বছরে তামাকে মৃত্যু ১ লাখ ৬২ হাজার by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
তামাকের
নেশার ছোবলে বিশ্বে প্রতি ছয় সেকেন্ডের কম সময়ে একজন মানুষ মারা যায়। আর
বছরে মারা যাচ্ছে ৭০ লাখের বেশি লোক। এর মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ৯ লাখ
মানুষ মারা যায়। তামাকের কারণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬২ হাজারের বেশি
মানুষ মৃত্যুবরণ করছে বলে টোব্যাকো এটলাস ২০১৮ উল্লেখ করেছে।
সম্প্রতি এক সেমিনারে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক বলেন, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ইদানীং ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ তামাক ব্যবহার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি। হৃদরোগজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতা এতটাই দ্রুত বাড়ছে যে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে পৃথিবীব্যাপী মহামারি বা ‘প্যানডেমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে এই মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ, যা খুবই আশঙ্কাজনক। কাজেই হৃদরোগ সমস্যার টেকসই সমাধান এবং জনস্বাস্থ্যের কার্যকর উন্নয়নের জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
দেহের রক্তবাহী নালিগুলো যখন কোলেস্টেরল বা চর্বি জমে সরু হয়ে আসে কিংবা বন্ধ হয়ে যায়, তখনই দেখা দেয় হৃদরোগ। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকে থাকা নিকোটিন ও অন্যান্য প্রায় ৭০০০ উপাদান রক্তবাহী নালিগুলোর গাত্রে অযাচিত পদার্থ জমতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। প্রথমত, তামাক সেবনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেহের রক্তবাহী নালিগুলো নমনীয়তা হারিয়ে শক্ত হতে শুরু করে। এর ফলে এদের সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা কমে যায় এবং কোনো কারণে রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেলে সেগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, নিকোটিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান ধমনিগাত্রের এন্ডিথেলিয়াম স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং প্লাক বা অযাচিত পদার্থ জমার সুযোগ করে দেয়। তৃতীয়ত, তামাক দেহের জন্য উপকারী কোলেস্টেরল ‘হাই-ডেনসিটি কোলেস্টেরল’কে কমিয়ে আনে এবং ক্ষতিকর ‘লো-ডেনসিটি কোলেস্টেরল’কে বাড়িয়ে দেয়। চতুর্থত, রক্তপ্রবাহের গতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় এবং এভাবে উচ্চ রক্তচাপ তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়া বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নিকোটিন এবং কার্বন-মনোক্সাইড রক্তকণিকায় অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং দেহের ভেতরে রক্তকণিকায় অনাকাঙ্ক্ষিত জটের সৃষ্টি করে। ফলে দেহের অন্যান্য অঙ্গে রক্ত এবং অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যেতে পারে বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
তারা আরো বলেন, ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় দ্বিগুণ। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি তিন গুণ, বুকের ব্যথা বা অ্যানজিনার ক্ষেত্রে ২০ গুণ এবং দেহের কোনো পেশিতে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পাঁচ গুণ। নিজে ধূমপান না করলেও কেবল ধূমপায়ীদের সঙ্গে থাকার কারণে একজন ব্যক্তি যে নিকোটিন শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করেন, এতে তার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ধূমপান বা তামাক সেবন ত্যাগ না করে কেবল পরিমাণ কমিয়ে আনলে হৃদরোগ এড়ানো সম্ভব, এ ধারণাও পুরোপুরি ভুল। কারণ, দিনে একজন একটি সিগারেট খেলেও শেষ পর্যন্ত হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ এবং স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া ‘লাইট’/’মাইল্ড’ কিংবা ‘লো-নিকোটিন’ নাম দিয়ে বাজারে যেসব সিগারেট বা তামাকপণ্য বিক্রয় হয়, সেগুলো সেবনেও ক্ষতি কমানো যায় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে যারা তামাক ব্যবহার করছেন, তামাক ছেড়ে দেয়ার এক বছরের মধ্যেই তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। আর টানা ১৫ বছর কেউ যদি তামাক সেবন থেকে বিরত থাকেন, তাহলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে একজন অধূমপায়ীর পর্যায়ে নেমে আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, মৃত্যুর একক কারণ হিসেবে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর প্রায় ৩১ শতাংশই হৃদরোগজনিত মৃত্যু এবং যার এক-তৃতীয়াংশই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশের জন্য দায়ি তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপান। হৃদরোগের কারণ হিসেবে উচ্চ রক্তচাপের পরেই তামাক ব্যবহারের অবস্থান। তামাক মহামারি প্রতি বছর বিশ্বের ৭০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। পরোক্ষ ধূমপানে মৃত্যুবরণ করে আরো ৯ লাখ অধূমপায়ী মানুষ। বর্তমানে বিশ্বে মোট তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ বিলিয়ন, যার ৮০ শতাংশই বসবাস করে নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশেগুলোতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর ১৭ শতাংশের জন্য দায়ী হৃদরোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০১৭-এর তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সময়কালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সময়কালে বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর কারণের তালিকায় হৃদরোগ ৭ম স্থান থেকে ১ম স্থানে উঠে এসেছে এবং এই পরিবর্তনের হার ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ি হিসেবে তামাকের অবস্থান ৪র্থ। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৩০ শতাংশের জন্যই দায়ি ধূমপান। বাংলাদেশে তামাকের উচ্চ ব্যবহার এই ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দেশের মোট প্রাপ্তবয়ষ্ক জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ (৪ কোটি ১৩ লাখ) তামাক ব্যবহার করেন। টোব্যাকো অ্যাটলাসের (২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, মধ্যমসারির মানব-উন্নয়ন সূচকে অবস্থানকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুর হার ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগের প্রকোপ ভয়াবহ। প্রধানমন্ত্রী তামাককে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০৪০ সালের আগেই বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রজ্ঞা মনে করে এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে। তা হলো- পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান, তামাকপণ্যের মোড়কে আইন অনুযায়ী সচিত্র সতর্কবার্তা মুদ্রণ, তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন-প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতাসহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারাসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন; তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক খসড়া নীতিসমূহ (জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি) দ্রুত চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন; আর্টিক্যাল ৫.৩-এর আলোকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ, খোলা তামাকপণ্যের বিক্রয় বন্ধ, বিদ্যালয়-কলেজের নিকটে তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করে আইন/নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ এফসিটিসি’র আলোকে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে যুগোপযোগী করা; তামাকজাত পণ্যের দাম ক্রমশ জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘তামাক করে হৃৎপিণ্ডের ক্ষয়, স্বাস্থ্যকে ভালোবাসি, তামাককে নয়।’
সম্প্রতি এক সেমিনারে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক বলেন, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ইদানীং ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ তামাক ব্যবহার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি। হৃদরোগজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতা এতটাই দ্রুত বাড়ছে যে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে পৃথিবীব্যাপী মহামারি বা ‘প্যানডেমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে এই মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ, যা খুবই আশঙ্কাজনক। কাজেই হৃদরোগ সমস্যার টেকসই সমাধান এবং জনস্বাস্থ্যের কার্যকর উন্নয়নের জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
দেহের রক্তবাহী নালিগুলো যখন কোলেস্টেরল বা চর্বি জমে সরু হয়ে আসে কিংবা বন্ধ হয়ে যায়, তখনই দেখা দেয় হৃদরোগ। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকে থাকা নিকোটিন ও অন্যান্য প্রায় ৭০০০ উপাদান রক্তবাহী নালিগুলোর গাত্রে অযাচিত পদার্থ জমতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। প্রথমত, তামাক সেবনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেহের রক্তবাহী নালিগুলো নমনীয়তা হারিয়ে শক্ত হতে শুরু করে। এর ফলে এদের সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা কমে যায় এবং কোনো কারণে রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেলে সেগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, নিকোটিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান ধমনিগাত্রের এন্ডিথেলিয়াম স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং প্লাক বা অযাচিত পদার্থ জমার সুযোগ করে দেয়। তৃতীয়ত, তামাক দেহের জন্য উপকারী কোলেস্টেরল ‘হাই-ডেনসিটি কোলেস্টেরল’কে কমিয়ে আনে এবং ক্ষতিকর ‘লো-ডেনসিটি কোলেস্টেরল’কে বাড়িয়ে দেয়। চতুর্থত, রক্তপ্রবাহের গতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় এবং এভাবে উচ্চ রক্তচাপ তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়া বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নিকোটিন এবং কার্বন-মনোক্সাইড রক্তকণিকায় অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং দেহের ভেতরে রক্তকণিকায় অনাকাঙ্ক্ষিত জটের সৃষ্টি করে। ফলে দেহের অন্যান্য অঙ্গে রক্ত এবং অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যেতে পারে বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
তারা আরো বলেন, ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় দ্বিগুণ। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি তিন গুণ, বুকের ব্যথা বা অ্যানজিনার ক্ষেত্রে ২০ গুণ এবং দেহের কোনো পেশিতে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পাঁচ গুণ। নিজে ধূমপান না করলেও কেবল ধূমপায়ীদের সঙ্গে থাকার কারণে একজন ব্যক্তি যে নিকোটিন শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করেন, এতে তার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ধূমপান বা তামাক সেবন ত্যাগ না করে কেবল পরিমাণ কমিয়ে আনলে হৃদরোগ এড়ানো সম্ভব, এ ধারণাও পুরোপুরি ভুল। কারণ, দিনে একজন একটি সিগারেট খেলেও শেষ পর্যন্ত হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ এবং স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া ‘লাইট’/’মাইল্ড’ কিংবা ‘লো-নিকোটিন’ নাম দিয়ে বাজারে যেসব সিগারেট বা তামাকপণ্য বিক্রয় হয়, সেগুলো সেবনেও ক্ষতি কমানো যায় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে যারা তামাক ব্যবহার করছেন, তামাক ছেড়ে দেয়ার এক বছরের মধ্যেই তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। আর টানা ১৫ বছর কেউ যদি তামাক সেবন থেকে বিরত থাকেন, তাহলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে একজন অধূমপায়ীর পর্যায়ে নেমে আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, মৃত্যুর একক কারণ হিসেবে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর প্রায় ৩১ শতাংশই হৃদরোগজনিত মৃত্যু এবং যার এক-তৃতীয়াংশই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশের জন্য দায়ি তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপান। হৃদরোগের কারণ হিসেবে উচ্চ রক্তচাপের পরেই তামাক ব্যবহারের অবস্থান। তামাক মহামারি প্রতি বছর বিশ্বের ৭০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। পরোক্ষ ধূমপানে মৃত্যুবরণ করে আরো ৯ লাখ অধূমপায়ী মানুষ। বর্তমানে বিশ্বে মোট তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ বিলিয়ন, যার ৮০ শতাংশই বসবাস করে নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশেগুলোতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর ১৭ শতাংশের জন্য দায়ী হৃদরোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০১৭-এর তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সময়কালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সময়কালে বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর কারণের তালিকায় হৃদরোগ ৭ম স্থান থেকে ১ম স্থানে উঠে এসেছে এবং এই পরিবর্তনের হার ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ি হিসেবে তামাকের অবস্থান ৪র্থ। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৩০ শতাংশের জন্যই দায়ি ধূমপান। বাংলাদেশে তামাকের উচ্চ ব্যবহার এই ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দেশের মোট প্রাপ্তবয়ষ্ক জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ (৪ কোটি ১৩ লাখ) তামাক ব্যবহার করেন। টোব্যাকো অ্যাটলাসের (২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, মধ্যমসারির মানব-উন্নয়ন সূচকে অবস্থানকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুর হার ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগের প্রকোপ ভয়াবহ। প্রধানমন্ত্রী তামাককে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০৪০ সালের আগেই বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রজ্ঞা মনে করে এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে। তা হলো- পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান, তামাকপণ্যের মোড়কে আইন অনুযায়ী সচিত্র সতর্কবার্তা মুদ্রণ, তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন-প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতাসহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারাসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন; তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক খসড়া নীতিসমূহ (জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি) দ্রুত চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন; আর্টিক্যাল ৫.৩-এর আলোকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ, খোলা তামাকপণ্যের বিক্রয় বন্ধ, বিদ্যালয়-কলেজের নিকটে তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করে আইন/নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ এফসিটিসি’র আলোকে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে যুগোপযোগী করা; তামাকজাত পণ্যের দাম ক্রমশ জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘তামাক করে হৃৎপিণ্ডের ক্ষয়, স্বাস্থ্যকে ভালোবাসি, তামাককে নয়।’
No comments