আমি আশিতে নবাগত by হাফিজ মুহাম্মদ
সন্ধ্যাটি
যেন তারায় তারায় পূর্ণ হয়েছিল কেন্দ্রের মিলনায়তনে। কিন্তু অসংখ্য তারার
ভিড়ে ঝলমল করছিলেন একজনই। তিনি আবদুুল্লাহ আবু সায়ীদ। যিনি অশীতিপর এক
যুবক। কথাটি কেমন বৈপরীত্যপূর্ণে ঢাকা। আসলেই তাই। তিনি আশিতে পড়েছেন।
আশিতো অতিক্রম করেননি। তবে সকল যুবকের যুবক যিনি। আশিকে যিনি শুধু একটি
বছরের মধ্যেই বেঁধে দিয়েছেন। বলেছেন, কর্মময় মানুষের কোনো বয়স থাকে না।
চল্লিশ আর আশি দু’টিই মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একটিতে মানুষ পয়গম্বর হয় অর্থাৎ পরিণতি। আর অন্যটিতে পরিণতির শেষ অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি। কিছুই বাদ যায়নি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথামালায়। তিনি বলেন, আমি আজ যেদিকে তাকাই শুধুই ছাত্রদের দেখি। মানুষ দেখি না। প্রশংসা আর স্তুতির জবাবও দিয়েছেন মধুরতম শব্দ দিয়ে। টেনে এনেছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়কে। সেইসঙ্গে সভাসদদেরও। প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, একবার মাহফুজ আনাম (সম্পাদক, ডেইলি স্টার) জেদ ধরেছেন, ওনাকে তুমি বলতে। কারণ, আমি মাহফুজ আনামের চেয়ে পাঁচবছরের বড়। বললাম, ৫০ বছর আগে দেখা হলে বলতাম, কাঁদে না বাবু, কাঁদে না। কথায় কথায় জীবন-দর্শনের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা। ২৫শে জুলাই আশিতম জন্মদিনে পা দেয়া আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার চুম্বক অংশ মানবজমিন পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো-
যে যেভাবেই প্রসংসা করুক, তা শুনতে সকলেরই ভালো লাগে। অবশ্য আমার ভালো লাগে না, বার্ধক্যের জন্য। একটি গল্প মনে পড়ছে, গোপাল ভাঁড় একদিন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বললেন, মহারাজ এই যে সভাসদবৃন্দ বসে আছেন তারা একসঙ্গে কি ভাবছেন তা আমি বলে দিতে পারি। মহারাজ ভাবলেন এটা কি করে সম্ভব? তারা সবাই একই কথা ভাবে এটা কি করে সম্ভব। সবার চিন্তা-ভাবনা আলাদা। গোপাল ভাঁড় বললেন মহারাজ আপনি কি দেখতে চান? মহারাজ বললেন দেখাও। তখন গোপাল সবাইকে বললেন এই যে সভাসদবৃন্দ, বলেন আপনারা এই মুহূর্তে ভাবছেন কি-না, ‘মহারাজ দীর্ঘজীবী হোক।’ তারপরে গোপাল বললো আমি আরেকবার বলি, মহারাজ বললেন, বলো। গোপাল বললেন, সভাসদবৃন্দ আপনারা ভাবছেন কি-না, মহারাজের একটি পুত্রসন্তান হোক। মহারাজের সন্তান ছিল না। আর হলে তো পুত্রসন্তানই হবে। ফিরে আসি নিজের কথায়।
আমার জন্মদিন আর আমি সামনে। সভাসদবৃন্দের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আর এতো ছাত্র পড়িয়েছিলাম তা বুঝিনি। আজকে দেখি ছাত্র ছাড়া মানুষ নাই এই দেশে। একবার নিজেকে একটু আলাদা করে ভাবছিলাম। কি অদ্ভুত ব্যাপার, যে একজন মানুষ বুড়ো হচ্ছে, মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে। সেই দেখার আনন্দে এতো মানুষ একসঙ্গে হয়েছে। আমাদের সবাইকে ঘিরেই জীবনে কিন্তু অনেক মানুষ আসে। আমরা যখন জন্মাই তখন অনেক মানুষ আসে। আমরা যখন বিয়ে করি তখন অনেক মানুষ আসে না! দিব্বি দিয়ে আনা হয়। বিয়ের যে দাওয়াত। এটা কিন্তু একটা শাঁখের করাত। যা আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। দাওয়াত না দিলে বলে, দাওয়াত দিলি না কেন? আবার দাওয়াত দিলে বলে খসালি তো টাকা। আমাকে একজন অশীতিপর বলছে। আসলে আমি তা নই।
কেননা অশীতিপর হতে হলে আশি পার হতে হয়। আমি তা নই। আমি আশিতে নবাগত। এবং আমি জীবনেও নবাগত। ওই আশি/নব্বই আমাকে ধরতে পারবে না। মৃত্যু তার কাজ করুক। জীবন আমার হাতে পরিপূর্ণভাবেই। আশি বছর এটা কিন্তু একটি বছর। এতদিন যে বাঁচবো তা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। কতবার যে মৃত্যুর সম্ভবনা হয়েছে, একবার দু’বার নয়। আমার মনে আছে ছোটবেলায় একবার টাইফয়েড হয়েছিল। আমাদের সময় যাদের টাইফয়েড হতো তাদের হয় একটা ঠ্যাং না হয় একটা চোখ, একটা কান অথবা দুইটা কান দিতে হতো। আমার মনে আছে টানা ৪২ দিন টাইফায়েড থাকলো।
কিন্তু আমি সেরে উঠলাম, কিছুই হয়নি। সাতদিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার আবার হলো। তখনও মারা যাইনি। এটা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। কতরকম মানুষের মৃত্যুর কারণ রয়েছে। একদিন আমি আর লেখক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ যাচ্ছি। এক লোক জিজ্ঞেস করছে আপনার রাশি কি ভাই। আমি বললাম ভাই কি মনে হয়, মেষ মনে হয়। সে বললো না। তাহলে। সিংহ মনে হয়। আমি বললাম ওই। একবার আর্মি ধরে নিয়ে গেলো যুদ্ধের সময়। আমার সামনে আরো সাতজন। এ কয়জনকেই বাদ দিলো।
ছোটবেলায় একবার নানার বাড়িতে গেছি বেড়াতে। যখন আমার বয়স পাঁচবছর। তখন হঠাৎ দেখলাম নানা ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ। এগুলোরে তাড়া এখান থেকে। তখন আমার খুব লাগলো। আমি একটি কাগজে লিখলাম, ‘আমি কোনোদিন এই বাড়িতে আসিবো না’। লিখলাম তবে অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে। আবার যেন নানার হাতে না পড়ে। সেটা একটা কাঠের চলার ডিপের নিচে রাখলাম। যাতে প্রতিবাদও জানানো হলো আবার নানাও দেখলো না। কেন এত সতর্কতা? সতর্কতার কারণ হচ্ছে নানা কলকাতা থাকেন। কলকাতা মানে চিড়িয়াখানা, কলকাতা মানে আইসক্রিম।
কলকাতা মানে গাড়ি, কলকাতা মানে শত শত দালান। আমরা থাকি গ্রামের মধ্যে। সেই কলকাতা থেকে বিতাড়িত হওয়াটা আদম-হাওয়ার মতোই অবস্থা। তবে বড় হয়ে ওই বাড়িতে একবার গেছি। গিয়ে ছাদে উঠে মনে হলো এ কি ব্যাপার। হঠাৎ স্মৃতিতে ভাসলো আমরা তো ছাদের কার্নিশ দিয়ে দৌড়াতাম। নিচে রাস্তা। আহা কেমন আরামে দৌড়াচ্ছি। তখন মরতে পারতাম। কতবার মৃতুর সম্ভাবনা জীবনের উপর দিয়ে যায়। সেটা শুধু আমার একার নয় প্রত্যেকের জীবনেই যায়। অন্তত ৩০/৪০ বার আমরা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে তারপরে আসল কবরে যাই। এটা কিন্তু খুব আশ্চর্য যে, মানুষ কি করে সারভাইব করে এই পৃথিবীতে? সেখানে আমি ৮০ বছরে পা রাখলাম। হয়তো ৮০ বছর পার করেই এসব কথা বলা উচিত ছিল। তবে সেই সুযোগ যদি না পাই তাই আগেই বলে ফেললাম। কিছুদিন আগে লন্ডনে আমার জন্মদিন পালন করছে। তখন আমি বললাম এই যে তোমরা আমার জন্মদিন পালন করছো আমি যদি ২৫ তারিখ পর্যন্ত না বাঁচি?
৪০ বছর আর ৮০ বছর জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বয়স। ৪০ বছর হচ্ছে পয়গম্বর হওয়ার বয়স। মানে ৪০ বছর হচ্ছে জীবনের পরিণতির সূচনা। ৮০ বছর হচ্ছে জীবনের পরিণতির শেষ। ৮০ বছর মানে এরপর আর নতুন কিছুই হবে না। এরপর শুধু পুনরাবৃত্তি আর পুনরাবৃত্তি। আগের ঘটনার পনরাবৃত্তি।
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আছে, ‘প্রথমদিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল, সত্তার নুতন আবির্ভাবে, কে তুমি, কিন্তু মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য প্রশ্ন করলো পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় কে তুমি? পেল না উত্তর।’ এখন এই আশি বছর হচ্ছে পেলো না উত্তর। এরপরে মানুষের জীবনে কিছু আছে বলে ধরা হয় না। তবে আমি এটাতে বিশ্বাস করি না। জর্জ বার্নার্ড শ, কী দুর্ধর্ষ মানুষ। ৯২/৯৩ বছর বয়সে বলে ফেললেন আমি মরবো না। কারণ এই বুড়ো লোকটা যখন যা বলেছে তখন তা হয়েছে। তাই পৃথিবীর ভিতরে ওলটপালট লেগে গেছে এই কথায়। সবাই ভাবতে শুরু করছে আসলে ওনি মরবেন না। ওনি মরে গেছে কিন্তু এটাই রয়ে গেছে। কেননা জীবনে যে বাঁচতে জানে না সে কিছুই পায় না। আমার নিউরোলজিস্ট দীন মোহাম্মদ সাহেব বললেন, এখন আর হবে না। এখন স্মৃতির উপরে আর চাপ দেয়া যাবে না। নোট রাখতে হবে। আমেরিকায় তো সব দেখে দেখে পড়ে। আর সেখানে আমরা যে এত সৃজন করলাম মুখে-মুখে। তার কোনো দাম নেই।
আমার আর একটা পাঁচবছরের শিশুর মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে। আমিও বেঁচে আছি, সেও বেঁচে আছে। আমাদের মধ্যে যে প্রবীণ তা নির্ধারিত হবে কে আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। আমি নিজেকে পাঁচবছরের শিশু ভাবতে এক বিন্দুও কার্পণ্য করি না। তার মানে এই নয় যে, হামাগুড়ি দেয়া শিশু। একবার মাহফুজ আনাম (সম্পাদক, ডেইলি স্টার) আর আমি। মাহফুজ আনামের বয়স ৫৫ আর আমার ৬০। মাহফুজ আনাম জেদ ধরলো তাকে তুমি বলতে হবে। আমি বললাম, যে আমার সঙ্গে যদি আপনার ৫০ বছর আগে দেখা হতো তাহলে সহজেই বলতে পারতাম। তখন কোলে নিয়ে বলতাম কাঁদে না বাবু, কাঁদে না।
তবে শেষ পর্যন্ত সেটাও আমি বলতে পারছি না। আমি একটা কবিতা বলবো। এটি চীনা কবিতা। অনুবাদটা এতই ভালো হয়েছে যে, একবার ভাবলাম ওই সংস্করণ থেকে কবির নাম বাদ দেই। সেই কবিতাটা হচ্ছে, হাওয়া বয় শনশন, তারারা কাঁপে, হৃদয়ে কি জং ধরে পুরনো খাপে (মানে বুড়োদের)। কার চুল এলোমেলে, কী বা তাতে এলোগেলো। কার চোখে কত জল, কি হবে মেপে। (এটি কি মেনে নেয়া যায়, আমি বুড়ো হয়েছি তাতে কি আমার হৃদয়ে জং ধরেছে) জেনে কী-বা প্রয়োজন অনেক দূরের বন, রাঙা হলো বহ্নিতাপে। (জেনে কি লাভ, অনেক দূরের বন রাঙা হয়েছে তা আমাদের জানতে হবে না। মৃত্যুর আগে কি জানা ছেড়ে দিবো। আমাদের জানতে হবে।)
ইকবালের একটা কবিতা দিয়ে শেষ করি। তিনটি লাইন। ‘দুর্বার তরঙ্গ এক বলে গেল তীর তীব্র বেগে।
আমি আছি যতক্ষণ আমি গতিমান। যখনই হারাই গতি, সে মুহূর্তে আমি আর নাই।’ আমার আশি হয়েছে বলে আমার গতি শেষ হয়েছে। নতুন গতি, এইবার সবচেয়ে তীব্রতম যুদ্ধ। আগে প্রকৃতি আমাকে যোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছে, এইবার প্রকৃতি নাই, আমিই যোদ্ধা। তবে সেইভাবে যেন আমাদের জীবন বাঁচে এবং শেষ হয়।
একটিতে মানুষ পয়গম্বর হয় অর্থাৎ পরিণতি। আর অন্যটিতে পরিণতির শেষ অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি। কিছুই বাদ যায়নি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথামালায়। তিনি বলেন, আমি আজ যেদিকে তাকাই শুধুই ছাত্রদের দেখি। মানুষ দেখি না। প্রশংসা আর স্তুতির জবাবও দিয়েছেন মধুরতম শব্দ দিয়ে। টেনে এনেছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়কে। সেইসঙ্গে সভাসদদেরও। প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, একবার মাহফুজ আনাম (সম্পাদক, ডেইলি স্টার) জেদ ধরেছেন, ওনাকে তুমি বলতে। কারণ, আমি মাহফুজ আনামের চেয়ে পাঁচবছরের বড়। বললাম, ৫০ বছর আগে দেখা হলে বলতাম, কাঁদে না বাবু, কাঁদে না। কথায় কথায় জীবন-দর্শনের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা। ২৫শে জুলাই আশিতম জন্মদিনে পা দেয়া আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার চুম্বক অংশ মানবজমিন পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো-
যে যেভাবেই প্রসংসা করুক, তা শুনতে সকলেরই ভালো লাগে। অবশ্য আমার ভালো লাগে না, বার্ধক্যের জন্য। একটি গল্প মনে পড়ছে, গোপাল ভাঁড় একদিন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বললেন, মহারাজ এই যে সভাসদবৃন্দ বসে আছেন তারা একসঙ্গে কি ভাবছেন তা আমি বলে দিতে পারি। মহারাজ ভাবলেন এটা কি করে সম্ভব? তারা সবাই একই কথা ভাবে এটা কি করে সম্ভব। সবার চিন্তা-ভাবনা আলাদা। গোপাল ভাঁড় বললেন মহারাজ আপনি কি দেখতে চান? মহারাজ বললেন দেখাও। তখন গোপাল সবাইকে বললেন এই যে সভাসদবৃন্দ, বলেন আপনারা এই মুহূর্তে ভাবছেন কি-না, ‘মহারাজ দীর্ঘজীবী হোক।’ তারপরে গোপাল বললো আমি আরেকবার বলি, মহারাজ বললেন, বলো। গোপাল বললেন, সভাসদবৃন্দ আপনারা ভাবছেন কি-না, মহারাজের একটি পুত্রসন্তান হোক। মহারাজের সন্তান ছিল না। আর হলে তো পুত্রসন্তানই হবে। ফিরে আসি নিজের কথায়।
আমার জন্মদিন আর আমি সামনে। সভাসদবৃন্দের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আর এতো ছাত্র পড়িয়েছিলাম তা বুঝিনি। আজকে দেখি ছাত্র ছাড়া মানুষ নাই এই দেশে। একবার নিজেকে একটু আলাদা করে ভাবছিলাম। কি অদ্ভুত ব্যাপার, যে একজন মানুষ বুড়ো হচ্ছে, মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে। সেই দেখার আনন্দে এতো মানুষ একসঙ্গে হয়েছে। আমাদের সবাইকে ঘিরেই জীবনে কিন্তু অনেক মানুষ আসে। আমরা যখন জন্মাই তখন অনেক মানুষ আসে। আমরা যখন বিয়ে করি তখন অনেক মানুষ আসে না! দিব্বি দিয়ে আনা হয়। বিয়ের যে দাওয়াত। এটা কিন্তু একটা শাঁখের করাত। যা আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। দাওয়াত না দিলে বলে, দাওয়াত দিলি না কেন? আবার দাওয়াত দিলে বলে খসালি তো টাকা। আমাকে একজন অশীতিপর বলছে। আসলে আমি তা নই।
