গর্ব ও গ্লানির সংমিশ্রণ by বদিউর রহমান
ড.
ইউনূস একজন বিশ্ববরেণ্য সম্মানিত ব্যক্তি। তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। আমাদেরও
একজন নোবেল বিজয়ী আছেন, তাও আবার শান্তিতে- এটা আমাদের বুকের ছাতিকে বেশ
ফুলিয়ে দেয়। তার নোবেল বিজয়ের সময়ে আমি চাকরিতে ছিলাম। শান্তিতে
নোবেল তাকে কেন দেয়া হল, তার ব্যাখ্যা নোবেল কমিটিই ভালো বুঝেছেন।
অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে শান্তি অর্জন বা শান্তিকে মজবুত করা যায়- এমন
যুক্তি উড়িয়ে দেয়া যায় না। অতএব গ্রামীণ ব্যাংকও শান্তিতে নোবেল বিজয়ের
অংশীদার। তখন আমার মতো বেকুবের মনে হয়েছে, ওই বছর অর্থনীতিতে যাকে নোবেল
দেয়া হয়েছে, ড. ইউনূসকে অর্থনীতিতে দিতে গেলে তিনি হয়তো বাদ পড়ে যেতে
পারেন। অতএব দুকূলই রক্ষে, টেনেটুনে অর্থনৈতিক মুক্তিতে শান্তি বেশি মজবুত-
এমন যুক্তিতে ড. ইউনূসকে শান্তিতে একোমোডেট করে নিল নোবেল কমিটি। ঘটে
বুদ্ধি থাকলে, হাতে ক্ষমতা থাকলে, সুপারিশকারীর ‘হ্যাডম’ থাকলে কী না করা
যায়! আমরা খুশি, আমরা আনন্দিত। বঙ্গভবনে তাকে দেয়া সংবর্ধনায় তার
মুরব্বিসুলভ চমৎকার উচ্চারণ- আপনি সবার কথা শুনবেন, আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন
নিজ বিবেচনায় ধরনের কথাগুলো (যদিও আমার হুবহু মনে নেই) আমাদের আন্দোলিত
করেছে, চমৎকৃত করেছে।
তিনি যখন খুব বলিষ্ঠ আওয়াজে আমাদের আশাবাদী করেন, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে মানুষ, যখন বলেন দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেবেন, তখন আমাদের রক্তে শিহরণ জাগে। ভাবতে আনন্দ লাগে, আমরাও পারব, আমাদের প্রজন্ম না হোক পরবর্তী প্রজন্ম তো হতেই পারে। হ্যাঁ, এটা সম্ভব। ইতিমধ্যে আমাদের আয় অনেক বেড়েছে, মধ্য আয়ের দেশে যাই-যাই বলে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড করেছে; গড় আয়ুও বেড়েছে। আর বলা সমীচীন নয়। অনেক পাঠক ভাবতে পারেন, আমি বুঝি বিলবোর্ডীয় প্রচারে চলে গেলাম। কিন্তু উন্নতি যে হয়েছে তা অস্বীকার করব কীভাবে? এই ষাটের দশকেও গ্রামে ভাতের ফ্যান (মাড়) নেয়ার গরিব মানুষ ছিল, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে ভিক্ষা করতে আসার পুরুষ-মহিলা ছিল, মহিলা বেশি ছিল, প্রচুর কৃষি শ্রমিক ছিল। এখন তো এসব আর চোখে পড়ে না। গ্রামে গ্রামে পাকা রাস্তা, দালান, নিদেনপক্ষে টিনের ঘর। ছনের ছাউনির কুঁড়েঘর আর তেমন চোখে পড়ে না। তহবন্দ (লুঙ্গি) মাথার উপর উঠিয়ে খাল-নদী তো আর পার হতে হয় না, মানুষ এখন চলে গাড়িতে। গ্রামের গরিব মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে অনেক সমালোচনা, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি কাজ দিয়েছে। নারীদের স্বাবলম্বী করাতে চড়া সুদে হলেও গ্রামীণ ব্যাংকের জামানতবিহীন ঋণ সহায়ক হয়েছে। অবশ্যই আমরা ড. ইউনূসকে বড় মানুষ ভাবি। বাড়ির গরু ঘাটার (আঙিনার) ঘাস খায় না, আমরা দেশে তাকে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যায়ন করি, বিদেশে তার কদর অনেক বেশি। তা এমনি এমনি তো হয়নি, তার যোগ্যতা অবশ্যই আছে। প্রেসিডেন্ট, রানীদের ‘পটিয়ে’ যদি সব করে থাকেন, তবু বলব, সেটাও একটা যোগ্যতা। পারলে আপনিও করুন না, আরেকটা নোবেল নিয়ে আসুন দেখি। গায়ে পড়ে তাকে ‘ছোট’ করার চেষ্টায় আপনিই ছোট হলেন, তার কিছু হয়নি। ডজনে ডজনে সম্মানসূচক ডক্টরেট না হয় আনা যায়, কিন্তু নোবেল কি এখনও তেমন সহজপ্রাপ্য কিংবা বেচাকেনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে? অবশ্যই নয়। অতএব আমরা ড. ইউনূসকে সম্মান করি, সম্মান করব। তিনি অন্তত সবার সঙ্গে ফটো তুলতে দ্বিধা করেন না, নিজের কনিষ্ঠ সহকর্মীদের ছেলেমেয়ের বিয়েতে হাজির হতে বিরত থাকেন না, গ্রামের বাড়িতে হলেও যান দেখি। তখন তার সঙ্গে একটা ছবি রাখার জন্য যত চাহিদা থাকে, তিনি দেখলাম তাও পূরণ করেন। এটা কি একটা বড় গুণ নয়?
কিন্তু তার কিছু কাজ আমার ভালো লাগে না। হতেই পারে সবাইকে সবার সমানভাবে ভালো লাগবে না, লাগার কথাও নয়। কর নিয়ে তাকে অসম্মানের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমি সরাসরি সম্প্র্রচারেও বলিষ্ঠ ও দৃঢ়ভাবে বলেছি। কিন্তু নোবেল জয়ের প্রাপ্ত অর্থের করমুক্তি নিয়ে তার যে আকুলতা কিংবা ব্যাকুলতা কিংবা অস্থিরতা আমি লক্ষ্য করেছি, তা আমার কাছে বড় বেমানান ঠেকেছে। সে অবস্থায় এক সহকর্মীকে বলেছিলাম, আমি নোবেল পেলে এমনটি করতাম না, প্রযোজ্য না হলেও কর দেয়ার সুযোগ নিতাম। আমার ধারণা ছিল, যারা নোবেল বিজয়ী হোন তাদের মনও বিরাট, তাদের হৃদয় থাকে বিশাল, তাদের ত্যাগের বা দেয়ার মানসিকতা থাকে সবার উপরে। কিন্তু ড. ইউনূসের তখনকার হাবভাব আমাকে পীড়িত করেছে, হতাশ করেছে, আমার ধারণা বদলে দিয়েছে।
আমি মাঝে মধ্যে বলি, টিভি অনুষ্ঠানেও বলেছি, আমার শেষ পদায়নটা আমাকে বেশ পরিচিতি দিয়েছে, বলা চলে অনেক মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাও দিয়েছে, যার ফল আল্লাহর মেহেরবানিতে এখনও ভোগ করে চলেছি। কিন্তু সেই পদায়ন আমার কাছে অনেক অনেক নুরানি চেহারায় মানুষের ভেতরের দুর্গন্ধযুক্ত কর্দযকে খোলাসা করে দিয়েছে। এ মানুষগুলোই কি আমার নমস্য ছিলেন? কর না দেয়াতে তাদের এ কী আচরণ! যাক, হতেই পারে, টাকার ব্যাপার তো, কেয়ামত পর্যন্ত কেবল টাকা আর টাকা চাই। এ টাকা দিয়েই তো মন্ত্রী-এমপি সব হওয়া যায়, নয় কি? অনেক বড় সাহেব আজও আমার ওপর বেশ অসন্তুষ্ট। কিন্তু এ আমার ধারণা ছিল না, বিশ্বাস ছিল না।
ড. ইউনূসকে নিয়ে বা বলা চলে তার সঙ্গে সরকারের, আমার মতে, অযাচিত বা গায়ে পড়ে ঝগড়ার বিষয় নিয়ে, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর ‘সুদখোর’, ‘রক্তচোষা’ ধরনের বক্তব্য নিয়ে আমি এর আগে দু’বার লিখেছি। ভেবেছিলাম, তাকে নিয়ে আমাকে আর লিখতে হবে না। কিন্তু এখন দেখি ড. ইউনূস তাকে নিয়ে আরও লেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। সম্প্রতি ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার ‘হাত ভেঙে দেয়ার’ হুমকি বড় দুঃখজনক। তার মুখে এমনতরো মারদাঙ্গা আওয়াজ, আহ্বান, কিংবা হুমকি বড়ই দুঃখজনক। কারও হাত ভাঙা অত সহজ নয়। আক্ষরিক অর্থে তা না নিয়ে আমরা তা রূপক অর্থে বা আলংকারিক অর্থে নিলেও বুঝে নিতে পারি যে, তিনি সরকারকেই বিপক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন। অবশ্যই আমরা অস্বীকার করি না, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব যেভাবে ড. ইউনূসকে অশোভন শব্দে আক্রমণ করেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আইনি লড়াইয়ে ড. ইউনূসের পরাজয়ের পরও তা অব্যাহত রেখেছেন, তা অপ্রত্যাশিত ও বেমানান। কিন্তু তাই বলে ড. ইউনূস তো আর তার সম্মান ক্ষুণ্নকারী শব্দ ব্যবহার করতে পারেন না। তিনি কিভাবে বলেন, হাত ভেঙে দেয়া হবে? অর্থমন্ত্রী যদি তার এ বক্তব্যকে সন্ত্রাসী বক্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেন, আমরা তাতে বিস্মিত হব না। ড. ইউনূসের এমনতরো বক্তব্য তার সাহসের পরিচয় বহন করে না, তার হীনমন্যতাকেই প্রকাশ করে। তিনি কি বোঝেন না যে, ক্ষমতার পালাবদল হলে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়েও পালাবদল হতে পারে। ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় গেলে গ্রামীণ ব্যাংককে পূর্বাবস্থায় নেয়ার আশ্বাস বাজাদ দিয়ে আসছে। বাজাদের (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) লক্ষ্য হচ্ছে ড. ইউনূসকে তুষ্ট করা, তার সমর্থন আদায় করা, তাকে পক্ষে পাওয়া। আলীর সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্কের পতনের সুযোগ নিতে গিয়ে ভোটের রাজনীতিতে ইউনূসের সমর্থন এখন বাজাদের জন্য বেশি প্রয়োজন। ইউনূসের রাজনৈতিক দল নেই, সে হিসেবে ভোটার নেই। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য অনেক, তারা তার সমর্থনে বাজাদের ভোটব্যাংক হতে পারে। এটাই বাজাদের রাজনীতি। তাছাড়া ড. ইউনূসকে খুশি রাখতে পারলে কিন্তু বিদেশী, বিশেষত আমেরিকার সমর্থনও সহায়ক হতে পারে মর্মে বাজাদ ভেবে থাকতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ আশায় গুড়েবালি। আমাদের মর্জিনা বেগমরা অতি ধুরন্ধর, অতীব কৌশলী, নিজ স্বার্থের বাইরে তাদের কোনো নীতি নেই। অতএব বাজাদের ইউনূস-তোষণ নীতিতে বিদেশী সমর্থন বড় বেশি ফলদায়ক হবে বলে মনে হয় না।
ড. ইউনূস সেনা-নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়ক আমলে খোলা চিঠি দিয়ে রাজনীতিতে আসতে চেয়েছিলেন। তাকে তখন অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ভালো চোখে দেখেনি। দুর্জনরা সমালোচনা করে থাকেন যে, শেখ হাসিনার ড. ইউনূসের প্রতি অসন্তোষের এটাও একটা বড় কারণ। এমনকি শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরও শান্তিতে নোবেল পাননি, অথচ ইউনূস পেয়ে গেলেন- এতেও নাকি শেখ হাসিনার একটা ক্ষোভ রয়েছে। তবে ড. ইউনূসের চেয়ে শেখ হাসিনার ডক্টরেট কিছু কম নয় বোধ হয়। গত মেয়াদে শেখ হাসিনা অনেক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। যাক, খোলা চিঠি বন্ধ করে দিয়ে ড. ইউনূস তার নিজ ঘরে ফিরে গিয়েছেন। গত তত্ত্বাবধায়কের কলকাঠি নাড়ানোর অভিযোগও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, তখনও ইউনূসের একটা প্রভাব ছিল। বাজাদ বা বেগম খালেদা সরকারের সঙ্গে তার সখ্য বা অপ্রকাশিত দহরম-মহরম হয়তো অজানাও নয়। হালে ড. ইউনূসের রাজনৈতিক বক্তব্য বড় বেশি প্রকাশ্য। রাজনীতি না করেও তিনি সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন মানবেন না বলে যে ধমক উচ্চারণ করেছেন, তা শেখ হাসিনার ‘একচুলও নড়ব না’ থেকে কম ওজনের নয়। আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে হাসিনা সরকার এবং হাসিনা নিজেও যে আচরণ প্রকাশ্যে করছেন, ইউনূসও এখন সরাসরি তার প্রতিশোধে নেমেছেন। তার রাজনৈতিক বক্তব্য এবং হাত ভেঙে দেয়ার ঘোষণায় তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে, এ দেশের গর্ব হিসেবে, একজন উঁচু পর্যায়ের নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস রাজনীতি নিয়েও অবশ্যই তার মত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তার সম্মানের অবস্থান থেকে অবশ্যই তার আরও রুচিশীল হওয়া সমীচীন। তিনি যদি কোনো কোনো মন্ত্রীর মতো হাত ভাঙার কথা বলেন, তিনি যদি খালেদা জিয়ার মতো নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণার সুরে নির্বাচন না মানার হুমকি দেন, তাহলে তো আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, তিনিও রাজনীতিতে দলকানা হয়ে পড়েছেন। তার হালের কর্মকাণ্ড থেকে এমন ধারণা যদি আমজনতা করেই ফেলে, ড. ইউনূস দেশেও একটা কিছু হতে চাচ্ছেন, তাহলে বোধ হয় আমাদের দোষ দেয়া যাবে না। হয়তোবা নেপথ্যে থেকে তিনি রাজনীতির একজন গডফাদার হতে চাচ্ছেন। আমরা আশা করব, তিনি আর আড়ালে না থেকে বাজাদে যোগ দেবেন অথবা তার অবস্থান পরিষ্কার করবেন।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
তিনি যখন খুব বলিষ্ঠ আওয়াজে আমাদের আশাবাদী করেন, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে মানুষ, যখন বলেন দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেবেন, তখন আমাদের রক্তে শিহরণ জাগে। ভাবতে আনন্দ লাগে, আমরাও পারব, আমাদের প্রজন্ম না হোক পরবর্তী প্রজন্ম তো হতেই পারে। হ্যাঁ, এটা সম্ভব। ইতিমধ্যে আমাদের আয় অনেক বেড়েছে, মধ্য আয়ের দেশে যাই-যাই বলে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড করেছে; গড় আয়ুও বেড়েছে। আর বলা সমীচীন নয়। অনেক পাঠক ভাবতে পারেন, আমি বুঝি বিলবোর্ডীয় প্রচারে চলে গেলাম। কিন্তু উন্নতি যে হয়েছে তা অস্বীকার করব কীভাবে? এই ষাটের দশকেও গ্রামে ভাতের ফ্যান (মাড়) নেয়ার গরিব মানুষ ছিল, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে ভিক্ষা করতে আসার পুরুষ-মহিলা ছিল, মহিলা বেশি ছিল, প্রচুর কৃষি শ্রমিক ছিল। এখন তো এসব আর চোখে পড়ে না। গ্রামে গ্রামে পাকা রাস্তা, দালান, নিদেনপক্ষে টিনের ঘর। ছনের ছাউনির কুঁড়েঘর আর তেমন চোখে পড়ে না। তহবন্দ (লুঙ্গি) মাথার উপর উঠিয়ে খাল-নদী তো আর পার হতে হয় না, মানুষ এখন চলে গাড়িতে। গ্রামের গরিব মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে অনেক সমালোচনা, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি কাজ দিয়েছে। নারীদের স্বাবলম্বী করাতে চড়া সুদে হলেও গ্রামীণ ব্যাংকের জামানতবিহীন ঋণ সহায়ক হয়েছে। অবশ্যই আমরা ড. ইউনূসকে বড় মানুষ ভাবি। বাড়ির গরু ঘাটার (আঙিনার) ঘাস খায় না, আমরা দেশে তাকে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যায়ন করি, বিদেশে তার কদর অনেক বেশি। তা এমনি এমনি তো হয়নি, তার যোগ্যতা অবশ্যই আছে। প্রেসিডেন্ট, রানীদের ‘পটিয়ে’ যদি সব করে থাকেন, তবু বলব, সেটাও একটা যোগ্যতা। পারলে আপনিও করুন না, আরেকটা নোবেল নিয়ে আসুন দেখি। গায়ে পড়ে তাকে ‘ছোট’ করার চেষ্টায় আপনিই ছোট হলেন, তার কিছু হয়নি। ডজনে ডজনে সম্মানসূচক ডক্টরেট না হয় আনা যায়, কিন্তু নোবেল কি এখনও তেমন সহজপ্রাপ্য কিংবা বেচাকেনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে? অবশ্যই নয়। অতএব আমরা ড. ইউনূসকে সম্মান করি, সম্মান করব। তিনি অন্তত সবার সঙ্গে ফটো তুলতে দ্বিধা করেন না, নিজের কনিষ্ঠ সহকর্মীদের ছেলেমেয়ের বিয়েতে হাজির হতে বিরত থাকেন না, গ্রামের বাড়িতে হলেও যান দেখি। তখন তার সঙ্গে একটা ছবি রাখার জন্য যত চাহিদা থাকে, তিনি দেখলাম তাও পূরণ করেন। এটা কি একটা বড় গুণ নয়?
কিন্তু তার কিছু কাজ আমার ভালো লাগে না। হতেই পারে সবাইকে সবার সমানভাবে ভালো লাগবে না, লাগার কথাও নয়। কর নিয়ে তাকে অসম্মানের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমি সরাসরি সম্প্র্রচারেও বলিষ্ঠ ও দৃঢ়ভাবে বলেছি। কিন্তু নোবেল জয়ের প্রাপ্ত অর্থের করমুক্তি নিয়ে তার যে আকুলতা কিংবা ব্যাকুলতা কিংবা অস্থিরতা আমি লক্ষ্য করেছি, তা আমার কাছে বড় বেমানান ঠেকেছে। সে অবস্থায় এক সহকর্মীকে বলেছিলাম, আমি নোবেল পেলে এমনটি করতাম না, প্রযোজ্য না হলেও কর দেয়ার সুযোগ নিতাম। আমার ধারণা ছিল, যারা নোবেল বিজয়ী হোন তাদের মনও বিরাট, তাদের হৃদয় থাকে বিশাল, তাদের ত্যাগের বা দেয়ার মানসিকতা থাকে সবার উপরে। কিন্তু ড. ইউনূসের তখনকার হাবভাব আমাকে পীড়িত করেছে, হতাশ করেছে, আমার ধারণা বদলে দিয়েছে।
