যৌন সহিংসতা বা জোরপূর্বক যৌন আচরণে আছে এইচআইভি/এইডস ছড়ানোর ঝুঁকি by সাকিলা মতিন মৃদুলা
শুধুমাত্র 'খারাপ জায়গায়' 'খারাপ'
কাজ করলেই এইচআইভি/এইডস হয়। যাদের এই রোগ হয় তারা সবাই খারাপ মানুষ।
সনাতন এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে মানুষ।
মানুষ
এখন জানে এইচআইভি/এইডস নানা কারণেই হতে পারে। একই সুই-সিরিঞ্জ ব্যবহার
করলে, অপরীক্ষিত রক্ত ব্যবহারে, এইডস আক্রান্ত গর্ভধারিণী মায়ের থেকে,
মায়ের বুকের দুধ থেকে, যৌন রোগ থেকে ইত্যাদি।
এই কারণগুলোর
প্রচার-প্রচারণা আছে। মানুষ জানতে পারছে। সচেতন হচ্ছে। সাবধানতা অবলম্বন
করছে। কিন্তু আরও কারণ আছে। যার সত্যতা এবং প্রমাণ আছে কিন্তু প্রচারণা
নেই।
এই যেমন, যৌন সহিংসতা বা জোরপূর্বক যৌন আচরণে এইচআইভি ছড়ানোর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কিছুটা
বিস্ময়, কিছুটা আত্মদহন এবং কিছুটা বিবেকের তাড়না থেকে এই লেখা।
দায়িত্ববোধও বলা যায়। ন্যূনতম আলোচনা হলেও চলতো। কিন্তু না, কোথাও এই
নিয়ে টুঁ'শব্দটি নেই।
কেউ কথা বলে না। হয়তো মনে নেই। কিংবা জানা
নেই। জানা থাকলেও গুরুত্ব নেই। কেউ দেখছেনা, জানছেও না। অথচ জানা প্রয়োজন।
জানানো প্রয়োজন। প্রসঙ্গটা এইচআইভি এইডস এবং যৌন সহিংসতা নিয়ে।
ঢাকায় এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচীতে যৌনকর্মীরা যোগ দেয়। |
জোরপূর্বক যৌনাঙ্গে অনুপ্রবেশের ফলে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় তা শরীরে
এইচআইভি জীবাণু প্রবেশে সহায়তা করে। বিষয়টি বয়:সন্ধিকালীন মেয়েদের জন্য
বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য, যেহেতু কিশোরীদের যৌনাঙ্গের মিউকাস মেমব্রেন
পুরোপুরি তৈরি হয় না।
বিভিন্ন গবেষণালব্ধ পর্যালোচনায় প্রমাণিত
যে, ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা সংঘটিত শারীরিক ও যৌন সহিংসতা এবং শৈশবে সংঘটিত
যৌন নির্যাতন প্রত্যক্ষভাবে ভাইরাস সংক্রমণ এবং পরোক্ষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ যৌন
আচরণের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে বেড়ে যায় এইচআইভি সংক্রমণের
ঝুঁকি।
শৈশব বা কৈশোরে জোরপূর্বক যৌনমিলনের শিকার হলে পরবর্তীতে
তাদের মধ্যে বহুগামিতা, অনিরাপদ যৌন মিলন, যৌনকর্মী হিসেবে জীবন অতিবাহিত
করার প্রবণতা তৈরি হয়।
সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় যারা জোরপূর্বক যৌনমিলনের শিকার হন, তাদের কনডম ব্যবহারের ব্যাপারে অটল থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
কিশোর
বয়সে যৌন সহিংসতা আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে এবং মানসিকভাবে হতাশা তৈরি করে-
এগুলোও এইচআইভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ানোর আচরণ হিসেবে গণ্য।
সহিংস
যৌন আচরণ কিংবা ধর্ষণের ফলে ছিঁড়ে যাওয়া টিস্যু অথবা শারীরিক আঘাতের ফলে
সৃষ্ট ক্ষত নারীর জৈবিকভাবে সংক্রমণের হার বাড়িয়ে দিতে পারে। পায়ুপথে
ধর্ষণের সম্মুখীন নারী এক্ষেত্রে আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকে কারণ পায়ুপথের
টিস্যু বেশি সংবেদনশীল থাকে, যার ফলে সহজেই টিস্যু ছিঁড়ে দেহে ভাইরাস
প্রবেশের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
তাহলে কেন এইডসের আলোচনায় একেবারে অনুপস্থিত বিষয়টি?
গবেষণার
ফলাফলে, ছাপার অক্ষরে বিষয়টি উপস্থিত। অনুপস্থিত কেবল আলোচনায়, লোকমুখে,
সচেতনতার প্রয়োজনীয়তায়। যৌন সহিংসতা গভীরভাবে ব্যক্তিগত, ঘনিষ্ঠ। কিন্তু
তাই বলে কি জনমানুষের আড়ালেই থেকে যাবে বিষয়টি?
তবে কি এখানেও ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ? দায়মুক্তির সংস্কৃতি ? যৌনতার রাজনীতি?
যৌন
সহিংসতা বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যুদ্ধ
এবং বিদ্রোহকালীন, এমনকি শান্তিপূর্ণ অবস্থা! ঘনিষ্ঠ সঙ্গী কিংবা ঘরোয়া
যৌন সহিংসতা।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরেও অবস্থান করে যৌন সহিংসতা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং মূল্যবোধের অভাব যৌন সহিংসতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
দেয়।
জোরপূর্বক যৌনমিলন এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে
নারীদের নিরাপদ যৌন আচরণের ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা
একেবারে শেষ না করে দিলেও দুর্বল করে দেয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে কনডম
ব্যবহারের ঘটনা বিরল।
চিকিৎসা বা প্রতিরোধমূলক কোন সেবার সুযোগ না
পাওয়ার ফলে যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় নারীরা এইচআইভি সংক্রমণের
ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া নারীরা গণধর্ষণের শিকার হয় যার
ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
এইচআইভি এইডস সংক্রমণে যৌনকর্মীরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
কারণ হিসেবে হউক কিংবা ফলাফল। এইডসের আলোচনায় ঘুরেফিরে বারবার সবচাইতে আগে
আসে যৌনকর্মী।
জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক, অন্যায়ভাবে বিকৃত যৌনাচরণ,
বলপূর্বক দলীয় যৌন সম্পর্ক যা কিনা শুধুমাত্র যৌনকর্মী হওয়াতেই 'ধর্ষণ',
'গণধর্ষন' কিংবা 'নির্যাতনের' আওতাভুক্ত হয় না। নীরবে সয়ে যেতে হয়
যৌনকর্মীদের।
অথচ প্রতিটি সূত্র থেকেই ছড়াতে পারে যৌনরোগ। পরবর্তীতে বেড়ে যায় এইচআইভি/এইডসের সম্ভাবনা।
ওয়ান
স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলোতে যৌন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার নারীদের
জন্য এইচআইভি টেস্টের ব্যবস্থা আছে। টেস্ট করাও হয়। কিন্তু বলা হয় না।
যৌন
নির্যাতন/ধর্ষণের সাথে এইচআইভি এইডসের সম্পর্কটা কোথায় সেটা যদি লোকমুখে
না ছড়ায় তবে মানুষ সাবধান হবে কেন? পরীক্ষাগারে আসবেই বা কেন?
হতে
পারে বিষয়টি মুখ্য নয় কিন্তু একেবারে গৌণও নয়। প্রধান কিংবা একমাত্র
কারণ নাই হতে পারে। কিন্তু তাই বলে অন্যতম কারণ হিসেবেও কি সে আলোচনায়
স্থান করে নিতে পারেনা?
একেবারেই যে অনুপস্থিত বিষয়টি তা কিন্তু
নয়। গবেষণার ফলাফলে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থার নিজস্ব ওয়েব-পেজে, বই-এর
পাতায়, সেমিনারের কাগজে হয়তো ঘুরে ফিরে অসংখ্যবার এসেছে এইচআইভি/এইডস
এবং যৌন সহিংসতার সম্পর্ক। তারপরও কোথায় যেন নীরবতা।
যৌন সহিংসতা
বলেই কি কথা বলতে এত বাধা? বিষয়টির সরব উপস্থিতি প্রয়োজন সাধারণ মানুষের
মুখে মুখে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে হবে এই বার্তা।
সাকিলা মতিন মৃদুলা ।। লেখক ও উন্নয়ন কর্মী |
No comments