বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চল: সহজ পাঠ -বিচারের বাণী by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
২ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে বঙ্গোপসাগরের অন্তঃস্থ খনিজ সম্পদে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব ও মালিকানা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে জেনে চমকে উঠেছি এবং তাত্ক্ষণিক এ লেখাটির জন্ম হয়েছে বিক্ষুব্ধ অন্তরে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির যে তালিকা দেওয়া আছে, তার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগরের অন্তঃস্থ কিংবা বাংলাদেশের মহীসোপানের উপরিস্থ মহাসাগরের অন্তঃস্থ সকল ভূমি, খনিজ এবং অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী।’ এই অনুচ্ছেদের ২ দফায় বলা আছে, জাতীয় সংসদ ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমা ও মহীসোপানের সীমা-নির্ধারণের বিধান’ করতে পারবে। সেই মতো জাতীয় সংসদ কর্তৃক ১৯৭৪ সালে ‘বাংলাদেশ জলসীমা ও সমুদ্রোপকূল অঞ্চলসমূহ আইন’ প্রণীত হয়েছে এবং আইনটির ভিত্তিতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বাংলাদেশের যে জলসীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেটা এই—বঙ্গোপসাগরের জলের ১০ ফ্যাদম (১ ফ্যাদম = ৬ ফুট বা ১.৮ মিটার) গভীরতা যেখানে শেষ হয়েছে, সেই ভিত্তিরেখা থেকে আরও দক্ষিণে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ৬০৮০ ফুট বা ১৮৫২ মিটার) পর্যন্ত।
প্রতিবেদনটি পড়ে কেন চমকে উঠেছিলাম সেটা এখন বলছি। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানিয়েছেন, অতি শিগগিরই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার মধ্যে তিনটি ব্লক তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হবে। অপরদিকে ওই প্রতিবেদন পড়ে জানা গেল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, ভারত সরকার ও মিয়ানমার সরকার উভয়ই ইজারা দেওয়ার আপত্তি জানিয়েছে এই মর্মে যে ওই ব্লক তিনটি তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। এখানে দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আন্তর্জাতিক আইনগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের আইনবলে প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ভিত্তিরেখা থেকে বাংলাদেশের জলসীমা প্রকৃত পক্ষে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল বা ৬৫০ কিলোমিটার, কিন্তু অদ্যতক ওই বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করা হয়নি এবং জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত বিশেষ কমিশনে সেই মতো দাবি জানানো হয়নি, অথচ সে দাবি জানানোর নির্দিষ্ট শেষ সময় ২০১১ সালের ২৭ জুলাই এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সে জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রকাশ্য তত্পরতা জোট সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার উভয়ের আমলেই দেখা যায়নি।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এখন লক্ষ করুন, এই লেখার সঙ্গে ছাপা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মানচিত্র এবং সেটার ভেতরে ভারত ও মিয়ানমারের আগ্রাসী রেখাচিত্র। এই মানচিত্রটির ফটোকপি নেওয়া হয়েছে কমোডর মোহাম্মদ খুরশেদ আলমের লেখা বাংলাদেশ’স মেরিটাইম চ্যালেঞ্জেস ইন দ্য টোয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি নামের গবেষণামূলক বই থেকে। কমোডর আলমের অভিমত এই যে বাংলাদেশের উপকূলরেখা খিলানাকৃতি হওয়ায় ন্যায়পরতার নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী এ তিনটি দেশের জলসীমা নির্ধারণ করা সঠিক হবে। তদুপরি ঐতিহাসিক স্বত্ব অর্থাত্ জলভাগটির নাম বঙ্গোপসাগর বিবেচনায় রাখতে হবে। জলসীমা নির্ধারণে কমোডর আলমের প্রস্তাবটির সমর্থন পাওয়া যায় আরেকটি পুস্তকে, যার নাম ডেলিমিটেশন অব মেরিটাইম বাউন্ডারি। এ পুস্তকটির লেখক রাজশাহী বিশ্ববািদ্যালয়ের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান।
অধ্যাপক রহমানের অভিমত এই যে ন্যায়পরতা নীতির ভিত্তিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ নর্থ সি কন্টিনেন্টাল কেসে যে রায় দিয়েছে, তারই ভিত্তিতে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়নামারের জলসীমা নির্ধারণ করা যায়। রায়টির সংশ্লিষ্ট অংশটির বঙ্গানুবাদ এই: ‘(ক) জলসীমা নির্ধারণ করতে হবে ন্যায্যতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বোঝাপড়ার মাধ্যমে ও সব কটি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে এ মতো উদ্দেশে যেন প্রত্যেক পক্ষকে যথাসম্ভব দেওয়া যায় মহীসোপানের ওই অংশটি, যেটা পক্ষ-দেশটির মূল ভূভাগ থেকে সমুদ্র বরাবর জলের অভ্যন্তরস্থ প্রাকৃতিক বর্ধিত অংশ এবং অন্য পক্ষ দেশ বা দেশগুলোর বর্ধিত অংশের তেমন সীমানা লঙ্ঘন করে না। (খ) যদি উপরিউক্ত নীতিটি প্রয়োগে দেখা যায় যে পক্ষ-দেশগুলোর মহীসোপানের কোনো অংশ পরস্পরকে আবৃত করেছে, সে ক্ষেত্রে সে অংশটি আপসে ভাগ-বণ্টন হবে কিংবা আপস ব্যর্থ হলে সে অংশটির যৌথ মালিকানা দেওয়া হবে।’ প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, ইউরোপের মানচিত্রটি লক্ষ করুন। দেখবেন, নর্থ সি বা উত্তর সাগরকে কেন্দ্র করে আটটি দেশের অবস্থান। ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে, সেভাবে অবস্থিত দেশগুলোর নাম হচ্ছে নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য।
এখন অন্য মতটি উল্লেখ করা যাক। প্রকৌশলী ইনামুল হক বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং তিনি ওয়াটার রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ নামের এক গবেষণামূলক বইয়ের লেখক। প্রকৌশলী হকের মতটি হচ্ছে, সমদূরত্ব নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী এ তিনটি দেশের জলসীমা নির্ধারণ করা সঠিক হবে। এই মতটি আলোচনা করার আগে আমাদের জানা দরকার যে জাতিসংঘের উদ্যোগে সমুদ্র আইন সম্পর্কীয় কনভেনশন বা মতৈক্য গৃহীত এবং কার্যকর হয় ১৯৯৪ সালের ১০ নভেম্বর। প্রকৌশলী হকের অভিমত এই: উপরিউক্ত কনভেনশনের ৩ আর ১৫ ধারা অনুযায়ী পশ্চিমে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত ধরে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলরেখা থেকে সমদূরত্বে এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ছেড়া দ্বীপ ও ওয়েস্টার দ্বীপের মাঝামাঝি উপকূলরেখা ধরে সমদূরত্বে হবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং সেটা পশ্চিমের ও পূর্ব দিকের উপকূলের শেষ পয়েন্ট থেকে উপরিউক্ত রেখা দুটির দক্ষিণ বরাবর দূরত্বের ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হবে। প্রকৌশলী হকের আরও অভিমত হচ্ছে, ভারত যে অতল সমুদ্রের পূর্ব দিকে মহীসোপানের ওপর দাবি জানিয়েছে, সেটা বাংলাদেশের নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত হওয়ায় জাতিসংঘ কনভেনশনের ৭৬ ধারার লঙ্ঘন এবং মিয়ানমার যে বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণমুখী খাড়ির পশ্চিমে মহীসোপানের ওপর দাবি জানিয়েছে, সেটাও বাংলাদেশের নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত হওয়ায় একই ৭৬ ধারার লঙ্ঘন। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি ভাটায় জাগে, জোয়ারে ডুবে যায় এবং দ্বীপটি হাড়িভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোতের পূর্ব দিকে অবস্থিত, যা বাংলাদেশের জলসীমার অন্তর্গত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্থলভাগের আয়তন কিছু কম দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার আর বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকার আয়তন দুই লাখ বর্গকিলোমিটার। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্থলভাগের চেয়ে জলভাগের আয়তন বেশি। শুধু তা-ই নয়, এই জলভাগে মহীসোপানের ওপরে ও সমুদ্রের অভ্যন্তরে আছে অফুরন্ত সম্পদ। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আসুন সবাই মিলে দাবি করি, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদ রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক। শুধু তা-ই নয়, পৃথক মন্ত্রণালয় জরুরি এ জন্য যে সমগ্র আদি বাখেরগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলার দ্বীপগুলো নিয়ে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চল, যা ক্রমাগত সে অঞ্চলের প্রবাহিত নদীগুলো পলি বহন করে ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
প্রতিবেদনটি পড়ে কেন চমকে উঠেছিলাম সেটা এখন বলছি। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানিয়েছেন, অতি শিগগিরই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার মধ্যে তিনটি ব্লক তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হবে। অপরদিকে ওই প্রতিবেদন পড়ে জানা গেল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, ভারত সরকার ও মিয়ানমার সরকার উভয়ই ইজারা দেওয়ার আপত্তি জানিয়েছে এই মর্মে যে ওই ব্লক তিনটি তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। এখানে দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আন্তর্জাতিক আইনগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের আইনবলে প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ভিত্তিরেখা থেকে বাংলাদেশের জলসীমা প্রকৃত পক্ষে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল বা ৬৫০ কিলোমিটার, কিন্তু অদ্যতক ওই বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করা হয়নি এবং জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত বিশেষ কমিশনে সেই মতো দাবি জানানো হয়নি, অথচ সে দাবি জানানোর নির্দিষ্ট শেষ সময় ২০১১ সালের ২৭ জুলাই এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সে জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রকাশ্য তত্পরতা জোট সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার উভয়ের আমলেই দেখা যায়নি।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এখন লক্ষ করুন, এই লেখার সঙ্গে ছাপা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মানচিত্র এবং সেটার ভেতরে ভারত ও মিয়ানমারের আগ্রাসী রেখাচিত্র। এই মানচিত্রটির ফটোকপি নেওয়া হয়েছে কমোডর মোহাম্মদ খুরশেদ আলমের লেখা বাংলাদেশ’স মেরিটাইম চ্যালেঞ্জেস ইন দ্য টোয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি নামের গবেষণামূলক বই থেকে। কমোডর আলমের অভিমত এই যে বাংলাদেশের উপকূলরেখা খিলানাকৃতি হওয়ায় ন্যায়পরতার নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী এ তিনটি দেশের জলসীমা নির্ধারণ করা সঠিক হবে। তদুপরি ঐতিহাসিক স্বত্ব অর্থাত্ জলভাগটির নাম বঙ্গোপসাগর বিবেচনায় রাখতে হবে। জলসীমা নির্ধারণে কমোডর আলমের প্রস্তাবটির সমর্থন পাওয়া যায় আরেকটি পুস্তকে, যার নাম ডেলিমিটেশন অব মেরিটাইম বাউন্ডারি। এ পুস্তকটির লেখক রাজশাহী বিশ্ববািদ্যালয়ের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান।
অধ্যাপক রহমানের অভিমত এই যে ন্যায়পরতা নীতির ভিত্তিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ নর্থ সি কন্টিনেন্টাল কেসে যে রায় দিয়েছে, তারই ভিত্তিতে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়নামারের জলসীমা নির্ধারণ করা যায়। রায়টির সংশ্লিষ্ট অংশটির বঙ্গানুবাদ এই: ‘(ক) জলসীমা নির্ধারণ করতে হবে ন্যায্যতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বোঝাপড়ার মাধ্যমে ও সব কটি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে এ মতো উদ্দেশে যেন প্রত্যেক পক্ষকে যথাসম্ভব দেওয়া যায় মহীসোপানের ওই অংশটি, যেটা পক্ষ-দেশটির মূল ভূভাগ থেকে সমুদ্র বরাবর জলের অভ্যন্তরস্থ প্রাকৃতিক বর্ধিত অংশ এবং অন্য পক্ষ দেশ বা দেশগুলোর বর্ধিত অংশের তেমন সীমানা লঙ্ঘন করে না। (খ) যদি উপরিউক্ত নীতিটি প্রয়োগে দেখা যায় যে পক্ষ-দেশগুলোর মহীসোপানের কোনো অংশ পরস্পরকে আবৃত করেছে, সে ক্ষেত্রে সে অংশটি আপসে ভাগ-বণ্টন হবে কিংবা আপস ব্যর্থ হলে সে অংশটির যৌথ মালিকানা দেওয়া হবে।’ প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, ইউরোপের মানচিত্রটি লক্ষ করুন। দেখবেন, নর্থ সি বা উত্তর সাগরকে কেন্দ্র করে আটটি দেশের অবস্থান। ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে, সেভাবে অবস্থিত দেশগুলোর নাম হচ্ছে নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য।
এখন অন্য মতটি উল্লেখ করা যাক। প্রকৌশলী ইনামুল হক বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং তিনি ওয়াটার রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ নামের এক গবেষণামূলক বইয়ের লেখক। প্রকৌশলী হকের মতটি হচ্ছে, সমদূরত্ব নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী এ তিনটি দেশের জলসীমা নির্ধারণ করা সঠিক হবে। এই মতটি আলোচনা করার আগে আমাদের জানা দরকার যে জাতিসংঘের উদ্যোগে সমুদ্র আইন সম্পর্কীয় কনভেনশন বা মতৈক্য গৃহীত এবং কার্যকর হয় ১৯৯৪ সালের ১০ নভেম্বর। প্রকৌশলী হকের অভিমত এই: উপরিউক্ত কনভেনশনের ৩ আর ১৫ ধারা অনুযায়ী পশ্চিমে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত ধরে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলরেখা থেকে সমদূরত্বে এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ছেড়া দ্বীপ ও ওয়েস্টার দ্বীপের মাঝামাঝি উপকূলরেখা ধরে সমদূরত্বে হবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং সেটা পশ্চিমের ও পূর্ব দিকের উপকূলের শেষ পয়েন্ট থেকে উপরিউক্ত রেখা দুটির দক্ষিণ বরাবর দূরত্বের ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হবে। প্রকৌশলী হকের আরও অভিমত হচ্ছে, ভারত যে অতল সমুদ্রের পূর্ব দিকে মহীসোপানের ওপর দাবি জানিয়েছে, সেটা বাংলাদেশের নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত হওয়ায় জাতিসংঘ কনভেনশনের ৭৬ ধারার লঙ্ঘন এবং মিয়ানমার যে বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণমুখী খাড়ির পশ্চিমে মহীসোপানের ওপর দাবি জানিয়েছে, সেটাও বাংলাদেশের নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত হওয়ায় একই ৭৬ ধারার লঙ্ঘন। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি ভাটায় জাগে, জোয়ারে ডুবে যায় এবং দ্বীপটি হাড়িভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোতের পূর্ব দিকে অবস্থিত, যা বাংলাদেশের জলসীমার অন্তর্গত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্থলভাগের আয়তন কিছু কম দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার আর বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকার আয়তন দুই লাখ বর্গকিলোমিটার। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্থলভাগের চেয়ে জলভাগের আয়তন বেশি। শুধু তা-ই নয়, এই জলভাগে মহীসোপানের ওপরে ও সমুদ্রের অভ্যন্তরে আছে অফুরন্ত সম্পদ। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আসুন সবাই মিলে দাবি করি, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদ রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক। শুধু তা-ই নয়, পৃথক মন্ত্রণালয় জরুরি এ জন্য যে সমগ্র আদি বাখেরগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলার দ্বীপগুলো নিয়ে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চল, যা ক্রমাগত সে অঞ্চলের প্রবাহিত নদীগুলো পলি বহন করে ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
No comments