নেরুদা-আয়েন্দের মৃত্যু নিয়ে... by আন্দালিব রাশদী

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, মাতৃভূমি চিলির বড় দুঃসময়ে মৃত্যু হয় কবি পাবলো নেরুদার। এ বছর তাঁর মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলনের পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছেন এই নোবেলজয়ী।
অন্যদিকে নেরুদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিলির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দের মৃত্যুও ছিল রহস্যময়। দুটো ঘটনা এক সূত্রে গাঁথা

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ পাবলো নেরুদা আর ১১ সেপ্টেম্বর সালভাদর আয়েন্দের মৃত্যুর ৪০ বছর পূর্তির দিন। আয়েন্দে ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সহযোদ্ধাদের রক্তস্নাত সান্তিয়াগো তখন এক ভয়ানক আতঙ্ক-নগর। পিনোশের ঘাতক বাহিনী টহল দিচ্ছে রাজধানীতে। গুম করে ফেলা হচ্ছে আয়েন্দের আস্থাভাজন মানুষদের।

বিশ শতকে পাবলো নেরুদার চেয়ে বেশি পঠিত কোনো কবি নেই, এটাই সত্য। এই নেরুদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালভাদর আয়েন্দে। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এদুয়ার্দো ফ্রেয়িকে পরাজিত করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় বন্ধু নেরুদার ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। তাঁর কারণে সব কমিউনিস্ট ভোট আয়েন্দের জন্য নিশ্চিত হয়ে যায়। ডানপন্থীদের বাধা ও সামরিক বাহিনীর অসন্তোষের মুখে ১৯৭০-এর ৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে যখন তাঁর ‘চিলিয়ান পাথ টু সোশ্যালিজম’ ঘোষণা করলেন এবং তাঁর জাতীয়করণ ও যূথবদ্ধকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হলো, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এদুয়ার্দো ফ্রেয়ি। সেনাবাহিনীর সামনে আসার পথ সুগম হয়ে উঠল। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ ঘটল সামরিক অভ্যুত্থান।



সেনা অভ্যুত্থান ও আয়েন্দের মৃত্যু

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, সকাল সাতটায় অভ্যুত্থানকারীরা আয়েন্দের অনুগত নৌ, বিমান ও সেনা কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আটটার মধ্যে দখল করে রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্র। লা মনেদা ভবনে অবস্থানরত আয়েন্দে ভেবেছিলেন, তাঁর একান্ত অনুগত জেনারেল অব দি আর্মি অগাস্তো পিনোশে সংকট মোকাবিলায় পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু তিনি তাঁর ফোন ধরেননি। সাড়ে আটটায় ঘোষণা হয়, আয়েন্দে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। অভ্যুত্থানকারীরা প্রেসিডেন্ট ভবনে বোমাবর্ষণের হুমকি দিতে থাকে। সোশ্যালিস্ট পার্টি তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয় এবং পুনরায় সংগঠিত হয়ে পাল্টা অভ্যুত্থানের কথা বলে। সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেন। তিনি সবই প্রত্যাখ্যান করেন। মৃত্যু আসন্ন নিশ্চিত হয়ে বিদায়ী ভাষণ দেন।

এর পরপরই একে-৪৭ রাইফেলের গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন আয়েন্দে। আয়েন্দে আত্মহত্যা করতে পারেন, তাঁর সমর্থকদের কেউই তা বিশ্বাস করেননি। ১৯৭৫-এ প্রকাশিত রবিনসন রোয়াসের আয়েন্দে হত্যাকাণ্ড ও চিলির পথের সমাজতন্ত্রের সমাপ্তি বইতে আত্মহত্যা তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়। সেখানে জোর দিয়ে বলা হয়, পিনোশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি নিহত হন। তবে সরকারি ভাষ্যটি ছিল আত্মহত্যারই এবং আয়েন্দে পরিবার তা মেনে নেয়। বন্দুকের স্বয়ংক্রিয় গুলি তাঁর মাথার ওপরের অংশ উড়িয়ে দেয়। তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে তাঁর।

কিন্তু বিতর্ক রয়েই যায়। মৃত্যুর ৩৮ বছর পর ২০১১-এর জানুয়ারিতে চিলির আদালত আয়েন্দের মৃত্যুর প্রকৃতি নিশ্চিত করার জন্য তাঁর মৃতদেহ উত্তোলন ও পরীক্ষার নির্দেশ দেন। পরিবারের অনুমতিতে ২০১১-এর মে মাসে তাঁর মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য উত্তোলন করা হয় এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেন, আয়েন্দের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা।



পাবলো নেরুদার মৃত্যু

আয়েন্দের মৃত্যুর প্রকৃতি নিশ্চিত হওয়া গেলেও প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায় তাঁর প্রিয় বন্ধু, প্রিয় কবি পাবলো নেরুদার মৃত্যুর কারণ।

আয়েন্দের বাসভবন যখন বোমাবর্ষণে ধ্বংস হলো, নেরুদার মনে পড়ছিল নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের কথা। তিনি লিখলেন:

‘আজ তিন দিন হয়ে গেল আমার প্রিয়তম বন্ধু কমরেড সালভাদর আয়েন্দে তাঁরই স্বদেশবাসীর চক্রান্তে নিহত হয়েছেন। আমার এই অনুস্মৃতি দ্রুত শেষ করার জন্য আমি লিখে চলেছি। আয়েন্দেকে হত্যার খবর সমগ্র বিশ্বের কাছে গোপন রেখে তাঁর অমর দেহকে গোপনে সমাহিত করার সময় একমাত্র তাঁর পত্নী ছাড়া আর কাউকেই সেদিন কাছে থাকতে দেওয়া হয়নি। নির্লজ্জ শয়তান হত্যাকারীরা প্রচার করতে লাগল আয়েন্দে যে আত্মহত্যা করেছেন তার সব প্রমাণই নাকি তাদের কাছে রয়েছে। ...(বোমাবিধ্বস্ত ভবনে শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ আয়েন্দে) ...এমন একটি চমৎকার মুহূর্তকে কি ফ্যাসিস্ট দস্যুরা হাতছাড়া করতে পারে! মেশিনগানের একঝাঁক গুলি তাঁর দেহকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।...মহিমান্বিত এই শবদেহের সর্বাঙ্গে ছিল বুলেটের চিহ্ন, যে বুলেট বেরিয়ে এসেছিল চিলিরই সেনাবাহিনীর মেশিনগানের নল থেকে— চিলির সেনাবাহিনী বিদেশি প্রভুদের খুশি করতে তাদের আরও একবার প্রতারিত করল।’

অনুস্মৃতিতে এই ছিল নেরুদার শেষ লেখা। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সান্তিয়াগোর সান্তা মারিয়া হাসপাতালে মারা যান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এই কবি।

কিন্তু তাঁর মৃত্যুসংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল ১২ তারিখেই: ‘১১ সেপ্টেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানে আয়েন্দের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে নিহত হয়েছেন পাবলো নেরুদা।’ তাঁর স্ত্রী উরুটিয়া মাতিলদে লিখেছেন, তিনি সারা দিন টেলিফোনে জবাব দিচ্ছেন—জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স বিভিন্ন স্থান থেকে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রশ্নের জবাবে বলছেন, ‘পাবলো মরেনি, পাবলো বেঁচে আছে।’

১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে নেরুদার শরীর একটু তেতে ওঠে। জ্বর এসেছে। মাতিলদে সান্তিয়াগোর একজন ডাক্তারকে ফোন করলে তিনি একটি ইনজেকশনের নাম বলেন আর বড্ড সরলভাবে বলতে থাকেন, দেশে যা-ই ঘটেছে তা পাবলোকে জানানোর দরকার নেই, তাতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লে পাবলোর ক্ষতি হবে।

কিন্তু তাঁর চোখের সামনেই টেলিভিশন। সবই দেখছেন, জানছেন। ১৪ সেপ্টেম্বর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলো। স্ত্রীকে ডাকলেন নেরুদা, কাগজ-কলম আনতে বললেন। হুড়োহুড়ি করে কাগজ-কলম নিয়ে ডিকটেশন নিতে বসে গেলেন মাতিলদে। নেরুদা তাঁর স্মৃতিকথার শেষ অধ্যায় বলে যাচ্ছেন।

১৮ সেপ্টেম্বর চিলির স্বাধীনতা দিবস। বিকেলের দিকে নেরুদার জ্বর বাড়তে শুরু করে। মাতিলদে হাসপাতালে ফোন করলে তাঁকে বলা হয়, পরদিন অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হবে। তাঁদের নিবাস ইস্লা নেগ্রা থেকে সান্তা মারিয়া ক্লিনিক দুই ঘণ্টার পথ।

চিলিতে নিযুক্ত মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত নেরুদাকে দেখতে হাসপাতালে এলেন। তিনি বললেন, অবিলম্বে পাবলোর দেশ ছাড়া উচিত।

প্রস্তাবটি মাতিলদের পছন্দ হয়। কিন্তু স্ত্রীকে নেরুদা বলেন, ‘আমি চিলি ছেড়ে যাব না। আমার ভাগ্য এখানেই লেখা। এটা আমাদের দেশ, আমাদের জায়গা।’

সেনাবাহিনী যে সান্তিয়াগোতে নেরুদার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে, মাতিলদে স্বামীকে তা জানালেন না।

২০ সেপ্টেম্বর নেরুদা পরিবারের একজন বন্ধুকে নিয়ে রাষ্ট্রদূত আবার এলেন। স্বল্পকালের জন্য দেশ ছাড়তে রাজি হলেন নেরুদা। দেশ ছাড়ার সময় নেরুদা সঙ্গে যেসব বই নিতে চান সেগুলো আনার জন্য মাতিলদে ইস্লা নেগ্রা চলে গেলেন। মাত্র কটা বই একত্র করতেই স্বামীর ফোন পেলেন তিনি, এখনই চলে এসো। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।

মাতিলদে আবার ছুটলেন সান্তা মারিয়া ক্লিনিকের পথে। যখন হাসপাতালে পৌঁছালেন, দেখলেন— নেরুদা উত্তেজিত। তিনি জানতে পেরেছেন সামরিক জান্তা ধরে ধরে বহু মানুষকে খুন করছে। লোকসংগীতশিল্পী ভিক্তর হারাকে হত্যা করেছে।

তাঁর জ্বর বাড়ছে। জ্বরের ঘোরে তিনি বলছেন, ‘ওদের গুলি করে মারছে, গুলি করে মারছে।’ নার্স এসে স্নায়ু শীতলকারী ইনজেকশন দিয়ে যায়। তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

২৩ সেপ্টেম্বর অপরাহ। তখনো তাঁর ঘুম ভাঙেনি। উদ্বিগ্ন মাতিলদে, পাবলোর বোন লরা এবং নিজের বান্ধবী টেরেসা হামেলকে সঙ্গে রাখলেন। তিনজন নারীর নিবিড় চোখ একজন ঘুমন্ত কবির ওপর। মাতিলদের তীক্ষ দৃষ্টিতে ধরা পড়ল—কবি একটু কেঁপে উঠেছেন, মুখটা কেমন দুমড়ে যাচ্ছে। তিনি আরও কাছে এলেন। নিঃশ্বাসের শব্দ আর আসছে না। তিনি নেই। রাত তখন সাড়ে ১১টা।

বিতর্ক শুরু হলো নেরুদার মৃত্যু নিয়ে। অভিযোগ উঠল, বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ম্যানুয়েল আরাইয়া বললেন, ‘আমি মরে গেলেও এ দাবি থেকে সরে আসব না।’ তবে হাসপাতালের বুলেটিনে জানানো হয়, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। কিন্তু এটাও সত্য, তিনি ক্যানসারে ভুগছিলেন।

ক্যানসার না বিষপ্রয়োগ—বিরোধ আদালতে গড়ায়। মৃত্যুর ৪০ বছর পর আদালতের আদেশে এ বছর ইস্লা নেগ্রায় সমাহিত পাবলো নেরুদার দেহাবশেষ উত্তোলন করা হয় এবং সেটি উন্নততর পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখান থেকে এ পর্যন্ত একটি প্রতিবেদনই পাওয়া গেছে—পাবলো নেরুদা প্রোস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন এবং ক্যানসার অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছিল।

মৃত্যু যেভাবেই হোক, পিনোশের অভ্যুত্থান, আয়েন্দের মৃত্যু, চিলির দুর্যোগ এমনিতে কবিকে মরণাপন্ন করে তুলেছিল। তাঁর কবিতায়ও আছে সে কথা: শেষ হয়ে আসে মানবতার বসন্তকাল।

No comments

Powered by Blogger.