চশমা, চটিজুতা ও ছাতা হারিয়ে কী পেলাম -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বিপুল ভোটারের অংশগ্রহণে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে আমারও অবদান রয়েছে। বলতে লজ্জা নেই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমি খুইয়েছি আমার একটি চশমা, দেড় জোড়া চটিজুতা (এক জনসভায় এক জোড়া চুরি হয়, আরেক জনসভায় মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়ে নেমে দেখি এক পাটি নেই) এবং একটি ছাতা।
একবার এক জনসভায় পূর্ববর্তী বক্তার অফুরন্ত কথা শেষ হওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ‘এই ধরনের গণতন্ত্র আমরা ছুড়ে ফেলে দিই’—বলেই উত্তেজিত অনলবর্শী বক্তা এমনভাবে বাহু উত্তোলিত বা প্রসারিত করলেন যে তাঁর হাত লেগে আমার চশমাটি ছিটকে গিয়ে পড়ল মঞ্চ থেকে ১০ হাত দূরে। এক শ্রোতা তত্ক্ষণাত্ ওটা উদ্ধার করল বটে, কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নয়। এক মতবিনিময় সভায় গণতন্ত্রের একটা বিহিত করে বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ছাতাটা নেই।
জুতা, ছাতা যা-ই হারাই না কেন, বাস্তবতা ও সত্য হলো সাধারণ সচেতন মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষার সপক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে গত পাঁচ-ছয় বছরে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, সেমিনার, মতবিনিময় অনুষ্ঠান করেছে। তাতে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ যুক্ত ছিলেন। তবে অবসরপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। তাঁদের সম্মিলিত নামকরণ সিভিল সমাজ। ভাষাজ্ঞানহীন কেউ তার বঙ্গানুবাদ করেছিল সুশীল সমাজ। গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেই নাগরিক সমাজের প্রধান চরিত্রগুলোর চারিত্রিক সংহতি অর্থাত্ তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে মানুষের সন্দেহ ছিল। সন্দেহের কারণও ছিল বটে। কোনো দিন তাঁদের কিছু ত্যাগ করতে দেখেনি কেউ। আমাদের দেশে সামরিক-বেসামরিক আমলা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি শ্রেণীর কাছে বড় থেকে বৃহত্তর চাকরিই জীবনের ধ্রুবতারা। সেদিকে তাকিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁদের জীবনের গতি। তাঁদের কাছে একটি উঁচু বেতনের চাকরি পাওয়ার যে সুখ তার কাছে ম্লান প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গী হয়ে কোনো নির্জন হ্রদে নৌবিহার করা অথবা শিল্পা শেঠীকে নিয়ে জোছনারাতে সাগরসৈকতে ঘুরে বেড়ানো কিংবা মাধুরী দীক্ষিতের মায়াবী হাসির সামনে মুখোমুখি নির্জনে বসে থাকা।
কথিত সিভিল সোসাইটির একজন মানুষ হিসেবে আমি মাঝেমধ্যে গ্লানি বোধ করি। প্রথম যৌবনে আমরা অনেকেই অর্থকষ্ট ভোগ করেছি। এক জোড়া স্যান্ডেল ও দুটোর বেশি শার্ট ছিল না। পরে যত ভালো চাকরিই করি না কেন এবং দুটো গাড়ি থাকলেও আরও বেশির জন্য প্রাণ কাঁদে। পুরোনো মডেলের টয়োটায় মন ভরে না—নিজেরও না, গিন্নি-ছেলেমেয়েদের মন তো ওঠেই না। তাই পেনশনের অনেকগুলো টাকাসহ অবসরে গিয়েও কনসালটেন্সি বা একটি চাকরির জন্য উমেদারি করি, এনজিও গড়ে তুলি। তারপর সামাজিক অবস্থান মজবুত করতে দেশকে গণতন্ত্র উপহার দেওয়ার জন্য গোলটেবিলের আয়োজন করি এবং গণতন্ত্রের সভা থেকেই একেবারে সোজা বিমানবন্দর উড়োজাহাজ যেদিকে নিয়ে যায়।
সমালোচনা হতেই পারে। তবু অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের নাগরিক সমাজের বহু দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তারা মূলধারার সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর সহযোগিতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে কাজ রাজনীতিকদের করার কথা তা করেছে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ। তারা সরকারকে চাপে রেখেছে, বিরোধী দলকেও তাদের ভুলের জন্য সমালোচনা করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক দিন থেকেই বিদেশিরা যুক্ত হয়েছে—একসময় ছিল তলে তলে, অর্থাত্ নেপথ্যে, এখন প্রকাশ্যে। বিদেশিদের আমাদের রাজনীতির অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়ার কাজটি রাজনীতিকেরাই তাঁদের স্বার্থে করেছেন, অন্য কেউ নয়। তারপর বিদেশিদের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থে বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল নাগরিক সমাজের নেতাদের। তবে বিদেশিরা নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই করে যাচ্ছে সকাল সাতটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত—সেটাও মনে করা খুবই হীনম্মন্যতা এবং সে কথা বড় বড় শিরোনাম দিয়ে প্রচার করা আরও ক্ষতিকর।
গত নির্বাচন সম্পর্কে আবদুল জলিল সাহেব লন্ডনে যা বলেছেন তা বহুকাল উদ্ধৃত হবে। তাঁর বক্তব্যের সত্যতা-অসত্যতা প্রমাণও চাট্টিখানি কাজ নয়। তবে তাঁর বক্তব্য মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষের প্রলাপ মাত্র—এ কথা যে মনে করে তারও মানসিক ভারসাম্য নিয়ে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। অন্যান্য বিষয়েও তিনি যা বলেছেন তা নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই, তা তাদের দলের নিজস্ব ব্যাপার। বিব্রত হলে দলীয় নেতৃত্ব হবেন, অন্য কেউ নয়।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার খুব একটা বাজে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সরকার হয়ে উঠেছিল উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উদার পৃষ্ঠপোষক। দুর্নীতি পেয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। ওই পরিস্থিতিতে ২০০৩-০৪ সাল থেকে সুশাসন, নির্বাচনী সংস্কার, নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি প্রভৃতি প্রশ্নে ‘রাজনৈতিক সংস্কার’-এর একটা দাবি ওঠে। সে ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে কয়েকটি সংগঠনও দাঁড়িয়ে যায়। কার কী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল তা তারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরাই ভালো বলতে পারবেন। কীভাবে যেন আমিও ওগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। দেখেছি নির্বাচনী সংস্কার ও সুশাসনের কথায় বিএনপি-জামায়াত বিরক্ত হলেও সাধারণ মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সাড়ে চার বছর অনেকের সঙ্গে আমিও বান্দরবান থেকে বাংলাবান্ধা, কক্সবাজার থেকে কুড়িগ্রাম, সুন্দরবন থেকে সুনামগঞ্জ ঘুরে বেরিয়েছি। অন্তত ৩৫টি সংগঠনের আমন্ত্রণে চার শর মতো আলোচনা সভা, গোলটেবিল, মতবিনিময়, মানববন্ধন, শোভাযাত্রা প্রভৃতিতে অংশ নিয়েছি। বিষয় একটাই: সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। একটি পর্যায়ে সেই প্রক্রিয়ায় বাধা আসে। দোষ শুধু জোট সরকারকে দেওয়া যাবে না, চৌদ্দদলীয় বিরোধী মহাজোটেরও ছিল। অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ১১ জানুয়ারি একটি প্রেরিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সেই সরকারের খোসাটি ছিল বেসামরিক কিন্তু পুরো শাঁস ও আঁটি পর্যন্ত ছিল সামরিক। হরতাল-অবরোধে ক্লান্ত জনগণ সেই সরকার আসায় সাময়িক স্বস্তি বোধ করে। তাদের দুর্নীতিবিরোধী তত্পরতাও সমর্থন করে। কিন্তু অবিলম্বেই সেই সরকারের প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের একটিমাত্র কৃতিত্ব, তা হলো একটি ভালো ভোটার তালিকা তৈরি। নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ হয়। ভোট পড়ে কিছুটা মাত্রার বেশি। তার পরও দেশে ও বিদেশে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় অপ্রত্যাশিত ছিল না। এত বেশি অর্থাত্ ২৬২ আসন ছিল অপ্রত্যাশিত। অন্যদিকে তাঁর সরকারের ওপর জনগণ বিরক্ত হলেও বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। নির্বাচনের আগের জনসভাগুলো থেকে তা বোঝা যায়। নির্বাচনের ১০-১২ দিন আগে কয়েকজন বিদেশি পর্যবেক্ষক আমাকে বলেছিলেন, সরকার গঠন না করতে পারলেও বিএনপি ভালো আসনই পাবে বলে তাঁদের ধারণা। এত কম অর্থাত্ ২৯টি আসন কাম্য ছিল না জনগণের। সে কারণেই সন্দেহ। মানুষ লক্ষ করেছে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বৈরিতামূলক এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তাঁকে পুরস্কৃত করারও একটা পাঁয়তারা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি না হলেও জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করার আয়োজন প্রায় সাঙ্গ হয়ে এসেছিল। অথচ নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বই ছিল দুবছরী অনির্বাচিত সরকারের কাজের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ। সে প্রসঙ্গেই জলিল সাহেব বলেছেন, ওই সরকারের সঙ্গে মহাজোটের নেতার একটা বোঝাপড়া হয়েছিল।
