মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানের সঙ্গে কখনো সমঝোতা নয়
ব্যবসার ক্ষেত্রে মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা ও পণ্যের মানের সঙ্গে কখনো সমঝোতা না করতে তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লতিফুর রহমান। তিনি মনে করেন, এসব বিষয়ের সঙ্গে সমঝোতা করা হলে তাতে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও টেকসই প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা দাঁড় করানো কঠিন। লতিফুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসায়িক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও তা এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। বড় বড় অনেক ব্যবসায়ীকে দেখি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ভালো আছেন, অনেক কিছু করছেন। তাই বলে কখনো তাঁদের দেখে প্রভাবিত হওয়া যাবে না। কারণ জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে ঠিকই কিন্তু টাকা উপার্জন যদি একমাত্র লক্ষ্য হয়, তাহলে জীবনে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়।’
বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উদ্ভাবন ও সংরক্ষণ কেন্দ্র (ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার-আইআইসি) আয়োজিত উদ্যোক্তা উন্নয়নবিষয়ক ধারাবাহিক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের অষ্টম আয়োজনে লতিফুর রহমান এসব কথা বলেন। গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেন এবং লতিফুর রহমানের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা বা এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগে দুটি শিক্ষাবৃত্তি চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এ শিক্ষাবৃত্তির অধীনে উদ্যোক্তা বিভাগের দুজন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এমনকি পাঠ্যক্রমের আওতায় ভবিষ্যতে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের প্রয়োজন হলে ট্রান্সকম গ্রুপে সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার ঘোষণা দেন লতিফুর রহমান। হলি আর্টিজানের ঘটনায় বন্ধুদের বাঁচানোর চেষ্টা করে প্রাণ দেন ফারাজ হোসেন। প্রয়াত ফারাজ ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি। অনুষ্ঠানে ফারাজের আত্মত্যাগের জন্য এক মিনিট দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন উপস্থিত হল ভর্তি শ্রোতা। লতিফুর রহমান তাঁর বক্তব্যের শুরুতেও ফারাজের কীর্তির কথা স্মরণ করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘দেশে-বিদেশে এখন অনেকে আমাকে ফারাজের নানা হিসেবে চেনে। এটা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের।’ অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা বিভাগের শিক্ষার্থীদের আঁকা ফারাজের একটি স্কেচ লতিফুর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠা, ট্রান্সকম গ্রুপের শুরু থেকে বর্তমান, ব্যবসায়িক উত্থান-পতন, দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে তিনি তুলে ধরেন হল ভর্তি তরুণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও আগত অতিথিদের সামনে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি সবুর খান অনুষ্ঠানে লতিফুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দেন প্রচারের আড়ালে থেকে সফল প্রতিষ্ঠান গড়ার একজন অনুকরণীয় উদ্যোক্তা হিসেবে। যাঁর প্রতিষ্ঠান ও পণ্য পরিচিিত মানুষের মুখে মুখে থাকলেও প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তার নামটি অনেকে জানেন না। এ সময় প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকানাধীন দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোর নামও। অনুষ্ঠান সঞ্চালক উপস্থিত শ্রোতা ও দর্শকের কাছে জানতে চান সকালে আপনারা কতজন নিয়মিত প্রথম আলো পড়েন? এ সময় অনেকে হাত তুলে তার উত্তর দেন। এরপরই সঞ্চালকের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, আপনারা কি জানেন প্রথম আলোর মালিক কে? জবাব আসে ‘না’। তখন সঞ্চালক বলেন, প্রথম আলো ট্রান্সকম গ্রুপ ও লতিফুর রহমানেরই একটি প্রতিষ্ঠান। অনুষ্ঠানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রথম আলো বন্ধুসভার একদল বন্ধু ফুলেল শুভেচ্ছা জানান লতিফুর রহমানকে। লতিফুর রহমানের মতে, দেশভেদে ব্যবসার মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও পণ্যের মান কখনো আলাদা হতে পারে না। আবার কখনো এ তিন জিনিসের সঙ্গে সমঝোতা করাও উচিত না। ব্যবসায় নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চার জন্য ২০১২ সালে অসলো বিজনেস ফর পিস পুরস্কারজয়ী লতিফুর রহমান বলেন, ব্যবসায়িক জীবনে কখনো তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ৫ টাকার ব্যাংক ঋণখেলাপিও হননি। মুনাফার জন্য মূল্যবোধকে বিসর্জন দেননি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক বাধা আছে। কিন্তু সেই বাধাকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। এ সময় তিনি ট্রান্সকম গ্রুপের শুরুর গল্পটি বলেন।
সেটি ১৯৭৩ সালের কথা। তার আগে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পারিবারিক ডব্লিউ রহমান জুট মিলটি জাতীয়করণের আওতায় চলে যায়। ওই মিলেই চাকরি দিয়ে ১৯৬৬ সালে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল লতিফুর রহমানের। মিলটি ১৯৭২ সালের মার্চে জাতীয়করণের পর স্বাচ্ছন্দ্যের আর্থিক জীবনে হঠাৎ করেই টানাপোড়েন দেখা দেয়। ১০০-২০০ টাকাও হাতে নগদ থাকত না। দমে যাননি তিনি। টিকে থাকতে হবে এই ব্রতে বলীয়ান হয়ে ভাড়া করা চেয়ার-টেবিল দিয়ে শুরু করেন ট্রান্সকমের যাত্রা। প্রথমে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এক কোম্পানির পণ্য এ দেশে বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ধীরে ধীরে কলেবর বাড়তে থাকে প্রতিষ্ঠানের। বর্তমানে খাদ্য, ওষুধ, পানীয়, ইলেকট্রনিকস, মিডিয়াসহ ট্রান্সকম গ্রুপ ৯ খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কর্মিসংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। আর বার্ষিক ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। সফল প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হলে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন লতিফুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন উদ্যোক্তা। কারণ প্রতিদিনই তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং সেটির বাস্তবায়ন করছেন। যিনি অর্থ লগ্নি করবেন, তিনিই কেবল উদ্যোক্তা এই ধারণা সঠিক নয়। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকের ভেদাভেদ করা হলে তাতে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেও মনে করেন লতিফুর রহমান। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-বিষয়ক পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে লতিফুর রহমানের জীবনবৃত্তান্ত উপস্থাপন করেন আইআইসির পরিচালক আবু তাহের খান। সমাপনী বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্য দেন সবুর খান। এ সময় তিনি লতিফুর রহমানের মতো উদ্যোক্তাদের নিয়ে গবেষণার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। সেটি করা হলে তাতে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
No comments