লোকরঞ্জনবাদ বনাম গণমাধ্যম
এটা স্মরণ করার মতো যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছে যে, একসময় লোকরঞ্জনবাদ জনপ্রিয় ছিল না। স্বাদেশিকতা কোনোভাবেই তখন রাজনীতিতে গুরত্বপূর্ণ হতো না। এমনকি অর্থনৈতিক সুরক্ষাবাদীরা নির্বাচনে জিততে পারত না। যে ভোটাররা অভিবাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাঁরা অর্থনৈতিক ও কল্যাণমূলক বিষয়ের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতেন। গণমাধ্যমও এ নিয়ে আপেক্ষিকভাবে নির্ভুল প্রতিবেদন প্রকাশ করত। যদিও আজ আমরা এক ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত নজির হচ্ছে, গত বছর ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া। ওদিকে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির রাজনীতিকেরা জাতীয়তাবাদী ও লোকরঞ্জনবাদী বাগাড়ম্বর ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাইছেন, যার মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এ কথা অবশ্যই বলতে হবে যে গণতান্ত্রিক ও প্রকৃত অর্থে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলো একই কায়দায় জাতীয়তাবাদের স্থূল ব্যবহার করে না।
চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করে নিজেদের সমর্থন সংহত করেন, যেটা পশ্চিমা রাজনীতিকেরাও করে থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁদের পথে গণতান্ত্রিক বাধা নেই। তাঁরা আর যা-ই করুন না কেন, আইনের শাসন লঙ্ঘন করতে পারেন না। সি তাঁর সমালোচকদের গারদে পুরে দেন। পুতিনের সমালোচকেরা প্রায়ই মারা পড়েন। আপনি যদি ট্রাম্পের কথা বিশ্বাস করেন, তাহলে বলবেন, রুশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কিছু জানে না। আর তারা যদি সেটা করেও থাকে, তাহলে সেটা নিন্দনীয় নয়, সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প এমনটাই বলেছেন। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ‘খুনি তো অনেক আছে। আপনি কি মনে করেন (যুক্তরাষ্ট্র) খুব একটা নির্দোষ?’ এখন যুক্তরাষ্ট্রকে নির্দোষ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে তর্ক থাকলেও এই সত্য অস্বীকারের জো নেই যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একধরনের সাংবিধানিক বন্দোবস্ত ও মূল্যবোধ ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হয়, যেটা রুশ ও চীনা প্রেসিডেন্টদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। তিনি খুনিদের ক্ষমা করতে পারেন না, সমালোচকদের মেরে ফেলা তো দূরের কথা। কথা হচ্ছে, কমরেড ট্রাম্প হয়তো এই ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করতে পারেন, কিন্তু তিনি এটা এড়িয়ে যেতে পারেন না। তবে এর মানে এই নয় যে ট্রাম্প তা করার চেষ্টা করবেন না। যখনই সম্ভব হয়েছে, ট্রাম্প বিরুদ্ধাচরণকারীদের সরিয়ে দিয়েছেন। অন্যথায়, তিনি প্রতিপক্ষকে নিরন্তর আক্রমণ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে তাঁর জারি করা নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে যখন আদালত রায় দিলেন, তখন তিনি বিচারক ও আদালতের ওপর হামলে পড়েছিলেন। ট্রাম্প গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ শুরু করেছেন। তাঁর প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন গণমাধ্যমকে ‘বিরোধী দল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন নিয়ে যেকোনো সমালোচনামূলক প্রতিবেদনকে ‘ভুয়া খবর’ হিসেবে আখ্যা দেন, এমনকি জরিপের নেতিবাচক ফল প্রকাশ করা হলেও তিনি এমনটা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের সমালোচনা করেন, এরা ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের জীব’। ট্রাম্পের মিছিলে ভক্তরা ‘দড়ি। গাছ। সাংবাদিক’ লেখা টি-শার্ট পরে অংশ নিতেন। এই মনোভাব ট্রাম্পের অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়। পোলিশ ও হাঙ্গেরীয় সরকার কর্মকর্তাদের গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছে। কর্তৃত্বপরায়ণ ও আধা কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যবস্থায় গণমাধ্যম সব সময়ই হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়, যদি তাকে নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু না-ও করা হয়। কিন্তু মার্কিন গণমাধ্যম ট্রাম্পের কাছে মাথা নত করেনি। বস্তুত অনেক প্রকাশনাই সেখানে প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের অভিভাবক হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার কথা জোর দিয়ে বলে। তারা এই বিশ্বাস ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে যে গণতন্ত্রকে স্বাস্থ্যবান ও কর্মক্ষম করতে হলে নাগরিক সংলাপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে; যার মধ্যে জ্ঞান, সত্য, ভিন্নমত ও ব্যঞ্জনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। এর মানে এই নয়, সাংবাদিকদের ব্যানন-কথিত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে। এর অর্থ হলো, সাংবাদিকদের কাজটা করে যেতে হবে। ‘বিকল্প সত্য’ প্রত্যাখ্যান করে তাঁদের সত্য খুঁজতে হবে। ঠিক যেমন ইতালীয় লেখক প্রিমো লেভিও দেখেছিলেন, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে মুসোলিনি ও অসউইচের জামানায় তাঁর মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়েছিল। তেমনি সাংবাদিকদের উচিত হবে, এই মিথ্যুক রাজনীতিকদের মোকাবিলা করতে কাজের প্রতি আগের চেয়েও বেশি নিষ্ঠাবান হওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সাংবাদিকদের মার্কিন বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ব্রেক্সিটের পর ব্রিটিশ গণমাধ্যমের বড় অংশ গণতন্ত্রকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের তোড়ে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি;
বরং অধিকাংশ ছাপা ট্যাবলয়েডসহ ব্রিটেনের অধিকতর ঐতিহ্যবাহী একটি পত্রিকা লোকরঞ্জনবাদী সংস্কার আরও জোরদার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফক্স নিউজ যা করে থাকে। এই তরিকার পত্রিকাগুলোর কাছে জনগণের ইচ্ছার মূর্ত রূপ হলো সেই ক্ষুদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার, যাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। সেই ভোট দিয়ে তাঁরা কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, সেটা ভুলে যান। সেই ৪৮ শতাংশ মানুষের কথা তারা ভুলে যান, যাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে এরা তাঁর সমালোচনা করে। ব্রিটেনের লোকরঞ্জনবাদী গণমাধ্যম যেখানে দেশটিতে সংসদীয় সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য শোরগোল করছে, তারাই আবার সেই সাংসদদের সমালোচনা করে, যাঁরা দেশটির পথপরিক্রমা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এমনকি তারা আইনের শাসন পায়ে মাড়িয়ে যায়, যা তাদের স্বাধীনতা দিত। কিন্তু তারা প্রায়ই এর অপব্যবহার করত। যখন ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আদালত জোর দিয়ে বললেন, সরকারের উচিত, আইনিভাবে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করা, তখন বিচারকদের ‘গণশত্রু’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করা হলো। সম্প্রতি ট্রাম্প মার্কিন গণমাধ্যম নিয়েও একই টুইট করেছেন। কিন্তু ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম যদি সেই মূল্যবোধগুলো অস্বীকার করে যেতে থাকে যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও স্পন্দনের ওপর জোর দিয়ে আসছে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ আগের মতো অতটা সমৃদ্ধিশালী হবে না। সেই দিন আর বেশি দূরে নয়।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ক্রিস প্যাটেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ক্রিস প্যাটেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।
No comments