অর্থবছরের শুরুতেই অর্থমন্ত্রীর কপালে ভাঁজ
২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুটা হয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে। কেউ ভাবেনি নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কাজ দুই বছরের জন্য স্থগিত হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছিল ভ্যাটের হার কমানো হতে পারে। প্রস্তাব ছিল ১৫ শতাংশের। সবার দাবি ছিল ১০ থেকে ১২ শতাংশ করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো আইন বাস্তবায়নের কাজই সংসদ স্থগিত করে দেয়। এতে নতুন অর্থবছরের বাজেট এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। অনিশ্চয়তা খরচের বাজেট নিয়ে নয়, অনিশ্চয়তা রাজস্ব আয়ের বাজেট নিয়ে। কারণ খরচ নিয়ে চিন্তা নেই, এটা হবেই যদি না খরচ কাটছাঁট করা হয়। যত চিন্তা রাজস্ব নিয়ে। এবার এ চিন্তা, চিন্তা বলি কেন, দুশ্চিন্তার মধ্যেই বাজেটের প্রথম মাস জুলাই শুরু হয়েছে। কারণ কী? কারণ অর্থমন্ত্রী ভেবেছিলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা গেলে তিনি ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পাবেন। এ আশাতেই তিনি চার লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে না। এটা তো হল ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার আশু ফল। ফল তো আরও রয়েছে। কোনো বছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। এবারও তাই হবে বলে আশঙ্কা করা যায়। আর তা হলে শেষ পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়াবে বিপুল অংকের। এর বাড়ি কোথায়? কীভাবে এ ঘাটতি পূরণ হবে তা-ই ভাবার বিষয়। অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতেই তিনি বিচলিত। সাংবাদিকদের বলেছেন, এ মুহূর্তে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। মিটিং-সভা করে পরে বলবেন। এ অবস্থায় পরিষ্কার বোঝা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন বাজেট তার প্রথম মাসেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমাদের বেশকিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বুঝতে যে কী হচ্ছে শেষ পর্যন্ত। সরকারের হাতে নানা অস্ত্র আছে। আছে ঋণের অস্ত্র। সরকার তা ব্যবহার করে বেশি বেশি ঋণের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। সরকার ধনীদের ওপর ট্যাক্স আরোপ করতে পারে, যা আশা করা সমীচীন হবে না। কারণ সরকার ধনীদের উদার হস্তে দিতেই ব্যস্ত। এবারও গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের আয়কর উল্লেখযোগ্য হারে কমানো হয়েছে, যেখানে সাধারণ করদাতাদের আয়কর হারে কোনো পরিবর্তন ঘটানো হয়নি। সরকার আবার এমআরও (স্টেটুটরি রেগুলেটরি অর্ডার) নামের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ব্যবহার করতে পারে। এর মাধ্যমে রাজস্ব বোর্ড যে কোনো সময় যে কোনো পণ্য ও সেবার ওপর যে কোনো হারে কর বসাতে পারে। করের হার সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করতে পারে। সরকার তার সেবাগুলোর দাম বাড়াতে পারে। এ ধরনের বহু অস্ত্র আছে, যা ব্যবহার করা হতে পারে। ক্লান্ত মানুষ কত প্রতিবাদ করবে? আর প্রতিবাদ করার আগে তো জানতে ও বুঝতে হবে। যদি কৌশলটি হয় ‘চোরাগোপ্তা’, তাহলে বুঝতে বুঝতেই চলে যাবে বছর, যেমনটি ঘটেছে এবার আবগারি শুল্ক নিয়ে। এ অবস্থায় অপেক্ষায় থাকতে হবে সরকার কোন্ পথে তার ২০ হাজার কোটি টাকার ‘ভ্যাট ঘাটতি’ পূরণ করে তা দেখতে। নতুন অর্থবছরটি শুধু ভ্যাটজনিত কারণে অনিশ্চয়তায় পড়েনি। প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাই মাসে অর্থনীতির খবর ভালো নয়। গেল মাস গেছে রোজার মাস। পরে উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদ। এ উপলক্ষে এবং নতুন বাজেট ঘোষণা উপলক্ষে পুরো জুন মাস গেছে মূল্যবৃদ্ধির মাস। সবকিছুর মূল্য আরেক দফা বাড়িয়েছে ‘দেশপ্রেমিক’ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। মূল্যস্ফীতির ধাক্কাজনিত কষ্ট, অনিশ্চয়তার জীবন শেষ হতে না হতেই অর্থনীতিতে ঘটেছে আরও কিছু ঘটনা। এসব ঘটনা প্রাকৃতিক। কিন্তু এর প্রভাব অর্থনীতিতে ভীষণভাবে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা কোথা থেকে শুরু করব? যখন এ কলাম লিখছি তখনও ঢাকা শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ। যে পুরান ঢাকায় জীবনে জল জমতে কেউ দেখেনি সেখানেও জল। নাজিমউদ্দিন রোড হাঁটু জলের তলে। নারিন্দা, গোপীবাগ, মতিঝিল, নটর ডেম কলেজ রোড, মালিবাগ চৌধুরীপাড়াসহ ঢাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের নিচে পড়ে এক রাতের বৃষ্টিতে। অথচ পুরো ঢাকায় চলছে জল নিষ্কাশনের বিশাল আয়োজন। বড় বড় ড্রেন খোঁড়া হয়েছে পুরো ঢাকায়। তারপরও মানুষের কেন এত কষ্ট, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। ডিএনডি বাঁধের মানুষ জলের তলে। অর্থবছরের শুরুতে এ বিপর্যয় অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড় ধস, ভূমি ধস আরেকটি বিপদ। এতে প্রাণ যেমন গেছে, তেমনি হয়েছে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। চট্টগ্রাম শহর অর্থবছরের প্রথম মাসেই জলের তলে। খবরের কাগজে তার ছবি প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে। এদিকে আরেক প্রাকৃতিক বিপদ হচ্ছে বন্যা। এটা অকাল বন্যা নয়। অকাল বন্যায় মাস দেড়েক আগে বৃহত্তর সিলেটের সমগ্র অঞ্চল, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের মানুষ ফসল হারিয়েছে, গবাদিপশু হারিয়েছে। জীবনযাপন তাদের জন্য হয়েছে এক জ্বালা। অকাল বন্যা, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের জ্বালাতন শেষ হতে না হতেই এবার আষাঢ়ী বন্যা শুরু হয়েছে। সরকারসমর্থিত একটি দৈনিকের খবরের শিরোনাম, প্রথম পাতায় প্রথম খবরের শিরোনাম : ‘বন্যার পানি আরও বেড়েছে’। ভেতরে বলা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি, দুর্ভোগ চরমে, দুর্গত এলাকায় মেডিকেল টিম, কক্সবাজারে তিনজনের মৃত্যু। স্টাফ রিপোর্টারের রিপোর্ট পড়লে রীতিমতো ভয় জাগে। উত্তরবঙ্গ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ সারা দেশের অনেক অঞ্চল বন্যার জলে প্লাবিত। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এমন সময়ে হচ্ছে যখন ইতিমধ্যেই মানুষ নানা সমস্যায় আক্রান্ত। চালের সমস্যা শুরু হয়েছে। চাল আমদানির খবর হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা এ বছর ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করবে। বিপরীতে অবশ্য দেশের ভেতরে চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। সরকার চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। এর সুযোগ নিয়েছে চাল আমদানিকারক ও চাল ব্যবসায়ীরা। তারা মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের চালের দাম হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি। এ এক অসম্ভব ঘটনা। অতএব ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুটা যে খারাপ, তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে বন্যা পরিস্থিতির যদি আরও অবনতি ঘটে, তাহলে নতুন বাজেটের ওপর যে চাপ বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। এদিকে রফতানির খবরও ভালো নয়। রেমিটেন্সের খবরও ভালো নয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিটেন্স হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এ খারাপ খবর নিয়েই নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের ধরে ধরে ফিরতি বিমানেই দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবৈধভাবে বসবাসকারী প্রায় এক লাখ লোককে ফেরত আনতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের খবরও ভালো নয়। হ্রাসমান রেমিটেন্সের এ ধারা কীভাবে ঠেকানো যাবে তা-ই এবারের বাজেটের আরেক প্রশ্ন। রফতানি আয়ও আমাদের আশানুরূপ হচ্ছে না। একমাত্র পণ্য গার্মেন্ট, যা রফতানিতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মূল্য প্রতিযোগিতা তো বহুল কথিত সমস্যা। এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক সমস্যা। এ খাতে নতুন করে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ধীরে ধীরে গার্মেন্ট খাত হয়ে উঠছে আধুনিক যন্ত্রায়িত খাত, যেখানে শ্রমিকের প্রয়োজন কম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট এসব সংকট ও সমস্যা নিয়েই শুরু হয়েছে।কাগজে দেখলাম ২০১৬-১৭ অর্থবছরটি শেষ হয়েছে আরেকটি খারাপ খবর দিয়ে। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরটি শুরু হচ্ছে বেসরকারি খাতে কম ঋণ প্রবাহ দিয়ে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে; কিন্তু এপ্রিল ও মে মাসে ওই ঋণের পরিমাণ আবার হ্রাস পেতে শুরু করেছে। ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ থেকে ঋণ প্রবাহের পরিমাণ মে মাসে ১৬ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। এদিকে বছরের শুরুতে দৃশ্যত একটি ভালো খবর আছে। তা হচ্ছে, সরকারি ব্যাংক থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সরকার ধরিয়ে দেবে ‘হাইট্র্যাক’ বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে। দৃশ্যত এটি ভালো খবর। কিন্তু এটি ধরিয়ে দেয়ার আগে দশবার ভাবা উচিত। পরীক্ষা করে দেখা উচিত বড় বড় বেসরকারি, পিপিপি ইত্যাদি খাতে যে ঋণ যাচ্ছে, তা আদায় হচ্ছে কিনা। না দেখে নতুনভাবে ঋণ দেয়া হবে নিয়মবহির্ভূত কাজ। সবকিছু মিলিয়ে বছরের শুরুটা ভালো নয়। বাকিটা রূপালী পর্দায় দেখতে হবে।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতিবিষয়ক লেখক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
rmdebnath@yahoo.com
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতিবিষয়ক লেখক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
rmdebnath@yahoo.com
No comments