কেনিয়ার যে নাচের পার্টিতে পুরুষদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে
কেনিয়ায় নারীদের নাচের পার্টি |
নাইরোবিতে শুধুমাত্র নারীদের জন্য
নাচের পার্টির আয়োজনে কাজ করে যাচ্ছে একটি দল। তাদের দাবি এ ধরণের পার্টি
নারীদের জন্য রাতের বেলায় একটি নিরাপদ উৎসবের পরিবেশ তৈরি করতে পারবে।
কেনিয়ার
রাজধানীর একটি শহরতলিতে একটি উষ্ণ সন্ধ্যায়, এক আবাসিক ভবনের বাইরের একটি
অংশ ভাড়া করা হয়েছে ডান্স ফ্লোর হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
জোরেশোরে গান বাজছে এবং নারীরা তার তালে তালে নাচছে।
"পুরুষদের
সাথে কোনও জায়গায় গেলে আপনাকে একটু সাবধানে থাকতে হয়। আপনি সেখানে একা
যাওয়ার পরিবর্তে আপনার বন্ধুবান্ধব অথবা কোন পুরুষের সঙ্গে সেখানে যেতে
চান," বলছিলেন ২৬ বছর বয়সী জেন।
তিনি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু শানির সাথে এই পার্টিতে এসেছেন।
"সুতরাং
এমন একটি জায়গা যেখানে সবাই নারী, সেখানে মেয়েরা সাথে সাথেই নিরাপদ বোধ
করে এবং আপনি অনুভব করবেন যে আপনি এমন মানুষদের সাথেই আছেন যারা আপনাকে
বোঝে।"
এই পার্টির নিরাপত্তা বেশ কড়া। শুধুমাত্র কয়েকজন পুরুষকে
কিছু সময়ের জন্য ঢুকতে দেওয়া হয়, যারা হয়তো তাদের বান্ধবীকে পার্টিতে
পৌঁছে দিতে আসেন।
তারপরে, সেই পুরুষদের তাৎক্ষণিকভাবে চলে যেতে হয়।
এসব
পার্টিতে শুধুমাত্র অংশগ্রহণকারীরাই যে নারী তা নয়। বরং এখানকার
বারটেন্ডার, নিরাপত্তা কর্মী, ডিজে, সাউন্ড মিক্সার, এবং পার্টির আয়োজক
সবাই নারী।
মিশ্র ক্লাব, অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত
ক্লাবগুলোয় বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সময় অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে
শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে পার্টির এই ধারণা আসে কয়েকজন নারীর মধ্যে।
'কেনিয়ার নারীদের জন্য একটি কঠিন বছর'
শানি বলেন, "যখন আমি জানতে পারলাম যে এটি নারীদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তখনই আমি সঙ্গে সঙ্গে সাইন আপ করলাম।"
শানি এবং জেন ক্লাবিং বেশ উপভোগ করেন এবং সম্প্রতি টুইটারে তারা এই অল-উইমেন ডান্স পার্টির কথা জানতে পারেন।
নারীদের নিয়ে আয়োজিত এই পার্টির নাম রাখা হয়েছে স্ট্রেটলি সিল্ক।
এই পার্টির উদ্ভাবক হলেন, কেনিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠান দ্য নেস্ট কালেক্টিভের সদস্য জোকি গুমি, জেরি গাতুনগো এবং আকাটি খাসিয়ানি।
এই প্রতিষ্ঠানটি শিল্প, চলচ্চিত্র, সংগীত, ফ্যাশন এবং শিল্পকলার অন্যান্য শাখাগুলো নিয়ে কাজ করে।
২০১৮ সালে তারা এই অল-উইমেন নৃত্য পার্টির আয়োজন শুরু করেন।
কেনিয়ার ক্লাবগুলিতে পুরুষরা অযাচিতভাবে নারীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। |
আর এমন আয়োজনের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে ছিল কেবল মজাদার একটি রাতের আড্ডা।
"কেনিয়ার
নারীদের জন্য ২০১৮ সাল বেশ কঠিন একটি বছর ছিল। প্রতিদিনই সহিংসতার খবর
শোনা যেতো। এ ব্যাপারে নারীদের বলার ছিল অনেক। আজকাল মানুষজনও অনলাইন এবং
অফলাইনে নির্দ্বিধায় নারী বিদ্বেষ ছড়ায়," বলেন জোকি গুমি।
তিনি
আরও বলেন, "নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নের অনেক খবরও প্রকাশ পায় প্রতিনিয়ত।
এমন অবস্থায় আমরা চাইতাম নারীদের শক্তিকে কয়েকগুন বাড়িয়ে নারীদের জন্য
উৎসবের একটি স্থান তৈরি করতে। যেখানে নারীদের সচরাচর স্বাগত জানানো হয়না।,
বিশেষ করেন নৈশকালীন উৎসবকে ঘিরে তো নয়-ই।"
সম্প্রতি ধর্ষণ এবং ফেমিইসাইড অর্থাৎ নারীদের হত্যার কয়েকটি আলোচিত ঘটনার কারণে কেনিয়া খবরের শিরোনাম হয়ে আসে।
২০১৮
সালে, আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ২২টি শহরের একটি
তালিকা তৈরি করে, যে শহরগুলোয় নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন।
সেই তালিকায় নাইরোবি ষষ্ঠ স্থানে উঠে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে কেনিয়ায় যেকোনো জনসমাগমে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ৫০% আশঙ্কা থাকে।
২০১৯ সালের মে মাসে দেশটির নারী আইনজীবীদের সংগঠন ফেডারেশন অফ উইমেন ল'য়ারস কেনিয়া (ফিদা কেনিয়া) এই সমস্যা সামনে আনে।
সংস্থাটি জানায়, কেনিয়ায় চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৫০টিরও বেশি ফেমিসাইড বা নারী হত্যার মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
শুধু লেসবিয়ানদের জন্য নয়
মুনিরা
(২২) এবং খাদিজা (২৫) দুই বন্ধু। প্র্যাকটিসিং মুসলমান হিসাবে, রাতের
পার্টির মতো জায়গাগুলোয় তাদের যাওয়ার সুযোগ খুবই কম থাকে।
তারা জানায়, যদিও সব ধর্মের নারীরা এই অল উইমেন্স পার্টিতে অংশ নেয়, তবে মুসলমান নারীদের একটু খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
"যখন
আমরা নাচতে যাব তখন আমাদের অনেকেই নিজেদের হিজাবগুলো খুলে ফেলে, ভিড়ের
সাথে মিশে যাওয়ার জন্য। যখন আপনাকে হিজাব পরা অবস্থায় কেউ দেখে তখন তারা
অবাক হয়ে যায় আর ভাবে, তুমি এখানে কি করছো?"
খাদিজা বলেন, "আমাদের ধর্মে অবাধে পুরুষদের সাথে মিশতে নিষেধ করা হয়েছে, এজন্য এরকম একটি স্থান আমাদের জন্য বেশ ভাল।,"
সব সম্প্রদায়ের নারীদের এই পার্টিতে স্বাগত জানানো হয়। |
"শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে করা এমন একটি ক্লাব পাওয়া আসলেই দুষ্কর। এমনটা সচরাসচর দেখা যায় না," বলেন মুনিরা।
তবে কিছু লোকের মধ্যে একটি বিশ্বাস আছে যে নারীদের আমোদ মানেই এটি সমকামী নারীদের স্থান।
এ
ব্যাপারে মিজ গুমি বলেন, "আমরা সানন্দে সমকামীদের গ্রহণ করি এবং তাদের
নিয়ে উদযাপন করি। এজন্য লোকজন ধারণা করতে পারে যে এটি শুধুই সমকামীদের
নিয়ে কোনো আয়োজন। এটা ঠিক যে কিছু অনুষ্ঠান রয়েছে যেগুলো কুইর ইভেন্ট
হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তবে এই পার্টি তেমনটি নয়। আমরা সবাইকে স্বাগত
জানাই। "
"এলজিবিটি সম্প্রদায়ের যেসব নারী কেনিয়ার জনসাধারণের
হুমকি এমনকি সহিংসতার মুখে পড়েন, তাদের জন্য এই অল উইমেন্স পার্টির দরজা
সবসময় খোলা থাকে।"
কেনিয়ায় সমকামী যৌনতা অবৈধ, এজন্য ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান দেয়া আছে।
এই আইনটিকে বাতিল করার দাবি উঠলেও চলতি বছরের মে মাসে, কেনিয়ার হাই কোর্ট সমকামীদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক আইনটিকে বহাল রাখে।
"অনেকেই এটা জানেনা যে নাইরোবিতে একটি বিশাল সমকামী নারী সম্প্রদায়
রয়েছে এবং কখনও কখনও আমরা শুধুমাত্র নারীদের সাথে একটি জায়গায় থাকতে চাই
যেখানে সবাই আমাদের মতো ভাবে, যেখানে আমি নিরাপদ বোধ করবো।," বলেন ২২ বছর
বয়সী অ্যান মারি। যিনি একজন উভকামী বা বাইসেক্সুয়াল।
২৩ বছর বয়সী
বিন্তিও একজন সমকামী। তার কাছে অল উইমেন পার্টি এই বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয়
বিষয়। তিনি এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন।
মিজ গুমি আশা করছেন যে এই অল-উইমেন্স ডান্স পার্টি শুধু কেনিয়াতে নয়, পুরো আফ্রিকায় তিনি জনপ্রিয় করে তুলবেন।
"ক্লাব
সংস্কৃতি এবং নাইট লাইফ অনেক সময় নারীদের জন্য নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়ে
দাঁড়ায়। শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণেই তাদের এ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি
হতে হয়।" তিনি বলেন।
"মূলধারার ক্লাব সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হওয়ার
সাথে সাথে আমাদের অবশ্যই নারীদের জন্য এমন একটি স্থান নিশ্চিত করতে হবে যেন
তারাও নিরাপদে মূলধারার উৎসবের ভাগীদার হতে পারে।" বলেন মিজ গুমি।
আয়োজকরা চান এই পার্টি তারা আফ্রিকাজুড়ে ছড়িয়ে দিতে। |
No comments