ডাস্টবিনে নবজাতক সংখ্যা বাড়ছে
সকাল
থেকেই রিমঝিম বৃষ্টি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ
নাই। বাঁশ ব্যবসায়ী বিপ্লব হোসেন কাজে যেতে পারছিলেন না। ভেবেছেন আর কাজে
যাওয়া হবে না। স্ত্রী লিপি আক্তারকে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করতে বলেছেন।
লিপি কিছু কিনতে একটি ছাতা নিয়ে পার্শ্ববর্তী মুদির দোকানে যান। ঠিক তখনই পরিচিত এক প্রতিবেশী নারী তার কাছে আসেন। বলেন- ময়লা আবর্জনার স্তূপে পড়ে আছে একটি নবজাতক। কোনো কিছু না ভেবেই দৌড় দেন সেখানে। দেখেন একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা বাজারের ব্যাগে ময়লা কাপড় দিয়ে পেঁচানো নবজাতক। যার নাড়ি পর্যন্তই কাটা হয়নি। বৃষ্টির মধ্যে ব্যাগের ভেতরে হাত-পা নাড়াচ্ছে। ময়লা আবর্জনায় থাকা পিঁপড়াগুলো কামড়াচ্ছিলো। পুরো শরীরে লাল দাগের চিহ্ন। তাই কান্না করছিলো শিশুটি। খবর পেয়ে সেখানে অনেকেই আসেন। কিন্তু কেউই শিশুটির কাছে যাচ্ছিলেন না। রক্তমাখা শিশুটিকে লিপি আক্তারই নিয়ে যান বাসায়। তিনি শিশুটিকে গোসল করান। এরপর স্থানীয় এক দাইকে এনে তার নাড়ি কাটান। একজন ইমাম ডেকে এনে শিশুটিকে আজান শোনান। খবর পেয়ে শাহ আলী থানার পুলিশ এলে সবাই মিলে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সেখানেই শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠে। তার নাম রাখা হয় আনিশা। ঘটনাটি ২০১৭ সালের ১১ই মার্চ শাহ আলী থানার নবাবের বাগ পাকার মাথা এলাকার।
হালে বদলাচ্ছে সমাজের রূপ। আগের দিনে যেসব ঘটনা মানুষের মনকে নাড়া দিতো। এখন আর এসব ঘটনা নিয়ে ভাবে না কেউ। ডাস্টবিন থেকে নবজাতক উদ্ধার এখন অনেক স্বাভাবিক একটি ঘটনা। একের পর এক নবজাতক উদ্ধার। কখনও জীবিত কখনও মৃত। পরিত্যক্ত স্থান থেকে শুরু করে ডাস্টবিন, ড্রেন, ডোবা-নালা সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে নবজাতককে। ডাস্টবিনে রাখা নবজাতককে কুকুরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে এমন ঘটনাও ঘটে গেছে। ৩রা মে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় রাস্তার পাশে পড়েছিল একটি নবজাতক। একটি কুকুর তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এ দৃশ্যও দেখেছিল সাটুরিয়ার বাসিন্দারা। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। একইদিন বরগুনার সদর হাসপাতালের পাশের ডাস্টবিনে পাওয়া যায় আরেকটি নবজাতক। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন এ হলো সমাজের বিকৃত রূপ। সামাজিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে। এসব রোধে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকল্প নাই। পাশাপাশি সুশিক্ষার প্রয়োজন আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সারা দেশে নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে ১২ জন, ২০১৫ সালে ২৪ জন, ২০১৬ সালে ৯ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন ও চলতি বছরের মে মাসের ১৫ দিনেই ২৮ জন নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালে ৭ জন অজ্ঞাত নবজাতকের মরদেহ, ২০১৫ সালে ৫২ জন, ২০১৬ সালে ২৮ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন ও ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২৭ জন নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম মানবজমিনকে বলেন, ডাস্টবিনে নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। হাসপাতালের ডাস্টবিনে প্রায়ই নবজাতককে ফেলে রাখার ঘটনা শোনা যায়। যে সম্পর্কের সামাজিক কোনো স্বীকৃতি নেই এবং সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার সম্পর্ক থেকেই মূলত এই ঘটনা ঘটে। অনুকূল পরিবেশ, সামাজিক স্বীকৃতির অভাবেই এগুলো হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই ধরনের অপ্রত্যাশিত অনাগত শিশুদের জন্য আলাদা কোনো সংগঠন বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান নেই। এটা সামাজিক অনগ্রসরতার একটি অংশ। এক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। একজন মেয়ে যখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়ে তখন তার নাম-পরিচয় গোপন রেখে বাচ্চার নিরাপদ পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪
ভবিষ্যতের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে এতিমখানাগুলোয় বাচ্চারা যখন বড় হয় তখন তাদের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু এই স্বীকৃতিহীন বাচ্চাদের দায়িত্ব নেয় না এতিমখানাগুলো। এই ধরনের বাচ্চাদের বরং এতিমখানার মালিকরা পর্যন্ত গালিগালাজ করে এবং খারাপ চোখে দেখে। অথচ বিদেশে এসব বাচ্চা হওয়ার আগেই চার্চে গিয়ে জানানো হয়। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই ওই বাচ্চাকে চার্চে রেখে আসা হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের আগ্রাসন, পর্নোগ্রাফির কারণে অবাধ মেলামেশা ও পারিবারিক সুসম্পর্ক না থাকা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার পর্যালোচনা করে কারণ চিহ্নিত করতে না পারার কারণে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এছাড়া দেশের সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের নবজাতককে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র সন্তানহীন দম্পতিরা সন্তানের অভাব মেটাতে নবজাতকের দায়িত্ব নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঘটনা। সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক বাবুল মিয়া। ২রা মে রাত ২টার দিকে হাসপাতালের ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে তার অ্যাম্বুলেন্সের কাছে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনতে পান। ডাস্টবিন থেকে কান্নার শব্দ আসছিল। প্রথমে তিনি অনেকটা ভয় পেয়ে যান। এতো রাতে এখানে কেন নবজাতক কান্না করবে। কিছুটা সাহস নিয়েই তিনি ডাস্টবিনের কাছে যান। দেখেন ওই ডাস্টবিনের মধ্যেই পড়ে আছে একটি নবজাতক। বাক্সে মোড়ানো রক্তাক্ত অবস্থায় ছেলে নবজাতক দেখে তিনি পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে নবজাতককে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ইকবালের তত্ত্বাবধানে নবজাতকটিকে সুস্থ করে তোলা হয়। ৮ই মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক ও শিশু বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজওয়ানুর রহমানের উপস্থিতিতে এক দম্পতির কোলে ওই নবজাতকটিকে তুলে দেন জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোস্তফা মাহমুদ সারোয়ার। জহিরুল ইসলাম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা।
শুধু ডাস্টবিন ও পরিত্যক্ত স্থান থেকে নবজাতক উদ্ধার হচ্ছে না। মৃত নবজাতকও অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। ২৯শে এপ্রিল দুপুরে ময়মনসিংহের বাঘমারা এলাকার একটি ড্রেন এবং ভাটিকাশর ডাস্টবিন থেকে দুটি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দারা নবজাতকের মরদেহ দেখে পুলিশকে জানায়। পরে কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ এসে নবজাতক দুটিকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পুলিশের ধারণা ওই এলাকার ক্লিনিকে অবৈধ গর্ভপাতের পর নবজাতকের মরদেহ দুটি কেউ ফেলে রেখে চলে গেছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, ডাস্টবিনে নবজাতক উদ্ধার আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। মানুষের অবৈধ সম্পর্ক ও মেলামেশার কারণে যে সন্তানের জন্ম হচ্ছে তার দায়িত্ব নিতে না পেরে এভাবে ফেলে দেয়। এর কারণ হলো সমাজের মানুষের যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না। তাই এধরনের অনৈতিক বিষয়গুলো আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গোপনে অনেকেই সম্পর্ক করে অবাধে মেলামেশা করে। তখন যেসব সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার হয় তারা সেটা করে না। গোপন সম্পর্ক উপভোগ করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তারা আবার সেটি সামাল দিতে পারে না। মানসিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি শক্ত না হলে এমনটা হয়। এর বাইরে বৈধভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান লাভ করে তার ভরণপোষণ দিতে না পারা ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলার কারণে অনেক সময় সন্তানকে ফেলে রেখে চলে যায়। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, সমাজের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্বশীলতার অভাব ও পুঁজিবাদের দুর্দান্ত প্রভাব আমরা এখন ভোগ করছি। এর প্রভাব কিন্তু সমাজের উপর পড়ছে। কারণ পুঁজিবাদ সবসময় ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থটাকে বড় করে তুলে। অন্যের উপকারে, মানবিক দায়িত্বে প্রভাব ফেলে না। মানুষ যখন বেশি মাত্রায় স্বার্থপর ও নিজমুখী হয়ে যায় তখন অন্যরা যে সমস্যাগ্রস্ত সেদিকে তাদের নজর থাকে না। এতে করে প্রমাণ হয় আমাদের ভিত্তি ও মূল্যবোধ কতটুকু দুর্বল। এরকম অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য তৌহিদুল হক মনে করেন আমাদের মধ্যে পারস্পরিক-সামাজিক দায়িত্বশীলতা এবং রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতি সংবেদনশীলতা দরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস থাকা জরুরি। এসবের যদি পরিবর্তন আনা না যায় তবে বিশ্বায়ন ও আধুনিকায়ন যাই করা হউক না কেন মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ক্লিনিক ও হাসপাতাল) ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমরা একটি ডাটাবেজ অটোমোশন চালু করছি যেখানে নিবন্ধিত সব ক্লিনিক ও হাসপাতালের তথ্য পাওয়া যাবে। যারা নিবন্ধিত না তাদের কোনো তথ্য এখানে থাকবে না। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা বৈধ-অবৈধ এসব ক্লিনিক ও হাসপাতাল পরিদর্শনের জন্য কয়েকটি টিম তৈরি করেছিলাম। একজন উপ-পরিচালককে প্রধান করে ১ জন সহকারী পরিচালক ও ১ জন মেডিকেল অফিসার নিয়ে এই টিম মাসে ৬০টি ক্লিনিক ও হাসপাতাল পরিদর্শন করে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে কিছু অনৈতিকতার অভিযোগ পায় তবে তাদের প্রাথমিকভাবে নোটিশ দেয়া হয়। এরপরেও যদি না হয় তবে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
লিপি কিছু কিনতে একটি ছাতা নিয়ে পার্শ্ববর্তী মুদির দোকানে যান। ঠিক তখনই পরিচিত এক প্রতিবেশী নারী তার কাছে আসেন। বলেন- ময়লা আবর্জনার স্তূপে পড়ে আছে একটি নবজাতক। কোনো কিছু না ভেবেই দৌড় দেন সেখানে। দেখেন একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা বাজারের ব্যাগে ময়লা কাপড় দিয়ে পেঁচানো নবজাতক। যার নাড়ি পর্যন্তই কাটা হয়নি। বৃষ্টির মধ্যে ব্যাগের ভেতরে হাত-পা নাড়াচ্ছে। ময়লা আবর্জনায় থাকা পিঁপড়াগুলো কামড়াচ্ছিলো। পুরো শরীরে লাল দাগের চিহ্ন। তাই কান্না করছিলো শিশুটি। খবর পেয়ে সেখানে অনেকেই আসেন। কিন্তু কেউই শিশুটির কাছে যাচ্ছিলেন না। রক্তমাখা শিশুটিকে লিপি আক্তারই নিয়ে যান বাসায়। তিনি শিশুটিকে গোসল করান। এরপর স্থানীয় এক দাইকে এনে তার নাড়ি কাটান। একজন ইমাম ডেকে এনে শিশুটিকে আজান শোনান। খবর পেয়ে শাহ আলী থানার পুলিশ এলে সবাই মিলে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সেখানেই শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠে। তার নাম রাখা হয় আনিশা। ঘটনাটি ২০১৭ সালের ১১ই মার্চ শাহ আলী থানার নবাবের বাগ পাকার মাথা এলাকার।
হালে বদলাচ্ছে সমাজের রূপ। আগের দিনে যেসব ঘটনা মানুষের মনকে নাড়া দিতো। এখন আর এসব ঘটনা নিয়ে ভাবে না কেউ। ডাস্টবিন থেকে নবজাতক উদ্ধার এখন অনেক স্বাভাবিক একটি ঘটনা। একের পর এক নবজাতক উদ্ধার। কখনও জীবিত কখনও মৃত। পরিত্যক্ত স্থান থেকে শুরু করে ডাস্টবিন, ড্রেন, ডোবা-নালা সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে নবজাতককে। ডাস্টবিনে রাখা নবজাতককে কুকুরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে এমন ঘটনাও ঘটে গেছে। ৩রা মে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় রাস্তার পাশে পড়েছিল একটি নবজাতক। একটি কুকুর তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এ দৃশ্যও দেখেছিল সাটুরিয়ার বাসিন্দারা। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। একইদিন বরগুনার সদর হাসপাতালের পাশের ডাস্টবিনে পাওয়া যায় আরেকটি নবজাতক। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন এ হলো সমাজের বিকৃত রূপ। সামাজিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে। এসব রোধে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকল্প নাই। পাশাপাশি সুশিক্ষার প্রয়োজন আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সারা দেশে নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে ১২ জন, ২০১৫ সালে ২৪ জন, ২০১৬ সালে ৯ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন ও চলতি বছরের মে মাসের ১৫ দিনেই ২৮ জন নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালে ৭ জন অজ্ঞাত নবজাতকের মরদেহ, ২০১৫ সালে ৫২ জন, ২০১৬ সালে ২৮ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন ও ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২৭ জন নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম মানবজমিনকে বলেন, ডাস্টবিনে নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। হাসপাতালের ডাস্টবিনে প্রায়ই নবজাতককে ফেলে রাখার ঘটনা শোনা যায়। যে সম্পর্কের সামাজিক কোনো স্বীকৃতি নেই এবং সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার সম্পর্ক থেকেই মূলত এই ঘটনা ঘটে। অনুকূল পরিবেশ, সামাজিক স্বীকৃতির অভাবেই এগুলো হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই ধরনের অপ্রত্যাশিত অনাগত শিশুদের জন্য আলাদা কোনো সংগঠন বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান নেই। এটা সামাজিক অনগ্রসরতার একটি অংশ। এক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। একজন মেয়ে যখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়ে তখন তার নাম-পরিচয় গোপন রেখে বাচ্চার নিরাপদ পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪
ভবিষ্যতের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে এতিমখানাগুলোয় বাচ্চারা যখন বড় হয় তখন তাদের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু এই স্বীকৃতিহীন বাচ্চাদের দায়িত্ব নেয় না এতিমখানাগুলো। এই ধরনের বাচ্চাদের বরং এতিমখানার মালিকরা পর্যন্ত গালিগালাজ করে এবং খারাপ চোখে দেখে। অথচ বিদেশে এসব বাচ্চা হওয়ার আগেই চার্চে গিয়ে জানানো হয়। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই ওই বাচ্চাকে চার্চে রেখে আসা হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের আগ্রাসন, পর্নোগ্রাফির কারণে অবাধ মেলামেশা ও পারিবারিক সুসম্পর্ক না থাকা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার পর্যালোচনা করে কারণ চিহ্নিত করতে না পারার কারণে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এছাড়া দেশের সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের নবজাতককে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র সন্তানহীন দম্পতিরা সন্তানের অভাব মেটাতে নবজাতকের দায়িত্ব নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঘটনা। সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক বাবুল মিয়া। ২রা মে রাত ২টার দিকে হাসপাতালের ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে তার অ্যাম্বুলেন্সের কাছে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনতে পান। ডাস্টবিন থেকে কান্নার শব্দ আসছিল। প্রথমে তিনি অনেকটা ভয় পেয়ে যান। এতো রাতে এখানে কেন নবজাতক কান্না করবে। কিছুটা সাহস নিয়েই তিনি ডাস্টবিনের কাছে যান। দেখেন ওই ডাস্টবিনের মধ্যেই পড়ে আছে একটি নবজাতক। বাক্সে মোড়ানো রক্তাক্ত অবস্থায় ছেলে নবজাতক দেখে তিনি পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে নবজাতককে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ইকবালের তত্ত্বাবধানে নবজাতকটিকে সুস্থ করে তোলা হয়। ৮ই মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক ও শিশু বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজওয়ানুর রহমানের উপস্থিতিতে এক দম্পতির কোলে ওই নবজাতকটিকে তুলে দেন জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোস্তফা মাহমুদ সারোয়ার। জহিরুল ইসলাম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা।
শুধু ডাস্টবিন ও পরিত্যক্ত স্থান থেকে নবজাতক উদ্ধার হচ্ছে না। মৃত নবজাতকও অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। ২৯শে এপ্রিল দুপুরে ময়মনসিংহের বাঘমারা এলাকার একটি ড্রেন এবং ভাটিকাশর ডাস্টবিন থেকে দুটি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দারা নবজাতকের মরদেহ দেখে পুলিশকে জানায়। পরে কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ এসে নবজাতক দুটিকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পুলিশের ধারণা ওই এলাকার ক্লিনিকে অবৈধ গর্ভপাতের পর নবজাতকের মরদেহ দুটি কেউ ফেলে রেখে চলে গেছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, ডাস্টবিনে নবজাতক উদ্ধার আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। মানুষের অবৈধ সম্পর্ক ও মেলামেশার কারণে যে সন্তানের জন্ম হচ্ছে তার দায়িত্ব নিতে না পেরে এভাবে ফেলে দেয়। এর কারণ হলো সমাজের মানুষের যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না। তাই এধরনের অনৈতিক বিষয়গুলো আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গোপনে অনেকেই সম্পর্ক করে অবাধে মেলামেশা করে। তখন যেসব সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার হয় তারা সেটা করে না। গোপন সম্পর্ক উপভোগ করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তারা আবার সেটি সামাল দিতে পারে না। মানসিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি শক্ত না হলে এমনটা হয়। এর বাইরে বৈধভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান লাভ করে তার ভরণপোষণ দিতে না পারা ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলার কারণে অনেক সময় সন্তানকে ফেলে রেখে চলে যায়। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, সমাজের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্বশীলতার অভাব ও পুঁজিবাদের দুর্দান্ত প্রভাব আমরা এখন ভোগ করছি। এর প্রভাব কিন্তু সমাজের উপর পড়ছে। কারণ পুঁজিবাদ সবসময় ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থটাকে বড় করে তুলে। অন্যের উপকারে, মানবিক দায়িত্বে প্রভাব ফেলে না। মানুষ যখন বেশি মাত্রায় স্বার্থপর ও নিজমুখী হয়ে যায় তখন অন্যরা যে সমস্যাগ্রস্ত সেদিকে তাদের নজর থাকে না। এতে করে প্রমাণ হয় আমাদের ভিত্তি ও মূল্যবোধ কতটুকু দুর্বল। এরকম অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য তৌহিদুল হক মনে করেন আমাদের মধ্যে পারস্পরিক-সামাজিক দায়িত্বশীলতা এবং রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতি সংবেদনশীলতা দরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস থাকা জরুরি। এসবের যদি পরিবর্তন আনা না যায় তবে বিশ্বায়ন ও আধুনিকায়ন যাই করা হউক না কেন মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ক্লিনিক ও হাসপাতাল) ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমরা একটি ডাটাবেজ অটোমোশন চালু করছি যেখানে নিবন্ধিত সব ক্লিনিক ও হাসপাতালের তথ্য পাওয়া যাবে। যারা নিবন্ধিত না তাদের কোনো তথ্য এখানে থাকবে না। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা বৈধ-অবৈধ এসব ক্লিনিক ও হাসপাতাল পরিদর্শনের জন্য কয়েকটি টিম তৈরি করেছিলাম। একজন উপ-পরিচালককে প্রধান করে ১ জন সহকারী পরিচালক ও ১ জন মেডিকেল অফিসার নিয়ে এই টিম মাসে ৬০টি ক্লিনিক ও হাসপাতাল পরিদর্শন করে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে কিছু অনৈতিকতার অভিযোগ পায় তবে তাদের প্রাথমিকভাবে নোটিশ দেয়া হয়। এরপরেও যদি না হয় তবে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
No comments