জনগণকে আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে by ফরহাদ মজহার
যুগান্তরে
গত সপ্তাহের লেখায় এখনকার রাজনৈতিক কর্তব্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। দেখুন,
বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিতা, ২ নভেম্বর ২০১৩। একই লেখা দুই-একটি
গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পয়েন্ট আরও ব্যাখ্যা করে চিন্তাওয়েবে
(www.chintaa.com) তোলা রয়েছে ‘গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিতা : এখনকার রাজনৈতিক
কর্তব্য ও বুদ্ধিজীবিতা’ শিরোনামে। এখন রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের দিকে নজর
রেখেই লিখছি। ইতিমধ্যে আঠারো দলের হরতাল ও সমাবেশ শেষ হয়েছে। এ লেখা যখন
লিখছি, তখন বিরোধী দলের ওপর নতুন করে দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। স্থায়ী কমিটির
সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম
মিয়াকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গভীর রাতে খালেদা জিয়ার বাসা থেকে
বেরিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার হয়েছেন ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপি
চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস। বেগম জিয়ার গুলশানের বাসা ঘিরে
রেখেছে পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। অন্যদিকে শেখ হাসিনা তার ভাষা
বদলাননি। একদিকে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম আর অন্যদিকে তাদের
সংলাপে ডাকা এ এক পরাবাস্তব পরিস্থিতি। সরকারপক্ষীয় গণমাধ্যমগুলো ক্রমাগত
প্রচার করে বেড়াচ্ছে হরতালে কত ক্ষতি। মানুষের প্রাণহানির দায়দায়িত্ব তারা
একতরফা বিরোধী দলের ওপরই চাপিয়ে নিজেদের দায়দায়িত্ব থেকে খালাস পেতে চাইছে।
অথচ উচিত ছিল আইনশৃংখলা বাহিনী কোথায় কোথায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি
প্রয়োগ করে প্রাণহানি ঘটিয়েছে, নাগরিকদের আহত করেছে, আর কোথায় হরতালকারীদের
কারণে ক্ষতি হয়েছে, সেসবের সঠিক সংবাদ পরিবেশন।
এর মধ্যেও শেখ হাসিনা ভোটের দাওয়াত দিচ্ছেন, ভোট চাইছেন। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে তিনি ভোট চাইতে পারেন কিনা এই প্রশ্ন কোনো গণমাধ্যম তুলেছে দেখিনি। বলাবাহুল্য, আঠারো দলীয় জোট আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি, হরতাল তখন চলছে। রাজনৈতিক বিভাজন দেশকে নিশ্চিত সংঘাতের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এর পরিণতি কী দাঁড়াবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। তবে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক বৈধতা হারিয়েছে অনেক আগেই। এর বিপরীতে আঠারো দলীয় জোটের পক্ষে গণসমর্থনের জোর কতটুকু তা গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্বের কারণে বোঝা মুশকিল। তবে ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমর্থন যে কমেছে সেটা নানান জরিপে আগেই প্রকাশিত। উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বজায় থাকলে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপিই ক্ষমতায় আসত তাতে সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীনরা সে কারণেই সংবিধান বদলিয়েছে এবং দমন-পীড়ন এমনভাবে চালাচ্ছে যাতে বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করা সম্ভব হয়।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ইস্যুর মীমাংসা করার হিসাব আলাদা। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হতে হলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে ধারণ করতে হবে। যদি শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাখ্যান করে তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে চলে যান, তাহলে এই দাবির আর কোনোই উপযোগিতা নাই। সংলাপের রাজনীতির কফিনে শেখ হাসিনা শেষ পেরেকটি মেরে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার করে। খালেদা জিয়ার অরাজনৈতিক ব্যক্তিগত সহকারীকে গ্রেফতার করার রাজনৈতিক অর্থ সুস্পষ্ট। খালেদা জিয়া গৃহে অন্তরীণ নাকি মুক্ত এই প্রশ্ন এখন প্রধান জিজ্ঞাসা। এ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মৃত লাশের কফিন গোরস্থানে বহন করে যাওয়ার অধিক রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে না। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে জয়ী হতে হলে গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে হাজির করা দরকার। খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় জোটের সামনে এটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ধারণ করতে পারে সেই দাবি-দাওয়া কেমন হতে পারে? সে ব্যাপারে আলাদাভাবে আলোচনা জরুরি। তবে কয়েকটি বিষয় জনগণের কাছে স্পষ্ট। জনগণের প্রথম ও প্রধান গণতান্ত্রিক দাবি হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সংবলিত একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সংবিধান ও গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র। এর জন্য দরকার ইসলাম-বিদ্বেষী রাজনীতি জনগণকে যেভাবে বিভক্ত ও বিষাক্ত করেছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে জনগণের মধ্যে সেই বিভক্তির নিরসন। বিশেষ বিশেষ আত্মপরিচয়ের সামাজিক পরিমণ্ডলের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে নাগরিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো। যাতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে পরিগঠন মজবুত হতে পারে।
দুই.
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। ক্ষুদ্র দেশ চতুর্দিকে বৈরী রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকলে চরিত্রের দিক থেকে এই ব্যবস্থা গণপ্রতিরক্ষার চরিত্র পরিগ্রহণ করে বা করতে বাধ্য। এই ব্যবস্থার আরেকটি নীতি বা দর্শন হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর চর্চা। এই মৈত্রী জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি। দিল্লির আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার অর্থ ভারতের কিংবা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক জনগণের বিরোধিতা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই মৈত্রীর চর্চা জরুরি। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে পরাশক্তির নিরন্তর হস্তক্ষেপ বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান অবশ্যই জরুরি। কিন্তু দিল্লির প্রশ্ন এখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হচ্ছে দিল্লি পরিষ্কারই জানিয়ে দিয়েছে যে শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় আবার প্রত্যাবর্তন করুক, তারা তাই চায়। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম মূলত দিল্লির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই নামান্তর। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
জনগণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আকাক্সক্ষা হচ্ছে, জীবন-জীবিকা ও সামাজিক ইনসাফ নিশ্চিত করা। শ্রমিকদের ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরি নিশ্চিত করা এবং কৃষককে অবাধ বাজার ব্যবস্থার শোষণ থেকে রক্ষা করা; বিশেষত কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশের দুষ্ট ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করা প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। কৃষকের হাতে থাকা খাদ্য ও বীজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তা কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার পথ আত্মঘাতী পথ। এই পথ থেকে দ্রুত ফিরে আসতে হবে। চতুর্থ ইস্যু হচ্ছে, প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা।
এর মধ্যেও শেখ হাসিনা ভোটের দাওয়াত দিচ্ছেন, ভোট চাইছেন। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে তিনি ভোট চাইতে পারেন কিনা এই প্রশ্ন কোনো গণমাধ্যম তুলেছে দেখিনি। বলাবাহুল্য, আঠারো দলীয় জোট আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি, হরতাল তখন চলছে। রাজনৈতিক বিভাজন দেশকে নিশ্চিত সংঘাতের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এর পরিণতি কী দাঁড়াবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। তবে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক বৈধতা হারিয়েছে অনেক আগেই। এর বিপরীতে আঠারো দলীয় জোটের পক্ষে গণসমর্থনের জোর কতটুকু তা গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্বের কারণে বোঝা মুশকিল। তবে ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমর্থন যে কমেছে সেটা নানান জরিপে আগেই প্রকাশিত। উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বজায় থাকলে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপিই ক্ষমতায় আসত তাতে সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীনরা সে কারণেই সংবিধান বদলিয়েছে এবং দমন-পীড়ন এমনভাবে চালাচ্ছে যাতে বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করা সম্ভব হয়।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ইস্যুর মীমাংসা করার হিসাব আলাদা। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হতে হলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে ধারণ করতে হবে। যদি শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাখ্যান করে তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে চলে যান, তাহলে এই দাবির আর কোনোই উপযোগিতা নাই। সংলাপের রাজনীতির কফিনে শেখ হাসিনা শেষ পেরেকটি মেরে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার করে। খালেদা জিয়ার অরাজনৈতিক ব্যক্তিগত সহকারীকে গ্রেফতার করার রাজনৈতিক অর্থ সুস্পষ্ট। খালেদা জিয়া গৃহে অন্তরীণ নাকি মুক্ত এই প্রশ্ন এখন প্রধান জিজ্ঞাসা। এ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মৃত লাশের কফিন গোরস্থানে বহন করে যাওয়ার অধিক রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে না। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে জয়ী হতে হলে গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে হাজির করা দরকার। খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় জোটের সামনে এটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ধারণ করতে পারে সেই দাবি-দাওয়া কেমন হতে পারে? সে ব্যাপারে আলাদাভাবে আলোচনা জরুরি। তবে কয়েকটি বিষয় জনগণের কাছে স্পষ্ট। জনগণের প্রথম ও প্রধান গণতান্ত্রিক দাবি হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সংবলিত একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সংবিধান ও গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র। এর জন্য দরকার ইসলাম-বিদ্বেষী রাজনীতি জনগণকে যেভাবে বিভক্ত ও বিষাক্ত করেছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে জনগণের মধ্যে সেই বিভক্তির নিরসন। বিশেষ বিশেষ আত্মপরিচয়ের সামাজিক পরিমণ্ডলের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে নাগরিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো। যাতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে পরিগঠন মজবুত হতে পারে।
দুই.
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। ক্ষুদ্র দেশ চতুর্দিকে বৈরী রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকলে চরিত্রের দিক থেকে এই ব্যবস্থা গণপ্রতিরক্ষার চরিত্র পরিগ্রহণ করে বা করতে বাধ্য। এই ব্যবস্থার আরেকটি নীতি বা দর্শন হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর চর্চা। এই মৈত্রী জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি। দিল্লির আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার অর্থ ভারতের কিংবা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক জনগণের বিরোধিতা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই মৈত্রীর চর্চা জরুরি। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে পরাশক্তির নিরন্তর হস্তক্ষেপ বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান অবশ্যই জরুরি। কিন্তু দিল্লির প্রশ্ন এখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হচ্ছে দিল্লি পরিষ্কারই জানিয়ে দিয়েছে যে শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় আবার প্রত্যাবর্তন করুক, তারা তাই চায়। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম মূলত দিল্লির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই নামান্তর। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
জনগণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আকাক্সক্ষা হচ্ছে, জীবন-জীবিকা ও সামাজিক ইনসাফ নিশ্চিত করা। শ্রমিকদের ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরি নিশ্চিত করা এবং কৃষককে অবাধ বাজার ব্যবস্থার শোষণ থেকে রক্ষা করা; বিশেষত কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশের দুষ্ট ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করা প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। কৃষকের হাতে থাকা খাদ্য ও বীজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তা কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার পথ আত্মঘাতী পথ। এই পথ থেকে দ্রুত ফিরে আসতে হবে। চতুর্থ ইস্যু হচ্ছে, প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা।
পঞ্চম
দাবি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান
প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম ও মজবুত করে তোলার সঠিক অর্থনৈতিক
নীতি প্রণয়ন। এই নীতির মর্মকথা বাজার ব্যবস্থাকে অবাধ করা নয়, বরং তাকে
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃংখলার অধীনে এনে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির
অভিমুখী করা। বাজার ব্যবস্থা কায়েম অর্থনীতির উদ্দেশ্য হতে পারে না,
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের উপায় হতে পারে।
আমি মনে করি, এই পাঁচটি সংক্ষিপ্ত অথচ মৌলিক গণতান্ত্রিক দাবি লিবারেল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব। যারা ন্যূনতম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী, তাদের এই দাবিগুলো সমর্থন না করার কোনো কারণ নাই।
তিন.
আমার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে গত লেখায় কিছু ধারণা দিয়েছি। এখানে আরও দুই-একটি কথা বলব।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল জায়গাটা হচ্ছে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। আমার অবস্থান হচ্ছে, এখনকার লড়াই হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই। এ লড়াইয়ে মতাদর্শিক বিভাজনের ভেদরেখা কারা বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে আর কারা তার রূপান্তর কামনা করে তার দ্বারাই ঠিক হবে। কে ইসলামপন্থী, কে সেক্যুলার সেই তর্ক গৌণ। রাজনীতি কংক্রিট রাষ্ট্র ও বিদ্যমান ক্ষমতার চরিত্র নিয়ে জনগণের মধ্যে নানান মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, বিরোধ ও বিভাজন রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নাই। মতাদর্শের মীমাংসা রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা লড়বে ও লড়ছে তাদের ঐক্যটাই এখন দরকার। মতপার্থক্যের সুরাহার লক্ষ্যে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের গণতান্ত্রিক কর্তব্য জনগণকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া আমাদের এখনকার প্রধান কাজ। আমি বর্তমান বাস্তবতায় এই রাজনীতিকেই সঠিক মনে করি। যারা রাজনীতির এই মূল জায়গায় না গিয়ে নানা বাগাড়ম্বরে এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষে ওকালতি করে, আমি তাদের বিরোধিতা করি। গণতন্ত্রের শত্র“ গণ্য করি। লক্ষ্য করি, তারা মূল জায়গায় না থেকে অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে কূটতর্ক করে, যা বুদ্ধিজীবিতার দিক থেকে ফলপ্রসূ কোনো পরিণতি বয়ে আনে না। এ ক্ষেত্রে মতাদর্শিক বিভক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হচ্ছে ইসলাম প্রশ্ন।
বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে কথা বলা রীতিমতো বিপজ্জনক ব্যাপার। সম্ভবত বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজচিন্তা, অর্থনীতি, আইন ও ফিকাহ সম্পর্কে কারও আন্তরিক আগ্রহকে তুমুল সন্দেহ করা হয়। এমনকি আলেম-ওলামা মওলানা মুফতি না হলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কেউ যে ইসলামে আন্তরিকভাবেই আগ্রহী হতে পারেন, এটা বিশ্বাস করানো রীতিমতো কঠিন। বড়ই আজব দেশ। এ ধরনের আগ্রহ যারা পোষণ করেন তাদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ হতে হয়। নিন্দা বিদ্বেষের শিকার হতে হয়। আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। তবে সন্দেহ নাই, ইতিহাস ও দর্শনের একনিষ্ঠ ছাত্র হওয়ার কারণে ইসলাম আমার বিপুল বিস্ময় ও আগ্রহের বিষয়। একইভাবে ইহুদি-খ্রিস্টীয় ধর্ম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার গ্রিক-খ্রিস্টীয় ভিত্তি এবং উপমহাদেশের এ অঞ্চলের সনাতন বা লোকায়ত ধর্ম ও ধর্মচর্চার ভাব ও ইতিহাসকে আমি আমার কল্পনা, মনন, ঐতিহ্য ও ভাবচর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করি। এর মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম যেমন আছে, একইভাবে আছে বাংলার কবি, সাধক ও ভাবুকদের বিশাল ভাণ্ডার। যারা আমার কবিতা ও এ ক্ষেত্রে আমার কাজ সম্পর্কে অবহিত তারা তা জানেন। এ ব্যাপারে নিজের ঢাক নিজে পেটানোর ইচ্ছা বিশেষ নাই।
ইসলামের ইতিহাস ও দর্শনই শুধু আমার আগ্রহের বিষয় নয়, ইসলামপন্থা বা ইসলামী রাজনীতির নানান চরিত্র ও বয়ান, তাদের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক অভিমুখ এবং ইসলামী রাজনীতির সীমা ও সম্ভাবনা সম্পর্কেও আমি বিপুল আগ্রহী। বিশ্ব ইতিহাস পৃথিবীর একটি বৃহত্তম ধর্মকে বাদ দিয়ে যেমন কল্পনা করা অসম্ভব, তেমনি আমি মনে করি উপমহাদেশে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ইসলামকে বিচার না করলে তার পরিণতি এই উপমহাদেশের জন্য কখনোই কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। বাংলাদেশ তো দূরের কথা। এই কথাগুলো আমি কমপক্ষে গত ২৫ বছর ধরেই বলছি। দুই হাজার এক সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পর কথাগুলো ইতিহাস ও বাস্তবতার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এর পরেও যারা ইসলাম নিয়ে কথা বলি বলে আমাকে নিন্দা করেন, তাদের মধ্যে ইসলাম-বিদ্বেষ প্রকট ও প্রবল। যারা তুলনামূলক ভাবে সহনশীল, এই অসুখ নাই, তাদের গোড়ার মুশকিল হচ্ছে মুসলমান ও ইসলামকে তারা সমার্থক গণ্য করেন। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বাংলাদেশে অবশ্যই আছে এবং তারা অনেক সময় সঙ্গত কারণেই উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন বোধ করেন। আমিও করি। তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য হচ্ছে, অসম অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার ভারসাম্যহীন বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলমানরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়বেই। এটাই বাস্তবতা। যেহেতু এই স্বার্থ রক্ষার দায় সমষ্টিগতভাবে মুসলমানরা বোধ করেন, অতএব অধিকাংশ সময় তাদের এই রাজনীতি সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ আসলে কী, সেই তর্কে আমি এখানে প্রবেশ করব না। মেনে নেব যে মুসলমান নিজেদের পরিচয় ধর্ম দিয়ে নির্ণয় করার মধ্য দিয়ে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বাইরে অন্য সব ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষকে যদি নিজের ‘অপর’ গণ্য করে তাহলে অবস্থা বিশেষে বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অপরের প্রতি শত্র“তা হিসাবে হাজির হতে পারে। হয়ও বটে। একই কথা ‘বাঙালি’ সম্পর্কেও খাটে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে একমাত্র পরিচয় গণ্য করে তার ভিত্তিতে অন্য সব পরিচয়ে পরিচিত জনগোষ্ঠীকে নিজের ‘অপর’ গণ্য করাও সমান সাম্প্রদায়িকতা। মুশকিল হচ্ছে ইসলামের প্রতি সহনশীল ব্যক্তিরা এই শেষের কথা মানতে চান না। তারা উগ্র ও সাম্প্রদায়িক ‘বাঙালি’ না হতে পারেন। কিন্তু বাঙালিত্বে বিশ্বাসী। ইসলাম যে বাঙালির ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা তাই তারা মানতে রাজি না। তাদের সঙ্গে এখানে আমার ঘোরতর পার্থক্য আছে। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন ও ভাবুকতার দিক থেকে ইসলামের সঙ্গে মোকাবিলার সঠিক নীতি ও কৌশল গ্রহণ না করে ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের অবাস্তব ও অসম্ভব বিরোধ জিইয়ে রাখলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা অসম্ভব, এটাই আমার অবস্থান। আশা করি তারা আমার নিন্দা করলে আমার অবস্থান যুক্তির সঙ্গে নাকচ করবেন।
সমাজে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে দুটো শক্তিশালী ধারা আছে। একটি স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট। এদের চেনা এখন তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে গিয়েছে। এদের ঘোর ইসলাম-বিদ্বেষ যখন চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হয়, তখন একে তারা ‘উসকানি’ বলে গণ্য করে। অন্যের মত সহ্য করতে না পেরে এরা থানা পুলিশ করে, আর মিথ্যাচার, কুৎসা প্রচার ও চরিত্র হনন তো আছেই। এই ধারা জাতিবাদী রাজনীতি নামে পরিচিত। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে তৈরি হওয়া ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এই ধারার আদর্শ।
জাতীয়তাবাদী উগ্রতা বর্জিত আরেকটি ধারা হচ্ছে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার ধারা। যারা কোনো কাটছাঁট না করে কিংবা বাংলাদেশের ইতিহাস ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমকে (বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে) বিমূর্ত ফর্মুলা হিসাবে বাংলাদেশে কায়েম করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তে অবস্থিত একটি দেশে ইংল্যান্ডের বা ইউরোপীয় মডেলে একটি ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ কায়েম করার অধিক চিন্তা করতে এই ধারা শোচনীয়ভাবে অক্ষম। তাদের ধারণা বাংলাদেশকেও ইউরোপীয় ইতিহাসের ঘাটগুলো ইউরোপীয় কায়দায় পার হতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের ইউরোপীয় ধারণার কারণে তারা সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার কথা বলে। যাকে আমরা সুশীল বা লিবারেল রাজনীতি বলি এই ধারা সেই রাজনীতিরই অংশ। তবে অন্য সুশীলদের সঙ্গে আমি যে সুশীলদের কথা বলছি তাদের পার্থক্য আছে। পার্থক্য হচ্ছে লিবারেল আদর্শ বাস্তবায়ন করতে সুশীলরা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির গোলামি ও দাসত্ব শুধু নয়, সুবিধা বুঝে সেনাবাহিনীর কাঁধে লিবারেল নীতি বিসর্জন দিয়ে ভর করে। এক-এগারোর সময় আমরা যা দেখেছি। পাশ্চাত্যের লিবারেল রাজনীতি যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, যাদের কথা এখন বলছি, তারা নীতি বিসর্জন দিয়ে সেনাশাসনের পক্ষে দাঁড়ান না।
আমি এ ধারার ব্যক্তিদের পাশ্চাত্যপ্রীতি সত্ত্বেও আমার রাজনৈতিক মিত্র মনে করি, যদি তারা চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তবে দেখা যায়, তারা ইসলামী মতাদর্শ প্রচারের বিপক্ষে দাঁড়ান। এদের ইসলাম-বিদ্বেষ আলেম-ওলামাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মাদ্রাসার ছাত্রদের বিচার করার মানদণ্ডে ধরা পড়ে। এদের অনেকের আজগুবি ধারণা হচ্ছে, ইসলামপন্থীদের দিয়ে আমি গণতন্ত্র কায়েম করতে চাই। ইসলামের সঙ্গে গণতন্ত্রের বিরোধ আছে, সে বিরোধ মৌলিক এবং সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই চিন্তা তাদের মধ্যে কাজ করে কেন? আসলে ইউরোপীয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে তাদের ধারণা অপরিচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। সেই তর্ক এখানে না তুলেও বলা যায় তারা ‘গণতন্ত্র’ বলতে রাষ্ট্র বোঝেন না, কয়েকটি আচার ও আদর্শ বোঝেন। যদি বুঝতেন তাহলে এটাও বুঝতেন যে, গণতন্ত্র মাত্রই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র নয়। আর আমি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য লড়ছি, যে লড়াইয়ে মজলুম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজ হোক কাল হোক বিপুল স্রোতের মতো যুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। অতএব সেক্যুলারিস্টরা গণতন্ত্র চাইবার পরেও যখন আলাদাভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, আমি তাকে ধর্ম-বিদ্বেষ, বিশেষত ইসলাম-বিদ্বেষ হিসাবেই বুঝি।
কিন্তু আমি আগেও বহুবারই বলেছি, ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের যে ইতিবাচক অর্জন, আমি তার বিরোধিতা করি না। কিন্তু সে অর্জনকে আমি সর্বজনীন মনে করি না। ইউরোপই দুনিয়ার ইতিহাস নয়। যারা তা মনে করেন তারা ইউরোপকেই দুনিয়ার আদর্শ মনে করেন। আমি করি না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লব বাংলাদেশের মতোই হবে। ইউরোপের মতো হবে না। তার সম্ভাব্য রূপ কী হতে পারে সেই আলোচনায় তারা আগ্রহী হলে এই মতপার্থক্য নিরসন রাজনীতির এই তাৎপর্যপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হতে পারে। ইসলাম নিয়ে আলোচনা এই জায়গা থেকে করলেই সেটা সবচেয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে।
আমি মনে করি, এই পাঁচটি সংক্ষিপ্ত অথচ মৌলিক গণতান্ত্রিক দাবি লিবারেল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব। যারা ন্যূনতম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী, তাদের এই দাবিগুলো সমর্থন না করার কোনো কারণ নাই।
তিন.
আমার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে গত লেখায় কিছু ধারণা দিয়েছি। এখানে আরও দুই-একটি কথা বলব।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল জায়গাটা হচ্ছে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। আমার অবস্থান হচ্ছে, এখনকার লড়াই হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই। এ লড়াইয়ে মতাদর্শিক বিভাজনের ভেদরেখা কারা বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে আর কারা তার রূপান্তর কামনা করে তার দ্বারাই ঠিক হবে। কে ইসলামপন্থী, কে সেক্যুলার সেই তর্ক গৌণ। রাজনীতি কংক্রিট রাষ্ট্র ও বিদ্যমান ক্ষমতার চরিত্র নিয়ে জনগণের মধ্যে নানান মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, বিরোধ ও বিভাজন রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নাই। মতাদর্শের মীমাংসা রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা লড়বে ও লড়ছে তাদের ঐক্যটাই এখন দরকার। মতপার্থক্যের সুরাহার লক্ষ্যে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের গণতান্ত্রিক কর্তব্য জনগণকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া আমাদের এখনকার প্রধান কাজ। আমি বর্তমান বাস্তবতায় এই রাজনীতিকেই সঠিক মনে করি। যারা রাজনীতির এই মূল জায়গায় না গিয়ে নানা বাগাড়ম্বরে এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষে ওকালতি করে, আমি তাদের বিরোধিতা করি। গণতন্ত্রের শত্র“ গণ্য করি। লক্ষ্য করি, তারা মূল জায়গায় না থেকে অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে কূটতর্ক করে, যা বুদ্ধিজীবিতার দিক থেকে ফলপ্রসূ কোনো পরিণতি বয়ে আনে না। এ ক্ষেত্রে মতাদর্শিক বিভক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হচ্ছে ইসলাম প্রশ্ন।
বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে কথা বলা রীতিমতো বিপজ্জনক ব্যাপার। সম্ভবত বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজচিন্তা, অর্থনীতি, আইন ও ফিকাহ সম্পর্কে কারও আন্তরিক আগ্রহকে তুমুল সন্দেহ করা হয়। এমনকি আলেম-ওলামা মওলানা মুফতি না হলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কেউ যে ইসলামে আন্তরিকভাবেই আগ্রহী হতে পারেন, এটা বিশ্বাস করানো রীতিমতো কঠিন। বড়ই আজব দেশ। এ ধরনের আগ্রহ যারা পোষণ করেন তাদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ হতে হয়। নিন্দা বিদ্বেষের শিকার হতে হয়। আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। তবে সন্দেহ নাই, ইতিহাস ও দর্শনের একনিষ্ঠ ছাত্র হওয়ার কারণে ইসলাম আমার বিপুল বিস্ময় ও আগ্রহের বিষয়। একইভাবে ইহুদি-খ্রিস্টীয় ধর্ম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার গ্রিক-খ্রিস্টীয় ভিত্তি এবং উপমহাদেশের এ অঞ্চলের সনাতন বা লোকায়ত ধর্ম ও ধর্মচর্চার ভাব ও ইতিহাসকে আমি আমার কল্পনা, মনন, ঐতিহ্য ও ভাবচর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করি। এর মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম যেমন আছে, একইভাবে আছে বাংলার কবি, সাধক ও ভাবুকদের বিশাল ভাণ্ডার। যারা আমার কবিতা ও এ ক্ষেত্রে আমার কাজ সম্পর্কে অবহিত তারা তা জানেন। এ ব্যাপারে নিজের ঢাক নিজে পেটানোর ইচ্ছা বিশেষ নাই।
ইসলামের ইতিহাস ও দর্শনই শুধু আমার আগ্রহের বিষয় নয়, ইসলামপন্থা বা ইসলামী রাজনীতির নানান চরিত্র ও বয়ান, তাদের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক অভিমুখ এবং ইসলামী রাজনীতির সীমা ও সম্ভাবনা সম্পর্কেও আমি বিপুল আগ্রহী। বিশ্ব ইতিহাস পৃথিবীর একটি বৃহত্তম ধর্মকে বাদ দিয়ে যেমন কল্পনা করা অসম্ভব, তেমনি আমি মনে করি উপমহাদেশে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ইসলামকে বিচার না করলে তার পরিণতি এই উপমহাদেশের জন্য কখনোই কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। বাংলাদেশ তো দূরের কথা। এই কথাগুলো আমি কমপক্ষে গত ২৫ বছর ধরেই বলছি। দুই হাজার এক সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পর কথাগুলো ইতিহাস ও বাস্তবতার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এর পরেও যারা ইসলাম নিয়ে কথা বলি বলে আমাকে নিন্দা করেন, তাদের মধ্যে ইসলাম-বিদ্বেষ প্রকট ও প্রবল। যারা তুলনামূলক ভাবে সহনশীল, এই অসুখ নাই, তাদের গোড়ার মুশকিল হচ্ছে মুসলমান ও ইসলামকে তারা সমার্থক গণ্য করেন। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বাংলাদেশে অবশ্যই আছে এবং তারা অনেক সময় সঙ্গত কারণেই উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন বোধ করেন। আমিও করি। তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য হচ্ছে, অসম অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার ভারসাম্যহীন বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলমানরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়বেই। এটাই বাস্তবতা। যেহেতু এই স্বার্থ রক্ষার দায় সমষ্টিগতভাবে মুসলমানরা বোধ করেন, অতএব অধিকাংশ সময় তাদের এই রাজনীতি সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ আসলে কী, সেই তর্কে আমি এখানে প্রবেশ করব না। মেনে নেব যে মুসলমান নিজেদের পরিচয় ধর্ম দিয়ে নির্ণয় করার মধ্য দিয়ে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বাইরে অন্য সব ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষকে যদি নিজের ‘অপর’ গণ্য করে তাহলে অবস্থা বিশেষে বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অপরের প্রতি শত্র“তা হিসাবে হাজির হতে পারে। হয়ও বটে। একই কথা ‘বাঙালি’ সম্পর্কেও খাটে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে একমাত্র পরিচয় গণ্য করে তার ভিত্তিতে অন্য সব পরিচয়ে পরিচিত জনগোষ্ঠীকে নিজের ‘অপর’ গণ্য করাও সমান সাম্প্রদায়িকতা। মুশকিল হচ্ছে ইসলামের প্রতি সহনশীল ব্যক্তিরা এই শেষের কথা মানতে চান না। তারা উগ্র ও সাম্প্রদায়িক ‘বাঙালি’ না হতে পারেন। কিন্তু বাঙালিত্বে বিশ্বাসী। ইসলাম যে বাঙালির ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা তাই তারা মানতে রাজি না। তাদের সঙ্গে এখানে আমার ঘোরতর পার্থক্য আছে। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন ও ভাবুকতার দিক থেকে ইসলামের সঙ্গে মোকাবিলার সঠিক নীতি ও কৌশল গ্রহণ না করে ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের অবাস্তব ও অসম্ভব বিরোধ জিইয়ে রাখলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা অসম্ভব, এটাই আমার অবস্থান। আশা করি তারা আমার নিন্দা করলে আমার অবস্থান যুক্তির সঙ্গে নাকচ করবেন।
সমাজে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে দুটো শক্তিশালী ধারা আছে। একটি স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট। এদের চেনা এখন তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে গিয়েছে। এদের ঘোর ইসলাম-বিদ্বেষ যখন চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হয়, তখন একে তারা ‘উসকানি’ বলে গণ্য করে। অন্যের মত সহ্য করতে না পেরে এরা থানা পুলিশ করে, আর মিথ্যাচার, কুৎসা প্রচার ও চরিত্র হনন তো আছেই। এই ধারা জাতিবাদী রাজনীতি নামে পরিচিত। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে তৈরি হওয়া ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এই ধারার আদর্শ।
জাতীয়তাবাদী উগ্রতা বর্জিত আরেকটি ধারা হচ্ছে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার ধারা। যারা কোনো কাটছাঁট না করে কিংবা বাংলাদেশের ইতিহাস ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমকে (বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে) বিমূর্ত ফর্মুলা হিসাবে বাংলাদেশে কায়েম করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তে অবস্থিত একটি দেশে ইংল্যান্ডের বা ইউরোপীয় মডেলে একটি ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ কায়েম করার অধিক চিন্তা করতে এই ধারা শোচনীয়ভাবে অক্ষম। তাদের ধারণা বাংলাদেশকেও ইউরোপীয় ইতিহাসের ঘাটগুলো ইউরোপীয় কায়দায় পার হতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের ইউরোপীয় ধারণার কারণে তারা সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার কথা বলে। যাকে আমরা সুশীল বা লিবারেল রাজনীতি বলি এই ধারা সেই রাজনীতিরই অংশ। তবে অন্য সুশীলদের সঙ্গে আমি যে সুশীলদের কথা বলছি তাদের পার্থক্য আছে। পার্থক্য হচ্ছে লিবারেল আদর্শ বাস্তবায়ন করতে সুশীলরা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির গোলামি ও দাসত্ব শুধু নয়, সুবিধা বুঝে সেনাবাহিনীর কাঁধে লিবারেল নীতি বিসর্জন দিয়ে ভর করে। এক-এগারোর সময় আমরা যা দেখেছি। পাশ্চাত্যের লিবারেল রাজনীতি যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, যাদের কথা এখন বলছি, তারা নীতি বিসর্জন দিয়ে সেনাশাসনের পক্ষে দাঁড়ান না।
আমি এ ধারার ব্যক্তিদের পাশ্চাত্যপ্রীতি সত্ত্বেও আমার রাজনৈতিক মিত্র মনে করি, যদি তারা চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তবে দেখা যায়, তারা ইসলামী মতাদর্শ প্রচারের বিপক্ষে দাঁড়ান। এদের ইসলাম-বিদ্বেষ আলেম-ওলামাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মাদ্রাসার ছাত্রদের বিচার করার মানদণ্ডে ধরা পড়ে। এদের অনেকের আজগুবি ধারণা হচ্ছে, ইসলামপন্থীদের দিয়ে আমি গণতন্ত্র কায়েম করতে চাই। ইসলামের সঙ্গে গণতন্ত্রের বিরোধ আছে, সে বিরোধ মৌলিক এবং সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই চিন্তা তাদের মধ্যে কাজ করে কেন? আসলে ইউরোপীয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে তাদের ধারণা অপরিচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। সেই তর্ক এখানে না তুলেও বলা যায় তারা ‘গণতন্ত্র’ বলতে রাষ্ট্র বোঝেন না, কয়েকটি আচার ও আদর্শ বোঝেন। যদি বুঝতেন তাহলে এটাও বুঝতেন যে, গণতন্ত্র মাত্রই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র নয়। আর আমি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য লড়ছি, যে লড়াইয়ে মজলুম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজ হোক কাল হোক বিপুল স্রোতের মতো যুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। অতএব সেক্যুলারিস্টরা গণতন্ত্র চাইবার পরেও যখন আলাদাভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, আমি তাকে ধর্ম-বিদ্বেষ, বিশেষত ইসলাম-বিদ্বেষ হিসাবেই বুঝি।
কিন্তু আমি আগেও বহুবারই বলেছি, ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের যে ইতিবাচক অর্জন, আমি তার বিরোধিতা করি না। কিন্তু সে অর্জনকে আমি সর্বজনীন মনে করি না। ইউরোপই দুনিয়ার ইতিহাস নয়। যারা তা মনে করেন তারা ইউরোপকেই দুনিয়ার আদর্শ মনে করেন। আমি করি না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লব বাংলাদেশের মতোই হবে। ইউরোপের মতো হবে না। তার সম্ভাব্য রূপ কী হতে পারে সেই আলোচনায় তারা আগ্রহী হলে এই মতপার্থক্য নিরসন রাজনীতির এই তাৎপর্যপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হতে পারে। ইসলাম নিয়ে আলোচনা এই জায়গা থেকে করলেই সেটা সবচেয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে।
No comments