চার্লি চ্যাপলিনের হাসির আড়ালে এক বিশাল দুঃখগাথা by মোস্তফা হোসেন আবীর
তাকে
দেখলেই হাসি পায়। আর তার অভিনয় দেখে তো দর্শক হাসতে হাসতে খুন। ঢিলেঢালা
প্যান্ট, আঁটসাঁট কোট, ঢাউস আকারের জুতো, নাকের নিচে মধ্য বরাবর সামান্য
কাটছাঁট নকল গোঁফ, মাথায় টুপি, হাতে ছড়ি বা লাঠি- রূপটা তার এমনই। আর এই
রূপ নিয়ে তার নির্বাক দাপুটে অভিনয় তাকে জগৎজুড়ে এনে দিয়েছে আকাশছোঁয়া
খ্যাতি। তিনি চার্লি চ্যাপলিন। অভিনয় জগতের হাসির রাজা। নির্মাতা হিসেবেও
তুলনাহীন। তার অভিনীত এবং নির্মিত সিনেমাগুলো দেখতে বসলেই চোখ-কান খাড়া হয়ে
যায় যে কারো।
কখন কী ঘটাবেন তিনি, হাসির নাকি কান্নার- তা বোঝা খুব কঠিন। তার প্রায় সব সিনেমাই নির্বাক। অথচ অনেক বক্তব্য, অনেক কাহিনি তিনি প্রতিটি মুহূর্তে নির্মাণ করেছেন হরেকরকম তামাশায়। সেসব দুর্দান্ত তামাশার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের যাপিত জীবনের দুঃখবোধ, হতাশা, হাহাকার, আশা ও আনন্দের মিশ্রণ। আর যিনি চলনে-বলনে নানান তামাশায় মানুষকে হাসাতেন, কাঁদাতেন, মানুষের মনে আনন্দের খোরাক জোগাতেন অনবদ্য অভিনয় শৈলীতে; সেই মানুষটির জীবন আসলে কতটা সুখের ছিল- এমন প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। উত্তরটিও তিনিই দিয়েছেন। চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন, আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না। যে মানুষটি নিজের চোখের পানি আড়াল করে শুধু মূকাভিনয়ের মাধ্যমে অগণিত মানুষের হাসির খোরাক হয়েছেন তার জীবনটা ছিল এক বিশাল দুঃখগাথা। সত্যিকার আনন্দের হাসি জীবনে তিনি ক’বার হেসেছেন তা বোধহয় গুণে গুণে বলে দেওয়া যায়। বেচারা জীবনে এক মা ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারেননি, আর ছোট বেলাকার সেই দুঃখের ছাপ এতদিন ধরে কোটি কোটি লোককে হাসিয়েও তিনি মুছে ফেলতে পারেননি। বাইরে কোথাও দাওয়াতে গেলে অবশ্য তিনি লোকজনকে খুব হাসাতে পারতেন, কিন্তু ঘরে বসে তাকে তার বেহালার করুণ সুর ছাড়া আর কোনো সুর সাধতে কেউ দেখেনি। চার্লি চ্যাপলিন তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে নর্দমায় ভেসে যাওয়া একটা গোলাপ ফুল। তিনি আরো লিখেছেন- শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি তার শৈশবকে বয়ে বেরিয়েছেন। সেই শৈশব কেটেছে চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্টের মাঝে। খুব ছোট বয়স থেকেই তিনি নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। চ্যাপলিনের বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই তার বাবা-মা আলাদা বসবাস করা শুরু করেন। বাবা তার মাকে ত্যাগ করার পর মা কখনো সস্তা নাটকের দলে গান গেয়ে, কখনো সেলাই করে চালিয়েছেন সংসার। তারা না খেয়ে থেকেছেন বহুদিন। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চুরি করে জোগাড় করতে হয়েছে খাবার। শৈশবের সেই বঞ্চনা আর অপমানকেই যেন চার্লি মোকাবেলা করেছেন তার চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে। তিনি লিখেছেন, প্রবল বঞ্চনার ভেতর দাঁড়িয়েও কী করে পৃথিবীকে ভালোবাসতে হয়, সে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চার্লি চ্যাপলিন নিজের সিনেমাতে নিজেই অভিনয় করতেন এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সংগীত পরিচালনাও করতেন। তিনি তার প্রতিটি সিনেমায় এক একটি থিম পরিবেশন করে পেয়েছেন বিশ্বখ্যাতি। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন একজন যথার্থ সিনেমার কবি। যিনি তার কবিত্ব সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন কৌতুকের মধ্য দিয়ে। সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরার জন্য তার এই কৌতুককে মাধ্যম হিসেবে নেয়ার অন্যতম একটি কারণ হয়তো এটিও হতে পারে যে, কৌতুুকের রয়েছে একটি নিজস্ব আড়াল ক্ষমতা। কৌতুকের প্রচুর অর্থ করা যায়। আইনে সহজে আটকে না। আর যে যার মতো করে অর্থ করে নিতে পারে, করতে পারে রসাস্বাদন। এই কৌতুকপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে তিনি বরাবরই তুলে এনেছেন গভীরতম বাস্তবতার বোধ। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষের অমানবিকতা, অভাব, বিচ্ছিন্নতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিষ্ঠুরতা। সেটা জুতা চিবানো, মেশিনের ভেতর চলে যাওয়া কিংবা খাদ্যযন্ত্রের যন্ত্রণায় পরা- যাই হোক না কেন! নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিককে ঘিরে সব কিছুকেই চার্লি চ্যাপলিন দেখেছেন ব্যক্তির সীমানা ডিঙিয়ে এক গভীরতর অনুভূতি দিয়ে। তার বসতি, পথঘাট, মানুষ, সবই সেই অনুভূতির প্রতীক। তাই তার বেদনাবোধটি নিতান্ত ব্যক্তিগত হয়েও যেন ব্যক্তির উর্ধ্বে এক বৃহত্তর অনুভূতির রাজ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। আর এই অনুভূতিই চ্যাপলিনের শিল্প সৃষ্টির উৎস। সৃষ্টির এই মূল উপাদানটি চার্লি চ্যাপলিন কুড়িয়ে পেয়েছেন তার ছেলেবেলাকার দুঃসহ জীবনযাত্রার মধ্যে। এখানেই তিনি চিনেছেন দুঃখকে, দারিদ্র্যকে; রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয় ঘটেছে। আবার এই কঠিন জীবনযাত্রার মধ্যে খাঁটি সোনার মতো খাঁটি প্রাণেরও সন্ধান তিনি পেয়েছেন লাঞ্চিত মানুষের ভিতরেই। চার্লি চ্যাপলিন তার সিনেমায় এমন একজন মানুষকে দেখিয়েছেন যার নিতান্ত ছোটখাট সাধারণ কাজগুলোর মধ্যেও বেশ একটু বোকামির আভাস পাওয়া যায়। যেমন হঠাৎ চার্লির মাথা থেকে টুপি উড়ে গিয়ে যত না হাসির বিষয় হয়, তার চেয়ে বেশি হাসির বিষয় হয় উস্কোখুস্কো চুলে, কোটের মস্ত বড় কোণ উড়িয়ে সেই টুপির পেছন পেছন হন্তদন্ত হয়ে তার ছুটতে শুরু করে দেয়া। চার্লি চ্যাপলিনের অনেক ছবিতেই দেখা যায়, একটি ঘটনাতেই দর্শককে দু’বার হাসাতে চেষ্টা করেছেন তিনি। এই যেমন ‘দি এডভেঞ্চার’ ছবিতে তিনি বারান্দায় বসে চামচ দিয়ে বরফ খেতে লাগলেন আর তার নীচে হলে বসালেন একজন উচ্চবংশীয় মহিলাকে। তারপর খানিকটা বরফ চামচে থেকে পড়ে গেল তার প্যান্টে, এবং শেষে বেয়ে বেয়ে গিয়ে সেটা পড়ল সেই মহিলাটির ঘাড়ে। মহিলা তো লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে সারা। দর্শকেরা একবার হাসেন চার্লির আনাড়ীপনায়, আর একবার তার চেয়ে বেশি হাসেন মহিলাটির লম্ফ-ঝম্ফে। চার্লি চ্যাপলিনের সব ছবিতেই এমন নানা মজার ঘটনা দেখে দর্শক দারুণভাবে আনন্দিত হন। প্রতিভাধর এই মানুষটির পুরো নাম স্যার চার্লস স্পেনসার জুনিয়র। ১৮৮৯ সালের ১৬ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ লন্ডনের ওয়েলওর্থের বার্লো স্ট্রিটে জন্ম নেন বিংবদন্তি এই মূকাভিনেতা। তবে তার জন্মস্থান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বলা