কেননা অশীতিপর হতে হলে আশি পার হতে হয়। আমি তা নই। আমি আশিতে নবাগত। এবং আমি জীবনেও নবাগত। ওই আশি/নব্বই আমাকে ধরতে পারবে না। মৃত্যু তার কাজ করুক। জীবন আমার হাতে পরিপূর্ণভাবেই। আশি বছর এটা কিন্তু একটি বছর। এতদিন যে বাঁচবো তা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। কতবার যে মৃত্যুর সম্ভবনা হয়েছে, একবার দু’বার নয়। আমার মনে আছে ছোটবেলায় একবার টাইফয়েড হয়েছিল। আমাদের সময় যাদের টাইফয়েড হতো তাদের হয় একটা ঠ্যাং না হয় একটা চোখ, একটা কান অথবা দুইটা কান দিতে হতো। আমার মনে আছে টানা ৪২ দিন টাইফায়েড থাকলো।
কিন্তু আমি সেরে উঠলাম, কিছুই হয়নি। সাতদিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার আবার হলো। তখনও মারা যাইনি। এটা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। কতরকম মানুষের মৃত্যুর কারণ রয়েছে। একদিন আমি আর লেখক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ যাচ্ছি। এক লোক জিজ্ঞেস করছে আপনার রাশি কি ভাই। আমি বললাম ভাই কি মনে হয়, মেষ মনে হয়। সে বললো না। তাহলে। সিংহ মনে হয়। আমি বললাম ওই। একবার আর্মি ধরে নিয়ে গেলো যুদ্ধের সময়। আমার সামনে আরো সাতজন। এ কয়জনকেই বাদ দিলো।
ছোটবেলায় একবার নানার বাড়িতে গেছি বেড়াতে। যখন আমার বয়স পাঁচবছর। তখন হঠাৎ দেখলাম নানা ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ। এগুলোরে তাড়া এখান থেকে। তখন আমার খুব লাগলো। আমি একটি কাগজে লিখলাম, ‘আমি কোনোদিন এই বাড়িতে আসিবো না’। লিখলাম তবে অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে। আবার যেন নানার হাতে না পড়ে। সেটা একটা কাঠের চলার ডিপের নিচে রাখলাম। যাতে প্রতিবাদও জানানো হলো আবার নানাও দেখলো না। কেন এত সতর্কতা? সতর্কতার কারণ হচ্ছে নানা কলকাতা থাকেন। কলকাতা মানে চিড়িয়াখানা, কলকাতা মানে আইসক্রিম।
কলকাতা মানে গাড়ি, কলকাতা মানে শত শত দালান। আমরা থাকি গ্রামের মধ্যে। সেই কলকাতা থেকে বিতাড়িত হওয়াটা আদম-হাওয়ার মতোই অবস্থা। তবে বড় হয়ে ওই বাড়িতে একবার গেছি। গিয়ে ছাদে উঠে মনে হলো এ কি ব্যাপার। হঠাৎ স্মৃতিতে ভাসলো আমরা তো ছাদের কার্নিশ দিয়ে দৌড়াতাম। নিচে রাস্তা। আহা কেমন আরামে দৌড়াচ্ছি। তখন মরতে পারতাম। কতবার মৃতুর সম্ভাবনা জীবনের উপর দিয়ে যায়। সেটা শুধু আমার একার নয় প্রত্যেকের জীবনেই যায়। অন্তত ৩০/৪০ বার আমরা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে তারপরে আসল কবরে যাই। এটা কিন্তু খুব আশ্চর্য যে, মানুষ কি করে সারভাইব করে এই পৃথিবীতে? সেখানে আমি ৮০ বছরে পা রাখলাম। হয়তো ৮০ বছর পার করেই এসব কথা বলা উচিত ছিল। তবে সেই সুযোগ যদি না পাই তাই আগেই বলে ফেললাম। কিছুদিন আগে লন্ডনে আমার জন্মদিন পালন করছে। তখন আমি বললাম এই যে তোমরা আমার জন্মদিন পালন করছো আমি যদি ২৫ তারিখ পর্যন্ত না বাঁচি?
৪০ বছর আর ৮০ বছর জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বয়স। ৪০ বছর হচ্ছে পয়গম্বর হওয়ার বয়স। মানে ৪০ বছর হচ্ছে জীবনের পরিণতির সূচনা। ৮০ বছর হচ্ছে জীবনের পরিণতির শেষ। ৮০ বছর মানে এরপর আর নতুন কিছুই হবে না। এরপর শুধু পুনরাবৃত্তি আর পুনরাবৃত্তি। আগের ঘটনার পনরাবৃত্তি।
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আছে, ‘প্রথমদিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল, সত্তার নুতন আবির্ভাবে, কে তুমি, কিন্তু মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য প্রশ্ন করলো পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় কে তুমি? পেল না উত্তর।’ এখন এই আশি বছর হচ্ছে পেলো না উত্তর। এরপরে মানুষের জীবনে কিছু আছে বলে ধরা হয় না। তবে আমি এটাতে বিশ্বাস করি না। জর্জ বার্নার্ড শ, কী দুর্ধর্ষ মানুষ। ৯২/৯৩ বছর বয়সে বলে ফেললেন আমি মরবো না। কারণ এই বুড়ো লোকটা যখন যা বলেছে তখন তা হয়েছে। তাই পৃথিবীর ভিতরে ওলটপালট লেগে গেছে এই কথায়। সবাই ভাবতে শুরু করছে আসলে ওনি মরবেন না। ওনি মরে গেছে কিন্তু এটাই রয়ে গেছে। কেননা জীবনে যে বাঁচতে জানে না সে কিছুই পায় না। আমার নিউরোলজিস্ট দীন মোহাম্মদ সাহেব বললেন, এখন আর হবে না। এখন স্মৃতির উপরে আর চাপ দেয়া যাবে না। নোট রাখতে হবে। আমেরিকায় তো সব দেখে দেখে পড়ে। আর সেখানে আমরা যে এত সৃজন করলাম মুখে-মুখে। তার কোনো দাম নেই।
আমার আর একটা পাঁচবছরের শিশুর মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে। আমিও বেঁচে আছি, সেও বেঁচে আছে। আমাদের মধ্যে যে প্রবীণ তা নির্ধারিত হবে কে আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। আমি নিজেকে পাঁচবছরের শিশু ভাবতে এক বিন্দুও কার্পণ্য করি না। তার মানে এই নয় যে, হামাগুড়ি দেয়া শিশু। একবার মাহফুজ আনাম (সম্পাদক, ডেইলি স্টার) আর আমি। মাহফুজ আনামের বয়স ৫৫ আর আমার ৬০। মাহফুজ আনাম জেদ ধরলো তাকে তুমি বলতে হবে। আমি বললাম, যে আমার সঙ্গে যদি আপনার ৫০ বছর আগে দেখা হতো তাহলে সহজেই বলতে পারতাম। তখন কোলে নিয়ে বলতাম কাঁদে না বাবু, কাঁদে না।
তবে শেষ পর্যন্ত সেটাও আমি বলতে পারছি না। আমি একটা কবিতা বলবো। এটি চীনা কবিতা। অনুবাদটা এতই ভালো হয়েছে যে, একবার ভাবলাম ওই সংস্করণ থেকে কবির নাম বাদ দেই। সেই কবিতাটা হচ্ছে, হাওয়া বয় শনশন, তারারা কাঁপে, হৃদয়ে কি জং ধরে পুরনো খাপে (মানে বুড়োদের)। কার চুল এলোমেলে, কী বা তাতে এলোগেলো। কার চোখে কত জল, কি হবে মেপে। (এটি কি মেনে নেয়া যায়, আমি বুড়ো হয়েছি তাতে কি আমার হৃদয়ে জং ধরেছে) জেনে কী-বা প্রয়োজন অনেক দূরের বন, রাঙা হলো বহ্নিতাপে। (জেনে কি লাভ, অনেক দূরের বন রাঙা হয়েছে তা আমাদের জানতে হবে না। মৃত্যুর আগে কি জানা ছেড়ে দিবো। আমাদের জানতে হবে।)
ইকবালের একটা কবিতা দিয়ে শেষ করি। তিনটি লাইন। ‘দুর্বার তরঙ্গ এক বলে গেল তীর তীব্র বেগে।
আমি আছি যতক্ষণ আমি গতিমান। যখনই হারাই গতি, সে মুহূর্তে আমি আর নাই।’ আমার আশি হয়েছে বলে আমার গতি শেষ হয়েছে। নতুন গতি, এইবার সবচেয়ে তীব্রতম যুদ্ধ। আগে প্রকৃতি আমাকে যোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছে, এইবার প্রকৃতি নাই, আমিই যোদ্ধা। তবে সেইভাবে যেন আমাদের জীবন বাঁচে এবং শেষ হয়।
No comments