বিদেশে কেন চিকিৎসা? by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
বিশ্বাস,
ব্যবহার আর আচরণ- এ তিন গুণ বাংলাদেশি রোগীদের টেনে নেয় বিদেশে। এছাড়া
ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার প্রতি অনাস্থাও বড় একটি কারণ। ক’দিন আগে ভারতের
চেন্নাই থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরেন ইমরাজ শিকদার। ভারতে কেন চিকিৎসা-এমন
প্রশ্নের জবাবে ইমরাজ বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যাপার চিকিৎসক ও নার্সদের সুন্দর
আচরণ। এ আচরণ ও ব্যবহারের কারণে রোগীরা ৩০ শতাংশ সুস্থ হয়ে যান। তিনি বলেন,
একই মানের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সে দেশে পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া
যায়। দেশে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একই রোগীর পরীক্ষার একেক ধরনের ফল
মিলে। থাকে টাকার ব্যবধানও। ভুল চিকিৎসা হয় অনেক ক্ষেত্রে। ভারত,
সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরা বেশ কজন রোগী জানান,
চিকিৎসার নামে ওই সব দেশে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়নি। ভুল চিকিৎসার
ঘটনাও কম। একই ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা একাধিকবার করানো, রোগীকে সময় কম দেয়া,
বাড়তি আয়ের জন্য রোগীকে অতিরিক্ত সময় কেবিন বা বিছানায় রাখার প্রবণতা নেই
সেখানে। ভুল চিকিৎসার জন্য মাশুল গুনতে হয় দেশগুলোর ডাক্তারদের। অভিযুক্ত
ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল বা ফৌজদারি মামলা হয়। কঠোর আইনের মধ্যেই থাকতে
হয় ডাক্তারদের। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। ভুল চিকিৎসার জন্য রোগীর
মৃত্যু ঘটলেও স্বজনরা অসহায়। ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। কয়েকজন
বলেন, দেশের চিকিৎসকরা কথায় কথায় টেস্ট এবং অনেক ওষুধ দেন। অযাচিত
এন্টিবায়োটিক। কিন্তু বিদেশে এই চিত্র কম। দুই বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের
আইনজীবী কামাল হোসেন চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন থাইল্যান্ডে। দেশটির
বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। তিনি জানান, সেখানে তিনি
এমআরআই পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অনেক চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। তিন লাখ টাকার ওপর
চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে থাইল্যান্ডে। কিন্তু সেখানকার সেবা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট।
বেশ ক’বছর ধরে বাংলাদেশি রোগীদের বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, চালানোর দক্ষ টেকনিশিয়ান নেই। দেশের সরকারি চিকিৎসা খাতে এ বেহাল চিত্র। অন্যদিকে বেসরকারি চিকিৎসাসেবাও আকর্ষণ করতে পারছে না রোগীদের। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বিশেষ করে ডাক্তার, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি আরোপ হয়নি। ফলে অসম বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে বেসরকারি খাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চিকিৎসার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোগী সুচিকিৎসার খোঁজে বিদেশে যাচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতে রোগীপ্রতি গড়ে দেড় লাখ টাকা খরচ হলে বিদেশে চিকিৎসা বাবদ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। রোগীর সঙ্গে স্বজনদের খরচ হিসাব করলে এ খরচের সঙ্গে যোগ হবে আরো প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ভারত ছাড়া সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও অন্যান্য দেশেও চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিরা নিয়মিত যাচ্ছেন।
প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার নামে লাখ লাখ রোগী পাঠানো হচ্ছে। চিকিৎসা বাবদ দেশ থেকে প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যায় বলে একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন প্রয়াত বিশিষ্ট চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। ধারণা করা হচ্ছে, দেশব্যাপী তিন শতাধিক এ রকম এজেন্ট রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার রোগী বিদেশে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ভারতেই যাচ্ছেন গড়ে প্রতি মাসে ১৫ হাজার রোগী। বাকিরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যাচ্ছেন বলে এজেন্ট প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন। এসব এজেন্ট প্রতিনিধি ভিসা প্রসেস ও সংশ্লিষ্ট দেশের ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর জন্য ব্যবস্থা নেন। এজন্য তারা প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে তিন হাজার টাকা ফি নেন। এ প্রক্রিয়া ছাড়াও সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ প্রশাসনের বড় বড় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিরা অনেক সময়ে বিদেশে ভ্রমণ করার সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন।
রাজধানীর ধানমন্ডির এমন একটি প্রতিষ্ঠান ইনটেক্স কেয়ার (গ্লোবাল ট্রেড লিংক)। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা ভারতের বিখ্যাত হাসপাতালসমূহে হার্ট, ক্যানসার, কিডনি চিকিৎসা, লিভার চিকিৎসা, বাইপাস সার্জারি, হাঁটুর অপারেশন, বনমেরু ট্রান্সপ্লান্টসহ সব ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা করানোর কাজ করেন। এছাড়া তারা মেডিকেল ভিসা সহায়তা ও এয়ার অ্যামু্বলেন্সের ব্যবস্থা করান বলে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে উচ্চবিত্ত শ্রেণির রোগী এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক দেখার কিছু নেই। তারা আরো বলেন, দেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে। অভিযোগ আছে অতিরিক্ত ব্যয়েরও। অন্যদিকে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসাপ্রাপ্তিও সহজ করেছে দেশটি। এসব কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্যসেবা রপ্তানি নিয়ে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব কমার্শিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস (ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এটি চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশ করা হয়। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতে চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারী বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশি। অর্থবছরটিতে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিয়েছে মোট প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার জন বিদেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৪৭০ হাজার জন। তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৮ হাজার ৩৬০ বাংলাদেশি নাগরিককে মেডিকেল ভিসা দিয়েছে ভারত। তবে পর্যটন ভিসায় ভারতে যাওয়া বাংলাদেশিদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য থাকে চিকিৎসা নেয়া। ভারতে মেডিকেল ভিসা গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশের পরই রয়েছে আফগানিস্তান। অর্থবছরটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ১ লাখ ৪১ হাজার ২৮৭টি মেডিকেল ভিসা দিয়েছে ভারত। যেসব রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই অর্থোপেডিকস, কার্ডিওলজি ও নিউরো সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা। উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতে যত সময় লাগে, ভারতে যেতে তার চেয়ে কম সময় লাগে। এছাড়া আমাদের কিছু ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি চিকিৎসকদের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে রোগীবান্ধব নয়। রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই মূলত বেশি সংখ্যক রোগী দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে টুরিস্ট ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা করান মানুষ। ওখানেও ভুল চিকিৎসা হয় না, এমন নয়। বাংলাদেশে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটি রেগুলেটরি সিস্টেম না থাকাকে দায়ী করেন তিনি।
বাংলাদেশী রোগীরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা তো অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি না। ফলে রোগীরা অপেক্ষা না করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান। এখানে রোগীদের জন্য এত বেশি বিনোদনের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, লোকসংখ্যা বাড়ছে, তার সঙ্গে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত রোগীরা বিদেশে চিকিৎসাসেবা নেয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যাদের সামর্থ্য আছে তারাই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এটা ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে দেখার কিছু নেই। দেশীয় চিকিৎসাসেবার প্রতি রোগীদের অনীহা কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা রোগীদের মনোজতাত্ত্বিক বিষয়। অনেকে ভ্রমণে যান এবং ব্যবসায়িক কাজে গিয়েও বিদেশ থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এই প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, অনেকগুলো কারণে মানুষে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। বিশেষ করে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট অর্থাৎ সীমান্তবর্তী এলাকার লোক সহজে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন। অনেক সময়ে মানুষ বিদেশে ঘুরতে গিয়েও চিকিৎসা করান। তাছাড়া কিছু কিছু চিকিৎসা যেমন-হার্টের, চোখের এবং ক্যানসারের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে ওখানে ভালো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। আমাদের দেশের করপোরেট হাসপাতালগুলোতে খরচ বেশি হওয়ায় মানুষ ভারতসহ অন্য দেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান। বিশাল জনসংখ্যার চাপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ যেখানে সন্তুষ্ট হন সেখানেই মুভ করেন। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কিছু কিছু চিকিৎসকের আচরণেও ঝামেলা আছে। বিষয়টি তাদের একটু বিবেচনায় নিতে হবে।
বেশ ক’বছর ধরে বাংলাদেশি রোগীদের বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, চালানোর দক্ষ টেকনিশিয়ান নেই। দেশের সরকারি চিকিৎসা খাতে এ বেহাল চিত্র। অন্যদিকে বেসরকারি চিকিৎসাসেবাও আকর্ষণ করতে পারছে না রোগীদের। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বিশেষ করে ডাক্তার, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি আরোপ হয়নি। ফলে অসম বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে বেসরকারি খাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চিকিৎসার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোগী সুচিকিৎসার খোঁজে বিদেশে যাচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতে রোগীপ্রতি গড়ে দেড় লাখ টাকা খরচ হলে বিদেশে চিকিৎসা বাবদ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। রোগীর সঙ্গে স্বজনদের খরচ হিসাব করলে এ খরচের সঙ্গে যোগ হবে আরো প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ভারত ছাড়া সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও অন্যান্য দেশেও চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিরা নিয়মিত যাচ্ছেন।
প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার নামে লাখ লাখ রোগী পাঠানো হচ্ছে। চিকিৎসা বাবদ দেশ থেকে প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যায় বলে একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন প্রয়াত বিশিষ্ট চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। ধারণা করা হচ্ছে, দেশব্যাপী তিন শতাধিক এ রকম এজেন্ট রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার রোগী বিদেশে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ভারতেই যাচ্ছেন গড়ে প্রতি মাসে ১৫ হাজার রোগী। বাকিরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যাচ্ছেন বলে এজেন্ট প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন। এসব এজেন্ট প্রতিনিধি ভিসা প্রসেস ও সংশ্লিষ্ট দেশের ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর জন্য ব্যবস্থা নেন। এজন্য তারা প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে তিন হাজার টাকা ফি নেন। এ প্রক্রিয়া ছাড়াও সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ প্রশাসনের বড় বড় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিরা অনেক সময়ে বিদেশে ভ্রমণ করার সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন।
রাজধানীর ধানমন্ডির এমন একটি প্রতিষ্ঠান ইনটেক্স কেয়ার (গ্লোবাল ট্রেড লিংক)। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা ভারতের বিখ্যাত হাসপাতালসমূহে হার্ট, ক্যানসার, কিডনি চিকিৎসা, লিভার চিকিৎসা, বাইপাস সার্জারি, হাঁটুর অপারেশন, বনমেরু ট্রান্সপ্লান্টসহ সব ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা করানোর কাজ করেন। এছাড়া তারা মেডিকেল ভিসা সহায়তা ও এয়ার অ্যামু্বলেন্সের ব্যবস্থা করান বলে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে উচ্চবিত্ত শ্রেণির রোগী এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক দেখার কিছু নেই। তারা আরো বলেন, দেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে। অভিযোগ আছে অতিরিক্ত ব্যয়েরও। অন্যদিকে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসাপ্রাপ্তিও সহজ করেছে দেশটি। এসব কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্যসেবা রপ্তানি নিয়ে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব কমার্শিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস (ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এটি চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশ করা হয়। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতে চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারী বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশি। অর্থবছরটিতে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিয়েছে মোট প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার জন বিদেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৪৭০ হাজার জন। তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৮ হাজার ৩৬০ বাংলাদেশি নাগরিককে মেডিকেল ভিসা দিয়েছে ভারত। তবে পর্যটন ভিসায় ভারতে যাওয়া বাংলাদেশিদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য থাকে চিকিৎসা নেয়া। ভারতে মেডিকেল ভিসা গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশের পরই রয়েছে আফগানিস্তান। অর্থবছরটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ১ লাখ ৪১ হাজার ২৮৭টি মেডিকেল ভিসা দিয়েছে ভারত। যেসব রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই অর্থোপেডিকস, কার্ডিওলজি ও নিউরো সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা। উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতে যত সময় লাগে, ভারতে যেতে তার চেয়ে কম সময় লাগে। এছাড়া আমাদের কিছু ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি চিকিৎসকদের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে রোগীবান্ধব নয়। রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই মূলত বেশি সংখ্যক রোগী দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে টুরিস্ট ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা করান মানুষ। ওখানেও ভুল চিকিৎসা হয় না, এমন নয়। বাংলাদেশে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটি রেগুলেটরি সিস্টেম না থাকাকে দায়ী করেন তিনি।
বাংলাদেশী রোগীরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা তো অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি না। ফলে রোগীরা অপেক্ষা না করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান। এখানে রোগীদের জন্য এত বেশি বিনোদনের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, লোকসংখ্যা বাড়ছে, তার সঙ্গে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত রোগীরা বিদেশে চিকিৎসাসেবা নেয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যাদের সামর্থ্য আছে তারাই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এটা ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে দেখার কিছু নেই। দেশীয় চিকিৎসাসেবার প্রতি রোগীদের অনীহা কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা রোগীদের মনোজতাত্ত্বিক বিষয়। অনেকে ভ্রমণে যান এবং ব্যবসায়িক কাজে গিয়েও বিদেশ থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এই প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, অনেকগুলো কারণে মানুষে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। বিশেষ করে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট অর্থাৎ সীমান্তবর্তী এলাকার লোক সহজে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন। অনেক সময়ে মানুষ বিদেশে ঘুরতে গিয়েও চিকিৎসা করান। তাছাড়া কিছু কিছু চিকিৎসা যেমন-হার্টের, চোখের এবং ক্যানসারের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে ওখানে ভালো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। আমাদের দেশের করপোরেট হাসপাতালগুলোতে খরচ বেশি হওয়ায় মানুষ ভারতসহ অন্য দেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান। বিশাল জনসংখ্যার চাপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ যেখানে সন্তুষ্ট হন সেখানেই মুভ করেন। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কিছু কিছু চিকিৎসকের আচরণেও ঝামেলা আছে। বিষয়টি তাদের একটু বিবেচনায় নিতে হবে।
No comments