হয়, চার্লি চ্যাপলিন ব্রিটেনেই জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার মৃত্যর পর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। তার জন্মস্থান ফ্রান্সও হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। ২০১১ সালে উদ্ধারকৃত একটি পুরোনো চিঠিতে পাওয়া তথ্যমতে, ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডশায়ারের একটি ক্যারাভ্যানে তার জন্ম হয়। চার্লি চ্যাপলিনের বাবার নাম চার্লস চ্যাপলিন। আর মা হানা চ্যাপলিন। তারা দুজনই একাধারে মঞ্চে অভিনয় করতেন এবং পাশাপাশি গানও গাইতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই চার্লিও শিল্পমনা ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর যেতে না যেতেই চার্লির মা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মানসিকভাবে অসুস্থই ছিলেন। অভাবের তাড়নায় ও মঞ্চে অভিনয় করার আগ্রহ থেকে মাত্র আট বছর বয়সেই চার্লি চ্যাপলিন যুক্ত হন ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামক একটি যাত্রাদলের সঙ্গে, যার সদস্যরা সবাই ছিল অল্পবয়সী। মূলত এখান থেকেই তার কর্মজীবন শুরু হয় এবং প্রথম থেকেই বালক চার্লি চ্যাপলিনের মঞ্চাভিনয় দর্শক ও আয়োজকদের নজর কাড়তে শুরু করে। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি উইলিয়াম জিলেট অভিনীত ‘শার্লক হোমস’ নাটকে কাগজওয়ালা বিলির চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সুবাদে তিনি ব্রিটেনের নানা প্রদেশে ভ্রমণ করেন ও অভিনেতা হিসাবে তিনি যে খুবই সম্ভাবনাময় তা সবাইকে জানিয়ে দেন। শুরু হয় তার জীবনের নতুন ও কর্মব্যস্ত এক অধ্যায়। এরপর চার্লি চ্যাপলিন নামের এই দুঃখী বালকটিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার বয়স যখন সতেরো, তখন আমেরিকার ‘কি স্টোন মুভিজ’-এর পরিচালক ম্যাক সেনেট চ্যাপলিনকে আমেরিকায় নিয়ে আসেন। সেনেটের পরিচালনায় কৌতুক চরিত্র ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প’ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চ্যাপলিন। সেনেট চ্যাপলিনের কাজে এতই সন্তুষ্টি আর নির্ভরতা খুঁজে পান যে, তার পরবর্তী সিনেমাগুলোর প্রযোজনা ও পরিচালনার ভার নিশ্চিন্তে চ্যাপলিনের ওপর ছেড়ে দেন। হাসির গল্পের মধ্যেও কিছু একটা অর্থ ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন স্বাধীন চ্যাপলিন, যেন বলতে চান পেছনে ফেলে আসা জীবনের কষ্টের কথা। সমগ্র জীবনে তিনি আশিটিরও বেশি ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সিটি লাইটস’, ‘মডার্ন টাইমস’, ‘দ্য ব্যাংক’, ‘পুলিশ’, ‘উওম্যান’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’. ‘দ্য ভ্যাগাবন্ড’, ‘দ্য গোল্ড রাশ’ ইত্যাদি। একাধারে কাহিনি রচনা, পরিচালনা, অভিনয়- চলচ্চিত্র জগতে এই ত্রয়ী রূপ চ্যাপলিনের মধ্যেই প্রথম দেখা যায়। চার্লি চ্যাপলিনের ৭৫ বছরের দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনটি বাদে বাকি সব চলচ্চিত্রই ছিল নির্বাক। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম কথা বলেন ১৯৪০ সালে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমায়। এটি একটি রাজনৈতিক ব্যাঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র। রিল লাইফের মতো চার্লি চ্যাপলিনের রিয়েল লাইফও অনেক ঘটনাবহুল। এ অভিনেতা তখন পৃথিবী বিখ্যাত। একবার তার অনুকরণে অভিনয়ের একটি প্রতিযোগিতার অয়োজন করা হয়। গোপনে চার্লিও নাম দেন সেই প্রতিযোগিতায়। মজার বিষয় হলো প্রতিযোগিতার শেষে দেখা গেল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে অন্য দু’জন প্রতিযোগী আর চার্লি চ্যাপলিন হন তৃতীয়। আর একবার দুই দিনের জন্য জন্মভূমি ইংল্যান্ডে যান চার্লি চ্যাপলিন। আর এই সময়ের মধ্যে ঘটে যায় বিশাল ঘটনা। মাত্র দু’দিনে তার কাছে প্রায় ৭৩ হাজার চিঠি আসে। ১৯২৫ সালের ৬ই জুলাই প্রথমবারের মতো অভিনেতা হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসেন চার্লি চ্যাপলিন। চার্লির ট্রেডমার্ক চরিত্র ভবঘুরে ২৬ বছরে আবির্ভূত হয় ৭০টি পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমায়। ১৯৮৭ সালে দেড় লাখ ডলারে বিত্রিু হয় চার্লির টুপি ও ছড়ি। ব্যক্তিজীবনে চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আর এ কারণে ১৯৫২ সালে তার্কে আমেরিকা ছাড়তে হয়েছিল। এরপর সুইজারল্যান্ডে তিনি স্থায়ী হন। অবশ্য ১৯৭২ সালে আরেকবার তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন বিশেষ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের জন্য। ব্রিটেনে তাকে ‘নাইট’ উপাধি দেওয়া হয়। এছাড়া ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সংবর্ধনা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি তার কর্মকৃতীর স্বীকৃতি। ১৯৭৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ৮৮ বছর বয়সে চার্লি চ্যাপলিন সুইজারল্যান্ডে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। ১৯৭৮ সালের ৩রা মার্চ সুইজারল্যান্ডের করসিয়ার-সার- ভেভে গোরস্তান থেকে চুরি হয়ে যায় তার মৃতদেহ। অবশেষে ১৮ই মার্চ পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করে এবং পুনরায় সমাহিত করা হয় চার্লি চ্যাপলিনকে।
কখন কী ঘটাবেন তিনি, হাসির নাকি কান্নার- তা বোঝা খুব কঠিন। তার প্রায় সব সিনেমাই নির্বাক। অথচ অনেক বক্তব্য, অনেক কাহিনি তিনি প্রতিটি মুহূর্তে নির্মাণ করেছেন হরেকরকম তামাশায়। সেসব দুর্দান্ত তামাশার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের যাপিত জীবনের দুঃখবোধ, হতাশা, হাহাকার, আশা ও আনন্দের মিশ্রণ। আর যিনি চলনে-বলনে নানান তামাশায় মানুষকে হাসাতেন, কাঁদাতেন, মানুষের মনে আনন্দের খোরাক জোগাতেন অনবদ্য অভিনয় শৈলীতে; সেই মানুষটির জীবন আসলে কতটা সুখের ছিল- এমন প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। উত্তরটিও তিনিই দিয়েছেন। চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন, আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না। যে মানুষটি নিজের চোখের পানি আড়াল করে শুধু মূকাভিনয়ের মাধ্যমে অগণিত মানুষের হাসির খোরাক হয়েছেন তার জীবনটা ছিল এক বিশাল দুঃখগাথা। সত্যিকার আনন্দের হাসি জীবনে তিনি ক’বার হেসেছেন তা বোধহয় গুণে গুণে বলে দেওয়া যায়। বেচারা জীবনে এক মা ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারেননি, আর ছোট বেলাকার সেই দুঃখের ছাপ এতদিন ধরে কোটি কোটি লোককে হাসিয়েও তিনি মুছে ফেলতে পারেননি। বাইরে কোথাও দাওয়াতে গেলে অবশ্য তিনি লোকজনকে খুব হাসাতে পারতেন, কিন্তু ঘরে বসে তাকে তার বেহালার করুণ সুর ছাড়া আর কোনো সুর সাধতে কেউ দেখেনি। চার্লি চ্যাপলিন তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে নর্দমায় ভেসে যাওয়া একটা গোলাপ ফুল। তিনি আরো লিখেছেন- শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি তার শৈশবকে বয়ে বেরিয়েছেন। সেই শৈশব কেটেছে চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্টের মাঝে। খুব ছোট বয়স থেকেই তিনি নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। চ্যাপলিনের বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই তার বাবা-মা আলাদা বসবাস করা শুরু করেন। বাবা তার মাকে ত্যাগ করার পর মা কখনো সস্তা নাটকের দলে গান গেয়ে, কখনো সেলাই করে চালিয়েছেন সংসার। তারা না খেয়ে থেকেছেন বহুদিন। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চুরি করে জোগাড় করতে হয়েছে খাবার। শৈশবের সেই বঞ্চনা আর অপমানকেই যেন চার্লি মোকাবেলা করেছেন তার চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে। তিনি লিখেছেন, প্রবল বঞ্চনার ভেতর দাঁড়িয়েও কী করে পৃথিবীকে ভালোবাসতে হয়, সে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চার্লি চ্যাপলিন নিজের সিনেমাতে নিজেই অভিনয় করতেন এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সংগীত পরিচালনাও করতেন। তিনি তার প্রতিটি সিনেমায় এক একটি থিম পরিবেশন করে পেয়েছেন বিশ্বখ্যাতি। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন একজন যথার্থ সিনেমার কবি। যিনি তার কবিত্ব সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন কৌতুকের মধ্য দিয়ে। সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরার জন্য তার এই কৌতুককে মাধ্যম হিসেবে নেয়ার অন্যতম একটি কারণ হয়তো এটিও হতে পারে যে, কৌতুুকের রয়েছে একটি নিজস্ব আড়াল ক্ষমতা। কৌতুকের প্রচুর অর্থ করা যায়। আইনে সহজে আটকে না। আর যে যার মতো করে অর্থ করে নিতে পারে, করতে পারে রসাস্বাদন। এই কৌতুকপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে তিনি বরাবরই তুলে এনেছেন গভীরতম বাস্তবতার বোধ। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষের অমানবিকতা, অভাব, বিচ্ছিন্নতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিষ্ঠুরতা। সেটা জুতা চিবানো, মেশিনের ভেতর চলে যাওয়া কিংবা খাদ্যযন্ত্রের যন্ত্রণায় পরা- যাই হোক না কেন! নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিককে ঘিরে সব কিছুকেই চার্লি চ্যাপলিন দেখেছেন ব্যক্তির সীমানা ডিঙিয়ে এক গভীরতর অনুভূতি দিয়ে। তার বসতি, পথঘাট, মানুষ, সবই সেই অনুভূতির প্রতীক। তাই তার বেদনাবোধটি নিতান্ত ব্যক্তিগত হয়েও যেন ব্যক্তির উর্ধ্বে এক বৃহত্তর অনুভূতির রাজ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। আর এই অনুভূতিই চ্যাপলিনের শিল্প সৃষ্টির উৎস। সৃষ্টির এই মূল উপাদানটি চার্লি চ্যাপলিন কুড়িয়ে পেয়েছেন তার ছেলেবেলাকার দুঃসহ জীবনযাত্রার মধ্যে। এখানেই তিনি চিনেছেন দুঃখকে, দারিদ্র্যকে; রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয় ঘটেছে। আবার এই কঠিন জীবনযাত্রার মধ্যে খাঁটি সোনার মতো খাঁটি প্রাণেরও সন্ধান তিনি পেয়েছেন লাঞ্চিত মানুষের ভিতরেই। চার্লি চ্যাপলিন তার সিনেমায় এমন একজন মানুষকে দেখিয়েছেন যার নিতান্ত ছোটখাট সাধারণ কাজগুলোর মধ্যেও বেশ একটু বোকামির আভাস পাওয়া যায়। যেমন হঠাৎ চার্লির মাথা থেকে টুপি উড়ে গিয়ে যত না হাসির বিষয় হয়, তার চেয়ে বেশি হাসির বিষয় হয় উস্কোখুস্কো চুলে, কোটের মস্ত বড় কোণ উড়িয়ে সেই টুপির পেছন পেছন হন্তদন্ত হয়ে তার ছুটতে শুরু করে দেয়া। চার্লি চ্যাপলিনের অনেক ছবিতেই দেখা যায়, একটি ঘটনাতেই দর্শককে দু’বার হাসাতে চেষ্টা করেছেন তিনি। এই যেমন ‘দি এডভেঞ্চার’ ছবিতে তিনি বারান্দায় বসে চামচ দিয়ে বরফ খেতে লাগলেন আর তার নীচে হলে বসালেন একজন উচ্চবংশীয় মহিলাকে। তারপর খানিকটা বরফ চামচে থেকে পড়ে গেল তার প্যান্টে, এবং শেষে বেয়ে বেয়ে গিয়ে সেটা পড়ল সেই মহিলাটির ঘাড়ে। মহিলা তো লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে সারা। দর্শকেরা একবার হাসেন চার্লির আনাড়ীপনায়, আর একবার তার চেয়ে বেশি হাসেন মহিলাটির লম্ফ-ঝম্ফে। চার্লি চ্যাপলিনের সব ছবিতেই এমন নানা মজার ঘটনা দেখে দর্শক দারুণভাবে আনন্দিত হন। প্রতিভাধর এই মানুষটির পুরো নাম স্যার চার্লস স্পেনসার জুনিয়র। ১৮৮৯ সালের ১৬ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ লন্ডনের ওয়েলওর্থের বার্লো স্ট্রিটে জন্ম নেন বিংবদন্তি এই মূকাভিনেতা। তবে তার জন্মস্থান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বলা হয়, চার্লি চ্যাপলিন ব্রিটেনেই জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার মৃত্যর পর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। তার জন্মস্থান ফ্রান্সও হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। ২০১১ সালে উদ্ধারকৃত একটি পুরোনো চিঠিতে পাওয়া তথ্যমতে, ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডশায়ারের একটি ক্যারাভ্যানে তার জন্ম হয়। চার্লি চ্যাপলিনের বাবার নাম চার্লস চ্যাপলিন। আর মা হানা চ্যাপলিন। তারা দুজনই একাধারে মঞ্চে অভিনয় করতেন এবং পাশাপাশি গানও গাইতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই চার্লিও শিল্পমনা ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর যেতে না যেতেই চার্লির মা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মানসিকভাবে অসুস্থই ছিলেন। অভাবের তাড়নায় ও মঞ্চে অভিনয় করার আগ্রহ থেকে মাত্র আট বছর বয়সেই চার্লি চ্যাপলিন যুক্ত হন ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামক একটি যাত্রাদলের সঙ্গে, যার সদস্যরা সবাই ছিল অল্পবয়সী। মূলত এখান থেকেই তার কর্মজীবন শুরু হয় এবং প্রথম থেকেই বালক চার্লি চ্যাপলিনের মঞ্চাভিনয় দর্শক ও আয়োজকদের নজর কাড়তে শুরু করে। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি উইলিয়াম জিলেট অভিনীত ‘শার্লক হোমস’ নাটকে কাগজওয়ালা বিলির চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সুবাদে তিনি ব্রিটেনের নানা প্রদেশে ভ্রমণ করেন ও অভিনেতা হিসাবে তিনি যে খুবই সম্ভাবনাময় তা সবাইকে জানিয়ে দেন। শুরু হয় তার জীবনের নতুন ও কর্মব্যস্ত এক অধ্যায়। এরপর চার্লি চ্যাপলিন নামের এই দুঃখী বালকটিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার বয়স যখন সতেরো, তখন আমেরিকার ‘কি স্টোন মুভিজ’-এর পরিচালক ম্যাক সেনেট চ্যাপলিনকে আমেরিকায় নিয়ে আসেন। সেনেটের পরিচালনায় কৌতুক চরিত্র ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প’ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চ্যাপলিন। সেনেট চ্যাপলিনের কাজে এতই সন্তুষ্টি আর নির্ভরতা খুঁজে পান যে, তার পরবর্তী সিনেমাগুলোর প্রযোজনা ও পরিচালনার ভার নিশ্চিন্তে চ্যাপলিনের ওপর ছেড়ে দেন। হাসির গল্পের মধ্যেও কিছু একটা অর্থ ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন স্বাধীন চ্যাপলিন, যেন বলতে চান পেছনে ফেলে আসা জীবনের কষ্টের কথা। সমগ্র জীবনে তিনি আশিটিরও বেশি ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সিটি লাইটস’, ‘মডার্ন টাইমস’, ‘দ্য ব্যাংক’, ‘পুলিশ’, ‘উওম্যান’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’. ‘দ্য ভ্যাগাবন্ড’, ‘দ্য গোল্ড রাশ’ ইত্যাদি। একাধারে কাহিনি রচনা, পরিচালনা, অভিনয়- চলচ্চিত্র জগতে এই ত্রয়ী রূপ চ্যাপলিনের মধ্যেই প্রথম দেখা যায়। চার্লি চ্যাপলিনের ৭৫ বছরের দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনটি বাদে বাকি সব চলচ্চিত্রই ছিল নির্বাক। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম কথা বলেন ১৯৪০ সালে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমায়। এটি একটি রাজনৈতিক ব্যাঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র। রিল লাইফের মতো চার্লি চ্যাপলিনের রিয়েল লাইফও অনেক ঘটনাবহুল। এ অভিনেতা তখন পৃথিবী বিখ্যাত। একবার তার অনুকরণে অভিনয়ের একটি প্রতিযোগিতার অয়োজন করা হয়। গোপনে চার্লিও নাম দেন সেই প্রতিযোগিতায়। মজার বিষয় হলো প্রতিযোগিতার শেষে দেখা গেল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে অন্য দু’জন প্রতিযোগী আর চার্লি চ্যাপলিন হন তৃতীয়। আর একবার দুই দিনের জন্য জন্মভূমি ইংল্যান্ডে যান চার্লি চ্যাপলিন। আর এই সময়ের মধ্যে ঘটে যায় বিশাল ঘটনা। মাত্র দু’দিনে তার কাছে প্রায় ৭৩ হাজার চিঠি আসে। ১৯২৫ সালের ৬ই জুলাই প্রথমবারের মতো অভিনেতা হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসেন চার্লি চ্যাপলিন। চার্লির ট্রেডমার্ক চরিত্র ভবঘুরে ২৬ বছরে আবির্ভূত হয় ৭০টি পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমায়। ১৯৮৭ সালে দেড় লাখ ডলারে বিত্রিু হয় চার্লির টুপি ও ছড়ি। ব্যক্তিজীবনে চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আর এ কারণে ১৯৫২ সালে তার্কে আমেরিকা ছাড়তে হয়েছিল। এরপর সুইজারল্যান্ডে তিনি স্থায়ী হন। অবশ্য ১৯৭২ সালে আরেকবার তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন বিশেষ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের জন্য। ব্রিটেনে তাকে ‘নাইট’ উপাধি দেওয়া হয়। এছাড়া ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সংবর্ধনা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি তার কর্মকৃতীর স্বীকৃতি। ১৯৭৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ৮৮ বছর বয়সে চার্লি চ্যাপলিন সুইজারল্যান্ডে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। ১৯৭৮ সালের ৩রা মার্চ সুইজারল্যান্ডের করসিয়ার-সার- ভেভে গোরস্তান থেকে চুরি হয়ে যায় তার মৃতদেহ। অবশেষে ১৮ই মার্চ পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করে এবং পুনরায় সমাহিত করা হয় চার্লি চ্যাপলিনকে।
No comments