ঢাকা মহানগর- এতিম এক শহর by এ কে এম জাকারিয়া

ঢাকা শহরটি চালায় কে? কারও কাছে এর জবাব আছে বলে মনে হয় না। এই নগরের পিতা বা মাতা বলে কেউ নেই, এমনকি কোনো অভিভাবকও।
কিন্তু বাবা-মা হারানো সন্তানেরা কি বেঁচে-বর্তে থাকে না! এতিমের মতোই দশা হয়েছে শহরটির এবং চলছেও সেভাবেই। গত বছর বসবাসের অনুপযোগী সবচেয়ে ‘সেরা’ শহরের সম্মান পেয়েছিল আমাদের ঢাকা। দুনিয়ার ১৪০টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশ দখল করেছিল ১৪০তম স্থান। এবার ১৩৯, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অবস্থা এত খারাপ যে ঢাকা এ বছর এই ‘সম্মান’ থেকে বঞ্চিত হলো!

যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বছর বছর পৃথিবীর কোনো শহর থাকার জন্য কতটা সুবিধাজনক, তার একটি তালিকা তৈরি করে। মূলত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এই সমীক্ষা করা হয়। কোনো শহরে কোনো কর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হলে তাঁকে কী পরিমাণ হার্ডশিপ ভাতা (কষ্টকর বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে কাজ করার ভাতা) দিতে হবে, সেটা নির্ধারণ করা হয় এই রিপোর্ট ধরে। ঢাকা এখন যে স্থান দখল করেছে, তাতে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি এখন ঢাকায় কোনো লোক নিয়োগ দেয়, তবে এখানে থাকার যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য নির্ধারিত বেতনের চেয়ে তাঁকে ২০ শতাংশ বেশি বেতন দিতে হবে।
বসবাসের জন্য সবচেয়ে ভালো শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে মেলবোর্ন। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার এই শহরটি পেয়েছে ৯৭ দশমিক ৫। আর ঢাকা পেয়েছে ৩৮ দশমিক ৭। এর পরই দামেস্ক (৩৮ দশমিক ৪)। ঢাকা আর দামেস্কের মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে। করাচি (৪০ দশমিক ৯), ত্রিপোলি (৪১ দশমিক ৭), হারারে (৪০ দশমিক ৭) বা লাগোসের (৩৮ দশমিক ৯) মতো শহরগুলোও আমাদের ঢাকার চেয়ে বেশি বাসযোগ্য!
পাঁচটি ক্ষেত্রের প্রায় ৩০টি দিক বিবেচনায় নিয়ে এই তালিকা তৈরি করে থাকে ইআইইউ। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো—এগুলো হচ্ছে বিবেচনার মূল বিষয়। স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ পরিস্থিতি, সহিংস অপরাধের মাত্রা, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক যুদ্ধের হুমকি ও গৃহযুদ্ধের হুমকি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ, সরকারি ও বেসরকারি সক্ষমতা ও স্বাস্থ্যসেবার সাধারণ মান—এসব দেখা হয়। সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিবেচনার মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, ভ্রমণকারীদের জন্য আবহাওয়াটা কতটুকু আরামদায়ক, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সেন্সরশিপের মাত্রা, ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি, খাদ্য-পানীয়-ভোগ্যপণ্যের মান ও সেবা-পরিস্থিতি। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ ও সার্বিক শিক্ষার মান। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগব্যবস্থার মান, গণপরিবহনব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, মানসম্মত বাসা ভাড়া পাওয়ার নিশ্চয়তা, জ্বালানি-পরিস্থিতি, পানি সরবরাহের মান ও টেলিযোগাযোগের মান।
এই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে এ বছরের শুরুর ছয় মাসের পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এ সময় বেশ সংঘাত ও সহিংসতা হয়েছে। বিশেষ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশের পর দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ ও সমাবেশকে কেন্দ্র করেও বেশ সহিংসতা ঘটেছে। এর পরও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ঢাকা ১০০ নম্বরের মধ্যে ৫০ নম্বর পেয়েছে। পাঁচটি বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে এটাই ঢাকার পাওয়া সর্বোচ্চ নম্বর। এর পরপরই আছে সংস্কৃতি ও পরিবেশ (৪৩.৩) ও শিক্ষা (৪১.৭)। বাকি দুটির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, স্বাস্থ্যসেবায় ২৯.২ ও অবকাঠামোয় ২৬.৮। এই দুটি ক্ষেত্রই ঢাকাকে এত নিচে নামিয়েছে।
একটি শহরের বাসযোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়ার জন্য এই যে পাঁচটি বিষয়ের প্রায় ৩০টি দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়, এগুলো দেখার জন্য ঢাকায় কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই। অসংখ্য কর্তৃপক্ষ ও বিভাগ এর সঙ্গে জড়িত। যে যে যার যার মতো দায়িত্ব পালন করছে অথবা করছে না। স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো—এই দুটি ক্ষেত্রে ঢাকা সবচেয়ে খারাপ করেছে। এই দুটি ক্ষেত্রে যদি উন্নতি করতে হয়, তবে এর সঙ্গে জড়িত সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কিন্তু ঢাকার এই দুর্দশা নিয়ে চিন্তা করার বা এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়ার কোনো একক কর্তৃপক্ষ বা কর্তৃত্ব নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রতি প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে, সাক্ষাৎকারে সবকিছু তুলে ধরা যায়নি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘দেশ পরিচালনার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন, তিনি সবকিছুর সমন্বয় করেন। ঢাকা আমাদের রাজধানী ও অন্যতম জনবহুল একটি শহর। এটি পরিচালনার জন্যও একজন নেতা দরকার, যাঁর ক্ষমতা
থাকবে, যিনি সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করবেন এবং একটি শহর পরিচালনার যোগ্যতা ও ভিশন থাকবে।’ তিনি ঢাকার জন্য একজন যোগ্য নেতার নেতৃত্বে এ ধরনের ‘সুপার অথরিটি’ দেখতে চান।
ঢাকাকে ‘আরও ভালোভাবে’ পরিচালনার জন্য দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুজন মেয়র পাওয়ার কথা উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার। জাতীয় রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি আর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের চক্করে পড়ে দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন চাপা পড়ে গেছে। আমলা প্রশাসকদের দিয়ে চলছে দুই ঢাকা। নেই কোনো কাউন্সিলর। ঢাকা নিয়ে কিছু বলতে হলে এখন কার দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করতে হবে, তা আমরা জানি না। ঢাকা শহরে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নত করার কিছু কাজ চলছে। সম্প্রতি কুড়িল উড়ালসড়ক চালু হয়েছে। এতে যান চলাচল অনেক সহজ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর সুফল পুরো কাজে লাগছে বলে মনে হয় না। উত্তরা থেকে যিনি মগবাজারের দিকে আসছেন, এই উড়ালসড়কের কারণে তাঁর বনানী আসার আগ পর্যন্ত কোথাও আটকানোর কথা নয়। কিন্তু বিমানবন্দর ছাড়িয়ে খিলক্ষেতে আসতেই উড়ালসড়কের আগেই এখন জ্যামে পড়তে হচ্ছে। এখানে ফুটপাত দখল করে আছে অনেক দোকানপাট, বাসগুলো এখানে একটির পর একটি না থেমে পাশাপাশি থামে। বটলনেক যাকে বলে তেমনি একটি অবস্থা তৈরি হয় এখানে। আপনাকে আটকাতেই হবে এখানে।
এত পয়সা খরচ করে উড়ালসড়ক হলো, এখন ফুটপাতের কিছু দোকানপাট আর ট্রাফিক পুলিশের ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে যানজটে পড়তেই হচ্ছে। প্রতিদিন যে এই অবস্থা হচ্ছে, এটা আসলে কার নজরে পড়া উচিত? সমস্যাটি সমাধান করার দায়িত্বই বা কার? ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের, ট্রাফিক পুলিশের, সড়ক বিভাগের, না রাজউকের? কারও নজরে যে পড়ছে না বা কেউ যে দায়িত্ব পালন করছে না, সেটা তো স্পষ্ট। এমনকি কোনো সচেতন নাগরিকের যদি এই সমস্যার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, তবে তাঁকে আসলে কোথায় গিয়ে অভিযোগ করতে হবে? যথাযথ কর্তৃপক্ষটি আসলে কে?
২০১১ সালের ইআইইউর প্রতিবেদনে এবারের মতো ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকা ১৩৯তম স্থান দখল করার পর এ নিয়ে আমার একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্ব কার?’ শেষটি ছিল এ রকম; ‘২০০৯ সাল থেকে ঢাকা একই কলঙ্ক বয়ে বেড়ালেও এই তালিকা “প্রত্যাখ্যান” করার মতো গুরুত্ব দেয়নি সরকারের কেউ। টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করতে করতে বাংলাদেশ এখন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের শীর্ষ স্থান থেকে নিচে নেমে এসেছে। ইআইইউয়ের এই তালিকা যদি আমাদের সরকারের তরফে প্রত্যাখ্যান করা হতো, বলা হতো “ভিত্তিহীন”—তবে আশা করতে পারতাম যে সামনে ঢাকা একটু একটু করে বসবাসের আরও উপযোগী হয়ে উঠবে। ঢাকার এই দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্ব আসলে কার?’ ২০১২ সালে লিখতে হলো, ‘ঢাকার দুর্নাম ঘোচেনি, বেড়েছে’। মানে ২০১১ সাল থেকে পরের বছর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
আসলে এই শহরটিকে দেখার কেউ নেই, এই শহরের দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্বও কারও নেই। এর বাবা-মা কেউ থাকলে এমন হেলাফেলা আর দুর্দশার মধ্যে পড়তে হতো না এই শহরকে! এতিম এক শহরের নাম ঢাকা।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.