দুদক আইনের সংশোধন: সোনার পাথরবাটি by শাহ্দীন মালিক
মহামান্য সরকার বাহাদুর চাইলে সবই পারেন। অল্প কিছুদিন আগে দুদকের চেয়ারম্যান দুদক আইনের প্রস্তাবিত সংশোধন সম্পর্কে টিআইবির আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মন্তব্য করেছিলেন যে আইনের সংশোধনগুলো গৃহীত হলে দুদক সোনার পাথরবাটি হয়ে যাবে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন এ আলোচনা হচ্ছিল, তখন সংশোধনী আইনে কোন কোন ধারার কী কী সংশোধন হচ্ছে, সেটা দুদকের চেয়ারম্যানসহ আমরা কেউই সঠিক জানতাম না। এটা ছিল সরকারের অতি গোপনীয় কাজের অংশ। অবশ্য পত্রপত্রিকা কিছু কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ফাঁস করে দিয়েছিল। খোদ চেয়ারম্যান সাহেব বলেছিলেন, যা পরে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল—তিনিও সংশোধনী সম্পর্কে কিছু জানেন না। অর্থাৎ মহামান্য সরকার বাহাদুর তাঁর সঙ্গে দুদক আইনের সংশোধন নিয়ে কোনো সলাপরামর্শ করেননি। আমজনতার মতো তিনিও সংবাদমাধ্যমের মারফত জানতে পেরেছেন, যা জানতে পেরেছেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছিল যে ওসব সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হলে সংশোধিত আইনের আওতায় দুদক সোনার পাথরবাটি হয়ে যাবে।
আমাদের মান-অভিমান, শঙ্কা, সংকোচ-সন্দেহ সব দূরীভূত করে দুর্নীতি দমন কমিশন [সংশোধনী] আইন, ২০১১-এ বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে।
স্পষ্টত সরকার বাহাদুর অনেকগুলো সোনার পাথরবাটি তৈরিতে বদ্ধপরিকর।
২.
যেমন, দেশে আইনের শাসনের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন সরকার বাহাদুর। রাজনৈতিক বিবেচনায় শত শত বা হাজার হাজার (হিসাব আজকাল আর রাখি না—জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি তাই) মামলা প্রত্যাহার করছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হয়েছিল, তাই সেগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
অর্থাৎ রাজনীতির সঙ্গে মামলা সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে। আগেও জড়িত ছিল কিন্তু সেটার কিছুটা হলেও রাখঢাক ছিল। এখন সব খোলামেলাভাবে হয়। অর্থাৎ স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আইনের শাসন পোক্ত হয়েছে।
যেমন সন্তু লারমা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল। জনৈক মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কারটা পেয়ে গেলেন। এদিক-ওদিক তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলো। ভাগ্যিস, অভিযোগগুলো এখনো তেমন গুরুতর নয়। তাই জামিন পাচ্ছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেহেতু ফৌজদারি মামলা দায়ের সর্বজনস্বীকৃত, সেহেতু গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত করে রাজনৈতিক মামলা হবেই। কত তাড়াতাড়ি হবে, সেটাই দেখার ব্যাপার। তদুপরি তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করার জন্য প্রফেসর ইউনূস কোর্ট-কাচারি করছেন। কোর্ট-কাচারি যখন তাঁর এত পছন্দ, তাই যাতে আরও বেশি বেশি বার তাঁকে কোর্টে যেতে হয়, তা সুনিশ্চিত করা মহামান্য সরকার বাহাদুরের অবশ্য করণীয়। এবং সেটা হওয়া উচিত রাজনৈতিক বিবেচনায়।
বর্তমান নিয়মের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্ঘাত মামলাগুলো প্রত্যাহার করবে। রাজনৈতিক বিবেচনাই এখন আমাদের আইনের শাসনের মূল কথা।
শুক্রবার (১১ মার্চ) সকালে প্রথম আলোয় খবর দেখলাম সংসদীয় উপকমিটির বাংলাদেশ বিমানে দুর্নীতিসংক্রান্ত তদন্তের ব্যাপারে। ১৯৯১ থেকে আজতক বিমানের সব দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত তাঁরা করেছেন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী মন্ত্রী-এমডি-কর্মকর্তাদের বিমানের দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা-সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন। তবে কমিটিটি ১৯৯৬-২০০১ সালের সময়কার কোনো লেনদেন, কেনাবেচা, দেনা-পাওনার ব্যাপারে নাক গলায়নি।
তামাম দুনিয়ায় প্রায় সব ধরনের বিশাল স্বীকৃতি-পুরস্কার অধ্যাপক ইউনূস পেয়েছেন। আমাদের সরকার বাহাদুর প্রশংসা-পুরস্কার-সম্মান-স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন। তবে একটা বিশেষ ধরনের অর্থাৎ আইনের শাসন মানে সবকিছুই রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত—নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন ও প্রয়োগের জন্য অতি শিগগিরই বিশ্বব্যাপী যে স্বীকৃতি মিলবে, সে ব্যাপারে অধমের সন্দেহ বা আশঙ্কা অতি ক্ষীণ।
৩.
দুর্নীতি দমন কমিশনও যাতে সবকিছু রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে করে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য দুদক আইনের এই সংশোধনীগুলো আনা হচ্ছে।
আশা করছি, পাঠক, মহামান্য সরকার বাহাদুরকে ভুল বুঝবেন না। সব কাজে নিয়মনীতি ভালো হোক, মন্দ হোক—একটাই থাকা উচিত। খুন, জখম, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি মামলা দায়ের ও মামলা প্রত্যাহার রাজনৈতিক বিবেচনায় হবে আর দুর্নীতি মামলায় কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা থাকবে না—এটা তো হতে পারে না। এক দেশে দুই আইন কেমনে গ্রহণযোগ্য হবে।
ইদানীং মহামান্য সরকার বাহাদুরের মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত কমিটি অনেকগুলো দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ পাঠিয়েছে দুদকের কাছে। দুদক সেগুলো আমলে নিচ্ছে না। সরকারের নিজের লোকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিবেচনায় গত সরকার-আমলে দায়ের করা কোনো মামলাই দুদক এখনো প্রত্যাহার করেনি।
দেশের এখন আইন হলো, মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের হবে, প্রত্যাহারও হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। দুদককেও আইন মানতে হবে। দুদক তো আর আইনের ঊর্ধ্বে নয় বা থাকতে পারে না। অতএব, দুদককে এই নতুন আইনের শাসনের আওতায় আনতে এখন দুদক আইনে সংশোধনী এনে বিধান করা হচ্ছে যে, সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা দায়ের করতে হলে মহামান্য সরকার বাহাদুরের পূর্বানুমোদন লাগবে। সরকার বাহাদুরের অনুমতি ব্যতিরেকে দুদক দুর্নীতি মামলা দায়ের করতে পারবে না।
অর্থাৎ এবং অতএব দুদক দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে হলে রাজনীতিকে বিবেচনায় আনতে হবে। বুঝতে হবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় কার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি পাওয়া যাবে, কার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি পাওয়া যাবে না।
‘কইনচাইন দেখি’ গোছের একটা চুটকি প্রশ্ন—বলেন দেখি কার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগেই আগাম অনুমতি পাওয়া যাবে?
শতকরা ৯৬ ভাগ উত্তরদাতার উত্তর সঠিক হয়েছে।
আজকাল আইন নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু লেখার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। কারণ, আমাদের আইনগুলো ক্রমশ হাস্যরস বা কৌতুকের কেতুকুতি দেয়। আইনগুলো কমেডি শোর বিষয়বস্তু হলে তার কিছুটা হয়তো যৌক্তিকতা থাকত।
জানি, আইন অনেক সিরিয়াস ব্যাপার। পাঠক, আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু একটু চেষ্টা করতে, অর্থাৎ অধমের কথায় বিশ্বাস করার চেষ্টা করতে দোষ কী? দুদক সংশোধনী আইনে একটা নতুন ধারা যোগ করা হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে, কারও দুর্নীতি সম্পর্কে ‘তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হইয়া’ যদি কোনো তথ্য দেন এবং সে তথ্যের কারণে তদন্ত পরিচালনা ‘হইবার সম্ভাবনা থাকে’ তাহলে ওই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য ন্যূনতম দুই আর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে।
তথ্যদাতাই যদি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে দুদকের কী দরকার, সেটা বোঝার ক্ষমতা এই অধমের নেই; তবে মহামান্য সরকার বাহাদুরের নিশ্চয় আছে।
দুদক তদন্তই করল না, অর্থাৎ তথ্য প্রদানকারী সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়েছিল কি না, সেটা যাচাই-বাছাইয়েরও দরকার নেই। প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে যেহেতু তদন্ত পরিচালনা একটা ‘সম্ভাবনা’ জাগ্রত হয়েছে, সেই সম্ভাবনা জাগ্রত করার কারণেই তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়ে যেতে পারে। আর তথ্য প্রদানকারী যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হন, তাহলে তার জন্য শুধু কারাদণ্ডই যথেষ্ট নয়, আইন বলেছে, তাদের রিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তথ্য দেওয়ার ঠেলা সামলাও। আরও আছে। বর্তমান আইনানুযায়ী তদন্তের জন্য দুদক কোনো ব্যক্তিকে তলব করতে পারত। বর্তমান আইনের ক্ষমতাবলে, দুদক আপনাকে ডেকে পাঠালে আপনি যেতে বাধ্য। এখন যাতে সরকারের পেয়ারা ব্যক্তিদের এসব ডাকাডাকি করতে না পারে—অর্থাৎ ডাকাডাকি করার আগে রাজনৈতিক বিবেচনা যদি মাথায় না নেয়, সে জন্য ডাকাডাকির ক্ষমতাই প্রায় বাতিল করা হয়েছে।
সংশোধনের ফলে দুদকের ক্ষমতা হবে ‘আমন্ত্রণ’ জানানো। ‘নেমন্তন্নপত্র’ কেউ যদি গ্রহণ না করে, তাহলে নেমন্তন্নদাতা ভদ্রলোকের সাধারণত করার কিছুই থাকে না মনে মনে গোস্সা করা ছাড়া। দুদকেরও এর পর থেকে নিতান্ত ভদ্দরলোক হয়ে গিয়ে গোস্সা করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
৪.
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেই, অথচ দেশের উন্নতি হচ্ছে—এমন কোনো দেশের কথা আমাদের জানা নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে শীর্ষস্থানের জন্য যারা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রবল প্রতিযোগিতা করে তাদের দেশের জনগণের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান সবই আমাদের মতো। অর্থাৎ দুর্নীতি হচ্ছে এবং একই সঙ্গে দেশের লোকের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
যারা দুর্নীতি করে তারাই দুর্নীতির বিচার চাইবে না—এর থেকে স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার আর কী হতে পারে?
দুদক দন্তহীন বাঘ। অর্থাৎ আইন সংশোধনের পক্ষে যুক্তি উঠছে যে দুদক তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, মন্ত্রী—সবাই দুদকের ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হতে পারে।
কথাটা সত্যি হলেও তার সমাধান এই নয় যে দুদকের হাত-পা ভেঙে তাকে পঙ্গু করে দিতে হবে। সরকারের ভূরি ভূরি গোয়েন্দা আছে। যদি সরষেতে ভূত থাকে, তাহলে তার প্রতিকার অবশ্যই করা সম্ভব। দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্মূল্যায়ন করতে দোষ কী?
যাহোক, দুর্নীতি থাকলে দেশের উন্নতি হবে না। আর বিদেশি মেহমান পেলেই সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী-সচিব, বৈদেশিক বিনিয়োগ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যানসহ সবাই আমাদের দেশে বিনিয়োগের জন্য এসব বিদেশি মেহমানের যতই তোষামোদি করি না, বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ করে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান করতে যদি পদে পদে ঘুষ দিতে হয়, তাহলে কেউই আসবে না। আসবে, তবে শুধু তারা যাদের ব্যাপারে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ কথাটা প্রযোজ্য।
আর দেশের ভাবমূর্তি। থাক, আর নাই-বা বললাম। শুধু এতটুকু—এটা সোনার পাথরবাটির দেশ।
শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন এ আলোচনা হচ্ছিল, তখন সংশোধনী আইনে কোন কোন ধারার কী কী সংশোধন হচ্ছে, সেটা দুদকের চেয়ারম্যানসহ আমরা কেউই সঠিক জানতাম না। এটা ছিল সরকারের অতি গোপনীয় কাজের অংশ। অবশ্য পত্রপত্রিকা কিছু কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ফাঁস করে দিয়েছিল। খোদ চেয়ারম্যান সাহেব বলেছিলেন, যা পরে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল—তিনিও সংশোধনী সম্পর্কে কিছু জানেন না। অর্থাৎ মহামান্য সরকার বাহাদুর তাঁর সঙ্গে দুদক আইনের সংশোধন নিয়ে কোনো সলাপরামর্শ করেননি। আমজনতার মতো তিনিও সংবাদমাধ্যমের মারফত জানতে পেরেছেন, যা জানতে পেরেছেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছিল যে ওসব সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হলে সংশোধিত আইনের আওতায় দুদক সোনার পাথরবাটি হয়ে যাবে।
আমাদের মান-অভিমান, শঙ্কা, সংকোচ-সন্দেহ সব দূরীভূত করে দুর্নীতি দমন কমিশন [সংশোধনী] আইন, ২০১১-এ বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে।
স্পষ্টত সরকার বাহাদুর অনেকগুলো সোনার পাথরবাটি তৈরিতে বদ্ধপরিকর।
২.
যেমন, দেশে আইনের শাসনের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন সরকার বাহাদুর। রাজনৈতিক বিবেচনায় শত শত বা হাজার হাজার (হিসাব আজকাল আর রাখি না—জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি তাই) মামলা প্রত্যাহার করছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হয়েছিল, তাই সেগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
অর্থাৎ রাজনীতির সঙ্গে মামলা সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে। আগেও জড়িত ছিল কিন্তু সেটার কিছুটা হলেও রাখঢাক ছিল। এখন সব খোলামেলাভাবে হয়। অর্থাৎ স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আইনের শাসন পোক্ত হয়েছে।
যেমন সন্তু লারমা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল। জনৈক মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কারটা পেয়ে গেলেন। এদিক-ওদিক তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলো। ভাগ্যিস, অভিযোগগুলো এখনো তেমন গুরুতর নয়। তাই জামিন পাচ্ছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেহেতু ফৌজদারি মামলা দায়ের সর্বজনস্বীকৃত, সেহেতু গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত করে রাজনৈতিক মামলা হবেই। কত তাড়াতাড়ি হবে, সেটাই দেখার ব্যাপার। তদুপরি তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করার জন্য প্রফেসর ইউনূস কোর্ট-কাচারি করছেন। কোর্ট-কাচারি যখন তাঁর এত পছন্দ, তাই যাতে আরও বেশি বেশি বার তাঁকে কোর্টে যেতে হয়, তা সুনিশ্চিত করা মহামান্য সরকার বাহাদুরের অবশ্য করণীয়। এবং সেটা হওয়া উচিত রাজনৈতিক বিবেচনায়।
বর্তমান নিয়মের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্ঘাত মামলাগুলো প্রত্যাহার করবে। রাজনৈতিক বিবেচনাই এখন আমাদের আইনের শাসনের মূল কথা।
শুক্রবার (১১ মার্চ) সকালে প্রথম আলোয় খবর দেখলাম সংসদীয় উপকমিটির বাংলাদেশ বিমানে দুর্নীতিসংক্রান্ত তদন্তের ব্যাপারে। ১৯৯১ থেকে আজতক বিমানের সব দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত তাঁরা করেছেন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী মন্ত্রী-এমডি-কর্মকর্তাদের বিমানের দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা-সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন। তবে কমিটিটি ১৯৯৬-২০০১ সালের সময়কার কোনো লেনদেন, কেনাবেচা, দেনা-পাওনার ব্যাপারে নাক গলায়নি।
তামাম দুনিয়ায় প্রায় সব ধরনের বিশাল স্বীকৃতি-পুরস্কার অধ্যাপক ইউনূস পেয়েছেন। আমাদের সরকার বাহাদুর প্রশংসা-পুরস্কার-সম্মান-স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন। তবে একটা বিশেষ ধরনের অর্থাৎ আইনের শাসন মানে সবকিছুই রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত—নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন ও প্রয়োগের জন্য অতি শিগগিরই বিশ্বব্যাপী যে স্বীকৃতি মিলবে, সে ব্যাপারে অধমের সন্দেহ বা আশঙ্কা অতি ক্ষীণ।
৩.
দুর্নীতি দমন কমিশনও যাতে সবকিছু রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে করে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য দুদক আইনের এই সংশোধনীগুলো আনা হচ্ছে।
আশা করছি, পাঠক, মহামান্য সরকার বাহাদুরকে ভুল বুঝবেন না। সব কাজে নিয়মনীতি ভালো হোক, মন্দ হোক—একটাই থাকা উচিত। খুন, জখম, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি মামলা দায়ের ও মামলা প্রত্যাহার রাজনৈতিক বিবেচনায় হবে আর দুর্নীতি মামলায় কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা থাকবে না—এটা তো হতে পারে না। এক দেশে দুই আইন কেমনে গ্রহণযোগ্য হবে।
ইদানীং মহামান্য সরকার বাহাদুরের মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত কমিটি অনেকগুলো দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ পাঠিয়েছে দুদকের কাছে। দুদক সেগুলো আমলে নিচ্ছে না। সরকারের নিজের লোকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিবেচনায় গত সরকার-আমলে দায়ের করা কোনো মামলাই দুদক এখনো প্রত্যাহার করেনি।
দেশের এখন আইন হলো, মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের হবে, প্রত্যাহারও হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। দুদককেও আইন মানতে হবে। দুদক তো আর আইনের ঊর্ধ্বে নয় বা থাকতে পারে না। অতএব, দুদককে এই নতুন আইনের শাসনের আওতায় আনতে এখন দুদক আইনে সংশোধনী এনে বিধান করা হচ্ছে যে, সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা দায়ের করতে হলে মহামান্য সরকার বাহাদুরের পূর্বানুমোদন লাগবে। সরকার বাহাদুরের অনুমতি ব্যতিরেকে দুদক দুর্নীতি মামলা দায়ের করতে পারবে না।
অর্থাৎ এবং অতএব দুদক দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে হলে রাজনীতিকে বিবেচনায় আনতে হবে। বুঝতে হবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় কার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি পাওয়া যাবে, কার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি পাওয়া যাবে না।
‘কইনচাইন দেখি’ গোছের একটা চুটকি প্রশ্ন—বলেন দেখি কার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগেই আগাম অনুমতি পাওয়া যাবে?
শতকরা ৯৬ ভাগ উত্তরদাতার উত্তর সঠিক হয়েছে।
আজকাল আইন নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু লেখার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। কারণ, আমাদের আইনগুলো ক্রমশ হাস্যরস বা কৌতুকের কেতুকুতি দেয়। আইনগুলো কমেডি শোর বিষয়বস্তু হলে তার কিছুটা হয়তো যৌক্তিকতা থাকত।
জানি, আইন অনেক সিরিয়াস ব্যাপার। পাঠক, আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু একটু চেষ্টা করতে, অর্থাৎ অধমের কথায় বিশ্বাস করার চেষ্টা করতে দোষ কী? দুদক সংশোধনী আইনে একটা নতুন ধারা যোগ করা হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে, কারও দুর্নীতি সম্পর্কে ‘তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হইয়া’ যদি কোনো তথ্য দেন এবং সে তথ্যের কারণে তদন্ত পরিচালনা ‘হইবার সম্ভাবনা থাকে’ তাহলে ওই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য ন্যূনতম দুই আর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে।
তথ্যদাতাই যদি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে দুদকের কী দরকার, সেটা বোঝার ক্ষমতা এই অধমের নেই; তবে মহামান্য সরকার বাহাদুরের নিশ্চয় আছে।
দুদক তদন্তই করল না, অর্থাৎ তথ্য প্রদানকারী সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়েছিল কি না, সেটা যাচাই-বাছাইয়েরও দরকার নেই। প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে যেহেতু তদন্ত পরিচালনা একটা ‘সম্ভাবনা’ জাগ্রত হয়েছে, সেই সম্ভাবনা জাগ্রত করার কারণেই তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়ে যেতে পারে। আর তথ্য প্রদানকারী যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হন, তাহলে তার জন্য শুধু কারাদণ্ডই যথেষ্ট নয়, আইন বলেছে, তাদের রিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তথ্য দেওয়ার ঠেলা সামলাও। আরও আছে। বর্তমান আইনানুযায়ী তদন্তের জন্য দুদক কোনো ব্যক্তিকে তলব করতে পারত। বর্তমান আইনের ক্ষমতাবলে, দুদক আপনাকে ডেকে পাঠালে আপনি যেতে বাধ্য। এখন যাতে সরকারের পেয়ারা ব্যক্তিদের এসব ডাকাডাকি করতে না পারে—অর্থাৎ ডাকাডাকি করার আগে রাজনৈতিক বিবেচনা যদি মাথায় না নেয়, সে জন্য ডাকাডাকির ক্ষমতাই প্রায় বাতিল করা হয়েছে।
সংশোধনের ফলে দুদকের ক্ষমতা হবে ‘আমন্ত্রণ’ জানানো। ‘নেমন্তন্নপত্র’ কেউ যদি গ্রহণ না করে, তাহলে নেমন্তন্নদাতা ভদ্রলোকের সাধারণত করার কিছুই থাকে না মনে মনে গোস্সা করা ছাড়া। দুদকেরও এর পর থেকে নিতান্ত ভদ্দরলোক হয়ে গিয়ে গোস্সা করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
৪.
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেই, অথচ দেশের উন্নতি হচ্ছে—এমন কোনো দেশের কথা আমাদের জানা নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে শীর্ষস্থানের জন্য যারা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রবল প্রতিযোগিতা করে তাদের দেশের জনগণের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান সবই আমাদের মতো। অর্থাৎ দুর্নীতি হচ্ছে এবং একই সঙ্গে দেশের লোকের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
যারা দুর্নীতি করে তারাই দুর্নীতির বিচার চাইবে না—এর থেকে স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার আর কী হতে পারে?
দুদক দন্তহীন বাঘ। অর্থাৎ আইন সংশোধনের পক্ষে যুক্তি উঠছে যে দুদক তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, মন্ত্রী—সবাই দুদকের ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হতে পারে।
কথাটা সত্যি হলেও তার সমাধান এই নয় যে দুদকের হাত-পা ভেঙে তাকে পঙ্গু করে দিতে হবে। সরকারের ভূরি ভূরি গোয়েন্দা আছে। যদি সরষেতে ভূত থাকে, তাহলে তার প্রতিকার অবশ্যই করা সম্ভব। দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্মূল্যায়ন করতে দোষ কী?
যাহোক, দুর্নীতি থাকলে দেশের উন্নতি হবে না। আর বিদেশি মেহমান পেলেই সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী-সচিব, বৈদেশিক বিনিয়োগ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যানসহ সবাই আমাদের দেশে বিনিয়োগের জন্য এসব বিদেশি মেহমানের যতই তোষামোদি করি না, বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ করে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান করতে যদি পদে পদে ঘুষ দিতে হয়, তাহলে কেউই আসবে না। আসবে, তবে শুধু তারা যাদের ব্যাপারে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ কথাটা প্রযোজ্য।
আর দেশের ভাবমূর্তি। থাক, আর নাই-বা বললাম। শুধু এতটুকু—এটা সোনার পাথরবাটির দেশ।
শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
No comments