হত্যার পর তিন ঘাতককে ঢাকায় পাঠান কাদের
সাংসদ মনজুরুল ইসলাম ওরফে লিটনকে হত্যার জন্য সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খান তিন ঘাতককে মোট ৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। হত্যা করে ফিরে আসার পর তিনি ঘাতকদের জিলাপি খাইয়ে নিজ গাড়িতে করে বগুড়া শহরে নিয়ে যান। এরপর বাসে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সাংসদকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যাকারী মেহেদী হাসান পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন। এই জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদী কাদের খানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়া থেকে শুরু করে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ-সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাহবাজ গ্রামে সাংসদ মনজুরুল ইসলামকে ঘরে ঢুকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনায় ইতিমধ্যে চার আসামি কাদের খান, মেহেদী, শাহিন ও আনারুল ইসলাম (রানা) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদী জানিয়েছেন, কাদের খান যে দীর্ঘদিন ধরে সাংসদ মনজুরুলকে হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন, তা হত্যাকাণ্ডের সময় থাকা তিনজন ছাড়াও আরও অন্তত পাঁচজন জানতেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সহ-দপ্তর সম্পাদক চন্দন কুমার রায়, তাঁর ফুফাতো বোনের জামাই সুবল, কাদেরের একসময়কার একান্ত সহকারী শামসুজ্জোহা এবং উত্তর সমস কবিরাজটারি এলাকার জাহিদ ও সামাদ। মেহেদীর বক্তব্য অনুযায়ী, জাহিদ ও সামাদ অনেক আগে থেকেই কাদেরের সঙ্গে থাকতেন। শাহীন ও রানাকে কাদেরের কাছে নিয়ে যান জাহিদ। আর শাহীন তাঁকে কাদেরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মেহেদী এক বছর আগে ঢাকার বাসাবো এলাকায় রিকশা চালাতেন। একদিন তিনি বাড়িতে গেলে শাহীন জানান, তিনি সাবেক সাংসদ কাদেরের সঙ্গে কাজ করেন। শাহীন একদিন তাঁকেও কাদেরের বাড়িতে নিয়ে যায়। মেহেদী জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, এর কয়েক দিন পর কাদের তাঁদের আবারও ডাকেন এবং এমনভাবে পরিকল্পনা করতে বলেন, যাতে সাংসদ মনজুরুলকে হত্যার পর তাঁরা নিরাপদে বাড়িতে আসতে পারেন। এরপর একদিন সন্ধ্যাবেলা কাদের আবার তাঁদের ডাকেন। সেখানে গিয়ে চন্দন, সুবল ও আরেক ব্যক্তিকে দেখতে পান মেহেদী।
মেহেদী পুলিশকে জানান, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেরার জন্য তাঁদের একটি মোটরসাইকেল কিনে দেন কাদের খান। তবে ওই বাড়িতে তাঁদের আনাগোনার বিষয়টি আশপাশের লোকজন পছন্দ করতেন না। বিষয়টি বোঝার পর কাদের খান নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তাঁদের অস্ত্র ও গুলি দিয়ে নলডাঙ্গায় তাঁর ধান-চালের গুদামে পাঠিয়ে দেন। গুদামটি দেখাশোনা করতেন তাঁর একসময়কার এপিএস শামসুজ্জোহা। কাদের সেখানে তাঁদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন। ওই গুদামে থাকার সময় তাঁরা মাঝেমধ্যে ছিনতাই করতে বের হতেন বলে মেহেদী পুলিশকে জানিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সুন্দরগঞ্জের বড়ুয়াহাটের একজন এবং গাইবান্ধা শহরের ইন্দারপাড়ের একজনও থাকতেন। তাঁরা সুন্দরগঞ্জ এলাকায় পাঁচ-ছয়টি ছিনতাইও করেছেন। মেহেদী বলেন, একদিন কাদের খান ফোন দিয়ে তাঁদের বগুড়ায় আসতে বলেন। তাঁরা আসার পর কাদের তাঁদের মনজুরুলকে হত্যার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন। মেহেদীরা তিনজনই গাইবান্ধা শহরের একটি বোর্ডিং থেকে সুন্দরগঞ্জে সাংসদ মনজুরুলের বাড়ির আশপাশে যাতায়াত করতে থাকেন। মেহেদী বলেন, ৩০ ডিসেম্বর তাঁরা একবার লিটনের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছার পর কাদের ফোন দিয়ে ফিরে আসতে বলেন। হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে মেহেদী বলেন, মনজুরুলের বাড়িতে যাওয়ার পর শাহীন ও রানা ঘরে ঢোকেন। তাঁরা সাংসদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। মেহেদী তখন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আশপাশের পরিস্থিতি দেখেন। বাড়ির সামনে মনজুরুলের গাড়িচালক গাড়ি পরিষ্কার করে ঘরে ঢোকা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষাÿকরেন। তারপর তিনি ঘরে ঢুকলে শাহীন তাঁকে ইশারা করেন। তিনজনের কাছে তিনটি অস্ত্র থাকলেও ভালো অস্ত্রটি মেহেদীর কাছে থাকায় তিনিই গুলি করেন সাংসদকে। মেহেদী বলেন, ঘরে তখন কেউ ছিল না। প্রথম গুলিটি লক্ষভ্রষ্ট হয়ে সাংসদের হাতে লাগে। এরপর তিনি কাছ থেকে চারটি গুলি করে বের হয়ে আসেন। বেরিয়ে আসার পর আশপাশের লোকজন যাতে কাছে ঘেঁষতে না পারেন,
সে জন্য রানা ও শাহীন দুটি ফাঁকা গুলি করেন। এরপর তাঁরা মোটরসাইকেলে ওঠেন। সেখান থেকে তাঁরা নলডাঙ্গা ও ধোপাডাঙ্গা হয়ে ছাপরহাটিতে কাদেরের বাড়িতে যান। হত্যার খবর জানালে কাদের খান তাঁদের পানি ও জিলাপি খাওয়ান এবং প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা করে দেন। এরপর নিজ গাড়িতে করে বগুড়া শহরে নিয়ে যান। সেখানে হোটেল আকবরিয়ায় কাদের খান, তাঁর গাড়িচালক হান্নানসহ তাঁরা তিনজন খাওয়াদাওয়া করেন। এরপর বাসে করে তাঁদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেহেদী জানান, গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিন আগে কাদের খান তাঁদের আবারও অন্য একজনকে হত্যার জন্য ডেকে পাঠান। তাঁরা হত্যার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েও ফিরে আসেন। মেহেদীকে জিজ্ঞাসাবাদকারী একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মনজুরুলের অবস্থান সম্পর্কে চন্দন কাদেরকে তথ্য দিতেন। কিন্তু চন্দন সেই তথ্য কোথা থেকে কীভাবে পেতেন, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। চন্দন কুমার রায় এখন ভারতে পলাতক। গতকাল বিকেলে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি কলকাতায় আছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান।
No comments