বাস্তুহীন হিটলার যেভাবে জার্মানির সর্বোচ্চ নেতা হলেন by মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন, হিটলারের উত্থানের পেছনে ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া এক অসম ও নিপীড়কমূলক চুক্তি। আর ওই চুক্তিই হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনে। হিটলার ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছিলেন।
চিত্রশিল্পী থেকে যোদ্ধা
অস্ট্রিয়ার ব্রাউনাউ শহরে ১৮৮৯ শহরে জন্মগ্রহণ করেন অ্যাডলফ হিটলার। তিনি হতে চেয়েছিলেন চিত্রশিল্পী। ভিয়েনার আর্ট কলেজে ভর্তি হতে দুবার আবেদন করেও ব্যর্থ হন। জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়। আশ্রয় নিয়েছিলেন বাস্তুহীনদের জন্য নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রে। আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মানুষের ছবি আঁকা।
হিটলার ১৯১৩ সালে জার্মানির মিউনিখে চলে যান। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। এ যুদ্ধে দুবার আহত হন হিটলার। কৃতিত্বের জন্য একাধিক পদকও পান। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে ‘মাস্টার্ড গ্যাসে’ আক্রান্ত হয়ে কিছু সময়ের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারান। হাসপাতালের থাকতেই জার্মানির আত্মসমর্পণের খবর শোনেন। পরে হিটলার দাবি করেন, এ খবর শুনে তিনি অনেক কেঁদেছেন। তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হন। তাঁর মনে হয়েছিল, সরকার জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
যে চুক্তির কারণে হিটলারের উত্থান
জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ও ওসমানী খেলাফতের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। পরাজিত জার্মানির ওপর বিজয়ী মিত্রশক্তি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়। চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে জার্মানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাদের সামনে দুটি বিকল্প দেওয়া হয়—হয় চুক্তিতে সই করো, না হয় জার্মানিতে আগ্রাসন মেনে নাও। বিগত কয়েক বছরের রক্তপাতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯১৯ সালের জুনে ‘ভার্সাই চুক্তি’ নামে মিত্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া শর্ত মেনে নিতে রাজি হয় জার্মানি।
কিন্তু শুরু থেকেই চুক্তির শর্তগুলো জার্মান সমাজে ক্রোধ, ঘৃণা ও বিদ্রোহের সৃষ্টি করে। ভার্সাই চুক্তিকে আরোপিত শান্তিচুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই চুক্তির অধীনে জার্মান সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়, সামরিক বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয় এবং বিপুল পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
এই চুক্তি নবগঠিত ভাইমার প্রজাতন্ত্রকে আরও চাপে ফেলে দেয়, যদিও ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তা ঠিকে ছিল। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ রবার্ট ওয়াইল্ড বলেন, ভার্সাই চুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা যে হিটলারের উত্থানে অবদান রেখেছে, তা বলা যায়।
কয়েকটি কারণে এই চুক্তির শর্তগুলো ছিল জার্মানি জন্য অবমাননাকর ও ক্ষতিকর। এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়া হয়। দেশটিকে প্রয়োজনীয় শিল্প আয় থেকে বঞ্চিত করা হয়। চুক্তির ‘ওয়ার গিল্ট ক্লজের’ মাধ্যমে যুদ্ধ শুরুর দায় জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা অনেক জার্মান অবমাননাকর মনে করেন এবং ক্ষুব্ধ হন।
চুক্তির সময় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়নি। পরে মিত্রশক্তি নিজেদের মতো করে একটি অঙ্ক চাপিয়ে দেয়। জার্মানিকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তৎকালীন সময়ে ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে বলা হয়। এই পরিমাণ অর্থ শোধ করতে না পারায় পরে তা কমিয়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়। এই ক্ষতিপূরণ চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির অর্থনীতি যাতে আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
চুক্তির কারণে জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর আকার অনেক ছোট করে ফেলতে হয়। বলে দেওয়া হয়, কোনো বিমানবাহিনী রাখা যাবে না। নৌবাহিনীর আকারও ছোট করতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীতে সর্বোচ্চ ১ লাখ সেনা রাখা যাবে।
ভার্সাই চুক্তির মারাত্মক প্রভাব পড়ে ভাইমার সরকারের ওপর। এই চুক্তিতে রাজি হওয়ার কারণে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা সরকারকে ‘নভেম্বর ক্রিমিনাল’ আখ্যা দেয় এবং এটাকে ‘পিঠে ছুরি মারা’ তথা বিশ্বাসঘাতকতা সঙ্গে সঙ্গে তুলনা করে। ভাইমার সরকারকে কোণঠাসা করতে হিটলার সভা-সমাবেশে প্রায়ই এ ভাষায় আক্রমণ করতেন।
সুবক্তা থেকে চ্যান্সেলর
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উদীয়মান রাজনৈতিক দল হিসেবে আলোচনায় আসে ‘জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’। দলটির ওপর নজরদারি করতে হিটলারকে মিউনিখে পাঠিয়েছিল সেনাবাহিনী। হিটলার দলটির কিছু সভায় অংশ নেন এবং তাদের অনেক চিন্তাভাবনার সঙ্গে একমত হন। ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি দলটিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
হিটলার সুবক্তা ছিলেন। তিনি ছোট দলটির সমর্থক বাড়াতে সাহায্য করেন। ১৯২০ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ করা হয়, যা পরে নাৎসি পার্টি নামে পরিচিতি পায়। ১৯২১ সালে নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব নেন হিটলার এবং ২৫ দফা ঘোষণা করেন। এসব দফার মধ্যে অন্যতম ছিল ভার্সাই চুক্তি বাতিল করা।
১৯২৩ সাল নাগাদ নাৎসি পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এ সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা এবং ভার্সাই চুক্তির চাপিয়ে দেওয়া শর্তের চাপ কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিল জার্মানি। হিটলার মনে করলেন, এ অবস্থায় অভ্যুত্থানের ডাক দিলে জনগণ তাতে সায় দেবে এবং সরকারের পতন ঘটাবে।
মিউনিখের একটি বিয়ার হলে ১৯২৩ সালের ৮ নভেম্বর বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যের নেতা গুস্তাভ কারের নেতৃত্বে একটি বৈঠক হচ্ছিল। হিটলারের সেখানে ঢুকে পড়েন। তাঁর প্রতি জার্মান যুদ্ধের বীর জেনারেল লুডেনডর্ফের সমর্থন ছিল এবং তাঁকে অভ্যুত্থানে সমর্থন দিতে গুস্তাভকে প্ররোচিত করেন হিটলার। এটি ‘মিউনিখ অভ্যুত্থান’ বা ‘বিয়ার হল অভ্যুত্থান’ হিসেবে পরিচিত।
পরদিন সমর্থকদের নিয়ে বার্লিনের রাস্তায় মার্চ শুরু করেন হিটলার। খবর পেয়ে পুলিশ চড়াও হলে পালিয়ে যান তিনি। ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিটলারের পাঁচ বছরের সাজা হয়। অবশ্য ৯ মাস পরেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারাগারে থাকতেই হিটলার লিখেন তাঁর আলোচিত বই ‘মাইন কাম্ফ (আমার সংগ্রাম)’।
হিটলার মুক্তি পেলেও নাৎসি পার্টি ধুঁকতে থাকে। নির্বাচনে বাজে ফল করে। দলটির চিন্তাধারা জনগণের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। এর মধ্যে ১৯২৯ সালের মহামন্দা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেয়। এতে হিটলারের সামনে সুযোগ চলে আসে। জার্মানিতে ওই সময় ছিল ৬০ লাখ বেকার। এ জন্য তিনি সরকারকে দায়ী করেন এবং ভার্সাই চুক্তি ও বিদেশি শক্তিগুলোকে দুষতে থাকেন।
নাৎসি পার্টির এই প্রচার কৌশল জনপ্রিয়তা পায়। দলটি জার্মান পার্লামেন্টে আসনও পেতে থাকে। হিটলার এই প্রচারের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তিনি একের পর সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিতে থাকেন এবং সারা দেশে সফর করেন। তিনি জার্মানির জনগণের সঙ্গে মিশতে থাকেন এবং তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা তিনি বোঝেন।
১৯৩২ সালের গ্রীষ্ম নাগাদ নাৎসি পার্টি জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে জার্মানির প্রেসিডেন্ট পল ফন হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে চ্যান্সেলরের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও তিনি হিটলারকে অতটা পছন্দ করতেন না। হিন্ডেনবার্গ এই ভেবে ভুল করেছিলেন যে হিটলারকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর হিটলারকে ক্ষমতায় দেখে তাঁর চিন্তা-ভাবনার জন্য জার্মান জনগণ শেষ পর্যন্ত তাঁকে মেনে নেবে না। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি চ্যান্সেলর হন হিটলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও একনায়ক হিটলারের পতন
চ্যান্সেলর হয়ে পার্লামেন্টে জোর করে আইন পাস করিয়ে নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করে নেন হিটলার। ১৯৩৪ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ মারা যান। এর পর থেকে চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব একাই পালন করতে শুরু করেন হিটলার। নিজেকে জার্মানির ‘ফুয়েরার বা সর্বোচ্চ নেতা’ ঘোষণা করেন। এভাবে চ্যান্সেলর থেকে একনায়ক হয়ে ওঠেন হিটলার।
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার পর হিটলার তাঁর সাম্রাজ্যবাদী খায়েশ পূরণে একের পর পদক্ষেপ নিতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে জার্মান বাহিনী। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইতালি, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা চলেছিল।
যুদ্ধের শেষ দিকে একের পর এক এলাকা থেকে জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। শেষরক্ষা হচ্ছে না বুঝতে পেরে আত্মহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন হিটলার। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল বাংকারে নিজের কপালের ডান পাশে গুলি করে আত্মহত্যা করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে স্ত্রী ইভা ব্রাউনও বিষ পান করে মৃত্যুকে বেছে নেন।
হিটলারের মৃত্যুর আট দিন পর ১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব ফ্রন্টে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে জার্মানির নাৎসি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির আনুষ্ঠানিক পরাজয় ঘটে। শেষ হয় ইতিহাসের চরম রক্তাক্ত এক অধ্যায়ের।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, ভার্সাই চুক্তিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিহিত ছিল। ওই চুক্তি সই হওয়ার সময় বিজয়ী পক্ষের কেউ কেউ চুক্তিটির সমালোচনা করেছিলেন। তাঁদের একজন অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিনস। তখন কেউ কেউ দাবি করেছিল, ওই চুক্তি কেবল কয়েক দশকের জন্য যুদ্ধটা পিছিয়ে দেবে। হিটলার চ্যান্সেলর হয়ে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যান, তাঁদের ওই ভবিষ্যদ্বাণীই ফলে যায়।
সূত্র: বিবিসি, থটকো ডটকম ও ইজে–সোশ্যাল
![]() |
নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার। ফাইল ছবি: রয়টার্স |
No comments