দূষিত রাজনীতি ও টিভি চ্যানেল by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সম্প্রতি চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ ঘোষিত হওয়ায় মিডিয়া মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এর আগে একুশে টিভি ও সিএসবিও বন্ধ ঘোষিত হয়েছিল। আরও দু-একটি চ্যানেল বন্ধ হতে পারে বলে বাজারে গুজব রয়েছে। গুজবে কান দেওয়ার দরকার নেই, যা ঘটেছে তা নিয়েই আলোচনা করা যাক।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে বলে সরকার দাবি করে থাকে। এই দাবি যে অযৌক্তিক তা নয়। কিন্তু সরকার নানা কৌশলে তাদের বিরোধী বা সমালোচক টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে কখনো আদালত, কখনো বিটিআরসি, কখনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেওয়া হয়। একজন বালকও বুঝতে পারে, কোনো টিভি চ্যানেলের ওপর সরকার অখুশি বা বিরক্ত হলে সরকার নানা অজুহাতে সেই টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছে। বেকার হচ্ছেন শত শত সাংবাদিক, কলাকুশলী ও কর্মী। একটা বয়সের পর বেকার হয়ে যাওয়া যে কী যাতনার, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারবেন। যাঁরা সরকার পরিচালনা করেন, এটা তাঁদের বিবেচনার বিষয় হয় না। তাঁরা বোঝেন শুধু রাজনীতি। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি।
বিএনপি সরকারের পরোক্ষ ইঙ্গিতে যেদিন একুশে টিভি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেদিন থেকে টিভি চ্যানেল বন্ধের এই সংস্কৃতির শুরু। বিএনপি হয়তো সেদিন ভেবেছিল, তারা চিরস্থায়ী সরকার। তাদের গায়ে কেউ আঁচড় দিতে পারবে না। কিন্তু বাস্তব খুব নির্মম। বিএনপি-সমর্থিত সিএসবিও নানা অজুহাতে বন্ধ হয়েছিল। সম্প্রতি বন্ধ হলো চ্যানেল ওয়ান।
একুশে টিভি বন্ধ করে বিএনপি সরকার আরও একটি বড় ভুল করেছিল। তা হলো বেসরকারি খাতে টেরিস্ট্রিয়াল টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পাওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এখন হাতছাড়া। ফলে সরকারনিয়ন্ত্রিত বিটিভি এখন মিডিয়া জগতে একচেটিয়া ব্যবসা করছে, নিম্নমানের অনুষ্ঠান দিয়েও। কোন যুক্তিতে সরকার বেসরকারি খাতে টেরিস্ট্রিয়াল টিভির লাইসেন্স দিচ্ছে না, তা স্পষ্ট নয়। এটা আমাদের বড় দুই দলের স্বেচ্ছাচারী ও অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমাদের দুর্বল নাগরিক সমাজ ও নির্বিকার মিডিয়া ভোক্তারা এসব দাবিতে সোচ্চার নয়।
সরকার কর্তৃক দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়াটা আমি বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না। এর জন্য আলাদা করে আমার মনে কোনো দুঃখ বা ক্ষোভও নেই। আমি মনে করি, এগুলো দেশের দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির ফল। টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা স্মার্ট ও সক্রিয় বলে নানাভাবে তাঁদের দাবি জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেন। বড় দল দুটির শাসনামলে দেশে আরও কত অবিচার, অন্যায়, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস, খুন, অপহরণ যে ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই। সবই হয়েছে রাজনীতির নামে। রাজনৈতিক বিরোধিতার নামে। শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিই। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের সরকারই গড়ে প্রায় ৩০০ জন (প্রতি আমলে) সরকারি কর্মকর্তাকে পাঁচ বছর কোনো কাজ করতে দেয়নি। অসংখ্য ছাত্র আবাসিক হলে থাকতে পারেননি। ব্যবসা করতে পারেননি অসংখ্য ব্যবসায়ী। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাদার ঠিকাদার, কন্ট্রাক্টররা কাজ করতে পারেন না। কাজ পেলেও লাভের বড় অংশ দিয়ে দিতে হয় ছাত্রনেতাদের।
সরকার পরিচালিত বিটিভিতে দুই দলের আমলে কত শিল্পী কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তার খবর কজন জানেন? কোনো কোনো শিল্পী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে বিটিভিতে কোনো অনুষ্ঠান করতে পারেননি। শুধু কি কালো তালিকা? বিটিভিতে কত অশিল্পী, ছাত্র-যুব কর্মী ও দলের শিল্পী ক্যাডার বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার নাম ভাঙিয়ে মাসের পর মাস বস্তাপচা অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে, তাদের বিচার কে করবে? বিটিভি থেকে অনুষ্ঠানের নামে কত যে লাখ লাখ টাকা তারা আত্মসাৎ করছে, তার হিসাব কে করেছে?
এভাবেই চলছে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই দূষিত রাজনীতিরই শিকার হয়েছে দুটি টিভি চ্যানেল। এটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়।
শুধু দুটি টিভি চ্যানেল বা তাদের সাংবাদিক ও কর্মীরাই নন, উল্লিখিত সবাই এই দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির শিকার। চ্যানেল ওয়ান, একুশে টিভি বা সিএসবি কি এই দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনো অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল? তারা কি বড় দুই দলের আমলে শুধু ‘ভিন্নমতের’ কারণে বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা নিগৃহীত হয়েছিলেন, নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁদের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেছিল? নাকি কোনো একটি দলের সরকারের পক্ষে সাফাই গেয়েছিল সারাক্ষণ? আজ টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার পর বর্তমান সরকারের সমালোচনা করছেন অনেক টিভি সাংবাদিক। ইটিভি যখন বন্ধ হয়েছিল, তখন অন্য টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা কোথায় ছিলেন? দুই দলের আমলে ‘ভিন্নমতের’ কারণে যাঁরা নিগৃহীত, নির্যাতিত বা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের কজনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এসব টিভি চ্যানেল?
আমাদের রাজনীতি যেমন দূষিত, তেমনি কয়েকটি গণমাধ্যমও দূষিত। তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণমাধ্যমের আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা একটি দল বা দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীর (মালিক) স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজেদের পরিচালিত করে। ‘গণমাধ্যম’ আলু-পোটল বিক্রির মতো একটি ব্যবসা নয়। যেভাবেই হোক, লাভ করার বাসনা থাকলে গণমাধ্যমের ব্যবসায় আসা উচিত নয়। একটি রাজনৈতিক দলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াও কোনো গণমাধ্যমের লক্ষ্য হতে পারে না। গণমাধ্যম সত্যকে তুলে ধরে নির্ভীকভাবে। কারও পক্ষে বা বিপক্ষে গণমাধ্যমের অবস্থান হতে পারে না। তাদের অবস্থান হতে পারে কেবল সত্যের পক্ষে।
যাঁরা এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গণমাধ্যম পরিচালনা করবেন, তাঁদের জীবনে অনেক দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। দূষিত রাজনীতির সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করবে। সেটাই স্বাভাবিক। অতীতেও করেছে, এখনো করছে, ভবিষ্যতেও করলে আমি অবাক হব না। দল ও সরকার সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক না হলে এ ধরনের আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়। শুধু ভোটে পাস করলেই সেই দল বা সরকারকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলা যায় না। বড়জোর ‘ভোটের সরকার’ বলা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকার ভিন্নমতকে দমন করে না। ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দেয়। পরমতের প্রতি সহিষ্ণু হয়।
দুটি টিভি চ্যানেলকে সরকার নানা অজুহাতে বন্ধ করে দিয়েছে—এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তার চেয়েও দুঃখজনক ও হতাশাজনক হলো, দেশে সত্যিকার অর্থে ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। বড় দুটি দল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হচ্ছে না। ব্যক্তিপূজা, পরিবারতন্ত্র, দলীয় নেতৃত্বে একনায়কত্ব, মন্ত্রিসভায় একনায়কত্ব, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় দিয়ে বড় দুটি দলের সরকার দেশে কোনো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারছে না। শুধু ‘ভোটের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেই বড় দল দুটি মহা আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ‘দেশে নির্বাচিত সরকার এসেছে’—এই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। নির্বাচিত সরকার যে তাদের আচরণে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী, তা অনেকে দেখেও না দেখার ভান করছেন। তাঁদের ভাবখানা এমন: ‘নির্বাচিত সরকার হলেই তার সাত খুন মাপ।’ সে জন্য বর্তমান সরকারের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। সুজন ও টিআইবি ছাড়া তেমন সক্রিয় ও প্রতিবাদী নাগরিক ফোরাম দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক নেতারা সরকারি নানা উচ্ছিষ্টের লোভে এখন প্রায় নীরব। বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা দলের (সরকারের) অতীতের কর্মকাণ্ড স্মরণ করে প্রতিবাদী হতে পারছেন না।
যত দিন অগণতান্ত্রিক, দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি সরকার পরিচালনায় প্রাধান্য পাবে, তত দিন টিভি চ্যানেল বন্ধ করার মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। স্বাধীন গণমাধ্যমের নিশ্চয়তা চাইলে গণমাধ্যমকে আগে সত্যিকার ‘গণমাধ্যম’ হতে হবে। দলের বা ব্যক্তিবিশেষের চোঙা হলে সেটাকে ‘গণমাধ্যম’ বলা যায় না। সে রকম গণমাধ্যম থাকলেই কী আর বন্ধ হলেই বা কী! বন্ধ হলে দল বা ব্যক্তিরই শুধু ক্ষতি।
আজকাল উচ্চবেতনে অনেক টিভি সাংবাদিক ও কলাকুশলী বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে চাকরি পাচ্ছেন। খুব ভালো কথা। ছেলেমেয়েদের উন্নতি দেখলে কার না ভালো লাগে। কিন্তু চাকরি নেওয়ার আগে সবাইকে ভেবে দেখতে বলি: এটা কি ‘গণমাধ্যম’, না কোনো দল বা ব্যক্তির চোঙা? চোঙা হলে তার পরিণাম কী হতে পারে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া দেখা দরকার, টিভি চ্যানেলের মালিকের ব্যবসায়িক অতীত, কীভাবে লাইসেন্স পেয়েছেন ইত্যাদি। এগুলো না দেখলে একদিন দেখা যাবে যে চ্যানেলের মালিক অফিসে না এসে জেলে চলে গেছেন। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় যাঁরা টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন, পরবর্তী অন্য দলের সরকার এলে নানা অজুহাতে তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করে দিতে পারে। এটাই এখনকার দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কাজেই টিভি চ্যানেলে (ব্যতিক্রম ছাড়া) যাঁরা এখন চাকরি নেবেন, তাঁরা এটাকে ‘অস্থায়ী চাকরি’ হিসেবে গ্রহণ করলে ভালো হবে। পরে মানসিক কষ্ট কম হবে।
সরকারের যেসব ব্যক্তি সম্প্রতি দুটি টিভির লাইসেন্স বাতিল করেছেন, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: এক মাঘে শীত যায় না। দুটির বদলে দশটির লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। দূষিত রাজনীতিতে অজুহাতের অভাব হবে না। এখন বড় দুই দলকে ঠিক করতে হবে টিভি চ্যানেল নিয়ে কীভাবে তারা খেলবে। ‘বন্ধ বন্ধ’ খেলবে? না ‘খোলা খোলা’ খেলবে? মাঘ মাসটা বড়জোর পাঁচ বছর মেয়াদি হবে। কিন্তু আবার মাঘ মাস আসে। তথ্যমন্ত্রী কি তা জানেন?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.