দুই হাজার কোটি ডলারের পোশাক খাত এখনো সরকারনির্ভর by শওকত হোসেন
দেশে তৈরি পোশাক খাত গড়ে উঠেছে মূলত সরকারি
পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে। শুরু থেকেই সরকার এই শিল্পকে সব ধরনের নীতি-সহায়তা
দিয়ে আসছে। মূলত, প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের এই পোশাক খাত এখনো
পুরোপুরি সরকারের ওপরই নির্ভরশীল।দেশে পোশাক খাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল
বেসরকারি উদ্যোগেই। উন্নত দেশ থেকে পঞ্চাশের দশকের দিকে পোশাক কারখানা
মেক্সিকো হয়ে অন্যান্য দেশে সরে আসতে শুরু করে। সত্তর দশকের শেষের দিকে তা
বাংলাদেশেও আসতে থাকে। উন্নত দেশ থেকে সরে আসার বড় কারণ ছিল উচ্চ শ্রম
মজুরি। ফলে সস্তা মজুরি ও অতিরিক্ত শ্রমশক্তি থাকায় বাংলাদেশ খুব সহজে
সুযোগটি গ্রহণ করে। সে সময়ে সরকারও নানা ধরনের নীতি-সহায়তা দেয়। আর্থিক
দায় অনেকটাই গ্রহণ করে ব্যাংকগুলো। আবার স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ
পায় নানা ধরনের অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা।বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে
করা বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, এখানে এই খাতের উত্থানের দুটি পর্যায় আছে।
যেমন, ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত কোটাসুবিধা ভোগ করত বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের
জন্য একটি নিশ্চিত বাজার ছিল। ২০০৫ সাল থেকে কোটাব্যবস্থা উঠে গেলে
প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই পর্বেই বাংলাদেশের সাফল্য বেশি। ২০০৫
সালের পর বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
শুরুর কথা: ১৯৭৮ সালে রিয়াজ
গার্মেন্টস ফ্রান্সে ১০ হাজার ছেলেদের শার্ট রপ্তানি করেছিল। সেটাই ছিল
বেসরকারি খাতের সরাসরি প্রথম রপ্তানি। তবে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রথম
প্রতিষ্ঠান ছিল দেশ গার্মেন্টস। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সাবেক আমলা নুরুল
কাদের খান প্রতিষ্ঠিত এই দেশ গার্মেন্টস ১৯৭৯ সালে ১২ ডলারের পোশাক রপ্তানি
করেছিল। যদিও ১৯৭৪ সালে সরকারি সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে কিছু পোশাক রপ্তানি
করা হয়েছিল।
পোশাক তৈরির কারখানার ধারণা নুরুল কাদের খান
পেয়েছিলেন কোরিয়া থেকে। তিনি কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির কারিগরি সহায়তাও
নিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, কাজ শেখানোর জন্য দেশ গার্মেন্টসের ১৩০ জনকে
সে সময়ে পাঠানো হয় কোরিয়ায়। তাঁরা দাইয়ুতে হাতে-কলমে কাজ শিখেছিলেন।
সেই ১৩০ জনের অনেকেই পরে পোশাক কারখানার মালিক হন। তাঁদের বড় অংশই আজ
পোশাক খাতের বড় বড় উদ্যোক্তা। এরপর বাংলাদেশে পোশাক খাতে বড় আকারে
বিনিয়োগ করে কোরিয়ার ইয়াংগুন। তারা ১৯৮০ সালে সুইডেনে প্রথম জ্যাকেট
রপ্তানি করে।
আন্তর্জাতিক নানা সুবিধা: বিশ্ব
বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) প্রতিষ্ঠার আগে গ্যাট আলোচনার সময় থেকেই
মাল্টি ফাইবার এগ্রিমেন্টের (এমএফএন) আওতায় বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে
কোটাসুবিধা পেয়েছে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। শুরুতে এটাই ছিল এখানে পোশাক কারখানা
তৈরির প্রধান প্রণোদনা।
২০০৫ সালে কোটা ব্যবস্থা উঠে গেলেও
প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েনি বাংলাদেশ। কারণ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ)
বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (জিএসপি) পায় বাংলাদেশ। কানাডার বাজারেও
শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশও একই ধরনের সুবিধা দেওয়ায়
পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি এখনো বাড়ছে।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা: ১৯৮২ সালের
শিল্পনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এ সময়ে আমদানি বিকল্প শিল্প
থেকে সরে এসে বেসরকারি খাত নির্ভর রপ্তানিমুখী শিল্পকে প্রধান লক্ষ্য বলে
ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরই দুটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুরুতে ছিল
ডেডো বা ডিউটি ড্র ব্যাক ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা কাঁচামাল
আমদানির সময় শুল্ক দিলেও রপ্তানি করার পর তা ফেরত পেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে
নানা ধরনের বিলম্ব, দুর্নীতি ও প্রক্রিয়াগত সমস্যা হওয়ায় এর পরিবর্তে
বন্ড-সুবিধা চালু করা হয়। এর মাধ্যমে পোশাক মালিকেরা বিনা শুল্কে পোশাক
তৈরির সব ধরনের কাঁচামাল আমদানি করতে পারতেন। শুরুতে এই সুবিধা কেবল পোশাক
খাতই পেত। পরে তা বিশেষায়িত বস্ত্র ও চামড়া খাতকেও দেওয়া হয়।
১৯৮৬-৮৭ সময়ে আরেকটি বড় সুবিধা দেওয়া হয়
পোশাক খাতকে। সরকার চালু করে স্থানীয় ঋণপত্র বা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির
ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে সব ধরনের কাঁচামাল ও আনুষঙ্গিক পণ্য আনতে উদ্যোক্তার
কোনো ধরনের অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না। উদ্যোক্তাকে কেবল রপ্তানির আদেশ
আনতে হয়। বাকি সব অর্থায়নের দায়িত্ব ব্যাংকের। পোশাক খাতের ব্যাপক
অগ্রগতির পেছনে বন্ড-সুবিধা এবং স্থানীয় এলসির ভূমিকাই প্রধান বলে মনে
করেন গবেষকেরা।
১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে আরেকটি বড় প্রণোদনা দেয়
সরকার। বস্ত্র ও পোশাক খাতকে এ সময় ২৫ শতাংশ নগদ সুবিধা দেওয়া হয়। পরে
অবশ্য ২০০২-০৩ অর্থবছরে তা কমিয়ে ১৫ শতাংশ এবং এখন তা দেওয়া হচ্ছে ৫
শতাংশ হারে। আবার ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে তৈরি পোশাক খাতকে কোনো ধরনের মূল্য
সংযোজন কর দিতে হয় না।
ধনী হওয়ার সহজ উপায়: ২০০৬ সালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ
আলী রশীদ পোশাক খাত নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে পোশাক
মালিকদের একটি বড় অংশ রপ্তানির নামে কাপড় আমদানি করে তা স্থানীয় বাজারে
বিক্রির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ মুনাফা করেছিলেন। আশির দশকে কাপড়
আমদানিতে ১৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো। একই সময়ে বন্ড-সুবিধা ব্যবহার করে
বিনা শুল্কে কাপড় আনতেন পোশাক মালিকেরা। সে সময়ে নিয়ম ছিল চাহিদার
অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি কাপড় আনা যাবে। তৈরির সময় কাপড় নষ্ট
হয়—এই কারণে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
অধ্যাপক আলী রশীদ বলছেন, অনেক মালিক সরকারের
বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ দিয়ে ১৫ শতাংশের অনেক বেশি কাপড় এনে তা বাইরে
বিক্রি করে দিয়েছেন। কাপড় বিক্রির একটি বড় জায়গা ছিল পুরান ঢাকার
ইসলামপুর। নব্বইয়ের দশকে এসে বাণিজ্য ব্যবস্থা উদার করা হলে কাপড়ের
আমদানি শুল্ক কমানো হয়। এর ফলে খোলা বাজারে পোশাক মালিকেদের কাপড় বিক্রি
কমে যায়। তবে এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, দেশে সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্য করার
ব্যয় অনেক বেশি হলেও অবৈধভাবে কাপড় বিক্রি করে পোশাক মালিকেরা অতিরিক্ত
মুনাফা করেছেন।
বিজিএমইএসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এখনকার
অনেক বড় বড় উদ্যোক্তাই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছিলেন সে সময়ে
খোলা বাজারে কাপড় বিক্রি করে। তাঁরা কারা তা-ও সবাই জানে। পাশাপাশি
কোটাব্যবস্থা চালু থাকার সময় ছোট পোশাক মালিকদের কাছে কোটা বিক্রি করেও
অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন এখনকার অনেক বিখ্যাত পোশাক মালিক।
সব শেষে অধ্যাপক আলী রশীদ প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশের
পোশাক খাতের উত্থানের পেছনে কারণ কী? এটা কী উদ্যোক্তোদের দক্ষতা, নাকি
সরকারের নীতি-সহায়তা। তিনি মনে করেন, অনেক ভালো উদ্যোক্তা আছেন। তা
সত্ত্বেও সরকারের নীতি-সহায়তাই এর প্রধান কারণ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা
সংস্থা (বিআইডিএস) এবং বিশ্বব্যাংকের জন্য তৈরি এই গবেষণাপত্রটির নামই ছিল
‘বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের উত্থান: উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনকুশলতা অথবা
সরকারি নীতি।
No comments