কূটকৌশলের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি নিয়ে যেন বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এখানে খুব একটা আলাপ-আলোচনা করার কিছু আছে বলে আমরা মনে করি না এবং সেটা এই কারণে যে ১৯৭১ সালে যারা গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, তাদের বিচার আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত আইন অনুযায়ী হবে। তত্কালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এ দেশীয় রাজাকার এবং আলবদরদের ব্যাপারে যেসব তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, সেগুলোই এই বিচারের জন্য যথেষ্ট। ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং এখন আমাদের যে বিষয়টির ওপর লক্ষ রাখা দরকার তা হলো, বিচার যেন সুষ্ঠু ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। সতর্ক থাকতে হবে যেন নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী না করা হয়। আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ওই সব ব্যক্তির ব্যাপারে, যারা আমাদের চোখের সামনে অপরাধ করেছে অথচ এখন আত্মপক্ষ সমর্থনের এমন কৌশল অবলম্বন করতে চাইবে, যাতে করে বিচারপ্রক্রিয়াটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এসব কথা এ জন্য বলা প্রয়োজন কেননা ইদানীং কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে বলতে শোনা গেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের পক্ষে এ জন্য কাজ করেছে, যেহেতু তখন এই বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখা হতো। তাদের এই কু-যুক্তিটি খুব দ্রুত খণ্ডন করতে হবে এবং সেটা অত্যন্ত সহজভাবেই করা যায়। আর তা হলো, তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর পর এই অঞ্চলে আইনগতভাবে পূর্ব পাকিস্তান নামের কোনো দেশ ছিল না। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পরে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঘোষণা জাতির জনকের পক্ষে আবার ব্যক্ত করা, এ সবই প্রমাণ করে যে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে আমরা বাঙালিরা ব্যস্ত ছিলাম। এরই সঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন সেটা হলো, এপ্রিল ১৯৭১-এ মুজিবনগর সরকার নতুন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত করে। মোট কথা, ২৬ মার্চের পর পাকিস্তান হয়ে দাঁড়ায় একটি বিদেশি শক্তিরূপে, যে শক্তিকে এই দেশ থেকে বিতাড়িত করার দায়িত্ব বাঙালি জাতির ওপর বর্তায়। অতএব, ২৬ মার্চের পর যেসব বাঙালি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, তারা নিজ দেশের বিরুদ্ধেই কাজ করেছে। এবং এই আইনগত দিক থেকে ১৯৭১-এর পাকিস্তানি দোসরদের বিচার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ যে কোনোক্রমেই গৃহযুদ্ধ ছিল না বরং দুটি পৃথক রাষ্ট্র যথা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ ছিল, সে বিষয়টিই দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা অত্যন্ত দরকার।
এখন আসা যাক জামায়াতে ইসলামীর বিষয়টিতে। এই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা যাদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীও আছে, আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা ১৯৭১-এ ভারতীয় ও হিন্দু সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। অত্যন্ত সুচতুরভাবে তারা বলার চেষ্টা করছে যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল না বরং এই দেশটি যাতে ভারত এবং হিন্দুদের দখলে চলে না যায়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কাজ করেছে। ইংরেজি ভাষায় একটি কথা রয়েছে, যা কিনা অসত্-যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো যায়। কথাটি হলো sophistry। এবং এই sophistry-ই আজকাল যুদ্ধাপরাধীরা ব্যবহার করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা তো কখনোই বলতে পারছে না, কেন ওই ভারতীয় ও হিন্দু সম্প্রসারণকে ঠেকাতে গিয়ে তারা পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যার কাজে সাহায্য করেছে। সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে খুন হয়েছে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করেছে এই রাজাকারের দল এবং পরে দেশের এই কৃতী সন্তানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই সবকিছুরই প্রমাণ রয়েছে এবং সেই সময়কার দৈনিক পত্রিকা, বিদেশি সাপ্তাহিকী ও পত্রিকা দেখলেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে। আমরা আশা করব যে সরকার পূর্ণ তথ্যাদি হাতে নিয়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার সূচনা করবে।
এই বিচারকাজের অপর একটি মুখ্য বিষয় হলো ওই সব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে যারা অত্যন্ত সক্রিয় একটি ভূমিকা পালন করেছে বাঙালি নিধনকাজে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পুরো বিষয়টি যাচাই করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে মোট ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। আমাদের দুঃখ এই যে অবশেষে বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়েছিলেন এই ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে মুক্ত করে দিতে। কিন্তু আপনাদের নিশ্চয় স্মরণে আছে, এসব কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়নি। এবং হয়নি বলেই এখন এদের বিচারের বিষয়টি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এবং সেটা এই কারণে, যেসব বাঙালি রাজাকারকে আমরা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করতে চলেছি, তারা এমনও প্রশ্ন করতে পারে, যখন গণহত্যার মূল হোতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন তাদের স্থানীয় দোসরদের কোন যুক্তিতে বিচারে তোলা হবে? তারপর আরেকটি বিষয় রয়েছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আওতায় অনেকে আসবে এবং অনেকে আসবে না, সেটা হয় না। আর এ কারণেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে পাকিস্তান সরকারের কাছে অনুরোধ করা, যেন ওই ১৯৫ জন সামরিক কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কাছে তুলে দেওয়া হয়। অবশ্য পাকিস্তান যে অনুরোধটি মেনে নেবে, তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যেটি করণীয় হবে তা হলো, এই ১৯৫ জন কর্মকর্তার বিচার তাদের অনুপস্থিতিতে আরম্ভ এবং সম্পন্ন করা। প্রতীকী হলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা খুবই প্রয়োজন। এরা দোষী সাব্যস্ত হলে সমগ্র পৃথিবীর সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে কলঙ্কিত নাম হয়ে থাকবে। খোদ পাকিস্তানের জনগণ জানতে পারবে তাদের এই বীর সৈনিকেরা কী ধরনের জঘন্য কাজ বাংলাদেশে করেছিল সেই ১৯৭১ সালে।
যুদ্ধাপরাধী কেবল ওই সব ব্যক্তি নয়, যারা সরাসরি গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ওই সব মানুষও, যারা বিভিন্ন অবস্থানে থেকে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান ও নিয়াজিকে সমর্থন করে গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাঙালি রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং আরও অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকেই আবার বিদেশে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবিত আছে, আবার অনেকেই মৃত। কিন্তু মৃত হোক কিংবা জীবিত, এদের বিষয়টি যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বাস্তবতা। যারা জীবিত নেই, তাদের ক্ষেত্রে মরণোত্তর বিচারের ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজনীয়। একইভাবে যদি ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজিকে মরণোত্তর বিচারের সম্মুখীন করা যেতে পারে; তেমনিভাবে আমাদের পাকিস্তান-পছন্দ বাঙালিদেরও বিচারে আনা আমাদের একটি বড় ধরনের নৈতিক দায়িত্ব।
যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের আমরা এই জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাব, যেহেতু তারা মানুষ হত্যা করেছে কতগুলো জঘন্য অজুহাতে। এদের বিচার করা হবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নয়।
আর একটি কথা। বর্তমানে বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এমন কর্তাব্যক্তি রয়েছে, যারা ১৯৭১-এ তাদের যৌবনে আলবদর ও আলশামস বাহিনীর হয়ে বাঙালি হত্যা করেছে। শোনা যায়, যারা অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের মতো বাঙালিকে হত্যা করেছে, তারা বহাল তবিয়তে আছে। এদেরও খুঁজে বের করতে হবে।
শেষ একটি কথা। এক ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে, ইতিমধ্যেই সে দেশত্যাগ করেছে। কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। এখানে আমাদের একটিই প্রশ্ন: আজ যারা দেশ শাসন করছেন, তাঁরা কি আমাদের আশ্বাস দিতে পারবেন যে আর কোনো যুদ্ধাপরাধী দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারবে না?
শেষ, একেবারে শেষ আর একটি কথা। যুদ্ধাপরাধী শুধু জামায়াত কেন, অন্য যে দলেই থাকুক না কেন, তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে এবং বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। কাউকে যদি ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে বিচারের পক্ষে সব যুক্তি ধসে পড়বে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
এসব কথা এ জন্য বলা প্রয়োজন কেননা ইদানীং কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে বলতে শোনা গেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের পক্ষে এ জন্য কাজ করেছে, যেহেতু তখন এই বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখা হতো। তাদের এই কু-যুক্তিটি খুব দ্রুত খণ্ডন করতে হবে এবং সেটা অত্যন্ত সহজভাবেই করা যায়। আর তা হলো, তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর পর এই অঞ্চলে আইনগতভাবে পূর্ব পাকিস্তান নামের কোনো দেশ ছিল না। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পরে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঘোষণা জাতির জনকের পক্ষে আবার ব্যক্ত করা, এ সবই প্রমাণ করে যে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে আমরা বাঙালিরা ব্যস্ত ছিলাম। এরই সঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন সেটা হলো, এপ্রিল ১৯৭১-এ মুজিবনগর সরকার নতুন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত করে। মোট কথা, ২৬ মার্চের পর পাকিস্তান হয়ে দাঁড়ায় একটি বিদেশি শক্তিরূপে, যে শক্তিকে এই দেশ থেকে বিতাড়িত করার দায়িত্ব বাঙালি জাতির ওপর বর্তায়। অতএব, ২৬ মার্চের পর যেসব বাঙালি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, তারা নিজ দেশের বিরুদ্ধেই কাজ করেছে। এবং এই আইনগত দিক থেকে ১৯৭১-এর পাকিস্তানি দোসরদের বিচার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ যে কোনোক্রমেই গৃহযুদ্ধ ছিল না বরং দুটি পৃথক রাষ্ট্র যথা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ ছিল, সে বিষয়টিই দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা অত্যন্ত দরকার।
এখন আসা যাক জামায়াতে ইসলামীর বিষয়টিতে। এই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা যাদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীও আছে, আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা ১৯৭১-এ ভারতীয় ও হিন্দু সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। অত্যন্ত সুচতুরভাবে তারা বলার চেষ্টা করছে যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল না বরং এই দেশটি যাতে ভারত এবং হিন্দুদের দখলে চলে না যায়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কাজ করেছে। ইংরেজি ভাষায় একটি কথা রয়েছে, যা কিনা অসত্-যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো যায়। কথাটি হলো sophistry। এবং এই sophistry-ই আজকাল যুদ্ধাপরাধীরা ব্যবহার করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা তো কখনোই বলতে পারছে না, কেন ওই ভারতীয় ও হিন্দু সম্প্রসারণকে ঠেকাতে গিয়ে তারা পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যার কাজে সাহায্য করেছে। সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে খুন হয়েছে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করেছে এই রাজাকারের দল এবং পরে দেশের এই কৃতী সন্তানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই সবকিছুরই প্রমাণ রয়েছে এবং সেই সময়কার দৈনিক পত্রিকা, বিদেশি সাপ্তাহিকী ও পত্রিকা দেখলেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে। আমরা আশা করব যে সরকার পূর্ণ তথ্যাদি হাতে নিয়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার সূচনা করবে।
এই বিচারকাজের অপর একটি মুখ্য বিষয় হলো ওই সব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে যারা অত্যন্ত সক্রিয় একটি ভূমিকা পালন করেছে বাঙালি নিধনকাজে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পুরো বিষয়টি যাচাই করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে মোট ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। আমাদের দুঃখ এই যে অবশেষে বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়েছিলেন এই ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে মুক্ত করে দিতে। কিন্তু আপনাদের নিশ্চয় স্মরণে আছে, এসব কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়নি। এবং হয়নি বলেই এখন এদের বিচারের বিষয়টি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এবং সেটা এই কারণে, যেসব বাঙালি রাজাকারকে আমরা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করতে চলেছি, তারা এমনও প্রশ্ন করতে পারে, যখন গণহত্যার মূল হোতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন তাদের স্থানীয় দোসরদের কোন যুক্তিতে বিচারে তোলা হবে? তারপর আরেকটি বিষয় রয়েছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আওতায় অনেকে আসবে এবং অনেকে আসবে না, সেটা হয় না। আর এ কারণেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে পাকিস্তান সরকারের কাছে অনুরোধ করা, যেন ওই ১৯৫ জন সামরিক কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কাছে তুলে দেওয়া হয়। অবশ্য পাকিস্তান যে অনুরোধটি মেনে নেবে, তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যেটি করণীয় হবে তা হলো, এই ১৯৫ জন কর্মকর্তার বিচার তাদের অনুপস্থিতিতে আরম্ভ এবং সম্পন্ন করা। প্রতীকী হলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা খুবই প্রয়োজন। এরা দোষী সাব্যস্ত হলে সমগ্র পৃথিবীর সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে কলঙ্কিত নাম হয়ে থাকবে। খোদ পাকিস্তানের জনগণ জানতে পারবে তাদের এই বীর সৈনিকেরা কী ধরনের জঘন্য কাজ বাংলাদেশে করেছিল সেই ১৯৭১ সালে।
যুদ্ধাপরাধী কেবল ওই সব ব্যক্তি নয়, যারা সরাসরি গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ওই সব মানুষও, যারা বিভিন্ন অবস্থানে থেকে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান ও নিয়াজিকে সমর্থন করে গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাঙালি রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং আরও অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকেই আবার বিদেশে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবিত আছে, আবার অনেকেই মৃত। কিন্তু মৃত হোক কিংবা জীবিত, এদের বিষয়টি যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বাস্তবতা। যারা জীবিত নেই, তাদের ক্ষেত্রে মরণোত্তর বিচারের ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজনীয়। একইভাবে যদি ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজিকে মরণোত্তর বিচারের সম্মুখীন করা যেতে পারে; তেমনিভাবে আমাদের পাকিস্তান-পছন্দ বাঙালিদেরও বিচারে আনা আমাদের একটি বড় ধরনের নৈতিক দায়িত্ব।
যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের আমরা এই জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাব, যেহেতু তারা মানুষ হত্যা করেছে কতগুলো জঘন্য অজুহাতে। এদের বিচার করা হবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নয়।
আর একটি কথা। বর্তমানে বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এমন কর্তাব্যক্তি রয়েছে, যারা ১৯৭১-এ তাদের যৌবনে আলবদর ও আলশামস বাহিনীর হয়ে বাঙালি হত্যা করেছে। শোনা যায়, যারা অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের মতো বাঙালিকে হত্যা করেছে, তারা বহাল তবিয়তে আছে। এদেরও খুঁজে বের করতে হবে।
শেষ একটি কথা। এক ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে, ইতিমধ্যেই সে দেশত্যাগ করেছে। কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। এখানে আমাদের একটিই প্রশ্ন: আজ যারা দেশ শাসন করছেন, তাঁরা কি আমাদের আশ্বাস দিতে পারবেন যে আর কোনো যুদ্ধাপরাধী দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারবে না?
শেষ, একেবারে শেষ আর একটি কথা। যুদ্ধাপরাধী শুধু জামায়াত কেন, অন্য যে দলেই থাকুক না কেন, তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে এবং বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। কাউকে যদি ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে বিচারের পক্ষে সব যুক্তি ধসে পড়বে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments