রাজনীতি মানে সেবাধর্ম, ব্যবসা নয় by অরবিন্দ রায়
রাজনীতির
খেলা ব্যবসায়ীরা খেলতে গেলে তাদের অবস্থা হবে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র
মতো। শ্যামের বাঁশি শুনে দেয়াল টপকাতে না পারলে শ্যাম মনঃক্ষুণœ হবেন। আবার
বাইরে পা রাখলে কুলের মুখে চুনকালি পড়বে। অর্থাৎ একই সঙ্গে শ্যাম ও কুল
রক্ষা করে চলা সম্ভব নয়। এ নিয়ম যেমন রাধার বেলায় প্রযোজ্য, অন্যের বেলাতেও
তাই। কাজেই একজন ব্যবসায়ী রাজনীতির খাতায় নাম লেখালে তাকে হয় নিজ ব্যবসা,
নয়তো দেশসেবা- এ দুয়ের যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। একই সময়ে দেশের কাজ ও
ব্যবসার কাজ দেখভাল করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। রাধা যেমন কুল বিনাশ
করেই শ্যামের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, সে রকম কোনো ব্যবসায়ী দেশ ও সমাজসেবা
করতে চাইলে নিজ ব্যবসার লালবাতি জ্বালিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু মজার বিষয়
হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব ব্যবসায়ী নিজের আসন পোক্ত করেছেন, তারা
ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতি করলেও তাদের কারও ব্যবসাই লাটে ওঠার খবর
অদ্যাবধি শোনা যায়নি। বরং হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। অর্থাৎ এ ধরনের ব্যবসায়ীর
অধিকাংশই ব্যবসা ও রাজনীতিকে একই ঠোঙায় বাজারজাত করে নিজ অবস্থাকে সুদৃঢ়
পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় না যে, এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী
কাম-রাজনীতিকরা দেশ ও সমাজসেবার নাম ভাঙিয়ে যা করছেন তা কেবলই নিজস্ব
ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়? অথচ শুরুতে তারা দেশ ও সমাজসেবার দৃঢ়
মনোবৃত্তি নিয়েই রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু কাল পরিক্রমায় তাদের সেই
সুমনোবৃত্তি কখন যে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে রূপ নিয়েছে তা হয়তো নিজেরাও
বুঝে উঠতে পারেননি। আর এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে। কারণ, এ ধরনের
দেশসেবকের ভেকধারীদের হাতে দেশ সেবার ভার চলে যাচ্ছে বলেই দেশ ও সমাজ আজ
গভীর থেকে গভীরতর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
রাজনীতির মাঠ চষানো ব্যবসায়ীরা নিজেদের হয়তো দেশ ও সমাজসেবক হিসেবে দাবি তুলতে পারেন। তাদের এ দাবিকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়াও যায় না। তবে দেশসেবা যদি ঈদের আগে জাকাত হিসেবে এলাকার গরিব-দুস্থদের মধ্যে কম দামি শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ, পাপের ভার লাঘবে নিজ এলাকায় উপাসনালয় নির্মাণে অর্থ প্রদান; কিংবা এলাকার কোনো বেকার যুবককে নিজ প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরাও যে সমাজসেবা করছেন, এ দাবি তুলতেই পারেন। চাকরি প্রদানের বেলায় অবশ্য চাকরিদাতার পিএস, এপিএস, ড্রাইভার বা ড্রাইভারের শ্যালকরা যে চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করেনি- এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আবার শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের মধ্যেও কিছু একটা ‘কিন্তু’ না থেকে যায় না। কারণ এ ধরনের বিতরণ কর্মের জন্য প্রথমেই যে জিনিসের প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে টাকা। দ্বিতীয়টি মন। টাকা ও মনের ব্যাট-বল সংযোগের ফলেই দান-খয়রাতের উৎপত্তি। তবে দান গ্রহণকারীরা কি জানেন, তিনি যার দান গ্রহণ করছেন, সেই ব্যক্তিটি ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ টাকা লুট ও সরকারি সম্পদ হরিলুট করেছেন? জানেন বলে মনে হয় না। যদি জানতেন, তাহলে বস্ত্রের অভাবে গাছের ছাল পরা লাগলেও কোট-টাই পরা ভদ্র ডাকাতদের দেয়া এসব খয়রাতি বস্ত্র গ্রহণ করতেন না। আর এসব খয়রাত নিতে গিয়ে এ পর্যন্ত যত নিরীহ আদম পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, সেসব প্রাণের মূল্য কি দিতে পারবেন কথিত দানকারীরা? তারপরও দান নিয়ে ফেরার সময় অনেককেই বলতে শোনা যায়- কেবল টাকা থাকলেই হয় না রে! মন লাগে! বেচারার মন আছে! বিশাল দিল-দরিয়া মানুষ! কিন্তু দিল দরিয়ার সনদ প্রদানকারীরা জানেন কি, যারা লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করেন, তারা কখনোই দিল খোলসাভাবে দান করতে পারেন না। প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে তারা এসব দান-খয়রাত করেন কেন? মানুষের মনের কথা জানার মেশিন থাকলে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা যেত। তবে ধারণা করা অমূলক হবে না যে, এসব দান-খয়রাতধর্মী কর্মকাণ্ডকে অনেকেই আÍরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তিই তার অপকর্মের বিষয়ে শতভাগ ওয়াকিবহাল। ভবিষ্যতে কোনো আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে কোমরে রশি উঠলে যেন এ খয়রাত গ্রহণকারীরা তার মুক্তির দাবিতে থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারে, এটাই এসব দান-খয়রাতের আসল কারণ বলে মনে হয়। তাছাড়া সবার উপরে মানুষ সত্য বলে যেমন একটি কথা আছে, রাজনীতির মাঠে সবার উপরে যে জিনিসটি সত্য সেটি হচ্ছে ভোটের হিসাব। ভোটের মৌসুমে নমিনেশন কিনতে যে পরিমাণ টাকা লাগবে, তার কিছু আগাম খরচ করে যদি কিছু জনসমর্থন কিনে রাখা যায় তাহলে নমিনেশন প্রাপ্তির জন্য শোডাউনে কাজে লাগবে বলে মনে হয়। এসব আত্মকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে কখনও কি দেশ ও সমাজসেবা বলা যায়? শিকারের উদ্দেশ্যে খাবার ছিটিয়ে মাছ ডেকে আনাকে যেমন দাওয়াত বলে না, স্বার্থকেন্দ্রিক এসব অনুদান ছিটানোকেও দেশসেবা বলে না। তারপরও তাদের যদি দেশ সেবকের মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে তেলাপোকাকেও পাখির মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এসব মর্যাদাহীন দেশ সেবকরাই আজ রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দুর্ভাগ্য এ কারণেই বলা হচ্ছে, এ ধরনের ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে দেশ রক্ষার সুযোগ দেয়া আর শেয়ালের হাতে মুরগি বর্গা দেয়ার মধ্যে খুব একটা তফাৎ আছে বলে মনে হয় না।
রাজনীতিতে প্রবেশকারী ব্যবসায়ীদের দুটি শ্রেণী আছে। কেউ ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন, আবার কেউ রাজনীতিতে আসন পোক্ত হওয়ার পর ব্যবসায় নেমেছেন। তবে উভয় শ্রেণীর উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। উদ্দেশ্যটি হচ্ছে রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চাইলে সময় ও শ্রম দুটিই বেশি লাগে। তার জন্য চাই লিফট। এ লিফটিই হচ্ছে রাজনীতি নামের স্টিকার। যেহেতু এ দুই শ্রেণীর প্রত্যেকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আখের গোছানো। কাজেই ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিক বা রাজনীতিক কাম ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণীই যে দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দুই শ্রেণীর কাছ থেকে দেশসেবা আশা করা আর জন্মান্ধের কাছ থেকে চাঁদনি রাতের বিবরণ শোনার মধ্যে খুব একটা তফাৎ আছে বলে মনে হয় না। আতংকের বিষয় এটাই যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন রাজনৈতিক প্রভাব নামের ছোঁয়াচে রোগ শিং চাড়া দিয়ে উঠেছে। চায়না শপে উন্মত্ত ষাঁড় যেমন সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়, শিং চাড়া দিয়ে ওঠা এ রোগটিও আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের সব শৃংখলাকে তিল তিল করে ধ্বংস করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন সংঘবদ্ধ হায়েনা পর্যায়ে চলে গেছে। সেই সঙ্গে এসব কর্মকাণ্ড এখন মস্ত বাণিজ্যিক ধারায় রূপ নিয়েছে। যার প্রধান বিক্রয়যোগ্য পণ্যের নাম তদবির। ইদানীং তদবিরের পনের আনাই তদবিরের হিল্লায় গেছে বলে মনে হয়। এখন অনেকেই রাজনৈতিক অফিসকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো তদবির সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করেন। এখানে হাতলঅলা চেয়ারে বসা না বসা নিয়ে, বসতে বলা না বলা নিয়ে, সালাম দেয়া না দেয়া নিয়ে, সর্বোপরি চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও বচসার সৃষ্টি হয়। এ বচসাই একসময় ভয়ংকর গ্র“প পলিটিক্সে মোড় নিয়ে পুরো বিষয়টি লাশ পতনে গিয়ে ঠেকে। এসব উদ্ভট অনাচার সংগঠনের অগ্রগামী ভূমিকা পালনকারী হিসেবে একজন ব্যবসায়ীর রাজনীতির খাতায় ও একজন রাজনীতিকের ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখানোকে দায়ী করা হলে মনে হয় না তারা এ দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন। কেননা রাজনীতিকে পুঁজিহীন রমরমা ব্যবসার ধারায় নিয়ে আসার পেছনে ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিকের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়।
তবে যে যত কথাই বলুক, একজন ব্যবসায়ী কখনও নিজ ব্যবসার উন্নতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। এ নিয়ে কোনো তর্কেরও অবকাশ নেই। কাজেই ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতির ময়দান দাপিয়ে বেড়াবেন, তখন রাজনীতির ময়দান মুখোশধারী দেশপ্রেমিকে ভরে উঠবে। আর তাদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন ঠিক সেদিনই হবে, যেদিন মানুষের হাতের তালুতে পশম গজানো শুরু হবে। জানি না হাতের তালুতে পশম গজাবে কবে। তবে তার আগেই নীতিনির্ধারকদের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেন একজন ব্যবসায়ী জনপ্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হতে না পারেন। আবার যারা জনপ্রতিনিধি থেকে ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তাদেরও ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ দেশ ও দশের ভাগ্যকে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র মতো দ্বিধাগ্রস্তদের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হবে না। আইনি জটিলতায় যদি তা সম্ভব হয়ে না ওঠে, তাহলে তাদের বর্জনের ভার আমজনতাকেই নিতে হবে।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
রাজনীতির মাঠ চষানো ব্যবসায়ীরা নিজেদের হয়তো দেশ ও সমাজসেবক হিসেবে দাবি তুলতে পারেন। তাদের এ দাবিকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়াও যায় না। তবে দেশসেবা যদি ঈদের আগে জাকাত হিসেবে এলাকার গরিব-দুস্থদের মধ্যে কম দামি শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ, পাপের ভার লাঘবে নিজ এলাকায় উপাসনালয় নির্মাণে অর্থ প্রদান; কিংবা এলাকার কোনো বেকার যুবককে নিজ প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরাও যে সমাজসেবা করছেন, এ দাবি তুলতেই পারেন। চাকরি প্রদানের বেলায় অবশ্য চাকরিদাতার পিএস, এপিএস, ড্রাইভার বা ড্রাইভারের শ্যালকরা যে চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করেনি- এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আবার শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের মধ্যেও কিছু একটা ‘কিন্তু’ না থেকে যায় না। কারণ এ ধরনের বিতরণ কর্মের জন্য প্রথমেই যে জিনিসের প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে টাকা। দ্বিতীয়টি মন। টাকা ও মনের ব্যাট-বল সংযোগের ফলেই দান-খয়রাতের উৎপত্তি। তবে দান গ্রহণকারীরা কি জানেন, তিনি যার দান গ্রহণ করছেন, সেই ব্যক্তিটি ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ টাকা লুট ও সরকারি সম্পদ হরিলুট করেছেন? জানেন বলে মনে হয় না। যদি জানতেন, তাহলে বস্ত্রের অভাবে গাছের ছাল পরা লাগলেও কোট-টাই পরা ভদ্র ডাকাতদের দেয়া এসব খয়রাতি বস্ত্র গ্রহণ করতেন না। আর এসব খয়রাত নিতে গিয়ে এ পর্যন্ত যত নিরীহ আদম পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, সেসব প্রাণের মূল্য কি দিতে পারবেন কথিত দানকারীরা? তারপরও দান নিয়ে ফেরার সময় অনেককেই বলতে শোনা যায়- কেবল টাকা থাকলেই হয় না রে! মন লাগে! বেচারার মন আছে! বিশাল দিল-দরিয়া মানুষ! কিন্তু দিল দরিয়ার সনদ প্রদানকারীরা জানেন কি, যারা লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করেন, তারা কখনোই দিল খোলসাভাবে দান করতে পারেন না। প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে তারা এসব দান-খয়রাত করেন কেন? মানুষের মনের কথা জানার মেশিন থাকলে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা যেত। তবে ধারণা করা অমূলক হবে না যে, এসব দান-খয়রাতধর্মী কর্মকাণ্ডকে অনেকেই আÍরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তিই তার অপকর্মের বিষয়ে শতভাগ ওয়াকিবহাল। ভবিষ্যতে কোনো আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে কোমরে রশি উঠলে যেন এ খয়রাত গ্রহণকারীরা তার মুক্তির দাবিতে থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারে, এটাই এসব দান-খয়রাতের আসল কারণ বলে মনে হয়। তাছাড়া সবার উপরে মানুষ সত্য বলে যেমন একটি কথা আছে, রাজনীতির মাঠে সবার উপরে যে জিনিসটি সত্য সেটি হচ্ছে ভোটের হিসাব। ভোটের মৌসুমে নমিনেশন কিনতে যে পরিমাণ টাকা লাগবে, তার কিছু আগাম খরচ করে যদি কিছু জনসমর্থন কিনে রাখা যায় তাহলে নমিনেশন প্রাপ্তির জন্য শোডাউনে কাজে লাগবে বলে মনে হয়। এসব আত্মকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে কখনও কি দেশ ও সমাজসেবা বলা যায়? শিকারের উদ্দেশ্যে খাবার ছিটিয়ে মাছ ডেকে আনাকে যেমন দাওয়াত বলে না, স্বার্থকেন্দ্রিক এসব অনুদান ছিটানোকেও দেশসেবা বলে না। তারপরও তাদের যদি দেশ সেবকের মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে তেলাপোকাকেও পাখির মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এসব মর্যাদাহীন দেশ সেবকরাই আজ রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দুর্ভাগ্য এ কারণেই বলা হচ্ছে, এ ধরনের ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে দেশ রক্ষার সুযোগ দেয়া আর শেয়ালের হাতে মুরগি বর্গা দেয়ার মধ্যে খুব একটা তফাৎ আছে বলে মনে হয় না।
রাজনীতিতে প্রবেশকারী ব্যবসায়ীদের দুটি শ্রেণী আছে। কেউ ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন, আবার কেউ রাজনীতিতে আসন পোক্ত হওয়ার পর ব্যবসায় নেমেছেন। তবে উভয় শ্রেণীর উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। উদ্দেশ্যটি হচ্ছে রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চাইলে সময় ও শ্রম দুটিই বেশি লাগে। তার জন্য চাই লিফট। এ লিফটিই হচ্ছে রাজনীতি নামের স্টিকার। যেহেতু এ দুই শ্রেণীর প্রত্যেকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আখের গোছানো। কাজেই ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিক বা রাজনীতিক কাম ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণীই যে দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দুই শ্রেণীর কাছ থেকে দেশসেবা আশা করা আর জন্মান্ধের কাছ থেকে চাঁদনি রাতের বিবরণ শোনার মধ্যে খুব একটা তফাৎ আছে বলে মনে হয় না। আতংকের বিষয় এটাই যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন রাজনৈতিক প্রভাব নামের ছোঁয়াচে রোগ শিং চাড়া দিয়ে উঠেছে। চায়না শপে উন্মত্ত ষাঁড় যেমন সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়, শিং চাড়া দিয়ে ওঠা এ রোগটিও আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের সব শৃংখলাকে তিল তিল করে ধ্বংস করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন সংঘবদ্ধ হায়েনা পর্যায়ে চলে গেছে। সেই সঙ্গে এসব কর্মকাণ্ড এখন মস্ত বাণিজ্যিক ধারায় রূপ নিয়েছে। যার প্রধান বিক্রয়যোগ্য পণ্যের নাম তদবির। ইদানীং তদবিরের পনের আনাই তদবিরের হিল্লায় গেছে বলে মনে হয়। এখন অনেকেই রাজনৈতিক অফিসকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো তদবির সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করেন। এখানে হাতলঅলা চেয়ারে বসা না বসা নিয়ে, বসতে বলা না বলা নিয়ে, সালাম দেয়া না দেয়া নিয়ে, সর্বোপরি চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও বচসার সৃষ্টি হয়। এ বচসাই একসময় ভয়ংকর গ্র“প পলিটিক্সে মোড় নিয়ে পুরো বিষয়টি লাশ পতনে গিয়ে ঠেকে। এসব উদ্ভট অনাচার সংগঠনের অগ্রগামী ভূমিকা পালনকারী হিসেবে একজন ব্যবসায়ীর রাজনীতির খাতায় ও একজন রাজনীতিকের ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখানোকে দায়ী করা হলে মনে হয় না তারা এ দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন। কেননা রাজনীতিকে পুঁজিহীন রমরমা ব্যবসার ধারায় নিয়ে আসার পেছনে ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিকের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়।
তবে যে যত কথাই বলুক, একজন ব্যবসায়ী কখনও নিজ ব্যবসার উন্নতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। এ নিয়ে কোনো তর্কেরও অবকাশ নেই। কাজেই ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতির ময়দান দাপিয়ে বেড়াবেন, তখন রাজনীতির ময়দান মুখোশধারী দেশপ্রেমিকে ভরে উঠবে। আর তাদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন ঠিক সেদিনই হবে, যেদিন মানুষের হাতের তালুতে পশম গজানো শুরু হবে। জানি না হাতের তালুতে পশম গজাবে কবে। তবে তার আগেই নীতিনির্ধারকদের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেন একজন ব্যবসায়ী জনপ্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হতে না পারেন। আবার যারা জনপ্রতিনিধি থেকে ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তাদেরও ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ দেশ ও দশের ভাগ্যকে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র মতো দ্বিধাগ্রস্তদের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হবে না। আইনি জটিলতায় যদি তা সম্ভব হয়ে না ওঠে, তাহলে তাদের বর্জনের ভার আমজনতাকেই নিতে হবে।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
No comments