আমি মাঝে মধ্যে বলি, টিভি অনুষ্ঠানেও বলেছি, আমার শেষ পদায়নটা আমাকে বেশ পরিচিতি দিয়েছে, বলা চলে অনেক মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাও দিয়েছে, যার ফল আল্লাহর মেহেরবানিতে এখনও ভোগ করে চলেছি। কিন্তু সেই পদায়ন আমার কাছে অনেক অনেক নুরানি চেহারায় মানুষের ভেতরের দুর্গন্ধযুক্ত কর্দযকে খোলাসা করে দিয়েছে। এ মানুষগুলোই কি আমার নমস্য ছিলেন? কর না দেয়াতে তাদের এ কী আচরণ! যাক, হতেই পারে, টাকার ব্যাপার তো, কেয়ামত পর্যন্ত কেবল টাকা আর টাকা চাই। এ টাকা দিয়েই তো মন্ত্রী-এমপি সব হওয়া যায়, নয় কি? অনেক বড় সাহেব আজও আমার ওপর বেশ অসন্তুষ্ট। কিন্তু এ আমার ধারণা ছিল না, বিশ্বাস ছিল না।
ড. ইউনূসকে নিয়ে বা বলা চলে তার সঙ্গে সরকারের, আমার মতে, অযাচিত বা গায়ে পড়ে ঝগড়ার বিষয় নিয়ে, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর ‘সুদখোর’, ‘রক্তচোষা’ ধরনের বক্তব্য নিয়ে আমি এর আগে দু’বার লিখেছি। ভেবেছিলাম, তাকে নিয়ে আমাকে আর লিখতে হবে না। কিন্তু এখন দেখি ড. ইউনূস তাকে নিয়ে আরও লেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। সম্প্রতি ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার ‘হাত ভেঙে দেয়ার’ হুমকি বড় দুঃখজনক। তার মুখে এমনতরো মারদাঙ্গা আওয়াজ, আহ্বান, কিংবা হুমকি বড়ই দুঃখজনক। কারও হাত ভাঙা অত সহজ নয়। আক্ষরিক অর্থে তা না নিয়ে আমরা তা রূপক অর্থে বা আলংকারিক অর্থে নিলেও বুঝে নিতে পারি যে, তিনি সরকারকেই বিপক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন। অবশ্যই আমরা অস্বীকার করি না, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব যেভাবে ড. ইউনূসকে অশোভন শব্দে আক্রমণ করেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আইনি লড়াইয়ে ড. ইউনূসের পরাজয়ের পরও তা অব্যাহত রেখেছেন, তা অপ্রত্যাশিত ও বেমানান। কিন্তু তাই বলে ড. ইউনূস তো আর তার সম্মান ক্ষুণ্নকারী শব্দ ব্যবহার করতে পারেন না। তিনি কিভাবে বলেন, হাত ভেঙে দেয়া হবে? অর্থমন্ত্রী যদি তার এ বক্তব্যকে সন্ত্রাসী বক্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেন, আমরা তাতে বিস্মিত হব না। ড. ইউনূসের এমনতরো বক্তব্য তার সাহসের পরিচয় বহন করে না, তার হীনমন্যতাকেই প্রকাশ করে। তিনি কি বোঝেন না যে, ক্ষমতার পালাবদল হলে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়েও পালাবদল হতে পারে। ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় গেলে গ্রামীণ ব্যাংককে পূর্বাবস্থায় নেয়ার আশ্বাস বাজাদ দিয়ে আসছে। বাজাদের (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) লক্ষ্য হচ্ছে ড. ইউনূসকে তুষ্ট করা, তার সমর্থন আদায় করা, তাকে পক্ষে পাওয়া। আলীর সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্কের পতনের সুযোগ নিতে গিয়ে ভোটের রাজনীতিতে ইউনূসের সমর্থন এখন বাজাদের জন্য বেশি প্রয়োজন। ইউনূসের রাজনৈতিক দল নেই, সে হিসেবে ভোটার নেই। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য অনেক, তারা তার সমর্থনে বাজাদের ভোটব্যাংক হতে পারে। এটাই বাজাদের রাজনীতি। তাছাড়া ড. ইউনূসকে খুশি রাখতে পারলে কিন্তু বিদেশী, বিশেষত আমেরিকার সমর্থনও সহায়ক হতে পারে মর্মে বাজাদ ভেবে থাকতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ আশায় গুড়েবালি। আমাদের মর্জিনা বেগমরা অতি ধুরন্ধর, অতীব কৌশলী, নিজ স্বার্থের বাইরে তাদের কোনো নীতি নেই। অতএব বাজাদের ইউনূস-তোষণ নীতিতে বিদেশী সমর্থন বড় বেশি ফলদায়ক হবে বলে মনে হয় না।
ড. ইউনূস সেনা-নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়ক আমলে খোলা চিঠি দিয়ে রাজনীতিতে আসতে চেয়েছিলেন। তাকে তখন অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ভালো চোখে দেখেনি। দুর্জনরা সমালোচনা করে থাকেন যে, শেখ হাসিনার ড. ইউনূসের প্রতি অসন্তোষের এটাও একটা বড় কারণ। এমনকি শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরও শান্তিতে নোবেল পাননি, অথচ ইউনূস পেয়ে গেলেন- এতেও নাকি শেখ হাসিনার একটা ক্ষোভ রয়েছে। তবে ড. ইউনূসের চেয়ে শেখ হাসিনার ডক্টরেট কিছু কম নয় বোধ হয়। গত মেয়াদে শেখ হাসিনা অনেক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। যাক, খোলা চিঠি বন্ধ করে দিয়ে ড. ইউনূস তার নিজ ঘরে ফিরে গিয়েছেন। গত তত্ত্বাবধায়কের কলকাঠি নাড়ানোর অভিযোগও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, তখনও ইউনূসের একটা প্রভাব ছিল। বাজাদ বা বেগম খালেদা সরকারের সঙ্গে তার সখ্য বা অপ্রকাশিত দহরম-মহরম হয়তো অজানাও নয়। হালে ড. ইউনূসের রাজনৈতিক বক্তব্য বড় বেশি প্রকাশ্য। রাজনীতি না করেও তিনি সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন মানবেন না বলে যে ধমক উচ্চারণ করেছেন, তা শেখ হাসিনার ‘একচুলও নড়ব না’ থেকে কম ওজনের নয়। আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে হাসিনা সরকার এবং হাসিনা নিজেও যে আচরণ প্রকাশ্যে করছেন, ইউনূসও এখন সরাসরি তার প্রতিশোধে নেমেছেন। তার রাজনৈতিক বক্তব্য এবং হাত ভেঙে দেয়ার ঘোষণায় তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে, এ দেশের গর্ব হিসেবে, একজন উঁচু পর্যায়ের নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস রাজনীতি নিয়েও অবশ্যই তার মত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তার সম্মানের অবস্থান থেকে অবশ্যই তার আরও রুচিশীল হওয়া সমীচীন। তিনি যদি কোনো কোনো মন্ত্রীর মতো হাত ভাঙার কথা বলেন, তিনি যদি খালেদা জিয়ার মতো নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণার সুরে নির্বাচন না মানার হুমকি দেন, তাহলে তো আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, তিনিও রাজনীতিতে দলকানা হয়ে পড়েছেন। তার হালের কর্মকাণ্ড থেকে এমন ধারণা যদি আমজনতা করেই ফেলে, ড. ইউনূস দেশেও একটা কিছু হতে চাচ্ছেন, তাহলে বোধ হয় আমাদের দোষ দেয়া যাবে না। হয়তোবা নেপথ্যে থেকে তিনি রাজনীতির একজন গডফাদার হতে চাচ্ছেন। আমরা আশা করব, তিনি আর আড়ালে না থেকে বাজাদে যোগ দেবেন অথবা তার অবস্থান পরিষ্কার করবেন।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments