‘বিচার’ হলে মাহ্ফুজ আনামের কেন? by আসিফ নজরুল

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে নিয়ে অভাবিত কর্মকাণ্ড চলছে দেশে। আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন এবং তাঁর পদত্যাগ ও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজপথে ছাত্রলীগের মিছিল হয়েছে, ছাত্রলীগ নেতাদের কর্তৃক এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত এক ডজনের বেশি মানহানির মামলা হয়েছে। সরকারের একজন আইনজীবী কর্তৃক তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের নালিশও করা হয়েছে।
মাহ্ফুজ আনামের ‘অপরাধ’ তিনি একটি স্বীকারোক্তি করেছিলেন কয়েক দিন আগে প্রচারিত একটি টিভি অনুষ্ঠানে। ২০০৭ সালের ১/১১-র সময় রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত সংবাদ তিনি যাচাই না করে ছেপেছিলেন—এ জন্য তিনি সেখানে দুঃখ প্রকাশ করেন।
তিনি যে সংবাদ ছেপেছিলেন তাতে আওয়ামী লীগের একজন নেতা কর্তৃক আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার ‘দুর্নীতি’-এর বিবরণ দেওয়া ছিল। উপরিউক্ত বিবরণ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা থেকে অন্য জাতীয় দৈনিকগুলোতেও সরবরাহ করা হয়েছিল। নূরুল কবীর সম্পাদিত নিউ এজ ছাড়া অন্য সব জাতীয় দৈনিকে এসব সংবাদ ছাপা হয়েছিল। তাঁদের কেউ এ জন্য দোষ স্বীকার করেননি, শুধু মাহ্ফুজ আনামই সেদিন প্রসঙ্গক্রমে এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। অথচ সে জন্যই তাঁকে এখন নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।
মাহ্ফুজ আনামের স্বীকারোক্তি ছিল শুধু শেখ হাসিনার তথাকথিত দুর্নীতির খবর যাচাই না করে ছাপানো নিয়ে। সেখানে প্রশ্ন হতে পারত: ১/১১-র আগে-পরে বা এখনো কি তিনি ও অন্য সম্পাদকেরা যাচাই না করে সংবাদ ছাপেন না? যেমন: ১৬৪ ধারায় বা পুলিশ-র্যা বের রিমান্ডে যেসব তথ্য স্বীকার করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রকে জানানো হয়, তা কি তাঁর পত্রিকা বা অন্য কোনো সংবাদপত্র যাচাই করে দেখে? ১/১১-র সময়ে বা এর পরে যাচাই না করে অন্য রাজনীতিবিদ বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এসব সংবাদ ছাপানোর কারণে সম্পাদকদের কি দুঃখ প্রকাশ করা উচিত? বাংলাদেশে কখনোই কি সাংবাদিকদের সবকিছু যাচাই করার মতো সৎ সাংবাদিকতার পরিবেশ ছিল বা আছে? এর দায়ই বা আসলে কার?
আলোচনায় আসতে পারত যে সংবাদ মাহ্ফুজ আনাম ছেপেছিলেন তা সৃষ্টির দায়দায়িত্ব নিয়েও। কারা আওয়ামী লীগ নেত্রীসহ অন্য রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে দুর্নীতির খবরের জন্ম দিয়েছিলেন? কারা এগুলো ছাপানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতেন? তাঁদের কোনো বিচারের আওতায় আনা উচিত কি না? উচিত হলে তা কেন করেনি সরকার গত আট বছরে? সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব আলোচনা হলে দেশের রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য তা ভালো হতো।
কিন্তু এসব আলোচনার ধারেকাছে যাওয়ার উৎসাহ দেখা গেল না ক্ষমতাসীন সরকার ও তার অনুগত মহলগুলোর মধ্যে। তারা বরং শুধু ব্যক্তি মাহ্ফুজ আনামকে অভিযুক্ত করার দিকে গেল। এবং সেটিও অনেকাংশে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে।
২.
মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে সবচেয়ে অন্যায় অভিযোগ হচ্ছে তিনি নাকি এক-এগারোর প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন। অথচ নির্জলা বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে এক-এগারো এসেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব–সংঘাত থেকে। বিএনপি সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ব্যবহার করে সাজানো একটি নির্বাচন করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ সর্বাত্মকভাবে তা প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। একপর্যায়ে সাজানো নির্বাচন হলে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ব্যাহত পারে—এমন আশঙ্কার মুখে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের চাপে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করা হয়। প্রশ্ন আসে এখানে এক-এগারো সৃষ্টির দায় কীভাবে মাহ্ফুজ আনাম বা অন্য কোনো গণমাধ্যমের হতে পারে?
এটি সত্যি যে সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা থেকে এক-এগারো সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে একে স্বাগত জানানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেত্রীও তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে নিজে সেনা-সমর্থিত এক-এগারো সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছিলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই পরিবর্তনকে সমর্থনও করা হয়েছিল। এক-এগারোর সরকারকে স্বাগত জানানো যদি এর প্রেক্ষাপট রচনা হয়ে থাকে, তাহলে এর দায়দায়িত্বও কি মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশের নয়?
এক-এগারো সরকারের দুটো সমালোচিত পদক্ষেপ ছিল ঢালাও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে বিরাজনীতিকরণ ও রাজনৈতিক সংস্কারের নামে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার চেষ্টা। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হলে প্রথমদিকে অন্য বহু মহলের মতো এটিকেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা স্বাগত জানিয়েছিলেন। এরপর একপর্যায়ে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে মাহ্ফুজ আনাম নিজে প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় লিখে তাঁর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন, দুই নেত্রীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ হয়েছিল গণমাধ্যমের আরও কিছু অংশ থেকেও।
আমরা জানি, গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সম্পাদকীয় রচনাই একটি পত্রিকার বক্তব্যকে প্রতিফলিত করে। চাপে পড়ে প্রেরিত সংবাদ ছাপানো প্রতিফলিত করে মূলত সে সময়কার সরকারের মানসিকতাকে। তারপরও শেখ হাসিনার (এবং অন্য যে কারও) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ স্পর্শকাতর বিষয় বলে অবশ্যই যাচাইহীনভাবে এটি না ছাপানোর চেষ্টা করা উচিত ছিল। কিন্তু এখানে মূল অপরাধটি ছিল দুর্নীতির খবরটি তৈরির এবং তা প্রকাশের চাপ সৃষ্টির। এটি যারা করেছিল, তাদের কারও প্রতি রুষ্ট না হয়ে (বরং তাদের কাউকে কাউকে নানাভাবে পুরস্কৃত করে) এ সংবাদ যে পত্রিকাগুলো ছেপেছিল, তার মধ্যে একটি পত্রিকার সম্পাদককে ঢালাওভাবে সমালোচনা করার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে কি?
এক-এগারোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল মাইনাস-টু ফর্মুলা। দুই নেত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলের ভেতর গণতন্ত্রায়ণ ও তৃণমূলের মতামতে দল পরিচালনা করা প্রয়োজন—এসব এক-এগারোর বহু আগে থেকে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ এমনকি কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার মুখেও শোনা যেত। এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু নেতা প্রকাশ্যে দলের সংস্কারের কর্মসূচি নিয়ে নামেন। বিএনপি নেতাদের একটি অংশ এমনকি পৃথক দলও গঠন করেন।
সংস্কারপন্থী নামে পরিচিত এসব নেতার অনেককে বিএনপির নেত্রী কখনোই ক্ষমা করেননি, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী তাঁদের প্রায় সবাইকে ক্ষমা করে দেন, অনেককে মন্ত্রিসভায়ও স্থান দেন।
রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাটি অপরাধমূলক ছিল না, তবে এর পদ্ধতিটি ছিল ভুল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্ধতিটির যাঁরা কুশীলব ছিলেন, এতে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন—অন্যায়টা তাঁদের, নাকি যাঁরা শুধু সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁদের? বিচার করতে হলে কাদের করা উচিত?
৩.
মাহ্ফুজ আনাম বিরোধিতার আরেকটি অদ্ভুত দিক হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলোর ধরন। তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির অধিকাংশ মামলা করেছেন ছাত্রলীগের নেতারা। তাঁদের দলের নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটি করা হয়েছিল এবং এটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল বহু আগে। প্রায় ১০ বছর পর কোনো সম্পাদক যদি বলেন যে এটি ঢালাওভাবে ছাপানো ঠিক হয়নি, তাতে তো বরং দুর্নীতির অভিযোগটি ভিত্তিহীন ছিল, সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়। আমাদের তথ্যমন্ত্রী এ জন্য তাঁকে প্রশংসিত করেছেন, এই স্বীকারোক্তির জন্য সেটিই তাঁর প্রাপ্য।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ঢালাও মানহানির মামলার একটি প্রচলন আমরা বর্তমান সরকারের আমলে লক্ষ করেছি। খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এ ধরনের বহু মামলার একজন বাদী পত্রিকায় নিজে স্বীকার করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ নেত্রীর চোখে পড়ার জন্য এবং ভালো একটি চাকরির জন্য তিনি এসব মামলা করেন। তারপরেই তাঁর দায়ের করা মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও দেশের বরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানান সময়ে ঢালাও অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান করা হলেও তাদের কোনো মানহানি মামলার শিকার হতে হয়নি। এই বৈষম্য কোনোভাবেই সমাজে আইনের শাসনকে প্রতিফলিত করে না।
মানহানির মতো ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার একটি রীতিও এই সরকারের আমলে গড়ে উঠেছে। এসব অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই ঠুনকো বা ভিত্তিহীন। যেমন মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে আনা সংবিধান সংশোধনীর অধীনে বিচার চাওয়া হয়েছে সংসদে, অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটি ২০০৭ সালের! সংবিধানের আলোচিত সেই সংশোধনী অনুসারে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ বা সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবমাননাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ হিসেবে বিচারের বিধান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের উত্তেজিত নেতারা ভুলে গেছেন সেই সময়ে শেখ হাসিনা সরকারের কেউ ছিলেন না, ‘সংবিধান’ সমতুল্যও ছিলেন না!
আর সরকারি কৌঁসুলির নালিশি আবেদনে মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২৪ক ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ১২৪ক ধারায় সরকারের প্রতি ঘৃণা, আনুগত্যহীনতা সৃষ্টির অপরাধের বিবরণ রয়েছে। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা সরকারের কোনো অংশ ছিলেন না। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ কী করে এবং কোন বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহ হবে?
৪.
মাহ্ফুজ আনাম ও ডেইলি স্টার-এর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর বিচ্ছিন্ন আক্রমণ নয়। এ দেশে আগেও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীন সত্তার ওপর আক্রমণ এসেছে। পত্রিকা বন্ধ করে, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দিয়ে, সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, সাংবাদিককে হত্যা করে, সংবাদ প্রচারে হস্তক্ষেপ করে এবং সম্পাদক-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গণমাধ্যমের শক্তিকে খর্ব করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব প্রবণতা বাড়ছে, বাড়ছে অপপ্রচার, হুমকি আর উসকানির মধ্যে কদর্যের মাত্রা।
কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি বা মহলের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ কে না জানে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ আর সাংবাদিকদের সন্ত্রস্ত রাখা শুধু স্বৈরাচারিতাকেই শক্তিশালী করে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.