পুরো দিনটি বদলের ঘোষণা দিয়ে এই সরকার জনগণের রায় নিয়েছে। বাস্তবে দিনের একটি প্রহরের যদি পরিবর্তন ঘটাতে পারত এই সরকার তা হলেই জনগণ খুশি হতো। পুরো মেয়াদের ছয় ভাগের এক ভাগ পার করেছে সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সরকার এমন সুশান্ত ও সহানুভূতিশীল বিরোধী দল পায়নি, যা পেয়েছে বর্তমান সরকার। ১৪৯টি আসন পেলেও তারা সংসদে যেত না। বিএনপি তার মহাসচিবকে করেছে দলের মুখপাত্র—দলটি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মুখপাত্র হতে পারল না। অন্যদিকে সরকারের মুখপাত্র অসংখ্য।
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, পৃথিবীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার রয়েছে বিভিন্ন দেশে, বাংলাদেশে পেয়েছি আমরা উপদেষ্টাশাসিত সরকার। চমকের মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টারা চমক লাগানো কথাবার্তা বলছেন প্রথম রাত থেকেই, তাঁদের ও এমপিদের পুত্ররা পিলে চমকে দেওয়া শুরু করেছেন পরদিন থেকে। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডের এলাকার মানুষ শুধু নয়, কথায় কথায় চমকে উঠছে সারা দেশের মানুষ।
মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া বিরোধী দল গত ১০ মাসে সরকারকে বিব্রত করার মতো কিছু করেনি। কিন্তু মন্ত্রীদের অনেকের কথাবার্তার ভাবে সরকারের মূর্তি বিএনপির মেরুদণ্ডের মতো অনেকখানি চুর্ণ হয়ে গেছে। যাঁরা জনগণের সেবক, বিশেষ করে যাঁদের ওপর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাঁদের কথাবার্তা হবে পাথরের মতো ভারী, শিমুল তুলার মতো হালকা নয়। পিলখানার বর্বরতা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজি এত রকম পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন, তা দিয়ে একটি বই হতে পারে। বিচার কোন আইনে হবে—একেক দিন একেক কথা। বিডিআরের আটককৃত সদস্যরা শুধু ‘হার্ট অ্যাটাকে’ই মরতে লাগলেন। নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা না করে বিডিআরের নাম ও পোশাক পরিবর্তন নিয়ে যা হলো তার জবাব একসময় মানুষ চাইবে। শেষ পর্যন্ত ডিজির ঈদ কার্ড নিয়ে যা হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে অনেক ব্যাপারেই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম জিয়াকে সরকার থেকে একট বাড়ি দেওয়া হয়। হঠাত্ শোনা গেল পিলখানায় নিহত সেনা অফিসারদের পরিবারকে দুটো করে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। সে ফ্ল্যাট নির্মিত হবে, অন্য কোথাও নয়, ৬ নম্বর শহীদ মইনুল সড়কে। কালবিলম্ব না করে বেগম জিয়াকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হলো। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে—পিলখানার নিহতের পরিবার যদি দুটো ফ্ল্যাট পায় নিহত রাষ্ট্রপতির স্ত্রী দুটো বাড়ি পাবেন না কেন? তা ছাড়া সেনাবাহিনীর বহু সদস্য দেশে ও বিদেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হচ্ছেন। তাঁদের পরিবার দুটো ফ্ল্যাট পাবে না কেন? কাউকে কোনো কিছু দিয়ে ফেরত নেওয়াটা অনুচিত। কোনো ব্যাপারেই প্রতিহিংসার প্রকাশ ঘটানো আরও অনুচিত। যা হতে পারে তা হলো, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বাড়িটাড়ি যা দেওয়া হয়েছে তা শুধু বেগম জিয়াই ভোগ করবেন, তাঁর সন্তানদের তাতে কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়। যিনি দেশের জন্য ত্যাগ করেন তিনিই গুরুত্বপূর্ণ—তাঁর বংশধরেরা নয়।
হঠাত্ সংসদ থেকেই শোনা গেল, সাত বছর সেনাবাহিনীতে যেসব নিয়োগ পোস্টিং হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত হবে। প্রতিরক্ষা বিভাগ অন্য বিভাগের মতো নয়। সব জায়গা থেকে সব কথা ঘোষণা দিতে নেই। কিছু রীতি বা কনভেনশন সব রাষ্ট্র মেনে চলে। সেই রীতি ভাঙা হঠকারিতা অথবা অর্বাচীনতা। পৃথিবীর কোনো দেশে তিন বাহিনীর নেতিবাচক বিষয় সংসদে আলোচনা হয় না। সংসদীয় কমিটিতে হতে পারে।
সরকার ও তাদের কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তি বলে বেড়াচ্ছেন, ১৯৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করবেন। কোন জ্ঞানে তা বলছেন আমার মতো পিএইচডিহীন মানুষের মাথায় তা আসে না। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধিত হওয়া এক জিনিস, আর অতীতে ফিরে যাওয়া অন্য জিনিস। ওই সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ আছে। আওয়ামী লীগ কি চীন, কিউবা, ভেনেজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার পথ গ্রহণ করতে চাইছে? তা যদি চায় ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বাগত জানাব, শান্তিবাদী বারাক হোসেন ওবামা স্বাগত জানালে ঢাকার রাজপথে আনন্দ মিছিলও করতে পারি। ১৯৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমও ছিল—রাষ্ট্রে সেক্যুলারিজমের নামগন্ধ না থাকলেও। ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার বহু পথ আছে। ইউরোপের প্রত্যেক দেশেই ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক বা কনজারভেটিভ পার্টি আছে। বাংলাদেশে কেউ ইসলামিক গণতান্ত্রিক দল গঠন করতে চাইলে তা কোন যুক্তিতে বাধা দেওয়া হবে। বাধা দিলে উগ্র মৌলবাদ মাথা খাড়া করবে। ভারতেও মুসলিম লীগ রাজনীতি করছে। তা ছাড়া ১৯৭২-এর সংবিধানে রয়েছে কিছু মারাত্মক গলদ। এখন তা পুনঃপ্রবর্তন হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী।
সরকারি দলের লোকদের সংযত আচরণ করতে হয়। কে কার জন্মদিন কীভাবে পালন করবে তা তাঁর ও তাঁর ভক্তদের ব্যাপার। জন্মদিন সকালবেলা কাঙালিভোজ দিয়ে করবে, না বিকেলে কেক কেটে করবে তা তাঁর মর্জি। বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাট্রিক বা এসএসসি পাস মানুষের দুটো জন্মদিন। ড. জাকির হোসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মিডিয়ার মানুষ জানতে চেয়েছিলেন তাঁর জন্মদিন কবে। তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মেছি যখন জন্মদিন একটা নিশ্চয়ই আছে।’ বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করাটা চরম রুচিবিবর্জিত কাজ। দুই বা সোয়া দুইবার তিনি হন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। যুগ যুগ মানুষ তাঁর ‘জন্মদিন’ পালন করবে। বাঙালির ১২৪ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে জঘন্য ক্ষুদ্রতার প্রকাশ ঘটেছে বেগম জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জন্মদিন নিয়ে প্রশ্ন তোলায়। এই নোংরামিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি ধিক্কার জানাই।
সরকারের সামনে কত কাজ। সব বাদ দিয়ে হাবিজাবি ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী বলতে থাকলেন, ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের বিচার ও শাস্তি হবে। আশ্বাসের পর আশ্বাস দিচ্ছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টারা। শ্রমমন্ত্রী শাহজাহান সাহেব বলেছেন, চিহ্নিত অপরাধীদের গুলি করে মারা চমত্কার কাজ। ফরিদপুরের আরেক মন্ত্রী জনগণকে গরুচোরদের চোখ উপড়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচার বিভাগ চলছে নির্বাহী বিভাগের নির্দেশে। চিনি ব্যবসায়ীদের একটি চুলেও টান পড়ল না। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন সরকারের হাতের মুঠোয়। মানবাধিকার কমিশনকে গলা টিপে ধরা হয়েছে।
সিরাজদ্দৌলা নাটকের সিরাজের কণ্ঠে কাল্পনিক সংলাপই যেন আজ নিরেট বাস্তবতা: গোলাম হোসেন, বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা...। মিয়ানমার আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, তারা সত্ প্রতিবেশীর মতো আচরণ করছে না। আমাদের সমুদ্রসীমার মাছ তারা নিয়ে যায়। সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনে বাধা দেয়। তাদের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। এখন তারা কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশ সীমান্তে সেনা জড়ো করছে। সরকারের পক্ষ থেকে কী করা হচ্ছে আমরা জানি না।
শুধু সরকারকে দোষ দেব না। কপাল আমাদের। অসহায় জনগণ নেতৃত্বহীন। আগের সেই আত্মত্যাগী ছাত্র ও যুবসমাজ নেই। সন্ত্রাসী আছে—সংগ্রামী ছাত্রনেতা নেই। নির্বাচন-পূর্ব বিপ্লবী সাংস্কৃতিক নেতারা এখন প্রাপ্তির জন্য দেনদরবারে ব্যস্ত। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতা গণতন্ত্রের জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত ছিলেন, তাঁরা ১০ মাস ধরে জীবিত যে আছেন তা বোঝার উপায় নেই। ১০ মাসের মধ্যে একবার প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে শুধু দেখা গেছে তাঁদের তত্পরতা। সুতরাং প্রার্থনা করি: আল্লাহই বাংলাদেশকে রক্ষা করুন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
একবার এক জনসভায় পূর্ববর্তী বক্তার অফুরন্ত কথা শেষ হওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ‘এই ধরনের গণতন্ত্র আমরা ছুড়ে ফেলে দিই’—বলেই উত্তেজিত অনলবর্শী বক্তা এমনভাবে বাহু উত্তোলিত বা প্রসারিত করলেন যে তাঁর হাত লেগে আমার চশমাটি ছিটকে গিয়ে পড়ল মঞ্চ থেকে ১০ হাত দূরে। এক শ্রোতা তত্ক্ষণাত্ ওটা উদ্ধার করল বটে, কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নয়। এক মতবিনিময় সভায় গণতন্ত্রের একটা বিহিত করে বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ছাতাটা নেই।
জুতা, ছাতা যা-ই হারাই না কেন, বাস্তবতা ও সত্য হলো সাধারণ সচেতন মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষার সপক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে গত পাঁচ-ছয় বছরে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, সেমিনার, মতবিনিময় অনুষ্ঠান করেছে। তাতে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ যুক্ত ছিলেন। তবে অবসরপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। তাঁদের সম্মিলিত নামকরণ সিভিল সমাজ। ভাষাজ্ঞানহীন কেউ তার বঙ্গানুবাদ করেছিল সুশীল সমাজ। গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেই নাগরিক সমাজের প্রধান চরিত্রগুলোর চারিত্রিক সংহতি অর্থাত্ তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে মানুষের সন্দেহ ছিল। সন্দেহের কারণও ছিল বটে। কোনো দিন তাঁদের কিছু ত্যাগ করতে দেখেনি কেউ। আমাদের দেশে সামরিক-বেসামরিক আমলা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি শ্রেণীর কাছে বড় থেকে বৃহত্তর চাকরিই জীবনের ধ্রুবতারা। সেদিকে তাকিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁদের জীবনের গতি। তাঁদের কাছে একটি উঁচু বেতনের চাকরি পাওয়ার যে সুখ তার কাছে ম্লান প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গী হয়ে কোনো নির্জন হ্রদে নৌবিহার করা অথবা শিল্পা শেঠীকে নিয়ে জোছনারাতে সাগরসৈকতে ঘুরে বেড়ানো কিংবা মাধুরী দীক্ষিতের মায়াবী হাসির সামনে মুখোমুখি নির্জনে বসে থাকা।
কথিত সিভিল সোসাইটির একজন মানুষ হিসেবে আমি মাঝেমধ্যে গ্লানি বোধ করি। প্রথম যৌবনে আমরা অনেকেই অর্থকষ্ট ভোগ করেছি। এক জোড়া স্যান্ডেল ও দুটোর বেশি শার্ট ছিল না। পরে যত ভালো চাকরিই করি না কেন এবং দুটো গাড়ি থাকলেও আরও বেশির জন্য প্রাণ কাঁদে। পুরোনো মডেলের টয়োটায় মন ভরে না—নিজেরও না, গিন্নি-ছেলেমেয়েদের মন তো ওঠেই না। তাই পেনশনের অনেকগুলো টাকাসহ অবসরে গিয়েও কনসালটেন্সি বা একটি চাকরির জন্য উমেদারি করি, এনজিও গড়ে তুলি। তারপর সামাজিক অবস্থান মজবুত করতে দেশকে গণতন্ত্র উপহার দেওয়ার জন্য গোলটেবিলের আয়োজন করি এবং গণতন্ত্রের সভা থেকেই একেবারে সোজা বিমানবন্দর উড়োজাহাজ যেদিকে নিয়ে যায়।
সমালোচনা হতেই পারে। তবু অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের নাগরিক সমাজের বহু দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তারা মূলধারার সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর সহযোগিতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে কাজ রাজনীতিকদের করার কথা তা করেছে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ। তারা সরকারকে চাপে রেখেছে, বিরোধী দলকেও তাদের ভুলের জন্য সমালোচনা করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক দিন থেকেই বিদেশিরা যুক্ত হয়েছে—একসময় ছিল তলে তলে, অর্থাত্ নেপথ্যে, এখন প্রকাশ্যে। বিদেশিদের আমাদের রাজনীতির অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়ার কাজটি রাজনীতিকেরাই তাঁদের স্বার্থে করেছেন, অন্য কেউ নয়। তারপর বিদেশিদের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থে বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল নাগরিক সমাজের নেতাদের। তবে বিদেশিরা নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই করে যাচ্ছে সকাল সাতটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত—সেটাও মনে করা খুবই হীনম্মন্যতা এবং সে কথা বড় বড় শিরোনাম দিয়ে প্রচার করা আরও ক্ষতিকর।
গত নির্বাচন সম্পর্কে আবদুল জলিল সাহেব লন্ডনে যা বলেছেন তা বহুকাল উদ্ধৃত হবে। তাঁর বক্তব্যের সত্যতা-অসত্যতা প্রমাণও চাট্টিখানি কাজ নয়। তবে তাঁর বক্তব্য মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষের প্রলাপ মাত্র—এ কথা যে মনে করে তারও মানসিক ভারসাম্য নিয়ে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। অন্যান্য বিষয়েও তিনি যা বলেছেন তা নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই, তা তাদের দলের নিজস্ব ব্যাপার। বিব্রত হলে দলীয় নেতৃত্ব হবেন, অন্য কেউ নয়।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার খুব একটা বাজে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সরকার হয়ে উঠেছিল উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উদার পৃষ্ঠপোষক। দুর্নীতি পেয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। ওই পরিস্থিতিতে ২০০৩-০৪ সাল থেকে সুশাসন, নির্বাচনী সংস্কার, নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি প্রভৃতি প্রশ্নে ‘রাজনৈতিক সংস্কার’-এর একটা দাবি ওঠে। সে ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে কয়েকটি সংগঠনও দাঁড়িয়ে যায়। কার কী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল তা তারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরাই ভালো বলতে পারবেন। কীভাবে যেন আমিও ওগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। দেখেছি নির্বাচনী সংস্কার ও সুশাসনের কথায় বিএনপি-জামায়াত বিরক্ত হলেও সাধারণ মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সাড়ে চার বছর অনেকের সঙ্গে আমিও বান্দরবান থেকে বাংলাবান্ধা, কক্সবাজার থেকে কুড়িগ্রাম, সুন্দরবন থেকে সুনামগঞ্জ ঘুরে বেরিয়েছি। অন্তত ৩৫টি সংগঠনের আমন্ত্রণে চার শর মতো আলোচনা সভা, গোলটেবিল, মতবিনিময়, মানববন্ধন, শোভাযাত্রা প্রভৃতিতে অংশ নিয়েছি। বিষয় একটাই: সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। একটি পর্যায়ে সেই প্রক্রিয়ায় বাধা আসে। দোষ শুধু জোট সরকারকে দেওয়া যাবে না, চৌদ্দদলীয় বিরোধী মহাজোটেরও ছিল। অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ১১ জানুয়ারি একটি প্রেরিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সেই সরকারের খোসাটি ছিল বেসামরিক কিন্তু পুরো শাঁস ও আঁটি পর্যন্ত ছিল সামরিক। হরতাল-অবরোধে ক্লান্ত জনগণ সেই সরকার আসায় সাময়িক স্বস্তি বোধ করে। তাদের দুর্নীতিবিরোধী তত্পরতাও সমর্থন করে। কিন্তু অবিলম্বেই সেই সরকারের প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের একটিমাত্র কৃতিত্ব, তা হলো একটি ভালো ভোটার তালিকা তৈরি। নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ হয়। ভোট পড়ে কিছুটা মাত্রার বেশি। তার পরও দেশে ও বিদেশে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় অপ্রত্যাশিত ছিল না। এত বেশি অর্থাত্ ২৬২ আসন ছিল অপ্রত্যাশিত। অন্যদিকে তাঁর সরকারের ওপর জনগণ বিরক্ত হলেও বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। নির্বাচনের আগের জনসভাগুলো থেকে তা বোঝা যায়। নির্বাচনের ১০-১২ দিন আগে কয়েকজন বিদেশি পর্যবেক্ষক আমাকে বলেছিলেন, সরকার গঠন না করতে পারলেও বিএনপি ভালো আসনই পাবে বলে তাঁদের ধারণা। এত কম অর্থাত্ ২৯টি আসন কাম্য ছিল না জনগণের। সে কারণেই সন্দেহ। মানুষ লক্ষ করেছে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বৈরিতামূলক এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তাঁকে পুরস্কৃত করারও একটা পাঁয়তারা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি না হলেও জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করার আয়োজন প্রায় সাঙ্গ হয়ে এসেছিল। অথচ নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বই ছিল দুবছরী অনির্বাচিত সরকারের কাজের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ। সে প্রসঙ্গেই জলিল সাহেব বলেছেন, ওই সরকারের সঙ্গে মহাজোটের নেতার একটা বোঝাপড়া হয়েছিল।
পুরো দিনটি বদলের ঘোষণা দিয়ে এই সরকার জনগণের রায় নিয়েছে। বাস্তবে দিনের একটি প্রহরের যদি পরিবর্তন ঘটাতে পারত এই সরকার তা হলেই জনগণ খুশি হতো। পুরো মেয়াদের ছয় ভাগের এক ভাগ পার করেছে সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সরকার এমন সুশান্ত ও সহানুভূতিশীল বিরোধী দল পায়নি, যা পেয়েছে বর্তমান সরকার। ১৪৯টি আসন পেলেও তারা সংসদে যেত না। বিএনপি তার মহাসচিবকে করেছে দলের মুখপাত্র—দলটি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মুখপাত্র হতে পারল না। অন্যদিকে সরকারের মুখপাত্র অসংখ্য।
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, পৃথিবীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার রয়েছে বিভিন্ন দেশে, বাংলাদেশে পেয়েছি আমরা উপদেষ্টাশাসিত সরকার। চমকের মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টারা চমক লাগানো কথাবার্তা বলছেন প্রথম রাত থেকেই, তাঁদের ও এমপিদের পুত্ররা পিলে চমকে দেওয়া শুরু করেছেন পরদিন থেকে। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডের এলাকার মানুষ শুধু নয়, কথায় কথায় চমকে উঠছে সারা দেশের মানুষ।
মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া বিরোধী দল গত ১০ মাসে সরকারকে বিব্রত করার মতো কিছু করেনি। কিন্তু মন্ত্রীদের অনেকের কথাবার্তার ভাবে সরকারের মূর্তি বিএনপির মেরুদণ্ডের মতো অনেকখানি চুর্ণ হয়ে গেছে। যাঁরা জনগণের সেবক, বিশেষ করে যাঁদের ওপর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাঁদের কথাবার্তা হবে পাথরের মতো ভারী, শিমুল তুলার মতো হালকা নয়। পিলখানার বর্বরতা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজি এত রকম পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন, তা দিয়ে একটি বই হতে পারে। বিচার কোন আইনে হবে—একেক দিন একেক কথা। বিডিআরের আটককৃত সদস্যরা শুধু ‘হার্ট অ্যাটাকে’ই মরতে লাগলেন। নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা না করে বিডিআরের নাম ও পোশাক পরিবর্তন নিয়ে যা হলো তার জবাব একসময় মানুষ চাইবে। শেষ পর্যন্ত ডিজির ঈদ কার্ড নিয়ে যা হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে অনেক ব্যাপারেই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম জিয়াকে সরকার থেকে একট বাড়ি দেওয়া হয়। হঠাত্ শোনা গেল পিলখানায় নিহত সেনা অফিসারদের পরিবারকে দুটো করে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। সে ফ্ল্যাট নির্মিত হবে, অন্য কোথাও নয়, ৬ নম্বর শহীদ মইনুল সড়কে। কালবিলম্ব না করে বেগম জিয়াকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হলো। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে—পিলখানার নিহতের পরিবার যদি দুটো ফ্ল্যাট পায় নিহত রাষ্ট্রপতির স্ত্রী দুটো বাড়ি পাবেন না কেন? তা ছাড়া সেনাবাহিনীর বহু সদস্য দেশে ও বিদেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হচ্ছেন। তাঁদের পরিবার দুটো ফ্ল্যাট পাবে না কেন? কাউকে কোনো কিছু দিয়ে ফেরত নেওয়াটা অনুচিত। কোনো ব্যাপারেই প্রতিহিংসার প্রকাশ ঘটানো আরও অনুচিত। যা হতে পারে তা হলো, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বাড়িটাড়ি যা দেওয়া হয়েছে তা শুধু বেগম জিয়াই ভোগ করবেন, তাঁর সন্তানদের তাতে কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়। যিনি দেশের জন্য ত্যাগ করেন তিনিই গুরুত্বপূর্ণ—তাঁর বংশধরেরা নয়।
হঠাত্ সংসদ থেকেই শোনা গেল, সাত বছর সেনাবাহিনীতে যেসব নিয়োগ পোস্টিং হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত হবে। প্রতিরক্ষা বিভাগ অন্য বিভাগের মতো নয়। সব জায়গা থেকে সব কথা ঘোষণা দিতে নেই। কিছু রীতি বা কনভেনশন সব রাষ্ট্র মেনে চলে। সেই রীতি ভাঙা হঠকারিতা অথবা অর্বাচীনতা। পৃথিবীর কোনো দেশে তিন বাহিনীর নেতিবাচক বিষয় সংসদে আলোচনা হয় না। সংসদীয় কমিটিতে হতে পারে।
সরকার ও তাদের কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তি বলে বেড়াচ্ছেন, ১৯৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করবেন। কোন জ্ঞানে তা বলছেন আমার মতো পিএইচডিহীন মানুষের মাথায় তা আসে না। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধিত হওয়া এক জিনিস, আর অতীতে ফিরে যাওয়া অন্য জিনিস। ওই সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ আছে। আওয়ামী লীগ কি চীন, কিউবা, ভেনেজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার পথ গ্রহণ করতে চাইছে? তা যদি চায় ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বাগত জানাব, শান্তিবাদী বারাক হোসেন ওবামা স্বাগত জানালে ঢাকার রাজপথে আনন্দ মিছিলও করতে পারি। ১৯৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমও ছিল—রাষ্ট্রে সেক্যুলারিজমের নামগন্ধ না থাকলেও। ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার বহু পথ আছে। ইউরোপের প্রত্যেক দেশেই ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক বা কনজারভেটিভ পার্টি আছে। বাংলাদেশে কেউ ইসলামিক গণতান্ত্রিক দল গঠন করতে চাইলে তা কোন যুক্তিতে বাধা দেওয়া হবে। বাধা দিলে উগ্র মৌলবাদ মাথা খাড়া করবে। ভারতেও মুসলিম লীগ রাজনীতি করছে। তা ছাড়া ১৯৭২-এর সংবিধানে রয়েছে কিছু মারাত্মক গলদ। এখন তা পুনঃপ্রবর্তন হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী।
সরকারি দলের লোকদের সংযত আচরণ করতে হয়। কে কার জন্মদিন কীভাবে পালন করবে তা তাঁর ও তাঁর ভক্তদের ব্যাপার। জন্মদিন সকালবেলা কাঙালিভোজ দিয়ে করবে, না বিকেলে কেক কেটে করবে তা তাঁর মর্জি। বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাট্রিক বা এসএসসি পাস মানুষের দুটো জন্মদিন। ড. জাকির হোসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মিডিয়ার মানুষ জানতে চেয়েছিলেন তাঁর জন্মদিন কবে। তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মেছি যখন জন্মদিন একটা নিশ্চয়ই আছে।’ বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করাটা চরম রুচিবিবর্জিত কাজ। দুই বা সোয়া দুইবার তিনি হন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। যুগ যুগ মানুষ তাঁর ‘জন্মদিন’ পালন করবে। বাঙালির ১২৪ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে জঘন্য ক্ষুদ্রতার প্রকাশ ঘটেছে বেগম জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জন্মদিন নিয়ে প্রশ্ন তোলায়। এই নোংরামিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি ধিক্কার জানাই।
সরকারের সামনে কত কাজ। সব বাদ দিয়ে হাবিজাবি ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী বলতে থাকলেন, ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের বিচার ও শাস্তি হবে। আশ্বাসের পর আশ্বাস দিচ্ছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টারা। শ্রমমন্ত্রী শাহজাহান সাহেব বলেছেন, চিহ্নিত অপরাধীদের গুলি করে মারা চমত্কার কাজ। ফরিদপুরের আরেক মন্ত্রী জনগণকে গরুচোরদের চোখ উপড়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচার বিভাগ চলছে নির্বাহী বিভাগের নির্দেশে। চিনি ব্যবসায়ীদের একটি চুলেও টান পড়ল না। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন সরকারের হাতের মুঠোয়। মানবাধিকার কমিশনকে গলা টিপে ধরা হয়েছে।
সিরাজদ্দৌলা নাটকের সিরাজের কণ্ঠে কাল্পনিক সংলাপই যেন আজ নিরেট বাস্তবতা: গোলাম হোসেন, বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা...। মিয়ানমার আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, তারা সত্ প্রতিবেশীর মতো আচরণ করছে না। আমাদের সমুদ্রসীমার মাছ তারা নিয়ে যায়। সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনে বাধা দেয়। তাদের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। এখন তারা কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশ সীমান্তে সেনা জড়ো করছে। সরকারের পক্ষ থেকে কী করা হচ্ছে আমরা জানি না।
শুধু সরকারকে দোষ দেব না। কপাল আমাদের। অসহায় জনগণ নেতৃত্বহীন। আগের সেই আত্মত্যাগী ছাত্র ও যুবসমাজ নেই। সন্ত্রাসী আছে—সংগ্রামী ছাত্রনেতা নেই। নির্বাচন-পূর্ব বিপ্লবী সাংস্কৃতিক নেতারা এখন প্রাপ্তির জন্য দেনদরবারে ব্যস্ত। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতা গণতন্ত্রের জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত ছিলেন, তাঁরা ১০ মাস ধরে জীবিত যে আছেন তা বোঝার উপায় নেই। ১০ মাসের মধ্যে একবার প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে শুধু দেখা গেছে তাঁদের তত্পরতা। সুতরাং প্রার্থনা করি: আল্লাহই বাংলাদেশকে রক্ষা করুন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments