এন্ডস নিষিদ্ধ করার আরো কিছু প্রস্তাব তুলে ধরার হয়েছে। বিশেষ করে তামাকবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট সীমা সেগাল গত বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে নিষিদ্ধ করার যেসব যুক্তি পেশ করেছিলেন, তা সামনে আনা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চলতে থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার তোতা পাখির মতো বলে চলেছে, এন্ডস প্রচলিত তামাক পণ্যের মতোই মানুষের জন্য ক্ষতিকর এবং এর কোনো স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নেই।
সেগাল বিক্রি ও বিতরণের ওপর কিছু বিধিনিষেধ কামনা করলেও অতি-উৎসাহী সরকার এক পা এগিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারির পথ ধরেছে, যদিও তারা স্বীকার করেছে যে ই-তরলযুক্ত নিকোটিন ধারাবাহিক গ্রহণের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা/ক্ষতি এখন পর্যন্ত জানা নেই। এর ফলে এন্ডসের ওপর নিষিষেধাজ্ঞা আরোপের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছাড়াও ই-সিগারেট ও সিগারেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশ্বিক ই-সিগারেট ও হিটস্টিক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা (তাদের একজন ভবিষ্যতে ধুমপানমুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছন) স্বীকার করেছেন যে তাদের পণ্যরাজি ‘ক্ষতিকর।’ কয়েকজন প্রতিনিধি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন যে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভালো বা খারাপের মধ্যে আপস করা যায় না। তবে তারা আরো বলেন, ভোক্তা-তাড়িত বাজারে লোকজনের কাছে খারাপ ও আরো খারাপের মধ্যে কিছু বিকল্প বেছে নেয়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন।
ভারতের বাজারে বিক্রি হওয়া এন্ডস ও সিগারেট ও অন্যান্য তামাকভিত্তিক পণ্যরাজি ‘সমানভাবে ক্ষতিকর’- উল্লেখ করে কলকাতাভিত্তিক ক্যান্সার ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ড. এম সিদ্দিকি (তিনি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণা করেছেন) বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত আগে সিগারেট ও জর্দার মতো সমান পর্যায়ে সব ধরনের এন্ডস পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা। কেবল তখনই সিগারেট ও অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, এন্ডসের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা কেবল সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া তাদের পণ্যরাজি বিক্রি অব্যাহত রাখতেই সহায়তা করবে। এক হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ১০০ মিলিয়নের বেশির ধূমপায়ী রয়েছে, যদিও সবার জানা আছে যে ভারতে প্রতিরোধযোগ্য আগাম মৃত্যু ও রোগের অন্যতম কারণ হলো ধূমপান।
এন্ডস নিষিদ্ধ করার যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে গত আগস্টে দিল্লি হাইকোর্টে দাখিল করা এক হলফনামায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ই-সিগারেট ও অন্যান্য ভেপিং পণ্য বিক্রি ও বিতরণ অনুমোদন করার ফলে ভোক্তারা প্রচলিত তামাক পণ্য চেষ্টা করতে পারে। এর ফলে এগুলো ধূমপানের পথ তৈরি করতে পারে। তবে হলফনামায় পরস্পর সাঙ্ঘর্ষিক যুক্তি ছিল। বলা হয়েছে, তামাক ও সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সরকার সিগারেট ও অন্যান্য তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে ২০০৩ সালে আইন প্রণয়ন করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল তামাক ব্যবহার ও ভোগ নিরুৎসাহিত করা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ২০১৪ সালের জুলাই মাসে একটি জাতীয় পরামর্শ/সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাস্থ্য ও মাদক বিভাগের চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, কর্মকর্তারা উপসংহার টানেন যে প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণে দেখা যাচ্ছে, এন্ডস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে এর উৎপাদন ও বিক্রি হ্রাস করার জন্য গঠনমূলক প্রয়াস গ্রহণ প্রয়োজন। এরপরপরই ভারতে এন্ডস নিষিদ্ধ/নিয়ন্ত্রিত করার ইস্যুটি বিবেচনার করার বিষয়টি সামনে আসে। এন্ডস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মুম্বাইভিত্তিক শেখসারিয়া ইনস্টটিউট ফর পাবলিক হেলথের পরিচালক ড. পি সি গুপ্ত বলেন, এসব পণ্য বিস্ফোরকে পরিণত হয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে ফেলেছে।
সরকার তার হলফনামায় এন্ডসের মতো নতুন সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলায় কোনো নির্দেশিকা নেই জানিয়ে স্বীকার করে যে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, কেরালা, কর্নাটক, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, মিজোরাম, জম্মু ও কাশ্মিরের মতো কোনো কোনো রাজ্য এন্ডস বা ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র টেকনিক্যাল উপদেষ্টা ড. রানা জে সিং বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ই-সিগারেট ও এন্ডসের বিপণন, সচেতনতা ও ব্যবহার দ্রুত বাড়ায় উদ্বিগ্ন, যদি নিরাপত্তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রদর্শিত হয়নি এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এখনো শনাক্তহীনই রয়ে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিহারের মতো কোনো কোনো রাজ্যে এন্ডস বন্ধে তড়িঘড়ি করে আইন করা হয়েছে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সাউথ এশিয়ান মনিটর’র কাছে বিহারের স্বাস্থ্য দফতরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে রাজ্য প্রশাসন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করার কথা। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনায় কিন্তু এন্ডস নিষিদ্ধ করার কোনো কথা ছিল না। রাজ্য সরকার কেবল এন্ডস বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারত।
কিন্তু এন্ডস নিষিদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করে, ফরমালডিহাইডের মতো রাসায়নিক ছাড়াও সীসা, ক্রোমিয়াম, নিকেলের মতো অনেক ধাতু এতে পাওয়া গেছে। আর এন্ডসে যে পরিমাণ ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে, তা প্রচলিত সিগারেটেও নেই।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করিডোরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী শক্তিশালী তামাক লবির বিরুদ্ধে থাকার ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থেকে বহুজাতিক একটি এন্ডস কোম্পানির এক প্রতিনিধি ইউকে রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্সের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ই-সিগারেটের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকি যথাযথভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব পণ্য ধোঁয়া সৃষ্টিকারী তামাক পণ্যের সৃষ্ট ক্ষতির চেয়ে ৫ ভাগের চেয়ে বেশি হবে না এবং তা এই সংখ্যার চেয়ে বেশ কমও হতে পারে। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ দফতরও (২০১৬ সালে) স্বীকার করেছে যে ই-সিগারেট ধোঁয়া সৃষ্টিকারী যেসব তামাক পণ্য বর্তমানে যেসব রোগ সৃষ্টি করে, ই-সিগারেট সেগুলোর প্রকোপ কমাতে পারে।
ই-সিগারেট ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে সাঙ্ঘর্ষিক দাবি (এন্ডস প্রচলিত সিগারেটের চেয়ে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ কিনা) অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে ই-সিগারেটের তথাকথিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিচার বিভাগের রায়ের ওপর। দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান আবেদনকারী সীমা সেগালের আইনজীবী ভুবনেশ সেগালের মতে, এন্ডস নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণলয়কে দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসতে হবে (মামলাটি আগামী মার্চে শুনানি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে) কিছু সুনির্দিষ্ট, সময়োচিত নির্দেশিকা নিয়ে। কারণ এসব পণ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিক্রি হচ্ছে, কিশোরেরা এগুলো গ্রহণ করছে।
No comments